করোনার প্রথম ঢেউও বাংলাদেশে আসতে দিয়েছিল এই সরকার নিজেই, ইতালির ফ্লাইট বন্ধ না করে। ফ্লাইট বন্ধ না করেও প্রবাসীদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের সুব্যবস্থা করলে ভীষণ ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতো।
করোনার জন্ম/আবির্ভাব তো বাংলাদেশে হয়নি, শুরুতেই সকল ফ্লাইট কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখলে হয়তো এই মহামারি সম্পূর্ণভাবেই ঠেকেনো সম্ভব ছিলো, যেটা ভিয়েতনাম করেছিল। সরকার তা করেনি বরং সরকার মিথ্যাচার করেছে। মহামারি মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন না করেনি। আতশবাজি করেছে। বুলি আওড়েছে। যার ফলে মানুষকে অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
তারপর যখন দেশে চলেই আসলো, তখনো বিদেশফেরতদের যথাযথভাবে, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোয়ারেন্টিনে রাখতে পারেনি, ছড়িয়ে পরেছে সারাদেশে। অপরিকল্পিতভাবে ‘লকডাইন-লকডাউন তামাসা’ করেছে, শ্রমজীবী মানুষদের একবার বাড়িতে পাঠিয়েছে, আবার ডেকেছে, আবার পাঠিয়েছে, আবার ডেকেছে…! এভাবে করোনা ভাইরাসকে ছড়িয়ে দিতে সরকার নিজেই সহায়তা করেছে। ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করেছে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে প্রণোদনার নামে। শ্রমজীবীদের সর্বশান্ত করেছে।
যতটুকু সহযোগিতা কার্যক্রম আমরা দেখেছি তা ছিলো জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে। সচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্যানিটাইজার বানানো ও বিতরণ, খাদ্য সহায়তা— ইত্যাদি অনেক অনেক তৎপরতা আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা করেছে স্ব-উদ্যোগে। সমন্বয়ের দায়িত্বটাও সরকারকে ঠিকঠাকমতো করতে দেখা যায় নাই। একপর্যায়ে সহযোগিতার নামে দলীয় লোকদের পকেট ভারী করার সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি ডাক্তারদের জন্য মাস্কসহ পিপিই, এগুলো নিয়েও হয়েছে দুর্নীতি। টেস্ট নিয়েও হয়েছে ভয়ংকরতম দুর্নীতি। শুধু তাই নয়, যারা স্বেচ্ছায় কিছু করার চেষ্টা করেছে- তাদের পেট্রোনাইজ করা দূরে থাক, ঠেকানোটাই সরকার দায়িত্বশীলতার সাথে করেছে।
আবহাওয়াগত কারণেই হোক আর আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কল্যাণেই হোক, করোনা বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর (তুলনামূলক) ক্ষতি করতে হয়তো পারেনি প্রথম বার। টিকা নিয়েও সরকার ভালোই অর্জন অর্জন খেলা খেলেছে! একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টিকা আনিয়ে বেশ দফায় দফায় লাফালাফি করতে দেখেছি আমরা! সেই লাফালাফিটা ১৮ কোটি মানুষের দেশে ৫৫ লাখ মানুষের জন্য একটা ডোজ টিকার লাফালাফি। ২য় ডোজের খোঁজ-খবর জানা নাই।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা শোনা যাচ্ছিলো গত বছরের নভেম্বরের শেষ থেকেই। যুক্তরাজ্যে এই নতুন ও ভয়াবহ ভ্যারিয়েন্টের অবির্ভাব ঘটেছিলো। তখনো সরকার নাকে তেল দিয়ে করোনা মোকাবেলায় ব্যস্ত থেকে মুজিববর্ষের কার্যক্রম করে যাচ্ছিল। তখনই যদি যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসার সকল ফ্লাইট বাতিল করা হতো, তাহলে এই দ্বিতীয় ঢেউটাও হয়তো ঠেকানো যেতো।
সারাদেশে মুজিববর্ষের উৎযাপন চললো মহাসমারোহে। একটা উদাহরণ দেই-
দ্বিতীয় ঢেউ যখন অলরেডি দেশে ঢুকে পরেছে তখন গত ৩০ মার্চ, বরিশালে ৯ হাজার ৪০৮ জন মানুষকে একসাথে জড়ো করে মুজিব বর্ষের মানব লোগো বানানো হয়েছে জনগণের টাকায়। তারজন্য দফায় দফায় করতে হয়েছে রিহার্সেল। তারা ৫ লাখ শিক্ষার্থীকে বিসিএস পরীক্ষায় বসিয়েছে। গত শুক্রবার মেডিকেলের ভর্তী পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। কেমন সামাজিক দুরত্ব মেইন্টেইন করা হয়েছে তার চিত্র আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি।
এর মধ্যে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। যার মধ্যে একটি দফা ‘দেন- এন-দেন’ ‘কার্যকর’ হয়েছে, পাবলিক বাসে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি। জনগণের কী পরিমাণ ভোগান্তি আর পকেট কাটার যে কী সুন্দর ব্যবস্থা! তা কারো অজানা নয়।
একবছর অতিবাহিত হলেও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বেহাল দশার কোনো আশানুরূপ পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি সরকার। করোনা টেস্টের রেজাল্ট পেতে দেরি, আইসিইউ নাই, অক্সিজেন নাই, টিকা নিয়ে কতোটুকু এ্যান্টিবডি তৈরি হলো তার কোনো মেজারমেন্ট নাই… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরমধ্যে সরকার সোমবার থেকে আবার এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন টাইপের কী একটা যেনো ঘোষণা করেছে। কিন্তু শিল্প-কল-কারখানা খোলা থাকবে, শ্রমজীবীরা কাজ করবেন কারণ তাঁদের নাকি কী এক ধরনের শক্তি আছে করোনা প্রতিরোধে (রুবানা হকের ভাষ্যমতে। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের শ্রমিকরা কাজ করবেন আর মালিকরা প্রণোদনা পাবেন।
এই হলো সরকারের করোনা মোকাবেলার তৎপরতা। বাজারে গুঁজব শোনা যায়- করোনা নাকি এই সরকারের জন্য আশির্বাদ নিয়ে এসেছে, আশির্বাদ নিয়ে এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। আর একটা কথা- এই ধরনের পর্যালোচনা-সমালোচনা করলে সরকার ও তার দলের লোকজন বলবেন- ‘পারেন তো খালি সমালোচনা করতে, কিছু করে দেখান।’ এই ক্ষেত্রে বলি- সরকার বাহাদূর, ক্ষমতায় তো আপনারা, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তো আপনাদের ম্যানেজারিয়াল কাজ করার কথা, বিরোধী দলগুলোর বা জনগণের নয়।
এই সরকার জনগণের সকল কষ্টার্জিত অর্জনকে নিজের বলে চালিয়ে আর নিজের সকল জনবিরোধী তৎপরতা ও ব্যার্থতার দায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এইটা বোঝার এখন সময় হয়েছে। নিজের জন্য হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, ভরসা রাখুন জনগণের সম্মিলিত শক্তির ওপর।
সৈকত মল্লিক
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
সংগঠক, গণসংহতি আন্দোলন