গনসংহতি আন্দোলনের প্রস্তাব

জাতীয় মুক্তি সনদ

রাজনৈতিক সংকট-সংঘাত উত্তরণে নতুন জাতীয় সনদ ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যে তৈরির বিষয়ে প্রস্তাব

বাংলাদেশ এখন এক গভীর রাজনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সংকটের মুখোমুখি হয়ে এক সত্যিকার ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। অল্প কিছু দিনের মাঝেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এই সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে আসছে এবং আগামী নির্বাচন যেভাবে হবে বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করছে ও সরকার ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা বেশিরভাগ মানুষ করেন না। বরং তাদের আশঙ্কা একটা লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতা ধরে রাখতে যাচ্ছে। জনগণের যে শুধু নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা নেই তাই নয়, তারা আস্থা হারিয়েছেন প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহসহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর, এমনকি বিচার বিভাগও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন।এই আস্থাহীনতা আসলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনগুলো থেকে চুঁইয়ে পড়া প্রভাবে একটা সর্বব্যাপী চেহারা নিয়ে রাষ্ট্রের সবগুলো সংস্থার প্রতি অনাস্থায় পরিণত হয়েছে। এই অনাস্থা থেকে আস্থায় পেীঁছতে সর্বাগ্রে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কেননা সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণ নির্বাচনকেই গ্রহণযোগ্য পথ হিসাবে বিবেচনা করেন। ফলে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সংকটই রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রীয় জায়গা নিয়েছে। কিন্তু সংকটের মূল আরও গভীরে প্রোথিত।

বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় তারা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারই অধিকারী হয় না, বরং সর্বব্যাপী ক্ষমতা লাভ করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, হাট, মাঠ, ঘাট, মসজিদ, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীদের প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই তাদের নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব ও দখল কায়েম হয়। তার সাথে যুক্ত হয় বলপ্রয়োগের একচেটিয়া কর্তৃত্ব। ক্ষমতা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের শর্ত। ক্ষমতায় থাকার অর্থ হয় সব পাওয়া আর ক্ষমতা হারানোর অর্থ দাঁড়ায় সব হারানো। যে ক্ষমতায় নেই, কার্যত সে নাগরিক অধিকারহীনে পরিণত হয়।

তার জীবন-সম্পদ-সম্মান সবই ক্ষমতাসীনের খামখেয়ালির বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে ক্ষমতার জন্য এমন এক মরিয়াপনা তৈরি হয়েছে যাতে ক্ষমতায় গেলে তা রক্ষার জন্য বেপরোয়া কাজকর্ম করতে থাকে, অন্যপক্ষও ক্ষমতায় পূনরায় আসীন হবার জন্য মরিয়া হয়ে যায়। এটা মূলত একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হয়ে যে এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামো তৈরি হয়েছে তারই ফলে সৃষ্ট। বারবারই যার প্রকাশ ঘটেছে নির্বাচন ও ক্ষমতা বদলকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলে দেখা যায় নব্বই এর দশকের আগে কোন সরকারেরই পরিবর্তন নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটেনি। ঘটেছে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি প্রাণঘাতি ও ভয়ঙ্কর পথের মাধ্যমে। এরপর জনগণের আন্দোলনে ‘৯০ এর অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন ধারা তৈরি হয়। অর্থাৎ তথাকথিত সাংবিধানিক পথে এখানে ক্ষমতার বদল ঘটেনি বরং জনগণের আন্দোলনের মুখে দুই দুই বার নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এবং বর্তমানে দলীয় সরকারের অধীনে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে স্বনির্বাচিত সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে। কিন্তু নির্বাচন কেন্দ্রিক এই সংকট যে মূল সংকটের উপসর্গ মাত্র। এটার শেকড় যে আরও গভীরে সেটা বোঝা যায় সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার ব্যর্থতা থেকে। প্রথমত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে পছন্দমত আমলা-প্রশাসন ফেলে সাজানোর মাধ্যমে একে অকার্যকর করার চেষ্টা হয়, তারপর নিজেদের দলীয় লোককে সরকার প্রধান করার চেষ্টা করা হয়, ফলশ্রুতিতে সামরিকবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে এবং সবশেষে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তির মাধ্যমে এই সাময়িক সমাধানও অন্তর্হিত হয়। কিন্তু তার পরিবর্তে কোন অধিকতর কার্যকর বা স্থায়ী ব্যবস্থা দ্বারা তা প্রতিস্থাপিত না হওয়ায় কার্যত তা ফিরে যায় নব্বই পূর্ববর্তী অবস্থায়।

অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোড়ার যে সংকট তাই নতুন রূপে আরও পরিপক্ক হয়ে হাজির হয়েছে বর্তমানে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ার সংকট একটা উৎপাদন সম্পর্কহীন শ্রেণীর শাসন ক্ষমতা দখল এবং তাদের লুন্ঠনের উপযোগী করে গোটা শাসনব্যবস্থাকে সাজানো। বাংলাদেশের সংবিধানেরও ক্ষমতা কাঠামোতেও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন করে তৈরি হওয়া মানুষের নতুন অভিপ্রায়কে পাশ কাটিয়ে পুরনো শাসনের ধারাবাহিকতাকেই বজায় রাখা হয়েছে। সংবিধানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মূলনীতি ইত্যাদিতে আমরা অনেকটাই জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাই। কিন্তু এসব যার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে সেই ক্ষমতা কাঠামো প্রথম থেকেই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক বিকাশের অনুপোযোগী। সংবিধানের সংশোধনীসমূহে, এমনকি মৌলিক নীতিসমূহে পরিবর্তন করা হলেও সংবিধানের মৌল ক্ষমতা কাঠামোটি রয়ে গেছে ‘পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়’। বরং সংশোধনীগুলোর মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়েছে, তা আরো ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।

আর এই ক্ষমতা কাঠামোটি রূপ পেয়েছে সংবিধানের ৭০, ৫৫ এবং অন্যান্য বেশকিছু অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। এখানে আমরা সংবিধানের উল্লিখিত ধারা দুটির কিছু অনুচ্ছেদকে বিশ্লেষণ করে এই ক্ষমতা কাঠামোটি কিভাবে এককেন্দ্রিক ক্ষমতার জন্ম দেয় তা দেখার চেষ্টা করব।

৭০। কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
তবে ৭০ ধারা সংবিধানের সামগ্রিক যে ক্ষমতা কাঠামো তারই অংশ এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ৫৫ ধারা।
৫৫। (১) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।
(২) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।
(৩) মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।
এই দুইকে মিলিয়ে দেখলে বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়।

প্রথমত, দলের সদস্য হবার কারণে তার স্বাধীন মতামত দেবার অধিকার খর্ব হলে তা কি আসলে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে? হতে পারে না, বরং তা ব্যক্তির স্বাধীন মত প্রকাশের যে মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতি তার পরিপন্থী। এর সাথে যদি রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসঙ্গটা যুক্ত করা যায় তাহলে দেখা যাবে আসলে সদস্যের ওপরে দলের নয় বরং দলের প্রধানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সাথে আরও একটা বাস্তবতাকে যুক্ত করতে হবে, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বও এখানে একই ব্যক্তির হাতে। তার হাতেই ন্যাস্ত দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগদান ক্ষমতা।

বলা হয়ে থাকে এই ধারা না থাকলে সংসদ সদস্যদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, এমপি কেনা-বেচা হবে, কাজেই তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ৭০ ধারা জরুরি। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদ প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রী পরিষদ। সেখানে যাকে ইচ্ছা তিনি নিয়োগ দিতে বা বরখাস্ত করতে পারেন। যে সংসদের কাছে মন্ত্রীসভা সামগ্রিকভাবে দায়বদ্ধ তার নিয়ন্ত্রণও আবার ৭০ ধারা বলে তারই কাছে। তার অর্থ মন্ত্রী পরিষদের সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকা কোন অর্থই তৈরি করে না। কেনাবেচার সংস্কৃতির কারণে যদি কোন সমস্যা তৈরি হবার সম্ভাবনা থেকেও থাকে, তা নিশ্চিতভাবেই চরম ও চূড়ান্ত একনায়কতন্ত্রের সংস্কৃতির তুলনায় সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব।

বিশেষ ব্যক্তি যিনি সংসদীয় দলের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী আবার দলীয় প্রধান ৭০ ধারা অনুযায়ী তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়ে যায়; কেননা এই ধারা বলে কখনও তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা যাবে না। আনলেই সংসদ সদস্যপদ খারিজ। দলে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হওয়াও এর ফলে হয়ে যায় অসম্ভব। এতে করে দলে এমন এক কেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় যে দ্বিতীয় কেউ প্রধান হবার ইচ্ছা করামাত্র সে ষড়যন্ত্রকারী বলে চিহ্নিত হবে। দল ও সংসদ এর এককেন্দ্রীকতা এভাবে একীভূত হয়েছে। সব মিলিয়ে যে একক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয় তার ফলে একটা জবাবদিহিতাবিহীন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তৈরি হয়। তৈরি হয় নিরঙ্কুশ লুন্ঠনের সুযোগ।
আর কোন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার অবর্তমানে এমনকি বিরোধী দলও যে কিভাবে সরকারি দল হয়ে দাঁড়ায় সেটা আমরা বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মাধ্যমে দেখছি। তারা একই সাথে সরকার ও বিরোধী দলে আছে, প্রকৃত বিরোধী দল হবার সুযোগ দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছে, এমনকি তাদেও অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেকিাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে এবং সেই হস্তক্ষেপে তার মীমাংসাও হচ্ছে। যার ফলে কোন একজন বিশেষ সদস্যের বিরোধী দল থেকে সরকারী দলে যোগ দিতে হচ্ছে না, বা ফ্লোর ক্রস করতে হচ্ছে না বরং ফ্লোর ব্লার হয়ে বিরোধী দলই সরকারী দল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বহুদলের মোড়কে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছে।

এরকম একটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয় গভীর অনাস্থা ও বিভাজন। তা জাতিগতভাবেও বিভাজন তৈরি করে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে করে দুর্বল ও ক্ষেত্রবিশেষে আত্মঘাতি। কারণ একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র তখন আর সমগ্র জাতির কিংবা জনগণের রাষ্ট্র থাকে না, বরং হয়ে ওঠে দলের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বার্থের চাইতে বড় হয়ে ওঠে কে রাষ্ট্রকে তার দলের অধীনস্ত করতে পারবে সেই প্রশ্ন। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথেও তখন রাজনৈতিক দলগুলো এরই ভিত্তিতে সম্পর্কিত হয়। ফলে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি বাংলাদেশকে কেবল জাতীয় নয় বরং একটা আর্ন্তজাতিক সংকটের ভেতরেও ফেলে দিচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মার্কিন-ভারত বনাম চীনের লড়াই রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন রূপ নেবার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে একদিকে, অন্যদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করছে। যার ফলে একদিকে যেমন নানা ধরনের বৈদেশিক আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি এর ফলাফলে নানা উগ্রবাদী শক্তির মাথাচাড়া দেবার এবং তার উছিলায় উগ্রবাদ দমনে হস্তক্ষেপের সুয়োগও তৈরি হচ্ছে। আর এসব বড় বিপদের মোকাবেলার প্রশ্ন আমাদের সামনে এমন এক সময়ে আসছে যখন আমরা জাতিগতভাবে সবচেয়ে বিভক্ত এবং পরস্পর বিধ্বংসী খেলায় লিপ্ত। এসব বিপদ জাতীয় ঐক্যের শক্তিতে মোকাবেলার ভিত্তিই আমরা হারিয়ে ফেলছি।

সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর দমন-পীড়ন, বিরোধী পথ ও মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা ইত্যাদির মাধ্যমেও ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও উগ্রপন্থার সম্ভাবনা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, কিশোর বিদ্রোহ দমনে সরকারের ভূমিকা সরকার ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় জনগণের মন জয় করে নয় বরং একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকার তার ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে চাইছে। লক্ষ্যনীয় সরকার এমনকি তার দলের লোক এবং সমর্থকদেরও ভয় দেখাচ্ছে যে ক্ষমতা হারালে লাখ লাখ লোক মারা যাবে, ফলে প্রাণের ভয়ে হলেও যাতে তারা এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন কর। অন্যদিকে বিরোধী বিএনপি জোটও আগামী নির্বাচনকে দেখছে তাদের অস্তিত্বের সংকট হিসাবে। সব পাওয়া অথবা সব হারানোর যে অবস্থা তা একটা গোত্রীয় সংঘাতের সাথেই তুলনীয়, কোন গণতান্ত্রিক শাসনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতার নয়।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশকে এমন এক সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে যার সমাধান এই বিবাদমান পক্ষগুলোর হাতে নাই। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধতা দূরে থাক তারা এমনকি নিজেদের জয়ের চাইতে প্রতিপক্ষের পরাজয়ে বেশি আগ্রহী। ফলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উদ্যোগ আসতে হবে প্রধান দুই বিবাদমান পক্ষের বাইরে থেকে এবং যে ব্যবস্থা এই সাংবিধানিক শাসনতান্ত্রিক সংকটের জন্ম দিচ্ছে তার বদলের মাধ্যমেই এই সমাধান খুঁজতে হবে।

আর এই সংকটের গোড়া নিহিত একটা ন্যায়ভিত্তিক, সমতামুখী, মর্যাদাসম্পন্ন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার বিপরীতে রাষ্ট্রকে পরিচালনার মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রকে যে এককেন্দ্রিক, অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়া হয়, তা দেয়া হয় একটা লুন্ঠনমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনে। মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাকারী জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি অর্জনও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দেশকে পরিচালনারই ফলাফল। যুদ্ধাপরাধীদেও বিচারের জনদাবি পূরণ করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দেওয়া এই সরকারকেও দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধেও অন্যতম প্রধান চেতনার বিপরীতে গিয়ে কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়নের শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে। আর তাদের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথেষ্ট পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না, সুষম বিকাশের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে না, প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে আর লুন্ঠন-দুর্নীতির একটা বড় ক্ষেত্র হয়ে কতিপয় লোকের স্বার্থসিদ্ধি ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের শ্রম-ঘাম-রক্ত তাদের জীবনের সত্যিকার কোন পরিবর্তনের বদলে একই বেঁচে থাকার সংগ্রামে তাদের ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। তাদের ওপর বর্ধিত ব্যয়ের বোঝা চাপছে, নতুন ট্যাক্স আরোপিত হচ্ছে কিন্তু তারা সেবা পাচ্ছেন না, নাগরিক মর্যাদা পাচ্ছেন না। এমনকি জীবনের নিরাপত্তাও নেই তাদের। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের কোন অংশগ্রহণ নাই, আইনসভা-মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পাবার কথা তারা কল্পনাতেও আনতে পারেন না, রাজনীতি চলে সাধারণের আওতার বাইরে সেখানে তারা দর্শক বা শিকার মাত্র। আগে ভোট দেবার অধিকার ছিল এখন তারা তাও হারিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে আরও এক কাঠি এগিয়ে কোন নাগরিকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকেও (সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কিশোর বিদ্রোহের ক্ষেত্রে যা আরও স্পষ্ট হয়েছে) অপরাধ হিসাবে গণ্য করা শুরু করেছে রাষ্ট্র। অর্থাৎ জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্র নিজেকে জনগণের বিপরীত শক্তি আকারে হাজির করছে। একটা নিরপেক্ষ জায়গায় থেকে ক্ষমতার জন্য বিবাদমান পক্ষগুলোর একটা মীমাংসার যে কাজ রাষ্ট্র করে থাকে তার সক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলছে। পুলিশ, আমলা. নির্বাচন কমিশনার সকলের বক্তব্যই যে রাজনৈতিক দলের নেতার মত মনে হয় সেটা এই বিষয়েরই প্রকাশ। আর যে রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ, আর্ন্তজাতিক চাপ মোকাবেলায় সে যে অক্ষম হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফলে বাংলাদেশের সামনে যে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংকট বিদ্যমান তার মোকাবেলায় প্রয়োজন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূণ:সজ্জায় এক ব্যাপক রাজনৈতিক ঐক্য। প্রয়োজন সংঘাত-সংকট মোকাবেলায় নতুন করে এক সামাজিক-রাজনৈতিক চুক্তি, এক নতুন জাতীয় সনদ। বাংলাদেশের ইতিহাস নির্ধারিত পথে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই যা তৈরি হতে পারে। সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমাদের এমন একটা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠবে যাতে সকল দলের অংশীদারিত্ব ও অংশগ্রহণ থাকবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামতই হবে নির্ণায়ক শক্তি, জনগণের সকল অংশের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষিত হবে। বহু মতের, বহু পথের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি ও দলের একচেটিয়া কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। এরকম একটা গণতান্ত্রিক পরিসর ও প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই গড়ে উঠতে পারে একটা জাতীয় ঐক্য যার মাধ্যমে আমরা সমস্ত জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক প্রশ্নকে মোকাবেলা করতে পারব। আমাদের মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক পথে এই সংকট সমাধানে ব্যর্থতা অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখলের পথকেই তৈরি করে। কাজেই আমাদের সামনে পথ দুইটি। একটা মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বিরোধীতাকারী জামাত বাদে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। অন্যটি অধিকতর স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংঘাতের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া। এই দ্বিতীয় বিকল্প আমাদের কারোই কাম্য নয়। কাজেই আসুন, একটা গণতান্ত্রিক উত্তরণের নতুন জাতীয় সনদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা দেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির জন্ম দিতে ঐক্যবদ্ধ হই।

জাতীয় সংকট মোকাবেলায় নতুন জাতীয় সনদের ভিত্তি হতে পারে:
ক. স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামো, বিচার বিভাগ ও শাসব্যববস্থার সংস্কার:
১.বাংলাদেশের বর্তমান এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামো বদল করে ক্ষমতার ভারসাম্য ও পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা। সকল নাগরিকের নাগরিক মর্যাদা, মত প্রকাশের অধিকার, জীবন-জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি এর সাথে সাংঘর্ষিক সমস্ত আইন-কানুন, বিশেষ আদেশ ইত্যাদি বাতিল করা।

২.এককেন্দ্রিক ক্ষমতার অন্যতম উৎস সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জনগণের প্রতিনিধিদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা।

৩.রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা।

৪.সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদিতে সাংবিধানিক কমিশন কর্তৃক নিয়োগের ব্যবস্থা করা ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা ও জনবল তৈরির আইনী বিধান তৈরি করা।

৫.বিচার বিভাগকে খবরদারিমুক্ত প্রকৃত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর করতে হবে। আলাদা সুপ্রিম কোর্ট কার্যালয় স্থাপন এবং নিম্ন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে।

৬.সংসদ নির্বাচনের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে জনগণের সর্বস্তরের অধিকতর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে হবে। নির্বাচিত সদস্যদের প্রত্যাহারের বিধান তৈরি করতে হবে।

৭.দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৮.কেন্দ্রমুখী, আমলাতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান করে সংসদের ওপর নীতি ও আইন প্রণয়ণের ভার দিয়ে শক্তিশালী ও খবরদারিমুক্ত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের পরিকল্পনা তৈরি, বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিতে হবে।

৯.সংবিধান সংশোধনে জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত প্রদানের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

খ. নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার ও আগামি নির্বাচন নিয়ে পদক্ষেপ

১.আমরা মনে করি সাংবিধানিক ক্ষমতা কাঠামো ও শাসনব্যবস্থার উল্লিখিত সংস্কার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতার এমন জবাবদিহীতা ও ভারসাম্য তৈরি হবে যাতে রুটিন দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলেও নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বেই অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তবতা তৈরি হবে। তবে দীর্ঘদিনের ক্ষমতার একচেটিয়াকরনের তৎপরতা যে বিভাযন ও অনাস্থা তৈরি করেছে তাতে দলীয় সরকারের অধীনে আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে। সে কারণে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরির জন্য আগামি ৩ টি জাতীয় নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে জাতীয় অঙ্গীকার তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বেই বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে, একটা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে বর্তমান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

২.আগামি ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনকালীন ঐক্যমত্যে সরকার গঠন করতে হবে। এই সরকার নির্বাচন কমিশন পুর্নগঠনসহ প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কার করবে।

৩.বাংলাদেশের বর্তমান হানাহানির পরিবেশকে মাথায় রেখে সম্ভাব্য নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা মোকাবেলায় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সমাজের নেতৃস্থানীয় নাগরিকদেও সমন্বয়ে একটা কমিশন গঠন করে প্রতিটি থানায় একটি ক্ষমতা হস্তান্তর কালীন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করতে হবে যাতে করে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় ও জনগণের জান-মালের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয়। সমস্ত আইন-শৃক্ষলা বাহিনী এই কমিশনের নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবে।

৪.অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রার্থীতার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকার লংঘনের বিধান বাতিল করে নতুন আইন তৈরি করতে হবে।

৫.নির্বাচনে কোটি টাকার খেলা বন্ধে নির্বাচনী ব্যয়সীমা তদারকীতে প্রচারের সুনির্দিষ্ট বিধান করতে হবে। প্রশাসনিক কারসাজি, পেশী শক্তি ও সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার বন্ধে কার্যকর বিধান তৈরি করতে হবে।

গ. দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে নূন্যতম জাতীয় অঙ্গীকার:

১.যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ধর্মের নামে উগ্রবাদী শক্তির যে কোনো রকম পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ, রাজনৈতিক ও আইনীভাবে মোকাবেলা।

২.সর্বস্তরে দুর্নীতিকে নির্মূল করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করা। সরকারি কর্মকর্তা বা অন্য যে কারও দুর্নীতি তদন্তে পূর্বানুমতির বিধান বাতিল করা। দুর্নীতি তদন্তে সকল দায়মুক্তি আইনকে অকার্যকর ঘোষণা করে দুর্নীতি দমনের রাষ্ট্রীয় আয়োজনকে শক্তিশালী করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে।

৩.নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদার বিপরীতে কোন আইন প্রনয়ণ করা যাবে না।

৪.সংখ্যালঘু ধর্ম ও জাতি সত্তার নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৫.গুম, খুন, ক্রস ফায়ারসহ সকল বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করে সকল নাগরিকের বিচার পাবার অধিকার প্রতিষ্ঠায় দলসমূহকে একমত হতে হবে। দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়অঙ্গীকার করতে হবে।

৬.পার্থক্যকে বিভক্তি নয় বরং বৈচিত্র আকারে চর্চা করতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এবিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। হিংসা, হানাহানি, বিভক্তি, বিভাজন বর্জন করে একটা সত্যিকার অর্ন্তভূক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে।

১০.যারাই সরকার গঠন করুক প্রাণ-প্রকৃতি, দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য নীতি কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হতে পারবে না। সর্বস্তওে সরকারের নীতির জবাবদিহীতার জন্য জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলা ও তাকে কার্যকর রাখা নিশ্চিত করতে হবে।

এই জাতীয় সনদ সমস্ত রাজনৈতিক দলের এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সংযোযিত- সংশোধিত হতে পারে। প্রয়োজনীয় গবেষণা, বিশ্লেষণ ও বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য জন্য বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে পারে। আর এই সনদের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে একটা জাতীয় ঐক্য যা এই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের সংগ্রাম গড়ে তুলতে থাকবে অঙ্গীকারাবদ্ধ।