You are currently viewing কিউবা: বিপ্লব রক্ষার দায়িত্বে থাকুক জনগণ
কিউবা: বিপ্লব রক্ষার দায়িত্বে থাকুক জনগণ

কিউবা: বিপ্লব রক্ষার দায়িত্বে থাকুক জনগণ

আমার বিশ্বাস বিপ্লবের স্বপ্নভূমি কিউবা তার বর্তমান সঙ্কট সাময়িক কালের জন্য কাটিয়ে উঠবে। খেয়াল করুন, এটা বলিনি যে, সাময়িক সঙ্কট কাটিয়ে উঠবে, বরং বর্তমান বিক্ষোভ প্রতিবাদ ইত্যাদিকে সে সাময়িক কালের জন্য কাটিয়ে উঠবে। দীর্ঘমেয়াদে কী ঘটবে, সেটা নিশ্চিত করে বলার জ্ঞান আমাদের কারও নাই। তবে আমাদের যা আছে, সেটা হলো করণীয় নির্ধারণের কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক ও মতাদর্শিক কষ্টিপাথর। সেগুলোর সাপেক্ষে কিছু কথা বলা যাক। বিপ্লবের জন্য আবেগকে যদি সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রেখে (কঠিন, যদিও) বিপ্লবের জন্য করণীয় নির্ধারণকে গুরুত্ব দেই, তাহলে বাংলাদেশে বসে কিউবা বিষয়ে কিছু সূত্র তোলার চেষ্টা করা যাক:

১.

কিউবার বিপ্লব ব্যর্থ নয়। নিজেদের স্বভাবদোষে অনুন্নত বলে সাবেক উপনিবেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া গরিবির ভুল ও মিথ্যা ব্যাখ্যাকে কিউবা বেঠিক প্রমাণিত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম অবরোধ ও আগ্রাসনকে ব্যর্থ প্রমাণ করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-নারীর অগ্রগতি-বর্ণবাদ বিলোপ সহ যে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি কিউবা নিজের জন্য ঘটিয়েছে, তা বিশ্বের জন্যও বিপুল উদাহরণ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, ভারত-পাকিস্তান শুধু নয়, গোটা গরিব দুনিয়ার জন্য কিউবা অনেক বড় একটা দৃষ্টান্ত, একটা আশাবাদ।

২.

বিশ শতকের সবগুলো বিপ্লব ভয়াবহ সব একদলীয়/স্বৈরতান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল বলে তার বিপরীতে নানান মাত্রায় তারা নিজেরাও একদলীয় শাসনকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এটা ঊনিশ ও বিশ শতকের বাস্তবতায় অনিবার্য ছিল। এছাড়া ছিল যে কোন রুপান্তরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আগ্রাসী শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্র-আগ্রাসন ও উস্কানি। বিশ্ব ইতিহাস হয়তো এই অনিবার্য প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে সঙ্গত কারণেই, কিন্তু সেগুলোকে যুক্তিযুক্ত করতেও গড়ে উঠেছে বিপুল রাজনৈতিক সাহিত্য, একদলীয় শাসনের যৌক্তিকতা এবং ব্যক্তির মতপ্রকাশকে নিরুৎসাহিত করাটাকে সঙ্গত প্রতিপন্ন করে। এটা সামনের দিনের বিপ্লবীর জন্য আর করণীয় হতে পারে না, মুক্তির রাজনৈতিক দর্শনের কাছে তা আর গ্রহণযোগ্য নয়।

  • ৩.
সূত্র: ইনটারনেট

কিউবার আমলাতান্ত্রিকতাহীনতাও দৃষ্টান্তস্থানীয়। বহু আগে ক্যাস্ট্রোর একটা অনুবাদ করেছিলাম, হার্লেমে দেয়া সেই বক্তৃতা ক্যাস্ট্রো দেখিয়েছিলেন কিভাবে ৯০ পরবর্তী তীব্র সঙ্কট কিউবা মোকাবেলা করেছিল সামান্য সম্পদকেই বন্টনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের কাছেই ছেড়ে দিয়ে। সোভিয়েত পতন পরবর্তী ভয়াবহতম সময়টিতে মার্কিন অবরোধ নৃশংস হয়ে দেখা দিলো, কিন্তু কিউবা মোকাবেলা করতে পেরেছিলো কোন মাতৃসেবার সুবিধা বন্ধ না করে, শিশুদের দুধ বন্ধ না করে, কোন হাসপাতাল বা বিদ্যালয় বন্ধ না করে। কিন্তু ‘বামপন্থী’ ঐতিহ্যে আমলাতান্ত্রিকতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনে। সোভিয়েতরা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম বিশালতম আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিল, যা তাদের পতনের একটা অন্যতম কারণ। চীন বলা চলে পৃথিবীর ইতিহাসে সফলতম আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে চীনের আমলাতন্ত্রও সফল হবে, এটা মনে করার কারণ নেই। সেটা নিয়ে আশা করি পরবর্তী সময়ে আবারও লেখা যাবে বিস্তারিত আকারে। কিউবা আমলাতান্ত্রিকতা থেকে একটা পর্যায় পর্যন্ত মুক্ত থাকতে পারলেও, ক্যাস্ট্রো ও চে স্মৃতি মানুষের মাঝে তীব্র আবেগ তৈরী করলেও আগে কিংবা পরে আমলাতান্ত্রিকতার জন্ম হবেই, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভাবে জনসম্পৃক্ততা কমে যাবার সূত্রে। একটা পর্যায়ে ‘শাসন’ টিকিয়ে রাখাটা জনগণের জন্য না, এই আমলাতন্ত্রের স্বার্থও হয়ে দাঁড়াবে।

৪.

পৃথিবীতে কিউবার মত উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠি খুব কমই আছে। এদের বড় অংশই আবার সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। বিপ্লবী চেতনা কিউবাতে যে এখনও দৃঢ়তা নিয়েই আছে, তার প্রমাণ এটুকুই: মার্কিনীদের দশকের পর দশক ধরে এত বিপুল প্রচারণা ও উস্কানি সত্ত্বেও, শিক্ষিত ও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী কিউবার সরকারকে ফেলে দেয়নি, বরং সাম্প্রতিক ঢেউতেও পরিস্কার বোঝা যায় হাজারো দুঃখ কষ্ট সত্ত্বেও জনগণ বিপ্লবী সরকারের সাথেই আছে। কিন্তু এই সাথে থাকাটা ক্ষয় বা হ্রাস পেতে থাকবে, যদি (ধরে নিলাম বাইরের উস্কানির মুখেই) জনগনের একাংশকেও রাষ্ট্র নিয়মিত রাস্তায় দমন করতে বাধ্য হয়, তখন কে বিপ্লবের শত্রু আর কে মিত্র তা নির্ধারণ করার একটা নিয়মিত কাজ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াবে, সোভিয়েত ইউনিয়নে যা শেষ পর্যন্ত একটা নিপীড়নের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল।

৫.

কিউবার করণীয় তারাই নির্ধারণ করবে, সত্যি। তবে বাংলাদেশে এই বিষয়ে আগ্রহের কমতি নেই, কারণ এটা সামনের দুনিয়ার, অন্তত চলমান দুনিয়ার আমাদের নিজেদের মতাদর্শ নির্ধারণে সাহায্য করবে। আমার ব্যক্তিগত মতামত, কিউবার উচিত মুক্ত নির্বাচনে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় সম্পদ উন্নয়ন ও বন্টনে যে যৌথতার সংস্কৃতি ক্যাস্ট্রো- চে রেখে গেছেন, সেটাকে মানুষের মতামত জনসম্মতির একটা সাংবিধানিক আকৃতি দেয়া।

বিপ্লবকে রক্ষা করার দায়িত্ব জনগণের হাতেই দেয়া হোক। নির্বাচন ও জনরায় দেয়ার, বেছে নেবার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি তৈরি করা গেলে সেটা বিপ্লবী অর্জনগুলোকে রক্ষা করার জন্য অনেক বেশি কার্যকর হয়ে দেখা দিতে পারে। অন্যথায় এমনও সম্ভাবনা আছে যে, প্রেরণা যোগাবার চাইতে তার পক্ষে সাফাই দেয়াটাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে রুপান্তরকামীদের করণীয় হয়ে দাঁড়াবে।

ফিরোজ আহমেদ

সদস্য,রাজনৈতিক পরিষদ,গণসংহতি আন্দোলন

#উম-৭/২

Leave a Reply