কোন একটি লংমার্চে, সম্ভবত সুনেত্র লংমার্চের সময়ের কথা। আমি বাসের মধ্যভাগে বসে ছিলাম। পেছন থেকে শুনলাম কেউ একজন বলছে, “এই অসভ্য বর্বর অনার্য”। তাড়াতাড়ি দুইজনকে ডেকে আক্ষরিক অর্থে খুব গুরুত্বদিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওরা উভয়েই এটাকে ”নিছক দুষ্টমি” বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। তো শিরোনামের অংশটি নব্য রাজনৈতিক কর্মী বা অল্প বয়সী রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে পেয়েছি। এবং তারপর থেকে লক্ষ করছি আমাদের বিশিষ্ট-অশিষ্ট সহ-নাগরিক, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক-স্বেচ্ছাসেবী ও এনজিও এ্যকিভিস্টসহ জনসাধারণ প্রায় সকলেই বিভিন্নভাবে মনে করেন বাঙালি ’অসভ্য অনার্য বর্বর জাতি’। এমনকি কবি-সাহিত্যিকবৃন্দও এরকম মনে করেন। যারা মনে করেন না তারা লেখাটি এড়িয়ে যেতে পারেন।
আমার এই নিবন্ধটির শিরোনাম হতে পারতো “সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি ”। সেটা করলাম না। কারন এই বাক্যটির জবাব বঙ্গবন্ধু এক বিশাল সমাবেশে দিয়েছেন। তারপরও একটু উল্লেখ করি, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” বলেছেন। “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” যদি এই শতাব্দীর মানুষ হতেন তাহলে স্বাস্থ্যসেবা /এনজিও কর্মীদের “যন্ত্রনায়” লেখালেখি করতে পারতেন কিনা তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে। তো এই “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন । যদিও তখন তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার জন্য দারুণ অর্থ সংকটে ছিলেন। জ্বি, আমি রবীন্দ্র অনুরাগী ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই তিনি যৌতুক দিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনার কারণ এই যে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের একজন। তিনি জানতেন ১০০ বছর পরও তাঁর লেখা মানুষ পড়বে। পড়তে হবে। তাঁকে আমরা হারিয়েছি মাত্র ৮০ বছর আগে।
মহামানবের সাথে তো আর সাধারণ মানুষের তুলনা চলে না। বরং মধ্যবুদ্ধির মানুষদের নিয়েই আলাপ করা যাক। যারা ইউরোপকে তীর্থ, সভ্যতায় সেরা ভাবেন। আপনাদের মনে করিয়ে দেই আমাদের প্রাণপ্রিয় রবি ঠাকুরও ’দীর্ঘ দিবস রজনী’ ইউরোপে কাটিয়েছেন।
পূর্ব বঙ্গ: ’অসভ্য অনার্য বর্বর জাতি’ জাতীয় স্বার্থে কীভাবে সাড়া দিয়েছিলো
আমি ঢাকায় এসে অনেকের কাছে শুনেছি, “ঢাকায় নতুন আসছেন?” “ঢাকায় কতোদিন থেকে আছেন?” এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সাথে কথা বলে জেনেছি তাঁদের অভিজ্ঞতা আরো খারাপ। যারা প্রশ্ন করেন তারা যে ঢাকার আদি নিবাসী তা নয় কিন্তু। তারাও ঢাকার বাহির থেকে এসেছেন। বড়জোড় তাদের বাবা ঢাকা এসে নানা চেষ্টা চরিত্র করে একটা বাড়ি বানিয়েছেন। ঢাকার বাহির থেকে এসে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পাওয়া ও পালন করা অনেক শক্ত। আপনি যতো সিনিয়র হোন না কেন ‘টাইম’ নাই। তবে স্বাধীনতার পূর্বে এই সমস্য বোধহয় খুব বেশি প্রকট ছিলো না। প্রকট থাকলে চ্যাগা মিয়া সম্ভবত আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হতে পারতেন না । এই চ্যাগা মিয়া অধিকতর পরিচিত মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী নামে।
আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ডেকেছেন আর মানুষের সমাগম হয়নি, সাড়া দেয়নি এরকম তথ্য আমার জানা নাই। বরং শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করতে তিনি ”মিলিটারি পাড়া” ঘেড়াওয়ের হুমকিও দিয়েছিলেন ফলে পাকিস্থানি জান্তা শেখ মুজিবর রহমানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । তারও আগের একটি উদাহরণ দেয়া যাক। এই ’অসভ্য অনার্য বর্বর জাতি’র এক সন্তানের নাম আব্দুস সালাম। তিনি আক্ষরিক অর্থে পিয়ন ছিলেন। এই পিয়ন আপনার ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়ে দিয়েছেন। চ্যাগা মিয়া বা কোর্টের সেরেস্তাদারের ছেলে খোকার ডাকে এই ’অসভ্য অনার্য বর্বর জাতি” খুব রেসপন্সিভ ছিলো। যার ফলে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হলাম।
বাংলাদেশ: সংস্কৃতি সভ্যতা কি আসমান থেকে নাজেল হয়?
তসলিমা নাসরিন কোন একটা প্রবন্ধে তার পড়াশোনা সম্পর্কে মোটামুটি এরকমভাবে জানিয়েছেন, “আর্থ-মনো-সামাজিক” টার্ম জেনেছি অনেক পরে। এরকম কিছু। সাথে সাথে আমি বইটা রেখে দেই। কারন যিনি সাধারণ টার্ম না জেনে সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্যের মতো গভীর বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখছেন তা না পড়লে কিছু এসে যায় না। লিখতে হলে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দিতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করা লাগবে। বিষয়ভিত্তিক প্রচুর অধ্যয়ণ ও চর্চা ছাড়া একটা জাতির আচার অনুষ্ঠান অভ্যেস সংস্কৃতি নিয়ে মন্তব্য করা সমীচিন নয়। এতে জাতীয় মানসিক ভারসাম্যও নষ্ঠ হতে পারে। বিরাট অংশের বাঙালি মনে করেন তারা নিচু জাতের মানুষ। কেন মনে করেন? এই হীনম্নতা বৃটিশরা আমাদের অস্থি মজ্জায় গেথে দিয়েছিলো। যা এখনও আপনাদের কারণে বহাল আছে। আইন তো আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ বানান না। আপনারা বানান, মতামত দেন, পলিসি ডায়লগ করেন। এতো কিছুর পরও দেশের মানুষ শাসিত হয় বৃটিশ আইনে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আছে আপনার কাছে? থাকলে জানায়েন।
অথচ এই বাঙালিকে বলা হয়েছে গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা নেয়া যাবে না। ‘দুইটির বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’। তারা মেনে নিয়েছেন। আমলেও নিয়েছেন। তাদের বলা হয়েছে খোলা যায়গায় পায়খানা করা যাবে না। খাদ্য সুরক্ষা না থাকলেও তারা খোলা য়ায়গায় পায়খানা করা বাদ দিয়েছে। আপনারা বলেছেন নদী, পুকুরের পানি খাওয়া যাবে না। তারা খাচ্ছেন না। আপনারা বলেছেন সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে হবে। তাঁরা না খেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছে, কলেজে পাঠাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। তারপর তারা বুঝতে পারছে তার সন্তান একটা বড় চোর হয়েছে। দালাল হয়েছে। আবার আপনারাই তাদের বলেছেন, চোর হওয়াটা বিশেষ ”সমস্যার” কিছু না। তারা বিস্মযের সাথে তা-ও মেনে নিয়েছেন। আপনারা মেনে নিতে বাধ্য করেছেন।
বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও নাগরিক
মাস্ক নিয়েই আলাপ চলতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ মাস্ক পরতে চান না। রাস্তায় নিয়ম মেনে যানবাহন চালান না। রাস্তা পারাপারে কোন সচেতনতা নেই। এতো সচেতনতার অভাব কেন? কেন তারা সুনাগরিকের মতো সভ্য আচরণ করেন না? উল্টো করে প্রশ্নটা নিজেকেই করুন। আর ভাবতে থাকুন, তারা কেন “সভ্য” আচরণ করবেন?
এক কথায় উত্তর দেয়া যায়। যদি আপনি সংবিধান মান্য করেন। সংবিধান অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অথচ রাষ্ট্রের সাথে তার কাগুজে কিছু সম্পর্ক আছে বটে তবে নাগরিক মর্যাদা তিনি পান না। এই রাষ্ট্র তার বিশেষ কোন কাজে লাগে না। এই সাধারণ জনগণকে আপনি আপনার শহরে কার্যত অবাঞ্ছিত করে রেখেছেন। তার বাসস্থান কেমন সেটা আপনি আমলে নেন না। তিনি কী খেয়ে বেঁচে থাকে সেটা জানেন না। আপনার পবিত্র ঢাকা শহরে যত্রতত্র মূত্র বিসর্জন করে অপবিত্র করে ফেলছেন তারা। ফেলবে না কেন বলেন? জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসে অফিসে কাজ করা আর রাস্তায় কাজ করার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। তিনি যায়গা না পেয়ে যত্রতত্র মল-মূত্র ত্যাগ করছেন। আপনিও মূত্র চেপে রেখে বিভিন্ন অসুখ বাধাচ্ছেন। ইউরিন ইনফেকশন হচ্ছে। আরো আরো রোগ। তবুও আপনি আপনার সাথে সবাইকে বা অন্যদের সাথে আপনি মূত্র ত্যগ করতে চান না। প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেটের কথা বলেন না। আপনারা আর যতো অভ্যেস সংস্কৃতির সমস্যা দ্যাখেন তার কারণ অনুসন্ধান করতে চান না। অনুসন্ধান করেন প্রতিকার দেখতে পাবেন।
উৎসব মোসাদ্দেক
সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন