Adv. Abdus Salam Ganosamhoti
Adv. Abdus Salam Ganosamhoti

গ্যাস রক্ষার আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই

গ্যাস রক্ষার আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই

( সম্পাদকীয় নোট: আজীবন সংগ্রামী রাজনিতিবিদ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম রাজশাহীতে অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাত্র ১৭(?) বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, মাইতি গ্রুপের সদস্য হিসেবে। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য পরবর্তী সময়েও তিনি আজীবন মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত থেকেছেন, মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সংবিধান প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ‘গ্যাস রক্ষার আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই’ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম কর্তৃক ফেসবুকে প্রকাশিত একটি লেখা যা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় )

গত পাঁচ বছর ধরে দেশের গ্যাস সম্পদ রক্ষা করবার জন্যতেল-গ্যাস সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তাই আন্দোলনের ফলে জাতীয়ভাবে গ্যাস সম্পদ সম্পর্কিত এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে,রফতানীযোগ্য পর্যাপ্ত গ্যাসের মজুদ নাই, গ্যাস রফতানি করার প্রস্তাব ও উদ্যোগে জাতীয় স্বার্থবিরোধী, গ্যাস উত্তোলনের জন্য এ পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে সম্পর্কি উৎপাদন বন্টন চুক্তিসমূহ অসম ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশের সকল জনগণ গ্যাস সম্পদের সমভোগের অধিকারীহওয়া সত্ত্বেও মুষ্টমেয় জনগোষ্ঠী এ্ই গ্যাস সম্পদের সুবিধাভোগী, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানা পরিচালনায় এই গ্যাস সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের কোনেো পরিকল্পনা ও নীতিমালা নাই। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় গ্যাস সম্পদের ব্যবহারের নামে বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফার স্বার্থে ভারতের শাসগেোষ্ঠীর কাছে গ্যাস রফতানি বিভিন্ন অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে দেশের অধঃপতিত, সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার শামকগোষ্ঠীর ক্ষমতাসী-ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলগুলো। উৎপাদন বন্টন চুক্তি অনুসারে শর্তগুলো পূরণের কারণে গ্যাস রফতানির অযুহাত দেখানো হচ্ছে। এ উৎপাদন বন্টন চুক্তিগুলি সম্পাদন করেছে এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সরকার; খালেদা-নিজামীর চারদলীয় জোট সরকার; শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার আর এখন গ্যাস রফতানির অপচেষ্টা চালাচ্ছে খালেদা-নিজামীর চার দলীয় জোট সরকার। আর এই সবই করা হয়েছে ও হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজির মুনাফার অর্জনের স্বার্থ নিশ্চিতকরণের বিশ্বব্যাপী পরিকল্পনার অধীনে এবং তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে।

বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের শোষণ লুণ্ঠনের পাহারাদার হিসাবে পৃথিবীর দেশে দেশে সামরিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক, কুটনৈতিক আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে তারা আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার আফগানিস্তান ও ইরানী জনগণকে হত্যা করে এ দুটি দেশে দখল কায়েম করেছে। উত্তর কোরিয়া, ইরানকে পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমনরত ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ সাহায্য দিয়ে আসছে, মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি জনগণের রাষ্ট্র সিরিয়া, জর্দান, লিবিয়া, মিশর ইত্যাদির বিরুদ্ধে সরাসরি ও ইসরাইলের মাধ্যমে অব্যাবহত হুমকী ও চাপ দিয়ে আসছে। অনুরূপভাবে দক্ষিণপূর্ব্ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ লুণ্ঠন ও মুনা্ফার স্বার্থ নির্বিঘ্ন করার জন্য ও আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে বিশ্বব্যাপী সাম্রজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতকে সহযোগী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

আমরা দেখি এ অঞ্চলের ভারতীয় আধিপত্যবাদকে কেন্দ্র করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন সামরিক, আর্থনীতিক, কুটনৈতিক তৎপরতা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই তৎপরতার ধারাবাহিক অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ভারতে গ্যাস রফতানির চাপ দিয়ে আসছে। ভারতে গ্যাস রফতানি হলে ভারতীয় আধিপত্যবাদের স্বার্থ রক্ষা হবে সেই সাথে সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুজির ধারক ও বাহক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মুনাফার স্বার্থ রক্ষিত হবে। এই সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুজির মুনাফার রফতানির পক্ষে জনমত সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত গ্যাস বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন দলউপদল প্রভৃতিরা, এরা দেশের স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিছক ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, দলগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাম্রাজ্যবাদের একান্ত বশংবদ সহযোগীর ভূমিকার পালনে তৎপরতা চালিয়ে আসছে।তেল-গ্যাস বন্দর রক্ষার জাতীয় কমিটির বর্শাফলক এদের উদ্দেশ্যেই নিক্ষেপ করতে হবে। এদেরকে আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না করলে আন্দোলনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। বিশেষভাবে আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের জাতীয় সম্পদ রফতানির প্রধান সুবিধাভোগী হবে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি; ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও তাদের দালাল এদেশীয় শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও বক্তিবর্গ। এদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত না করে এদের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত না করে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ অর্থহীন। এদের বিরুদ্ধে জনগণের সচেতন সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে আজকের প্রধান লক্ষ্য।

তেল-গ্যাস সম্পদ ও বিদুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গ্যাস রক্ষার আন্দোলন ইতিমধ্যে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করেছে যে এই আন্দোলন হচ্ছে সুনির্দিষ্টভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বামপন্থিদের নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই। এ লড়াইয়ের প্রধান শত্রু হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং তাদের এদেশীয় তাবেদার শাসকগোষ্ঠী ও এই শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা এযাবৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে ও আধিপত্যবাদের সেবাদাস হিসেবে নিজেদেরকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। শাসকশ্রেণীর এই দলগুলো বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা দখলের ইস্যু হিসেবে গ্যাস রফতানির ইস্যুকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জনগণকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করেছে। “জান দেব তবু গ্যাস দিব না” এই মুখরোচক শ্লোগান দিয়ে গ্যাস রফতানির বিরুদ্ধে ভুয়া জেহাদ ঘোষণা করে জনগণের বন্ধু হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেছে। আবার ক্ষমতায় গিয়েই গ্যাস রফতানির পক্ষে তৎপর হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের এই তাবেদার শাসকগোষ্ঠীর কোনো দলই এবং তাদের সহযোগীরা কোনোমতেই গ্যাস সম্পদ রক্ষার আন্দোলনের শক্তি হতে পারে না। যারা এই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের তাবেদার শাসকশ্রেণীর যে কোনো রাজনৈতিক দলকে এই  আন্দোলনের সহযোগী ভাববেন বা তাদেরকে আন্দোলনে অংশগ্রহণের পক্ষে সমর্থন করবেন তারা এই শাসকশ্রেণীর ঐতিহাসিক চরিত্রকেই আড়াল করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। আমরা ইতিহাসের এই দায় গ্রহণ করতে রাজি নই বলেই এদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের বর্শা ফলককে উঁচিয়ে ধরতে চাই। এটাই হচ্ছে আমাদের জনগণের স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার। এদেরকে পরাস্ত করাই হচ্ছে ঐতিহাসিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের নামে এই দেশে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগকারী বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, সংস্থা, কোটিকোটি ডলার সাহায্য, অনুদান ও ঋণ হিসাবে প্রদান করছে। এর পরিমাণ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন। এর শতকরা ৮০ ভাগ দাতাদের পকেটেই নগদ ফিরে গেছে, বাকি তাদের স্থানীয় সহযোগীদের লুটপাট ও আত্মসাতের অংশ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কাঙ্কিক্ষত উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের কোনো অগ্রগতি নাই। বাংলাদেশের জনগণের নামে প্রদান করা এই বিপুল অর্থ বাংলাদেশের জনগণের কাঁধে ঋণভার চাপিয়েছে মাত্র।অথচ বাংলাদেশের জনগণ জানে না কী শর্তে, কী পরিমাণ এইসব বিদেশী অর্থ এই দেশের লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর দলগুলো গ্রহণ করেছে। জনগণের মতামত গ্রহণ ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতারও বিধান জনগণের সামনে নেই।

সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুজির ধারক-বাহ এই দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ইত্যাদি সম্পাদনের সময় জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেই সম্পাদন করার বিধি ব্যবস্থা আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে বিদ্যমান আছে। তাই আমরা দেখি এদেশের শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন লুটেরা দল বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়নের এবং খোলাবাজার অর্থনীতির আওতায় এদেশের শিল্প-কৃষিকে ধ্বংস করে বিদেশী পণ্যের বাজারে বিশেষ করে ভারতীয় পণের বাজারে পরিণত করেছে এমন সব চুক্তি সম্পাদন করার মধ্য দিয়েই। এই সমস্ত চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে অনুমোদনের কোনো বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশের সংবিধানে নাই। ফলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারগুলো সব সময়ই জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ এ গোষ্ঠী স্বার্থে বাংলাদেশের জনগণের নামে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও সংস্থাসমূহের সাথে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করার মধ্য দিয়েই দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করতে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে। উৎপাদন বন্টন চুক্তি, হানা, পিসকোর চুক্তিসহ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে গোপনে সম্পাদিত চুক্তিগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে। এইসব চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ায় কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিধিবিধান ও ব্যবস্থা সম্মিলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে এদেশের লুটেরা শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে সাম্রাজ্যবাদীদের তাবেদার হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ও এ সংবিধানের সাহায্যে বাংলাদেশের সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা গ্রহণের অগণতান্ত্রিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে শ্রমিক-কৃষকের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

গণসংহতি আন্দোলন

তেল-গ্যাস সম্পদ ও বিদুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ঢাকা-মংলা-খুলনা লংমার্চ গ্যাস সম্পদ রক্ষার আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অভিমুখে বিকশিত করার লক্ষ্যই হোক লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের অঙ্গীকার।