করোনা সংক্রমনের প্রথম ধাক্কায় যখন সারাদেশে লকডাউন চলছিলো তখন থেকে ২০২১ সালের এই আগস্ট মাসের যে লকডাউন পর্যন্ত চা বাগান গুলোকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে চা শ্রমিকরা প্রাকৃতিক পরিবেশে কাজ করেন তাই তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নাই, কিন্তু এসব যুক্তি কে ভুল প্রমান করে বিভিন্ন চা বাগানে করোনা সংক্রমন দেখা দিয়েছে, সংক্রমণের পর মৃত্যুর ঘটনা ও ঘটেছে, এবং উপসর্গ নিয়েও অনেকে মৃত্যু বরন করছেন।
উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বেশি ঘটছে কারণ অনকগুলো প্রথমত অসচেতনতা চা শ্রমিকরা অধিকাংশই জানেন না করোনার উপসর্গ কি কি, প্রচার মাধ্যমে যেসব প্রচারনা হয় তারা সেসব থেকে অনেক দুরে বাস করেন। বেশির ভাগের ঘরে টেলিভিশন বা কোন প্রচার মাধ্যম নেই। গত ১৬ মাসে সরকারি বা কোম্পানির পক্ষে কোন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহন করা হয়নি, তারা হিসাবের বাহিরে আছে।
চা বাগানে কোন টেস্টিং বুথ না থাকায় উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর হার বেশি, শহর এবং প্রত্যন্ত এলাকার একজন শ্রমিকের পক্ষে বিভাগীয় শহরে এসে করোনা টেস্ট করানো প্রায় অসম্ভব। এছাড়া রয়েছে আতঙ্ক, যদি টেস্টের রেজাল্ট পজেটিভ হয় তখন তাকে একঘরে করা হবে এবং তার পরিবারের চরম দূর্দশা নেমে আসবে, করোনা আক্রান্ত একজন শ্রমিক বা তার পরিবারের জন্য সরকার বা কোম্পানির তরফ থেকে কোন রকম পদক্ষেপ নেই যাতে একজন শ্রমিক আশ্বস্ত হতে পারে, শহরের কোন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে যখন সিট নেই, তখন চা বাগান থেকে আসা একজন মুমূর্ষ রোগী যার অর্থনৈতিক কোন সামর্থ্যই নেই সে কিভাবে চিকিৎসা সেবা আশা করতে পারে?
মহামারির ১৬ মাস সময়েও চা শ্রমিকদের জন্য কোন আইসোলেশন সেন্টার বা কোন ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়নি। এমন কি তাদের যে ডিসপেনসারি গুলো আছে সেগুলোর ও কোন রকম সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, সুতরাং এক চরম অপ্রস্তুত মহামারীর সম্মুখীন হতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম লাভজনক শিল্পখাতের সবচাইতে নীম্নমজুরী ভোগী শ্রমিক জনগোষ্ঠী।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় গত ১৬ মাসে কয়েকবার তাদেরকে ওয়ানটাইম মাস্ক দেয়া হয়েছিল। ১০০/১২০ টাকা মজুরি থেকে প্রতিদিন নতুন মাস্ক কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব না, সম্ভব হয় না ক্ষারযুক্ত সাবান কেনা। নিয়মিত হাত ধোয়ার জন্য, করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য যে স্বাস্থ্যবিধি তার কোনটাই মেনে চলা তাদের জন্য সম্ভব নয়।
চা বাগানগুলোকে যেহেতু উৎপাদনের ক্ষতির কথা চিন্তা করে লকডাউনের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে তাই ”ফ্রন্টলাইনার” বিবেচনায় তাদের টিকা পাওয়ার কথা অথচ এখনো এ সম্পর্ক কোন পদক্ষেপ নাই, গনটিকা শুরু হলে কতজন স্বেচ্ছায় টিকা নিবে তারও কোন নিশ্চয়তা নাই।
আশংকার কথা হচ্ছে অবিলম্বে যদি টেস্ট বুথ না করা হয় এবং উপসর্গ নিয়ে ঘুরতে থাকা আক্রান্তদের মাধ্যমে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন একবার ঘটে যায় তখন ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটবে কারন তারা খুব ঘনিষ্ঠ এক বাতাবরণ এ বসবাস করেন। তাই এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবেনা এবং তাদের জীবনমান এরকম যে শিশুদের মাঝে ৯৫ ভাগ অপুষ্টিতে ভুগছে বয়স্করাও একই রকম অপুষ্টির শিকার, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রানসংহারী এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে না।
চা একটি শ্রমঘন শিল্প শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা চা শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শ্রমিকরা নতুনদের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করেন, এসব দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শ্রমিক যাদের অনেকের বয়স ৪০ এর বেশি এবং তারা সবচেয়ে ঝুঁকি তে আছেন, তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা যদি করোনায় মৃত্যু বরণ করেন তখন এই শিল্পখাত হুমকির মুখে পড়বে।
শিল্প বাঁচাতে হলে, শ্রমিক বাঁচাতে হবে। তাই দেরি না করে চা শ্রমিকদের জন্য আলাদা টেস্ট বুথ চালু করার পাশাপাশি তাদের জন্য জরুরি ভাবে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা এবং আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হোক, এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করার জন্য কাপড়ের মাস্ক, জীবানুনাশক সরবরাহ করা হোক এবং তাদের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত করা হোক।
বাগান এলাকা গুলোতে সচেতনতামূলক প্রচারনা শুরু করা হোক। কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন করে চা উত্তোলন, রপ্তানি এবং বানিজ্য চলতে পারেনা এটা অমানবিক, তাই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তমিস্রা তিথি
চা শ্রমিক অধিকার কর্মী
সম্পর্কিত লেখা:
#উম