You are currently viewing জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে দেশীয় শিল্প সহায়ক নীতি চাই

জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে দেশীয় শিল্প সহায়ক নীতি চাই

[এবারের বাজেট বক্তৃতায় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘নছিমন ও লেগুনার মতো দুর্ঘটনাপ্রবণ যানবাহনের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে বিকল্প গণপরিবহন হিসেবে মাইক্রোবাস ব্যবহারে উৎসাহিত করতে চাই। সে জন্য মাইক্রোবাস আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করছি।’ শুধু মাইক্রোবাস নয়, দাম কমবে জ্বালানি সাশ্রয়ী ‘মপেড’ মোটরসাইকেলেরও। কারণ, মপেড মোটরসাইকেল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করতে মপেড আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সুত্রঃ প্রথম আলো ‘৩ জুন ২০২১

[সরকারের আমদানি ও বিদেশনির্ভর গণপরিবহন নীতির বিরুদ্ধে গণসংহতি আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিষদের অন্যতম সদস্য ফিরোজ আহমেদের পুরনো লেখা প্রাসংগিকতা বিবেচনায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো ]

সারা দেশে নসিমন-করিমনের-আলমসাধু-ভটভটির সংখ্যা কত? কোন কোন হিসেবে বলা হচ্ছে  ১৩ লাখ, কেউ বলছে ১৯ লাখ। কেউ বলছে ১০ লাখ। অগভীর নলকূপের সেচ দেয়ার জন্য আমদানি করা যন্ত্রটিকে সড়ক পরিবহনের কাজে ব্যবহার নাকি শুরু হয় বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের সড়ক পথে, আশির দশকে। সে হিসেবে তিরিশের কোঠায় এই সব বাহনের অভিজ্ঞতা। ওই দশকেই এই যন্ত্রে চালিত নৌকারও প্রচলণ শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলে। স্থানীয় কারিগররা অতি সাধারণ কারিগরি বিদ্যা দিয়েই এর নির্মাণ ও মেরামতি পুরোটাই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর অন্তর্দাহী যন্ত্রটা বিদেশে প্রস্তুত, বাকি দেহকাঠামো সবই স্থুল ও প্রাথমিক ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োগ।

পত্রিকা নিয়মিত এদের বলে বিপদজনক। কথা মিথ্যা না। অজস্র দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এরা। বেশ গতিমান এবং কাঠ ও লোহার দেহের কারণে ভরবেগও এদের মন্দ না। অন্যদিকে এদের গতিনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই খারাপ, আধুনিক বাহনের অন্যান্য নিরাপত্তা বন্দোবস্তও নেই বললেই চলে। দেশের বহু অঞ্চলে বাস-ট্রাক-লরি সহ সকল প্রকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা বেশ কয়েকবার ধর্মঘট করেছেন মহাসড়কে এদের চলাচলের বিরুদ্ধে। বহু স্থানে কঠোর পুলিশী বন্দোবস্ত করেও এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। কোন কোন স্থানে খানিকটা রোধ করা গিয়েছে।

গ্রামীণ পরিবহনের অন্য অংশটি পুরোপুরি আমদানিকৃত, তাদের প্রচলন এক দশকের খুব বেশি না। তবে দেশে গত দশ বছরে এখন কত লক্ষ ইজি বাইক, মোটর চালিত ভ্যান, মাহিন্দ্রা, বেবি ট্যাক্সি এসেছে, কতগুলো সচল আছে তার ইয়ত্তা আপাতত নাই। এগুলো আমদানি হয়ে আসছে প্রধানত ভারত ও চিন থেকে। কম গতির হালকা এই বাহনটি বিপুল সংখ্যাধিক্যের কল্যাণে মফস্বলে যানজটের জন্য অন্যতম দায়ী, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনের কথা নানান মহল থেকে নিয়মিত বলা হয়। সর্বদা অযৌক্তিকও নয় কথাগুলো। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসি। আপাতত এগুলো কেন টিকে থাকছে, সেই বিষয়টাতে নজর দেয়া যাক।

২.

মফস্বলের এই সব ক্ষুদ্র বাহনের একেকটি একেক ধরনের সামাজিক চাহিদা মেটায়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ‘সংরক্ষিত’ করে মালামাল বা যাত্রী পরিবহন উভয় প্রয়োজন মেটাতে পারেন। এর বাইরে অধিকাংশ সময়ে এগুলো গণপরিবহন হিসেবেই চলাচল করে। মাহিন্দ্র বেশ গাট্টাগোট্টা দ্রুতগামী, গাদাগাদি করে জনা দশেক চড়তে পারেন। এক ‘উপজেলা থেকে আরেক উপজেলা’ এমন ধরনের মাঝারি দূরত্ব মোটামুটি তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য একে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ইজি বাইক জাতীয় বাহনগুলো যেন মফস্বলের চলন্ত সিঁড়ি, স্বল্প দূরত্বে সামান্য ভাড়ায় মানুষজন ক্রমাগত ওঠানামা করছেন তাতে। স্থানীয় পুলিশ ও প্রভাবশালীরা এগুলো চলার সনদ দেয়, কখনো এত পরিমানে বেশি দেয় যে গাড়িগুলো নিজেদের যটে নিজেরাই আটকে পড়ে। ফলে কিছুদিন চলে প্রশাসনের কড়াকড়ি, মোড়ে মোড়ে হয়রানি। তারপর আবার পুরনো বন্দোবস্ত। মানুষের প্রতিক্রিয়াও সঙ্গতই: পয়লা দিনে যা থাকে যানজট থেকে মুক্তির স্বস্তি, কয়েকদিনেই তা মিলিয়ে গিয়ে শুরু হয় সস্তার দ্রুতযানটির জন্য আকুতি।

নসিমন-করিমন-আলম সাধু এরা অবশ্য ভারত-চিন থেকে আসা বাহনগুলোর তুলনায় একটু বড় সড়। এদের কোন কোনটি ছোটখাটি ট্রাক আকৃতির। কোন কোনটিতে বসার বন্দোবস্ত আছে, যাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত হয় বলে। কোন কোনটির আকৃতি মানুষ ও মানবেতর যে কোন প্রাণী ও মালামাল পরিবহনের উপযুক্ত। চাষা দুই বস্তা ধান বেচবে, আগেকার দিন হলে মাথায় নিয়ে যাও বড় রাস্তা পর্যন্ত, আরেক বস্তা চাপিয়ে দাও ভাড়া করা আর কারও মাথায়। এরপর বাসের চালক কিংবা সহকারির সাথে অসহায় দরদাম। তারপর বাসের ছাদে তুলে আবার ফের যায়গায় নিয়ে মাথায় তোল। এখন ভাঙাচোড়া কিংবা রাস্তাহীন রাস্তা ধরেও বাড়ির দোড়গোড়ায় ইটখোলা থেকে মাল নিয়ে চলে আসছে আসছে (সম্ভবত) ১২ অশ্বশক্তির যন্ত্রচালিত আলম সাধু। মাইক্রোবাস কিংবা টেম্পোতে ব্যবহারপোযোগী চাকার ওপর ভর দিয়ে এক টন পর্যন্ত বোঝা নিতে পারবে সে। অত বেশি মাল না হলে আছে রিকশা-ভ্যানের সাথে কম অশ্বশক্তির যন্ত্র ব্যবহার করা নসিমন। এই যে কন্যা শিশুরা ছেলেদের ডিঙিয়েও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে পৌঁছে যাচ্ছে, সেই বিপ্লবের ইতিহাস কোনদিন লেখা হলে নসিমন নামের বাহনটার নামও অত্যাবশ্যকভাবেই আসবে।

একটা অন্তর্জাল ঠিকানায় দেখলাম: “যশোর শহর থেকে বাঘারপাড়া জনপ্রতি বাসভাড়া ১২ টাকা। আর নসিমনে ভাড়া ৭/৮ টাকা।”  তারিখ বলা নেই, কবেকার হিসেব। তবে ভাড়ার এই পার্থক্যটা স্বাভাবিকই। ওজন কম বলে তেল খায় কম, স্থানীয়ভাবে তৈরি বলে বিনিয়োগও কম। ফলে গ্রামীণ জীবনে এই যন্ত্রগুলোর টিকে যাবার পেছনে যা কার্যকারণ, সেটা রীতিমত অর্থনৈতিক দস্তুর। অন্যদিকে, যে কোন জাতীয় সংবাদপত্র পড়লে এদের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ পাওয়া যাবে। গ্রামগঞ্জের সড়কপথ এরা তো দখলে নিয়েছেই, নিয়মিত হানা দিচ্ছে রাজপথে। এদের সাথে বড় বড় যানবাহনের সংঘাতে রক্তাক্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অতি সামান্য সহানুভূতি আপনি দেখবেন না এই বাহনগুলোর জন্য।

এবং সত্যিই তাই, সহানুভূতি দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনীতি চলে না। কোন-না-কোন ন্যায্যতা তৈরি তাকে করতে হয় সমাজের কোন-না-কোন অংশের মাঝে, যারা তাকে টিকিয়ে রাখবে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত থেকে রক্ষাও করবে। সেটা যে টুকু সে করতে পেরেছে গ্রামীণ ও মফস্বলের জীবনে, ততটুকুই তার বিকাশ হয়েছে। বিপরীতক্রমে যতটুকু সে পরের ব্যবসায় হাত দিয়েছে, ততটুকু বসিয়ে দেয়ার শক্তিটাও তাকে ঘিরে ক্রিয়াশীল। লদ্ধিবল নির্ধারণে নেতিবাচকভাবে যুক্ত হবে এই লোকজ বাহনগুলোর দুর্ঘটনাপ্রবণতা; কারণটা সকলেই জানেন: কারিগরি জ্ঞানের ঘাটতি, প্রশিক্ষণহীনতা, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা।

৩.

অন্য আরেকটি দিক দিয়ে আমরা এবার ভাবার চেষ্টা করি। প্রকৌশলবিদ্যার চিরকালের একটা লক্ষ্য হলো সমাজের যান্ত্রিক সঙ্কট মোচন। খুবই উঁচুমানের একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আছে যেটি রাষ্ট্রটির নামে নামাঙ্কিত। এছাড়া বহু জেলায় আছে জেলার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জাতীয় দৈনিকগুলোতে আমরা অজস্রবার দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি, কত রকমের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের সন্তানেরা প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হয়েছেন, অন্তত সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছেন। নতুন নতুন কৌশল ও ভাবনায় তারা সৃজনীশক্তির ব্যয় করছেন। এমনকি দেশীয় স্তরেই আয়োজন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে নানান প্রতিযোগিতা। পৃথিবী বিখ্যাত নানান সংস্থায় তারা কাজ করেন। এগুলো নিশ্চযই জরুরি। বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে বৈশ্বিক সমস্যার কথা আমরা কেন ভাববো না? সুদিন এলে এই অভিজ্ঞতা আমাদেরও কাজে লাগবে।

তবে, আমাদের চাষা যে আদিম বা প্রায় আদিম যে সকল যান্ত্রিক শক্তির সমস্যায় আজও ভুগছেন, সেটা নিয়ে আমাদের প্রকৌশলীরা বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন, গবেষণা করছেন, বা ভাবছেন এমন সংবাদ আমরা নিত্য দেখি না। অল্প কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। ড্রোন বানাবার উদ্যোগ নিয়ে এদেশে অনেক আলাপ আছে, কিন্তু ঢেঁকির সাথে যন্ত্র জুড়ে দিয়ে কোটি কোটি গ্রামীণ নারীর শ্রম লাঘবের চেষ্টার কথা ভাবতেও সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের কাঁদামাটি, আমাদের জলহাওয়ার উপযোগী সম্ভাব্য নানান প্রযুক্তি নিয়ে যুক্ততার চেষ্টা প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীদের দিক দিয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।  হয়তো এগুলো ততটা অর্থকরী নয়, এমনকি সমস্যা হিসেবেও তত জটিল কিছু না বলে মর্যাদার দিক দিয়েও বলবার মত কিছু নয়। আলম সাধু উৎপাদনে যন্ত্রপ্রকৌশলীর তেমন কিছু করার নেই, এটি নির্মাণ ও সারাইয়ে শুধু মিস্ত্রী-কারিগরই যথেষ্ট। ফলে দেশের পরিবহন নিয়ে, কিংবা মফস্বল ও গ্রামীণ মানুষের প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে এখানকার যন্ত্রকৌশলীদের যুক্ততা বলার মত কিছু না। সাধারণ কারিগররাই লাগসই কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন অথবা অনুকরণ করে আমদানির বাইরে যে চাহিদাটুকু বাকি থাকে, তা মেটাচ্ছেন।

এর জন্য ঢালাও ভাবে প্রকৌশলীদের দায়ী করাও বৃথা। জগত চলে প্রণোদনায়। এই প্রণোদনা যদি অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করতে পারে, তার ঢেউ রাজনীতিতেও আসে। রাজনীতিতে যদি এই আকাঙ্ক্ষা শক্তি তৈরি করতে পারে, সে অর্থনীতির রাস্তা বদলে দিতে পারে। এইভাবেই একটা জাতীয় চেতনা বিকশিত হয়, উদ্যোক্তা বলুন, প্রকৌশলী বলুন, পরিকল্পনাবিদ বলুন, সকলের মাঝে একটা যৌথ আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। রাজনীতি ও অর্থনীতি একটা আরেকটাকে এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চালিকা শক্তি হতে পারে, মানুষকে আদর্শিকভাবে কোন উদ্দেশ্য সাধনে সংযুক্ত করতে পারে বলেই বিষয়টা রাজনৈতিক-অর্থনীতি। গ্রামীণ এই পরিবহনের সমস্যার সমাধান হতে পারে তখনই, তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো যে, গ্রামীণ এই চাহিদা মেটাবার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হবার সুযোগ আমরা সৃষ্টি করবো। এর যান্ত্রিক উন্নয়ন, নতুন নক্শা এবং কারিগরি সকল দিক দিয়ে একটা জাতীয় উদ্যোগ গৃহীত হবে।

৪.

তো, ১০ না কি ১৩ কিংবা ১৮ লাখ অথবা যে কোন সংখ্যার নসিমন-করিমন-আলম সাধু চিরকাল টিকিয়ে রাখার পক্ষে আমার বলার কিছু নাই।  কিন্তু গ্রামীণ সড়কের বিপুল পরিমান এই অবৈধ বাহনের প্রতিস্থাপন কি মাহিন্দ্র অথবা ক্ষুদে আকৃতির পিকআপ এবং সমজাতীয় আমদানি করা বাহন দিয়ে হবে, নাকি এ নিয়ে জাতীয় ভিত্তিতে কোন নতুন পরিকল্পনা করা হবে, সেটা নিয়ে প্রতিটা নাগরিকের গুরুতর ভাবনার কারণ আছে। কারণ, এই খাতটা আমরা যা ভাবছি, তারচেয়ে অনেক বড়। এটা আরও বড় হতে যাচ্ছে। গ্রাম ও মফস্বলের মানুষের গড় যাতায়াত নগরবাসীর চেয়ে এখন বেশিই, এবং দেশের প্রায় ৭০ ভাগের বেশি মানুষ এসব অঞ্চলেই থাকেন।

আমরা যদি জানিই যে, গ্রামাঞ্চলে-মফস্বলে পরিবহনের এমন একটা বিপুল চাহিদা তৈরি হচ্ছে সেই ৮০ দশক থেকে, সেই চাহিদা আমরা দেশীয় ভাবে মানসম্পন্ন এবং নিরাপদ বাহন দিয়ে মেটাবার কতটুকু উদ্যোগ নিয়েছি? এই ধরনের ক্ষুদ্র বাহন নির্মাণ, যার এই বিপুল চাহিদা আছে, সুনিশ্চিত বাজার আছে, তাকে কি করে আমরা এতটা অবহেলা করতে পারলাম? এবং শুধু উপেক্ষা না, সেই বাজারের একটা বড় অংশ আমরা পূরণ করলাম ভারত ও চিন থেকে সস্তার নানা বাহন আমদানি করে। এবং শেষ পর্যন্ত, সেই বাজারের যে অংশটুকু দেশীয় উদ্যোগে পূরণ হয়েছে, তার বিরুদ্ধেই অহর্নিশ যুদ্ধ পরিচালনা করতে শেখালাম! ফলে, এই বিশাল বাজার থেকে প্রকৌশলী বলি, পুঁজিপতির বলি, শ্রমিকের বলি, প্রায় যা কিছু মূল্যসংযোজন হচ্ছে, তা ঘটেছে, এবং ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে, তা চিনে অথবা ভারতে। বাংলাদেশে নয়।

বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী কিংবা শিল্প ইত্যাদি যে সকল মন্ত্রীরা আছেন, বা ছিলেন, তাদের মুখে কি কখনো শুনেছেন গ্রাম, মফস্বল আর নগরপ্রান্তের পরিবহন চাহিদা বলে একটা বিষয় আছে? সেখানে যে পরিমাণ গাড়ি এখনই লাগে, ভবিষ্যতে আরও অনেকদিন লাগবে, সংখ্যার দিক দিয়ে তার পরিমাণ সবগুলো মেট্রোপলিটন শহরের মোট বাহনের চাইতে অনেক অনেক বেশি। ২০১৫ সালের বিআরটিএর হিসেবে দেশে অনুমোদিত গণপরিবহনের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৪ হাজার। দেখাই যাচ্ছে যে, বৈধতা-না-পাওয়া দেশীয় বাহনের সংখ্যাই অনুমোদিত বাহনের আনুমানিক সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি, সাথে ধরুন আমদানি করা বাহনগুলোর কথা।  সংখ্যার তাৎপর্যটি এই যে, এই প্রতিটি বাহনপিছু অন্তত এক বা একাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এগুলোর নির্মাণ ও সারাইয়ের সাথে জড়িত আরও বহু মানুষ। 

নিশ্চয়ই কাগজে দেখেছেন, দেশের এই মূহুর্তের অন্যতম প্রধান চিন্তা কর্মসংস্থান। গত দুই বছরে মাত্র ৬ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অথচ গ্রামীন ও মফস্বলের পরিবহনের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, এই বিপুল সুনিশ্চিত বাজার শুধু এই মূহুর্তেই বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে রাখেনি, আমদানি করা ইজি বাইক-মাহেন্দ্র-সিএনজি ইত্যাদির বিকল্প বাহনগুলি দেশে উৎপাদনের পরিকল্পনা ঠিকঠাক গ্রহণ করা হলে শুধু এই খাতেই কয়েক বিপুল কর্মসংস্থান হয়তো সৃষ্টি হতে পারবে। কিংবা বিপদের অন্য দিকটিও ভাবুন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আমদানি সুবিধা ও ছাড় দিয়ে ছো্‌ট ও মাঝারি যে বিপুল পরিমান বাহন ইতিমধ্যে আমদানি করা হয়েছে, দেশীয় বাহনগুলোর বিরুদ্ধে নানান রকম যুদ্ধ ও প্রচারণার মধ্য দিয়ে তাদের স্থান সংকোচন করে ভবিষ্যতে আরও যা আমদানি হবে, তার ফলাফল হবে দেশে আরও বিপুল কর্মসংস্থান হ্রাস।

গ্রামীণ চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথেই, অথবা আগেই আসলে এই উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। পরিবহন খাতের মত একটি গূরুত্বপূর্ণ খাতের— হোক তা হালকা ও মাঝারি বাহন নির্মাণ— বিকাশ আমাদের দেশে বিনিয়োগ সঙ্কট বেশ খানিকটা কাটতো, শ্রমিক থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলী পর্যন্ত বিপুল একটা দক্ষ জনশক্তিরও চাহিদা তৈরি হতো। আবার এই বিপুল জনশক্তিকে আইনী অনুমোদনের আওতায় আনা, তাদের প্রশিক্ষণ এবং কাগজপত্রের বন্দোবস্তও বহুতর কাজের জন্ম দিতে সক্ষম।

৫.

দেশীয় এই বাজারকে ঘিরে পরিকল্পনা নাই সেটা বা বলি কী করে! বরং উলটো পরিকল্পনাই নীরবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এইবারের বাজটেও দেখুন, হিউম্যান হলার নামের দুর্ঘটনাপ্রবণ বাহনটার কর কমিয়ে সেটা আমদানির সুবিধা করে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দেশে মোটর সাইকেল প্রস্তুত হলেও কমেছে সেটা্রও আমদানি কর। আমদানি করা ক্ষুদ্রকায় পিকআপে গ্রামের সড়কগুলো ভরে উঠছে।

খুব দেরি নেই যে নসিমন-করিমন-আলম সাধুরা গ্রামীণ পরিবহনের ইতিহাস থেকে অন্তর্হিত হবেন। এ্‌ই বাহনগুলো ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সময়েই আসেন। এই অপসারণ সর্বদা যন্ত্রের প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার কারণে না, শুধু দুর্ঘটনার কারণেও না। এর সাথে যুক্ত আছে আইন, পুলিশ, বড় বড় আমদানিকারক, পরিবহন মালিকের স্বার্থ। নসিমন- করিমন- আলম সাধুরা সেই তুলনায় দুর্বল স্থানীয় পুঁজির প্রতিনিধি। তবে শেষ পর্যন্ত যন্ত্রের প্রতিযোগিতাও একটা বিষয়, কেননা কারিগরি দক্ষতা আর বাংলাদেশের গ্রামের চাহিদা অনুযায়ী নিত্য নতুন বাহনের নক্শা নির্মাণ ও তাদের আগমন অপ্রশিক্ষিত কারিগরদের হঠিয়ে দেবে। কিন্তু এই রূপান্তর যদি দেশীয় শিল্প দিয়ে হয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের দিয়ে হয়, শুধু তা বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে না, শুধু তা দেশীয় পুঁজির অস্থিরতাকে খানিকটা হলেও কমাবে না, আজকের গ্রামের  পরিবহনের চাহিদা, আজকের মফস্বলের পরিবহনের চাহিদা শুধু মেটাবে না, জাতীয় আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।এই কাজটি করতে গিয়ে শিল্পসংগঠন সংক্রান্ত যে অজস্র নতুন সঙ্কটের মোকাবেলা ও তাকে অতিক্রম করতে হবে, ঠিক সেটাই বাংলাদেশের উপযুক্ত শিল্পসংস্কৃতির প্রবর্তনও ঘটাবে।    

একই আলাপ দেশে ক্রমবর্ধমান বাস-ট্রাকসহ নাগরিক পরিবহন নিয়েও হতে পারে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত ভারি শিল্প। বহুগুণ বেশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি সম্ভব তাতে। ভবিষ্যৎ চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে তাদের সুরক্ষা দিয়ে উৎপাদনের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। আপাতত হালকা পরিবহনেই ক্ষ্যান্ত দিলাম, অন্তত কিছু একটা দিয়ে শুরু হোক।

লেখক: Firoz Ahmed
কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন,
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।

Leave a Reply