[প্রবন্ধটি ৩১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে প্রকাশিত, প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় পুনরায় গণসংহতি আন্দোলনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল]
আশ্বিনে গা শিন শিন। বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রামবাংলায় যেসব প্রবাদবাক্য ব্যবহার করা হয় তারই একটি এই বচন। অর্থাৎ আশ্বিনে সামান্য ঠাণ্ডা পড়া শুরু হয় যাতে করে গায়ে সেই অনুভূতির সাড়া পড়ে। আমাদের ছোটবেলায় সেই অনুভূতি আমরা পেয়েছি। আর এখন যখন লেখাটি লিখছি তখন রীতিমতো ঘামছি এই আশ্বিনের শেষে এসেও। ষড় ঋতুর বাংলাদেশ বড়জোর তিন ঋতুর দেশে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে শীত, গরমের তীব্রতা, অসময়ের বৃষ্টিপাত। জলবায়ুর এ ধরনের রূপান্তর যখন দশকজুড়ে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তখনই তাকে সাধারণভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সংজ্ঞাভুক্ত করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব এইসব সংজ্ঞার আওতা ছাড়িয়েও অনেকদূর বিস্তৃত ও গভীর।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের জীবন যাপনের পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তন ঘটে শস্য চক্রের, আবির্ভাব ঘটে নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের। এই পরিবর্তনগুলো ইতিমধ্যেই নানাভাবে আমরা দেখছি। জলবায়ু পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবে ভূভাগবেষ্টিত অঞ্চলগুলোর প্রায় পুরোটাই মরুভূমিতে রূপান্তরিত হতে পারে। একটা বিরাট অংশ তলিয়ে যেতে পারে সমুদ্রের তলে। সুপেয় পানির অভাব হয়ে উঠতে পারে প্রকটতর, সৃষ্টি হতে পারে জলবায়ু উদ্বাস্তু, বাড়তে পারে সামাজিক রাজনৈতিক সংঘাত, শুরু হতে পারে দখল উপনিবেশীকীকরণের নতুন পর্ব, এমনকি ধ্বংস হতে পারে গোটা দুনিয়ার এতদিনের সভ্যতা। এ যেন র্র্হ ফিল্মের প্রতিটি কাল্পনিক সম্ভাবনার বাস্তব হুমকি হিসেবে সামনে আসা। আসলেই তাই, জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মোকাবেলা করতে না পারলে আমাদের জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। প্রতিটি আশঙ্কাই বাস্তব, এবং বর্তমান গতিতে উষ্ণায়ন, পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকলে ভয়াবহতম পরিণতিটা আর কোনো সম্ভাবনা নয়, হয়ে দাঁড়াবে বাস্তব ঘটনা। সেই পরিণতি হবে কি না তা অনেকটাই নির্ভর করে বর্তমানে আমরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছি তার ওপর। আর এই পদক্ষেপও নির্ভর করে বিষয়টা আমরা কীভাবে দেখছি, এর মোকাবেলায় আমরা কতদূর যেতে প্রস্তুত আছি এবং বিদ্যমান ক্ষমতা বিন্যাসের কী বদল ঘটছে সেগুলোর ওপর।
জলবায়ু পরিবর্তন কি প্রাকৃতিক না সামাজিক ঘটনা?
জলবায়ু পরিবর্তন কি মানুষের কাজ কর্মের ফলাফল না প্রকৃতির সাধারণ রূপান্তরের অংশ এই প্রশ্নে বহুদিন যাবৎ তর্ক চলেছে বিজ্ঞানীদের ভেতর। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল রাজনীতির পক্ষ থেকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনাটিকে প্রকৃতির সাধারণ পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা ছিল লক্ষ্যণীয়। সারা দুনিয়ার বহু পরিবেশ বিজ্ঞানী, আন্দোলনের কর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টার পর আইপিসিসি ২০০৭ সালে বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনকে মানবসৃষ্ট হিসেবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ জলবায়ুর যে পরিবর্তন বর্তমানে ঘটছে তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবর্তনের অংশ নয় বরং এক ধরনের বিকৃত পরিবর্তন। এই বিকৃতি একটা আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাজাত। মানুষে-মানুষে এবং মানুষে-প্রকৃতিতে যে সম্পর্ক জারি আছে দুনিয়াজুড়ে তারই অনিবার্য ফলাফল হলো এই পরিবর্তন।
জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে প্রতিনিয়তই। পরিবর্তনই প্রকৃতির নিয়ম-অপরিবর্তন নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের দিক ও গতি এমনভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে যাতে করে তা এক মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি করছে আমাদের। আগে যে পরিবর্তন হতে সময় লাগতো হাজার বছর এখন তা হচ্ছে হয়তো ১০ বছরে। আগে ১০০ বছরে যে পরিবর্তন হতো তার জন্য হয়তো এখন লাগছে ১ বছর। প্রকৃতির এই দ্রুত গতির পরিবর্তনের ফলে সমগ্র প্রাণজগতই হয়ে পড়ছে ধ্বংসোন্মুখ।
জলবাযুর এই ধারার পরিবর্তনের পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উপস্থিতি আজকাল কমবেশি সকলেই স্বীকার করছেন। ২০০৭ সালে আই পি সি সি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সেগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়-
- সন্দেহাতীতভাবেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে।
- বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার যে বৃদ্ধি ঘটছে তা মানুষের কার্যকলাপের ফলাফল এবং এর জন্য প্রধানত দায়ী গ্রীনহাউস গ্যাসের উদগীরণ বৃদ্ধি।
- বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি চলমান ঘটনা এবং শত শত বছর ধরে চলতেই থাকবে এমনকি গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ একটা মাত্রার ভেতরে রাখা গেলেও। তবে এর পরিমাণ কী হবে তা নির্ভর করে মানুষ পরবর্তীতে কী পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছে তার ওপর।
- একুশ শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.১ থেকে ৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে।
- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই সময়ে বাড়বে ১৮ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার।
- প্রচণ্ড গরম, দাবদাহ এবং প্রবল বৃষ্টিপাত চলতেই থাকবে।
- খরা, ক্রান্তীয় সাইক্লোন ও প্রচণ্ড জোয়ার দেখা দেবে।
- পৃথিবীর বায়ুম লে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড-এর পরিমাণ বেড়েছে ১৭৫০ সাল থেকে। শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তীকালে গ্যাসের পরিমাণ আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। আগের ৬৫০০০০ বছরে এই গ্যাসের পরিমাণ ছিল প্রায় স্থির।
আইপিসিসি’র এই ঘোষণার পর সাধারণভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অস্বীকারের রাজনীতি অনেকখানি পেছনে পড়ে গেছে। বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিজেই যেমন অনেক নতুন সমীকরণের জন্ম দিচ্ছে, তেমনি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়েও তৈরি হচ্ছে অনেক নতুন সমীকরণ। সেসব প্রশ্নের আলোচনায় যাবার আগে এটুকু অন্ততঃ বলা যায় যে, জলবায়ু পরিবর্তন একটা সামাজিক ঘটনা এবং এর পেছনে আছে পুঁজিবাদের জ্বীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক মুনাফাকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা। এই উৎপাদনসম্পর্ক যে যান্ত্রিকীকরণ, জ্বালানি ব্যবস্থা ও ভোগের আয়োজন সৃষ্টি করে তার সাথেই সম্পর্কিত অধিকমাত্রায় গ্রীনহাউস গ্যাসের উদগীরণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
গ্রীন হাউস গ্যাস কীভাবে পৃথিবীকে উষ্ণ করছে?
গ্রীনহাউস শব্দটি এসেছে শীতের দেশে ফসল উৎপাদনের জন্য যে কাঁচের ঘর ব্যবহৃত হয় তা থেকে। ফসলের অঙ্কুরোদগম, বৃদ্ধি ও ফল আসার জন্য যে তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় তা প্রায়ই শীতপ্রধান দেশে পাওয়া যায় না। বিশেষত দিনের দৈর্ঘ্য সেখানে অত্যন্ত কম হবার কারণে এই ঘটনা ঘটে। সে কারণে তাপ ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয় যাতে করে উদ্ভিদের জীবনচক্র সম্পন্ন হতে পারে। তাপ ধরে রেখে সবুজ উৎপাদনের এই রীতিকেই গ্রীনহাউস হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই গ্রীনহাউসের মতোই তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা আছে কিছু গ্যাসের। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরফ্লোর কার্বন ইত্যাদি গ্যাস তাপ ধারণে সক্ষম। গোটা দুনিয়াটাই সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়, উত্তপ্ত হয় প্রতিদিন। এই উত্তাপ আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ হয়। কিন্তু এই বিকীর্ণ রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় তার ভেদ্যতা অনেক কম। ফলে তার বেশিরভাগটাই বায়ুমণ্ডলের চাদর ভেদ করতে পারে না। গ্রীনহাউস গ্যাসগুলো এই তরঙ্গকে আটকে দিয়ে দুনিয়া গরম রাখে। যা পৃথিবীর প্রাণের জন্যও প্রয়োজনীয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তখনই যখন এই গ্যাস পরিমাণে বেড়ে যায় এবং পৃথিবী প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় উষ্ণতার চাইতে উষ্ণতর হতে থাকে। প্রাণদায়ী উষ্ণতা তখন প্রাণসংহারী রূপে আবির্ভূত হয়। দুনিয়াতে এই গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে বনভ’মি ধ্বংস আর জীবাশ্ম জ্বালানির অধিক ব্যবহারের কারণে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পোৎপাদন ও কৃষির উৎপাদনে, যোগাযোগে, ভোগে এমনকি পুঁজির ফাটকাবাজারীও আখেরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ায় ও পৃথিবীকে উষ্ণ করে তোলে।
জীবাশ্ম জ্বালানি : পুঁজির প্রাণভোমরা, প্রাণের হন্তারক:
আজ আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যখন পুরোনো কালের সূর্য ওটার আগেই ঘুম থেকে ওঠা আর সন্ধ্যা নেমে এলেই ঘুমাতে যাওয়া প্রায় রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। অথচ মানবজাতি তার ইতিহাসের অধিকাংশই পার করেছে এভাবে। শিকার কিংবা আহরণের স্তরে তো বটেই কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের কালেও। সেই তুলনায় শিল্পভিত্তিক যুগ অনেকটাই নবীন। কিন্তু এই শিল্পভিত্তিক স্তর মূলত যা জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর তা অনেক বেশি নাটকীয়। এর সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে পুঁজির। পুঁজি এমন এক অস্তিত্ব নিজের সংবর্ধনই যার শর্ত। নিজের স্ফীতি ছাড়া পুঁজি, পুঁজি হিসেবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। পুঁজিকে প্রতিনিয়ত উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে হয় এবং সেই উদ্বৃত্তকে পুনরায় বিনিয়োগ করতে হয়, যা আবার শেষ পর্যন্ত আরও উদ্বৃত্ত নিয়ে আসবে। এরপর আরও বিনিয়োগ, আরও উদ্বৃত্ত, আবার বিনিয়োগ আবার উদ্বৃত এভাবে চক্রাকার প্রক্রিয়া চলতে থাকে যাতে করে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও তার বৃদ্ধি দাঁড়ায় একটা বাধ্যবাধকতায়। এই বাধ্যবাধকতা তার ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে তা একদিকে শ্রমের কার্যকারিতাকে বৃদ্ধির প্রয়োজন সৃষ্টি করে যাতে করে আপেক্ষিকভাবে কমমূল্যে অধিক শ্রম ব্যবহার করা যায়। ফলে শ্রম সময়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ও তার ঘনীভবন অতিশয় প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে তাগিদ সৃষ্টি করে উৎপাদন এলাকাকে, বাজারকে ছড়িয়ে দেবার। স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রাকৃতিক শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সৌরশক্তির বদলে কম রূপান্তর ব্যয় ও কম পরিমাণ ব্যবহারে অধিক শক্তি পাবার উৎস হিসেবে সামনে আসে জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানির আবির্ভাবের ফলে,
- প্রথমত, শক্তির উৎসের সাথে উৎপাদন এলাকার সরাসরি সম্পর্ক গেল ঘুঁচে। ফলে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্ক ছাড়াই উৎপাদনকে বিশেষ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব হলো। গড়ে উঠলো নতুন নতুন শহর, এমনকি দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার যে প্রয়োজন পুঁজির রয়েছে তা-ও সম্ভব হলো।
- দ্বিতীয়ত, জীবাশ্ম জ্বালানি যেহেতু ধরে রেখে যেকোনো সময় ব্যবহার করা যায়, ফলে দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম ইত্যাদি প্রাকৃতিক বাধা থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হলো। ফলে শ্রম সময় ও পরিসর উভয়কে ঘনীভূত করে শ্রম শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবার সুযোগ হলো অবারিত।
- তৃতীয়ত, জীবাশ্ম জ্বালানিকে সহজেই অন্য রূপে রূপান্তরের সুযোগ থাকায় বিশেষত গ্যাসোলিন বা বিদ্যুতে রূপান্তরিত করতে পারার কারণে জ্বালানির পরিমাণ সম্পর্কে রক্ষণশীল হিসাবনিকাশের আর কোনো প্রয়োজন রইলো না। নগরকে সারারাত আলোকজ্জ্বল করে রাখা, পেট্রোল ডিজেল চালিত গাড়ির ক্রমাগত বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্রমাগত গতি সঞ্চার, আর সমাজ জীবনে অদৃষ্টপূর্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে উৎপাদন ও ভোগের যে অলংঘনীয় চক্র তৈরি হলো, তা সম্ভব হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণেই।
আর এই পুরো প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই এর শিকারে পরিণত হলো প্রাণ-প্রকৃতি। উৎপাদন এলাকা ও শক্তির উৎসের বিচ্ছিন্নতা যে নগরায়ন সম্ভব করে তুললো তার ফলে নগর ও গ্রামের ভেতর তৈরি হলো অনতিক্রম্য ব্যবধান। নগরকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়লো গ্রামের ওপর। এর ফলে গ্রামের কৃষিকাজের ফলে মাটির যে পুষ্টি শহরে আসে তা আর কখনোই মাটিতে ফিরে যায় না। ফলে মাটি ধীরে ধীরে উর্বরতা হারায়। এর সাথে বর্তমানে কৃষির যে রূপান্তর হয়েছে তাকে যোগ করলে দেখা যাবে তা শুধু মাটির উর্বরতাই ধ্বংস করছে না, দূষিত করছে, নিঃশেষ করছে সুপেয় পানি, অসম্ভব করে তুলছে জলজ প্রাণের বেঁচে থাকা। কৃষিতে বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণ।
শিল্পোৎপাদনের প্রত্যেকটি স্তরেই ব্যবহৃত হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি এবং পুঁজির আত্মস্ফীতির প্রয়োজনে বা মুনাফার অপরিহার্যতার প্রয়োজনে এর ফলে যে দূষণ হয় যতদূর সম্ভব তার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেবারই চেষ্টা করে পুঁজিপতিরা। যা গোটা দুনিয়াকেই ভয়াবহ দূষণের মুখোমুখি করছে।
অন্যদিকে পুঁজিবাদ যে জীবনযাপন পদ্ধতিকে বিশ্বায়িত করছে তা দাঁড়িয়ে আছে উচ্চমাত্রার গতিশীলতার ওপর। যে গতিশীলতা বজায় রাখতে প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে টনকে টন জ্বালানি। ক্রমাগত প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা পরিবেশ দিয়ে।
পুঁজির পরিবর্ধন যেমন প্রায় পুরোটাই নির্ভরশীল জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর, বিপরীতে প্রাণের অস্তিত্বের প্রায় পুরোটাই নির্ভরশীল সৌরশক্তির ওপর। চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসাই যেমন পুঁজির প্রক্রিয়া, প্রকৃতির তেমনটি নয়। বস্তু ও শক্তির প্রাকৃতিক রূপান্তর এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর মতো জীবন্ত জিনিসের প্রাকৃতিক বিকাশের প্রক্রিয়া মোটেই পুনরাবৃত্তিমূলক নয়। যেসব বস্তু ও শক্তিকে সে ব্যবহার করে সেগুলো ক্ষয় পেতে থাকে ও গুণগতভাবে নতুন কিছুর জন্ম দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা জীবাশ্ম জ্বালানির সীমিত মজুদের ওপরই নির্ভরশীল। প্রথমত, তা ফুরিয়ে যাবে, দ্বিতীয়ত, তার ব্যবহার এত বিপুল পরিমাণে ক্ষতিকর নিঃসরণ ঘটাচ্ছে যাতে করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পরিস্থিতি দিনে দিনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়া, ওজনস্তর ক্ষয়, প্রাণবৈচিত্র্যের ধ্বংস, মরুকরণ, বনের উজাড় হওয়া, সুপেয় পানির মহার্ঘ হয়ে ওঠার মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে আমাদের।
জ্বালানি সাম্রাজ্যবাদ প্রকৃতির ওপরও সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ:
বিশ্ব বাজারে জ্বালানির চাহিদা ও দাম যেমন বেড়েই চলেছে তেমনি কমে আসছে এর মজুদ। বিশ্বের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর অধিকাংশই তার উৎপাদনের চূড়া ছুঁয়ে ফেলেছে এবং এখন মজুদ যেমন কমে আসছে তেমনি তা আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও হয়ে উঠছে ব্যয়বহুল। আর জ্বালানির পরিমাণ যতই কমে আসছে তার ওপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইও হচ্ছে তীব্র। দুনিয়ার জ্বালানি সম্পদের প্রায় পুরোটাই এখন বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। তারা শুধু জ্বালানি সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণই প্রতিষ্ঠা করে না, অনেকাংশেই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী বিষয়েও তাদের হাত প্রসারিত করে। ঠিক করে দেয় কারা ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না। প্রান্তের নানা দেশে তো বটেই এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা ও দুনিয়ার জ্বালানি সম্পদের ওপর আধিপত্য তথা সার্বিক আর্থ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার, যা তেল কোম্পানিগুলো দ্বারা সমর্থিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণের অর্থ- ১. জ্বালানি ক্ষেত্রগুলোর ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ ২. সরবরাহ কাঠামোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ৩. চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে দাম নিয়ন্ত্রণ ও ৪. কোন মুদ্রায় তার কেনাবেচা হবে তা নিয়ন্ত্রণ। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা যেমন চুক্তি করে বন্ধুত্বমূলক উপায়ে করা হয় তেমনি অন্তর্ঘাত, ষড়যন্ত্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ কোনো কিছুই এতে বাদ যায় না। কেননা বাজারের অদৃশ্য হাত মার্কিন সেনাবাহিনীর শক্ত থাপ্পড়ের মাধ্যমেই পূর্ণতা পায়।
আদতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দুনিয়ার উৎপাদন ও ভোগের সমগ্র আয়োজনের ওপরই প্রতিষ্ঠা করা হয় আধিপত্য। আর তা করা হয় একটা অসম প্রক্রিয়ায় যাতে করে সমস্ত দুনিয়ার সম্পদ ভোগ করে কেন্দ্র রাষ্ট্রগুলোর কিছুসংখ্যক লোক। ঐতিহাসিকভাবেই কেন্দ্র রাষ্ট্রগুলোর প্রতিবেশগত পদচিহ্ন বেড়ে চলে কারণ তারা শুধু নিজেদের সম্পদই ভোগ করে না, নিঃশেষ করে অন্যদের সম্পদও। সামরিক বল প্রয়োগ, ঋণের ফাঁদ হয়ে আজকের যুগের লুণ্ঠনমূলক বিদেশী বিনিয়োগ পর্যন্ত তা প্রসারিত। এর মাধ্যমে প্রান্তের রাষ্ট্রগুলোর সম্পদ কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হয় আর বাড়ায় বৈষম্য। পুঁজিবাদী দুনিয়ার কেন্দ্রের বাসিন্দারা যারা দুনিয়ার জনসংখ্যার ২৫% তাদের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে দুনিয়ার ৭৫% সম্পদ ব্যবহৃত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দুনিয়ার ওপর এমন সামাজিক-প্রকৃতিগত বিধান চাপিয়ে দেয় যার ফলে গ্রাম-শহরের, কেন্দ্র-প্রান্তের বৈষম্য তৈরি হয়। কৃষি ব্যবস্থার এমন রূপান্তর ঘটানো হয় যাতে তা একচেটিয়া পুঁজির সংবর্ধনের হাতিয়ার হয়। পুঁজিবাদী কেন্দ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থে সারা দুনিয়ার মানুষের সাধারণ সম্পদ যেমন বায়ুমণ্ডল, সাগর, বায়ুমণ্ডলের কার্বন শোষণক্ষমতা ইত্যাদিকে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্লোবাল নর্থ অধিক তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে সৃষ্ট পরিবেশগত আবর্জনা, যা আজকে চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠেছে, তাকে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দিয়েই ধনী ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর অর্থনীতি পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি বর্জ্য নিঃসরণ করছে। এই নিঃসরণের পরিমাণে এখন পর্যন্ত বৈষম্য প্রকট। ১৯৯৬ সালে ৭ বিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়েছে দুনিয়ায়, যার ৫০ ভাগেরও বেশি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। ২০০৬ সালে উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ করেছে ২২৮,৮০০ মিলিয়ন টন আর উন্নয়নশীল দেশগুলো (ভারত ও চীন বাদে) সকলে মিলে করেছে ৩৬,৭৫০ মিলিয়ন টন। কিন্তু অনেক কম কার্বন নির্গমন করেও এর ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে বেশি বেশি করে, প্রান্তের রাষ্ট্রগুলোরই। খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো আছেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সম্পূর্ণ তলিয়েও যেতে পারে বাংলাদেশের মতো দেশ ।
সামনে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ-মৃত্যু, ধ্বংস আর সংঘাত:
আইপিসি’র ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে থাকে বর্তমান গতিতে তাহলে কী হবে? আইপিসির ভাষ্য অনুযায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখা যায় তাতে প্রকৃতির যে পরিবর্তন ঘটবে তাকে উল্টে দেয়া সম্ভব, তার উপরে গেলে নয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তা বেড়ে যেতে পারে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রার যেকোনো বৃদ্ধির ফলে হতে পারে মেরু অঞ্চলে বরফের তলায় চাপা পড়ে থাকা মিথেনের বিস্ফোরণ। বরফ গলে এই মিথেন বের হয়ে আসলে তা অতি দ্রুত তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। কেননা মিথেনের উষ্ণায়ন ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের চাইতে অনেক বেশি। ফলে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধি অতি দ্রুতই ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস/৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। ভূ-ভাগবেষ্টিত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এর ফলাফল হবে দ্রুত মরুভূমির বিস্তার। এই মরুকরণ কোনো দেশের সীমানা মেনে তার বিস্তার ঘটাবে না। কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় শক্তির পুরোটাই সীমাহীন এক বালির সমুদ্রে হারিয়ে যেতে দেখবে। মঙ্গোলিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল মরুভূমি ইতিমধ্যেই উত্তর এশিয়া ও চীনের জন্য বড় হুমকি। সাহারা মরুভূমির বিস্তার ইতিমধ্যেই বহু স্থানীয় রাজ্যকে গিলে খেয়েছে। দারফুর ট্রাজেডি শুরু হয়ে গেছে। এই মরুকরণ শুধু এসব দেশেই থেমে থাবে না, আরও বিস্তার ঘটাতেই থাকবে। এই দেশগুলোর তাপমাত্রা এমন দাঁড়াবে যা কোনো ধরনের কৃষিকাজ বা খাদ্য উৎপাদনের উপযুক্ত নয়। আর ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফগলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এমন বেড়ে যাবে যে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, গ্রীস, পর্তুগাল, ইতালির মতো সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবে চিরতরে। উত্তরের রাজ্যগুলো ছাড়া বাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরস্থিতিতেও হবে একইরকম। এরকম পরিস্থিতিতে কী ঘটবে? অনুমান করা যায়, প্রথম পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি হবে। যারা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেবে। সেখানে বাড়বে অস্থিরতা, হানাহানি। শুধু এটুকুতেই হয়তো বিষয়টা থেমে থাকবে না, চীন হয়তো তার আশেপাশের দেশ দখল করে নেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দখল করবে কানাডা। হাত বাড়াবে রাশিয়ার দিকে। অন্যরাও শুধু বসে বসে দেখবে না নিশ্চয়ই, টিকে থাকার শেষ চেষ্টাটা করে দেখবে। হয়তো বেধে যেতে পারে একটা পারমাণবিক যুদ্ধও। তারপর মানবজাতির কত অংশ টিকে থাকবে, উষ্ণায়ন অব্যাহত থেকে সমগ্র দুনিয়াটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে কিনা সেসব অনুমানে আমরা যেতে চাই না। আমরা চাই পৃথিবীটাকে বাঁচাতে। কিন্তু কীভাবে?
পৃথিবীটাকে বাঁচাতে হবে; সেটা কি সম্ভব?
যে ভয়াবহ বির্যয়ের মুখোমুখি পৃথিবী দাঁড়িয়ে তার হাত থেকে রক্ষা পেতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা কি নেয়া হচ্ছে যথার্থভাবে? ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবেলায় আমরা কি প্রস্তুত? সত্য বটে এখন এ বিষয়ে একটা তোড়জোড় আছে। কিন্তু তোড়জোর, তর্জন-গর্জন যতটুকু আছে বাস্তব কাজ ততটুকু নাই। উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে অঙ্গীকার করেছে তার সামান্যই পূরণ করছে। আইপিসিসির অনুসন্ধান অনুযায়ী কার্বন নির্গমন ৬০ ভাগ কমিয়ে আনা গেলে তা দুনিয়াকে রক্ষা করতে পারবে। তারপরও উন্নত দুনিয়াকে তাদের নিগর্মন ২৫-৪০% কমানোর কথা বলা হলেও তারা তা কমাতে রাজি হয়নি। রাজি হয়েছে ১০-২৪% কমাতে। আর যাতে রাজি হয়েছে তা-ও পালন করছে না, এমনকি দূষণ রোধে জোর হাঁকডাক দেয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নও তার অঙ্গীকার রক্ষা করছে না। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা তো বলাই বাহুল্য। সর্বাধিক দূষণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সেদিন পর্যন্তও দূষণরোধের অঙ্গীকার কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষরই করেনি। কার্বন কমানোর বদলে নতুন কার্বন বাণিজ্য গড়ে উঠছে। যার মোদ্দা কথা যার টাকা আছে সেই কেবল পরিবেশ ধ্বংস করার লাইসেন্সধারী। নিজেদের উৎপাদন ও ভোগের আয়োজনকে নিরাপদ রেখে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো এখন দোষ চাপাতে চাইছে অনুন্নত দুনিয়ার কৃষি ও নতুন করে সেসব দেশের শিল্পায়ন ঘটছে তাদের ওপর। জ্বালানি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা, সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে যার সূচনা হয়েছিল তা আসলে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর দুনিয়ার কৃষি ব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া প্রতিষ্ঠারই পরিণতি এই সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে। মূলত: তাই তাদের প্রয়োজনেই কৃষি ব্যবস্থা পরিবেশ বিধ্বংসী হয়ে উঠছে। অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের যে শিল্পজাত দূষণের কথা বলা হচ্ছে তা-ও আসলে অধিক দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পের তৃতীয় বিশ্বে স্থানান্তরেরই ফলাফল। পরিবেশ বিষয়ক নীতির দুর্বলতার সুযোগে বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বে দূষণ রপ্তানি করা হয়েছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দূষণ পুরোটা তৃতীয় বিশ্বের নয়। তৃতীয় বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের প্রধান অংশ আসলে উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়ার কার্বণ নিঃসরণের স্থানিক প্রসারণ মাত্র।
এই সমস্ত সত্য ভুলিয়ে দিতে মুলা ঝুলানো হয়েছে অভিযোজন তহবিলের। তৃতীয় বিশ্বের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া শাসকরা সেই তহবিলেই ভুলছেন। এই তহবিল গঠন করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন বা খাপ খাইয়ে নেবার জন্য। সেই অর্থ ব্যয় হচ্ছে অভিযোজন কৌশল শেখানোর জন্য। বিদেশ থেকে এক্সপার্ট, কনসালটেন্টরা আসছেন প্রাকৃতিক বৈরীতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষদের অভিযোজন কৌশল শেখানোর জন্য। এনজিওগুলোর সেমিনার হচ্ছে, কর্মশালা হচ্ছে এবং অভিযোজনের অর্থ সেগুলোতে ব্যয় হচ্ছে। অভিযোজনের কৌশল হিসেবে যেসব সমাধান দেয়া হচ্ছে যেমন খরা, বন্যা সহনশীল বীজ, লবণাক্ততা সহনশীল বীজ ইত্যাদির মাধ্যমে জিনগতভাবে রূপান্তরিত বীজ ঢুকে পড়ছে। আর ব্যবসা চাঙ্গা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনগুলোর। নাওমি ক্লাইন তার শক ডকট্রিন গ্রন্থে দেখিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে দুর্যোগ ও পরিবেশ বিপর্যয়কেও নতুন করে তার আধিপত্য বিস্তারের কাজে লাগায়। বাংলাদেশে তার নানা নজির আমরা দেখছি এবং সামনে এই দেখাদেখিটা আরও বাড়বে সেটা বলা যায় নিঃসন্দেহেই। অভিযোজনের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্বারোপের সবচেয়ে বড় গেরোটা এইখানে যে এতে মনে করা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ঘটতেই থাকবে এবং তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়াটাই আমাদের কাজ। এতে করে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র রাষ্ট্রগুলোর সহজ দায়মুক্তি ঘটে এবং প্রকৃতির বিপর্যস্ততা থাকে অব্যাহত।
আশার কথা সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর এসব ভাঁওতা ও জারিজুরি এখন দুনিয়ার অনেক মানুষই ধরে ফেলেছেন। দাবি উঠেছে কার্বন নিঃসরণ বিষয়ে প্রতিবেশগত ন্যায্যতার। নারায়ণ ও আগরওয়াল (১৯৯১) পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য সমান কার্বন পোড়ানোর অধিকারের দাবি তুলে দেখিয়েছেন ধনী বিশ্বের প্রতিবেশগত ঋণ গরিব বিশ্বের আর্থিক ঋণের অন্তত ৩ গুণ। কাজেই দরিদ্র বিশ্বের সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেয়া হবে প্রথম পদক্ষেপ, যাতে করে সে স্বাধীনভাবে নিজের উন্নয়ন ও জ্বালানি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোও যদি ধনী দেশগুলোর মতো একই কায়দায় উন্নয়ন করতে চায় তাহলে দুনিয়াকে বাঁচানো যাবে না। সে কারণে তারা প্রস্তাব করেছেন, ধনী দেশগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণ আইপিসিসির প্রস্তাব অনুযায়ী কমিয়ে আনবে এবং দরিদ্র বিশ্ব তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তা ধীরে ধীরে বাড়ানোর সুযোগ পাবে। দুনিয়ার সমস্ত দেশ একটি সমান, মাথাপিছু কম মাত্রার নিঃসরণের সুযোগের অধিকারী হবে। এবাবে সারা দুনিয়ার প্রকৃতিকে রক্ষা করার, তাকে নবায়ন করার সংগ্রাম বৈশ্বিকভাবে চালু হতে পারে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে সারা দুনিয়ার পুঁজিবাদী রূপান্তরের চেনা পথ শিল্পায়নের মাধ্যমে যে বিশ্বব্যবস্থায় রূপ নিতে পারে না তা আজ পরিবেশগত বিবেচনায়ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সারা দুনিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক শিল্পায়নের ভার বহন করতে এই পৃথিবী অক্ষম। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্ষমতা বিন্যাসও একটা সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নের উপযোগী নয়। বরং অসমতাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ভিত্তি। এই ভিত্তিমূলে আঘাত না হেনে তাই পরিবেশগত বিপর্যয় বা জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা সম্ভব নয়।
সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার একটা বড় শক্তির জায়গা হলো খোদ ব্যবস্থাটির অপরিবর্তনীয়তায় লোককে বিশ্বাস স্থাপন করানো। সিনেমা, সিরিয়ালসহ নানা মাধ্যমে যেভাবে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার নানা কাল্পনিক কাহিনী আকছার দেখানো হয় তাতে বাচ্চা ছেলে-মেয়েরাও এখন দুনিয়া ধ্বংসের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদলকে তারও চাইতে মনে করা হয় অসম্ভব। কিন্তু তা সত্ত্বেও জলবায়ু সম্মেলনেও ধ্বনি উঠেছে Change the system, Not the climate. We need social changes to fight climate change. প্রশ্ন হল, কী সেই সামাজিক পরিবর্তন? কীভাবেই বা তা ঘটবে?
এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মানুষ আর প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন। মানুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর। উৎপাদন ও ভোগের বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল। পশ্চিমা জীবনধারার যে বিশ্বায়ন ঘটেছে তার খপ্পর থেকে বের হয়ে আসা। জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানির নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্ভাবন। নতুন করে পৃথিবীটাকে সাজানোর এক বিপুল আয়োজন। সেজন্য প্রথম প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থারই উচ্ছেদ। সারা দুনিয়ায় যেমন তেমনি বাংলাদেশেও সেই লড়াই নতুন করে দানা বাঁধছে। ফুলবাড়ীতে বহুজাতিক কোম্পানির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে কয়লা খনি করার বিরুদ্ধে লড়াকু কৃষক যখন বলেন- “এই লড়াই শুধু আমাদের লড়াই নয়। আল্লার আঠার হাজার মখলুকাতের জীবন রক্ষার লড়াই।” তখন সেই ডাকই তিনি দিয়ে যান। আর স্বপ্ন বুনে যান মানুষ প্রকৃতির সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনার। আমরা কি সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি?
আবুল হাসান রুবেল
ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সমন্বয়কারী
গণসংহতি আন্দোলন
#জ/উম-৬/৩