একটা সময় ছিল যখন কাঁটা ফোটা বা হাতে সামান্য কেটে যাওয়ার কারণে মানুষ মারা যেত। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও মানুষের হাত কেটে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ হতো এবং সেই ব্যাকটেরিয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে জীবাণুদূষণে মানুষের মৃত্যু হতো! এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর জীবাণুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যা বহুগুণে কমে এসেছে। ব্যাকটেরিয়া আগে মহামারি ঘটাতে পারত, এখন কয়েকদিনের এন্টিবায়োটিক কোর্সেই মানুষের সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটে। এন্টিবায়োটিক মানুষের দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করেছে।
১৯২৮ সালে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং’র পেনিসিলিন উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিকের যাত্রা। পরবর্তীতে কিভাবে ঔষধকোম্পানির মুনাফা মুখী মুক্তবাজার অর্থনীতি এন্টিবায়োটিককে তার সিংহাসন থেকে নামিয়ে বর্তমানের অন্যতম জনস্বাস্থ্যগত সমস্যায় পরিণত হলো সেই বিষয়ের বর্ণনা আছে ১ম পর্বে।
এই পর্বে এন্টিবায়োটিক গবেষণা হ্রাসের প্রভাব ও এন্টিবায়োটিক গবেষণা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেয়া পদক্ষেপ ও উদ্দেশ্য জানা বোঝার চেষ্টার অংশ হিসেবে আলোচনা করা হবে।
এন্টিবায়োটিক গবেষণা কমে যাওয়ার প্রভাব:
ব্যাকটেরিয়া জনিত রোগের জন্য এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এন্টিবায়োটিক গবেষণা হ্রাসের কারণে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি হয় না। ফলে অধিক ব্যাকটেরিয়ার ঔষধ প্রতিরোধী (multidrug-resistant) ‘সুপারবাগ’ হওয়ার সুযোগ পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৩৬,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটায়।(১) এই মৃত্যুর জন্য অতিরিক্ত এন্টেবায়োটিক ব্যবহারকেও দায়ী করা যায়।
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ফার্মাসিগুলোতে কমদামে এন্টিবায়োটিকের প্রাপ্যতা থাকার ফলে জনসাধারণ সহজেই এন্টিবায়োটিক কিনতে পারে। ফলে এ ধরনের সুপারবাগ সৃষ্টি হতে থাকে। বর্তমানে ভারত এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতার সবথেকে ঝুঁকিতে আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার নবজাতক এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ কারণে ভারতে প্রতি বছরে ৫৮,০০০ নবজাতকের মৃত্যু হয়।বাংলাদেশেও এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করছে।
সংকট নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ:
- ১৯৯৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) প্রথমবারের মতো এন্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধীতা আলোচনায় আনে। ২০০১ এ ‘WHO Global strategy for containment of Antimicrobial Resistance’ শিরোনামে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে।(২) কিন্তু, সেই সময় এই পরিকল্পনার বিশেষ কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায় না। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রসঙ্গে নতুনভাবে গ্লোবাল একশন প্ল্যান (GAP) সাজায়। এই পরিকল্পনায় FAO (Food and Agricultural Organisation) ও OAE(Organisation for Animal Health) কে সংকট নিরসনে শরিক দেশগুলোর পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। আবার ২০১৬ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে IACG(Interagency Coodination Group on Antimicrobial Resistance) তৈরি করা হয়। IACG ২০১৯ এ জাতিসংঘের কাছে এই সংকট নিরসনে তাদের পরিকল্পনা পেশ করে। তাতে সদস্য দেশগুলোর এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানানো হয়, পাশাপাশি এন্টিবায়োটিক গবেষণায় জোর দেয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।(৩)(৪)
- ব্যাকটেরিয়াবাহিত রোগ প্রতিকারে ব্যাকটেরিয়োফাজ (ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ভাইরাস) ব্যবহারের গবেষণায় বেশ সাফল্য এসেছে। আগামী দিনে ব্যাকটেরিয়ার এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতার গতি কমাতে ব্যাকটেরিয়োফাজের ব্যবহার সাফল্য আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী ভাইরাস দুই ধরনের হয়, lytic ও lysogenic. শুধুমাত্র লাইটিক ভাইরাসকে ব্যাকটেরিয়োফাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
১৯১৫ সালে প্রথম ব্যাকটেরিয়োফাজের সন্ধান পাওয়া যায় এবং ২০ দশকে রোগ নিয়ন্ত্রণে এটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এন্টিবায়োটিকের বাজারের কারণে ব্যাকটেরিয়োফাজ নিয়ে গবেষণা তেমন গতি পায়নি। অন্যদিকে, তৎকালীন সময়ে সেভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) পশ্চিমের উন্নত বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা এন্টিবায়োটিক বিকল্প হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফাজ ভাইরাসের সফল ব্যবহার করে।
৯০ দশকে পশ্চিমা বিশ্বে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতা অন্যতম বড় সমস্যায় পরিণত হয়। সাথে যোগ হয় এন্টিবায়োটিক গবেষণা হ্রাস। ফলে, সে সময়ে বিকল্প হিসেবে ব্যাকটেরিয়োফাজের ব্যবহার করে ‘ফাজ চিকিৎসা'(phage therapy) পশ্চিমা বিজ্ঞানীমহলে জনপ্রিয় হতে থাকে। ইতোমধ্যে, ২০১৫ সালে ফাজ চিকিৎসা ইঁদুর ও মানুষের রোগসৃষ্টিকারী Acinetobacter baumannii ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ফাজ চিকিৎসায় ব্যবহার এখনো পরীক্ষাধীন। এই চিকিৎসার সাথে যুক্ত ঝুঁকিগুলো এখনো সমাধান করা যায়নি। তাই মানুষের ওপর ব্যবহারের জন্য ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি বা ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের (FDA) ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। এন্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতার সাথে তুলনা করলে এই চিকিৎসা এন্টিবায়োটিকের বিকল্প না হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা।(৫)(৬)
- Antimicrobial peptide and proteins(AMPs) এন্টিবায়োটিকের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়। AMP বহুকোষী প্রাণীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই বহিরাগত জীবাণুর বিরুদ্ধে তৈরি করে থাকে। এটি এন্টিবায়োটিকের মতোই ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্রে বাধা সৃষ্টি করে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। এই তত্ত্বটি ব্যবহার করে রোগের চিকিৎসায় এন্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড ব্যবহার করা হয়। এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতার গতি কমানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক সমন্বয় করে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতার গতি কমানো চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতেই এন্টিবায়োটিকের পাশাপাশি এন্টিমাইক্রোবিয়াল পেপটাইড ব্যবহার করা হয়। গত কয়েক বছরে, AMP ব্যবহার করে অনেক সুপারবাগের বিরুদ্ধেও সফলতা নিশ্চিত করা গেছে। সামনের দিনে ব্যাকটেরিয়ার এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতা কমিয়ে আনার জন্য এটি ব্যাপকহারে ব্যবহার করা যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।(৭)
বলা যায়, গবেষণা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু ঔষধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের তুলনায় লাভের মাত্রা কমে যাওয়ায় গবেষণায় বরাদ্দ অপ্রতুল। বর্তমানে বিশ্বে শুধুমাত্র ৫টি বড় ঔষধকোম্পানী এন্টিবায়োটিক গবেষণায় বিনিয়োগ করে। তাই বর্তমান গবেষণার বড় অংশই ছোট ও মাঝারি মানের ঔষধ কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। এন্টিবায়োটিক উদ্ভাবন কমে আসায় এন্টিবায়োটিকের বাজারে প্রতিযোগিতা তুলনামূলক কম। তাই ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোর এই খাতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু পর্যাপ্ত সাহায্য না থাকায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এন্টিবায়োটিক সমস্যায় শুধু গবেষণা একমাত্র সমস্যা তা না, ঔষধ কোম্পানিগুলোর পর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় রাসায়নিক উপাদান নদী ও মাটিতে মিশে ব্যাকটেরিয়ার এন্টিবায়োটিক সহনীয়তা তৈরিতে সাহায্য করছে।
চীন ও ভারত বর্তমানে সবথেকে বেশি ঔষধ রপ্তানি কারী দেশ। কম দামে ঔষধ তৈরির জন্য এইসব দেশে পর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয় না। পরে এন্টিবায়োটিক তৈরির ফলে উৎপাদিত বর্জ্য আশপাশের নদীতে নিষ্কাশন করে ফলে, ভারতে বর্তমান বিশ্বে সবথেকে বেশি এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধিতার ঝুঁকিতে আছে। ডয়েচে ভেলের একটি ডকুমেন্টারিতে ভারতের পানিতে ভয়াবহ পরিমাণ সুপারবাগের সন্ধার পাওয়া যায়।(৮) আবার ২০১৪তে ফোর্বসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,
চীনের রাইন নদীতে ওসেলতামিভির(তামিফ্লু), টেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন পাওয়া গেছে। ডেনমার্ক ও সুইডেনের নদীতে সালফোনামাইডস পাওয়া গেছে। এছাড়া নরওয়ের পানিতে বেসিট্রিসিন পাওয়া গেছে। সস্তায় ঔষধ তৈরির জন্য পৃথিবীর বড় কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কাঁচামাল উৎপাদন করে। কিন্তু ইউরোপ থেকে আগত ট্যুরিস্টদের হাত ধরেই এই এন্টিবায়োটিক রোধি ব্যাকটেরিয়া ইউরোপের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।(৯) তাহলে বাংলাদেশের নদীতে কী মিলতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:
আবার, বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাজার বছর ধরে মানব সংস্পর্শের বাইরে থাকা অণুজীব মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করছে। হিম অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির খবর প্রায় শোনা যায়। সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রক্রিয়ায় পথে পৃথিবীর অনেক আদি জীবাণু গলিত বরফের সাথে মিশে মানব সংস্পর্শে প্রবেশ করছে।(১০) পাশাপাশি বর্তমান সময়ে বৃক্ষ নিধন, বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে গেছো জীবাণু মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে পশু পাখিরা মানুষের নিবাসের কাছাকাছি থাকতে বাধ্য হয়। ফলে নানা রোগ সংক্রমণ ঘটায়।
Borrelia burgdorferi নামক ব্যাকটেরিয়া বন্য হরিণের একটি পরজীবীর মধ্যে বাস করে। মানুষের সংস্পর্শে আসলে তা লাইম রোগ সংক্রমণ ঘটায়। সামনের দিনে আরো নতুন অনুজীব দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।(১১)
২০ শতকে বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল প্রকৃতিকে জয় করা। তবে, ২১ শতকে এসে মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ার কথাই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব না। প্রকৃতির সাধারণ নিয়মেই ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে পুনরায় আবির্ভূত হয়। তাই এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারের পুনর্বিন্যাস করা জরুরি। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধে প্রাণ-প্রকৃতি, প্রতিবেশকে রক্ষা করে অনুজীব থেকে সুরক্ষা লাভের বৈশ্বিক নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহন করা ছাড়া সম্ভবত মানুষ নামক প্রানীটিকে রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হবে না।
তথ্যসূত্র:
১.https://apnews.com/article/health-us-news-ap-top-news-a646fe6429ab46e0aab3f09a60d77b5c
২. WHO | WHO Global Strategy for Containment of Antimicrobial Resistance
৩. Strategies to Contain the Development and Consequences of Resistance
৪. Global initiatives to fight antibiotic resistance – Part 4 – ReAct
৫. Advantages and Limitations of Bacteriophages for the Treatment of Bacterial Infections
৬. Phage therapy
৭. Combinatory Therapy Antimicrobial Peptide-Antibiotic to Minimize the Ongoing Rise of Resistance৮. Deadly bacteria and the pharmaceutical industry | DW Documentary
৯. Who Is Responsible For Antibiotic Resistance?
১০. Scientists’ warning to humanity: microorganisms and climate change
১১. Science Deforestation is leading to more infectious diseases in humans
#জ/উম-৫/১৪