১৯২৮ সালে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং নামের একজন বিজ্ঞানী একটি ছোট একটি ভুল করেন! তিনি ল্যাবরেটরিতে Staphylococcus ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন। একদিন কাজ শেষে ব্যাকটেরিয়া চাষের (কালচারের) কয়েকটি পাত্র ভুলে পরিষ্কার না করে তিনি ছুটি কাটাতে চলে যান। দুই সপ্তাহ পর ফিরে এসে ফ্লেমিং লক্ষ করেন পাত্রগুলোতে ছত্রাক তৈরি হয়েছে। কৌতুহলবশত একটি পাত্র ল্যাবের মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখতে পান সেখানে কোনো ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারেনি। বুঝতে পারেন, ছত্রাকের কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণেই পাত্রটিতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারেনি। এই ছোট ভুল থেকে শুরু হয় “জাদুকরী ঐষধ” (Miracle Drug) খ্যাত এন্টিবায়োটিকের যাত্রা। ফ্লেমিং’র আগ পর্যন্ত কিছু কৃত্রিম এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছিল। ফ্লেমিং’র হাত ধরে প্রথম প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক পেনিসিলিনের সন্ধান পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়ের অন্যতম কারণ ছিল পেনিসিলিন আবিস্কার। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। এই সময় পেনিসিলিন ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যায়। তাই সরকারের সাথে মিলে ঔষধকোম্পানিগুলো পেনিসিলিন তৈরির কাজে নেমে পড়ে। যুদ্ধকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৬৪৬ বিলিয়ন ইউনিটের বেশি পেনিসিলিন তৈরি করা
হয়। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই কোম্পানিগুলোই এন্টিবায়োটিকের জনপ্রিয়তাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে তার অতিরিক্ত ব্যবহারকে প্রশ্রয় দেয়।(১)
তার আগেই ১৯৪৫ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং তার নোবেল প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, এন্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। তবে তাঁর সতর্কবার্তা কেউ আমলে না নিয়ে ব্যবসা ও যুদ্ধে এন্টিবায়োটিকের ব্যাপক ব্যবহার চালিয়ে যায়, যা এখন পর্যন্ত চলছে।
১৯৪৭ সালে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। সতর্কবার্তা না মেনে পরবর্তীতে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে সাহায্য করে।
এন্টিবায়োটিক হলো ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী একটি ঔষধ। ব্যাকটেরিয়া এককোষী জীব। এন্টিবায়োটিক সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার কোষের কোনো একটি উপাদানকে অনুকরণ করে তার স্বাভাবিক জীবনচক্রে বাধা তৈরি করে। ফলে ব্যাকটেরিয়াটি ধীরে ধীরে মারা যায়। যেমন: পেনিসিলিন staphylococcus ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীর তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কোম্পানিগুলো এন্টিবায়োটিক গবেষণায় ব্যাপক অর্থলগ্নি করে। ফলে, দ্রুতই পেনিসিলিন ছাড়াও অনেক ধরনের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়। যেমন: গনেরিয়া, সিফিলিস, মেনিনজাইটিস, কলেরা এ সকল রোগের এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে সহজে সাড়িয়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে আমরা কোনো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা এন্টিবায়োটিক কোর্স দিয়ে থাকেন। এছাড়া শরীরের বাইরে ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঠেকানোর জন্য অনেক সময়ে এন্টিসেপটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বর্তমানে প্রায় প্রতিটি এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরী হয়েছে। আমরা যখন এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করি, শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এতে আমাদের রোগমুক্তি ঘটে। তবে শরীরে কিছু ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরও বেঁচে থাকে এবং নিজের জিনে পরিবর্তন ঘটিয়ে ঐ এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধক্ষমতা ব্যাকটেরিয়াগুলো শুধু নিজেদের বংশধরদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় তাই না, তার সংস্পর্শে আসা অন্যান্য প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে। তাই দেখা গেছে, বাজারে প্রচলিত প্রায় সব এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে অনেক ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বলা হয় ‘সুপার বাগ’।(২) কিন্তু সেই তুলনায় নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরী হয়নি।
বর্তমান সময়ে বাজারে যে সকল এন্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে পাশাপাশি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রায় সবগুলোর আবিষ্কার হয় ১৯৮৭ সালের পূর্বে। ২০১৭ সালে World Health Organisation (WHO) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা এন্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টের সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, বর্তমানে ৫১টি এন্টিবায়োটিক ও ১১টি Biologicals বর্তমানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পার করে হয়তো সর্বোচ্চ ১০টি এন্টিবায়োটিক বাজার পর্যন্ত যেতে পারবে। তার মধ্যে সর্বোচ্চ ২টি হয়তো Gram-Negative ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, চাহিদার তুলনায় এন্টিবায়োটিকের যোগান অপ্রতুল।(৩)
এন্টিবায়োটিকের আবিস্কার কমে যাচ্ছে কেন?
কেন ৮০-র দশকের শেষ নাগাদ এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার এতটা কমে গেছে? কারণ এন্টিবায়োটিকের বাজার বা ব্যবসা। এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার ও তার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল একটি খরুচে প্রক্রিয়া। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের ওপরও এন্টিবায়োটিক গবেষণা নির্ভরশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এন্টিবায়োটিকের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার কারণে(এই জনপ্রিয়তা কৃত্রিমভাবে তৈরী করা হয়েছে বললে ভুল হবে না) ঔষধ কোম্পানিগুলো এন্টিবায়োটিক গবেষণায় ভুড়ি ভুড়ি টাকা ঢালতে থাকে। কিন্তু প্রথম দিকে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া না থাকায় প্রায় সকল গবেষণা সফল হতো।(৫)
তবে ঔষধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের মাধ্যমে সামান্য হাঁচি, কাশি, জ্বরের জন্যও এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে থাকে। শুধু মানুষের রোগের জন্যই না, গবাদি পশুর খাদ্যদ্রব্যে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। বর্তমান সময়ে এসেও ৮০% শতাংশ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় গবাদি পশুর খাদ্যদ্রব্যে। গবাদি পশুর অসুখের সাড়ানোর জন্যই নয় তাদের মোটাতাজাকরণের জন্যও অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার অনেক বেশি। ফলে, গবাদি পশুর শরীরের ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধীতা তৈরির পর তা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তখন মানুষের অজান্তেই শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলোর এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়।
ঔষধ কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িক স্বার্থে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার উন্মুক্ত করলেও ৬০ দশকের শেষ নাগাদ এন্টিবায়োটিক গবেষণায় ধাক্কা লাগে। আবিষ্কৃত ঔষধগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধক্ষমতা তৈরী হওয়ার অহরহ নজির পাওয়া যায়। এতে এন্টিবায়োটিক গবেষণা সময়ের সাথে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী এন্টিবায়োটিকের উন্মুক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচার করা হয়। ফলে এন্টিবায়োটিকের রমরমা ব্যবসায় ছেদ ঘটে। যদিও বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিক ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফলশ্রুতিতে ড্রাগ কোম্পানিগুলো এন্টিবায়োটিকের পেছনে বিনিয়োগ থেকে সরে আসে এবং নতুন এন্টিবায়োটিকের উদ্ভাবন কমতে থাকে। কিন্তু উদ্ভাবন কমে আসলেও এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। একজন মানুষের শরীরে কোনো এন্টিবায়োটিক গ্রহণ না করলেও তার দেহে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এন্টিবায়োটিকরোধী ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে। বর্তমানে নবজাতকের দেহে মায়ের শরীর থেকে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা দেখা যায়। ভারতে প্রতি বছর ৫৮,০০০ নবজাতকের মৃত্যু হয় শরীরে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হওয়ার কারণে।(৬)
পৃথিবীতে বছরে ৭.৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ওপর বাজারে প্রচলিত এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা না থাকার কারণে। অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তে নতুন এন্টিবায়োটিকের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় গবেষণা অপ্রতুল।
ঔষধ কোম্পানিগুলো বর্তমানে এন্টিবায়োটিকের পেছনে ঝুঁকিপূর্ণ ইনভেস্টমেন্ট না করে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, মানসিক রোগের ঔষধের ওপর ইনভেস্টমেন্ট বৃদ্ধি করেছে। কারণ এই রোগগুলোতে রোগীকে আমৃত্যু ঔষধ গ্রহণ করতে হয়। ফলে ঔষধ কোম্পানির ব্যাপক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়।
কিন্তু এন্টিবায়োটিক গবেষণার তেমন কোনো বিকল্পও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বরং বিজ্ঞানীরা বলছেন এন্টিবায়োটিকের সাথে সহায়ক ঔষধ তৈরি করা গেলেও এন্টিবায়োটিকের প্রকৃত কোনো বিকল্প নেই। তাই এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার সীমিত করার দিকেই নজর দেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সেক্ষেত্রে শুধু মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই না গবাদি পশুর খাদ্যদ্রব্যে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার সীমিত করে আনাও প্রয়োজনীয়। এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শল্যচিকিৎসা, কেমোথেরাপির মতো প্রক্রিয়ায় সেখানে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি, এছাড়া ফুসফুসের রোগ পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। ফুসফুসের রোগগুলো প্রধানত ব্যাকটেরিয়াঘটিত। তাই এন্টিবায়োটিকের সংকট ফুসফুসের রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে। তাই এন্টিবায়োটিক গবেষণায় গতি আনার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
(১) Penicillin: Medicine’s Wartime Wonder Drug and Its Production at Peoria, Illinois
(২)The Antibiotic Apocalypse Explained
(৩) WHO | ANTIBACTERIAL AGENTS IN CLINICAL DEVELOPMENT
(৪) Few antibiotics under development – How did we end up here? – ReAct
(৫)How can we solve the antibiotic resistance crisis? – Gerry Wright
(৬)অ্যান্টিবায়োটিক যথেচ্ছ প্রয়োগে বিপন্ন শিশুরাও – Anandabazar
nice write up