পাটকলের জন্য খুলনা তার ঐতিহ্য বহন করে আসছিল। শিল্পনগরের জন্য এতোদিন খুলনাবাসী গর্ববোধ করেছেন। পাটকল ও পাটশিল্পের জন্য খুলনাবাসী অহংকার করেছেন। অথচ পাটকল বন্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে খুলনাবাসীর সেই গর্ব বা অহংকারবোধ লুণ্ঠিত হলো। এখন আর শিল্পাঞ্চলে প্রাণচঞ্চলতা নেই। নিস্প্রাণ এই শিল্পাঞ্চলে জনকোলাহলপূর্ণ পরিবেশ একেবারে অনুপস্থিত। শিল্পনগরী খুলনা এখন কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। অকাট সত্যের মুখোমুখি খুলনা। খুলনাকে এখন আর শিল্পনগরী বলা যাবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু খুলনা নগরীই নয়, খুলনা মহানগরে গড়ে ওঠা বিস্তৃত শিল্পাঞ্চলকে আর শিল্পাঞ্চল বলা যাবে কিনা সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকাংশেই বলা যায়, খুলনাবাসীর গর্বিত হবার দিন শেষ হবার পথে। ২৫টি পাটকল বন্ধের রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের কারণে শ্রমিক, পাটচাষী ও তাদের পরিবার পরিজন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ প্রায় ৩ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা ঘোর অমানিশার অন্ধকারের মধ্যে পড়েছেন। এমনকি পাওনা প্রদানের ক্ষেত্রেও শ্রমিকেরা সরকারের প্রতারণামূলক ফাঁদে পড়ছেন।
১৮ হাজার ২ শত বদলী শ্রমিকের বকেয়া পাওনা অর্থের কোন খবর নেই। ৭ হাজার দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক অবগত নয়, তারা আদৌ অর্থ পাবেন কি না। শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কলোনী থেকে উচ্ছেদ হওয়া শ্রমিকেরা।
পাটকল ও পাটশিল্পের সাথে শ্রমিকের প্রাণের সম্পর্ক। বলা যায়, একে অপরের পরিপূরক। অথচ ২ জুলাই ২০২০ তারিখে পাটকল ও শ্রমিকের প্রাণের সম্পর্ক দ্বিখন্ডিত করা হল। রাজা হুকুম ঘোষণা করলেন। হুকুম জারি করা হল। জারিকৃত হুকুম মাটিতে পড়ল। বজ্রপাতের মত শব্দ হল। প্রকৃত বজ্রপাত দিবালোকে হলে কিছুসংখ্যক মানুষ মারা যেতেন। মানব সৃষ্ট বজ্রপাতের এই হুকুম হোল গভীর রাতে। দৈনিক ভিত্তিক, বদলী, স্থায়ী শ্রমিক, পাটচাষী ও তাদের পরিবার হলেন জীবনমৃত। শ্রমিক পরিবারের অনিশ্চিত জীবন কানাগলির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সাধারণ অর্থে সকল শ্রমিকের অর্থনৈতিক সংকট একই রকম। পাটকল বন্ধে কর্মহীন হওয়ায় শ্রমিকেরা অনাহারী অবস্থায় আছেন। তাদের পুত্র ও কন্যাদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মাঝ পথে লেখাপড়া বন্ধে শ্রমিকদের চক্ষু চড়কগাছের মত অবস্থা হয়েছে। স্ত্রীকে শাড়ী কিনে দেবার ক্ষমতা নেই। নিজে এমনকি বয়স্ক পিতা – মাতা হৃদরোগ, স্ট্রোক, হাঁপানী, এ্যাজমা, কিডনী রোগে আক্রান্ত হলেও ওষুধ কিনে দেবার ন্যূনতম সামর্থ নেই। নির্বিকার হয়ে, চোখের দেখা ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কোন ক্ষমতা নেই। খরচ না হলেও চিকিৎসার জন্য সরকারী হাসপাতালে গেলেও ওষুধ কেনার সামর্থ নেই। অথচ অনেক সময় দেশীয় প্রাইভেট চিকিৎসার ওপর আস্থা হারালে মন্ত্রী, সচিব, প্রভাবশালী সংসদ সদস্য, ক্ষমতাভোগী রাজনৈতিক ব্যক্তি সিঙ্গাপুরে ছুটে যায়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীও যুক্ত। তিনিও ব্যতিক্রম নন। কারণ, তার শরীরে রোগ যাতে বাসা না বাঁধে, দেহ যাতে সুরক্ষিত থাকে। অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি, প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকের ভাত খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছে না। জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন থাকায় তিনি নির্বিকার থাকে। এও আমাদের ভাবিত করে, যখন বিনা চিকিৎসায় লুটিয়ে পড়া শ্রমিকের জীবন যন্ত্রণার খবর প্রধানমন্ত্রীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না।
কেন এই পাটশিল্প সংশ্লিষ্ট ৩ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন করে পাটকল বন্ধের আয়োজন চলছে ? কেন পাটকল শ্রমিকদের ওপর জুলুমের সীমা অতিক্রম করেছে, যা নজিরবিহীন ? এখানে স্পষ্টত বলা যায়, সরকার গুটিকয়েক লুটেরাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য চক্রান্তের জাল বুনেছে। জনকল্যাণে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা রাজনীতিকে বিদায় জানিয়েছেন। বর্তমানে আমলা, পোশাক ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী হয়েছে। তাঁরাই ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। পূঁজিপতিরা ব্যবসা করবেন আর রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ ব্যবসায়ীরা শ্রমিক – কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন আর ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক সরকার তা বাস্তবায়নের সমস্ত আয়োজন করছে। চক্রান্তের এই মহোৎসবের কারণটা কী ? লুটেরাদের শ্রেণী সম্পর্কের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে গণবিরোধী দুঃশাসক সরকার শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
পাটকল বন্ধ হবার পর যাতে শ্রমিকেরা রাজপথে না থাকে, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে না ওঠে তার জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সশস্ত্র মহড়া চলে। সাঁজোয়া যান, জলকামান দিয়ে শ্রমিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। খুলনার খালিশপুর, আটরা, যশোরের রাজঘাট শিল্পাঞ্চল এলাকা ও সংশ্লিষ্ট সকল মিলগেট কার্যত অবরুদ্ধ থাকে। শ্রমিকের ভোটে নির্বাচিত সিবিএ, নন – সিবিএ শ্রমিক নেতারা বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় দিয়েছে। শাসক দল প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের কণ্ঠরুদ্ধ করতে পেরেছে। পাটকল বন্ধের রাতেই অসংখ্য শ্রমিক ও তার পরিবার – পরিজনের জীবন রক্ষার জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করেন। শ্রমিকদের বিশাল অংশ গ্রামে চলে গেছেন। সামান্য অংশ শিল্পাঞ্চলে ঘর ভাড়া নিয়ে আছেন। পাটকল চালু হবে কি হবে না এই আশা -নিরাশার দোলাচলে শ্রমিকদের মধ্যে প্রাচীর তৈরী হয়েছে। বেতন সময় মত দেবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী এই সরকার নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খালিশপুরের প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, দীঘলিয়ার স্টার, ফুলতলার ইস্টার্ণ, যশোর রাজঘাটের যশোর জুট ইন্ডাস্টিজ (জেজেআই) জুটমিল শ্রমিকদের কলোনী থেকে শ্রমিক ও তার পরিবারকে বের করে দেয়া হয়েছে।
শ্রম আইনের ৩২ এর ২ ধারায় সুস্পস্টভাবে উল্লেখ আছে, শ্রমিকের সকল পাওনা পরিশোধ না করে কোন শ্রমিককে বাসস্থান হতে উচ্ছেদ করা যাবে না। রাষ্ট্রের আইন সরকার নিজেই তো অমান্য করছে। আইন অমান্যের এই জবাবদিহিতা সরকার তো করছে না। এটা সম্পূর্ণরূপে আইন পরিপন্থী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার মাত্র।
এটা শ্রমিকের ওপর নিপীড়ন – নির্যাতনের সামিল। এভাবে সরকার কর্তৃক তুঘলকি কান্ড চলছে। উপরন্তু জুলুমবাজ এই সরকার শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা দ্রুত পাবার পূর্বশর্ত জুড়ে দিয়েছে। পূর্বশর্তে বলা হয়েছে, পাওনা মজুরী পেতে গেলে শ্রমিকের নিজের কষ্টার্জিত অর্থে তোলা ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ফেলতে হবে। ঘরবাড়ী ভেঙ্গে ফেলার অর্থ হচ্ছে, নিশ্চিত শ্রমিকদের কলোনী ছাড়তেই হবে। যাতে করে পাটকল বন্ধের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা কঠোর আন্দোলনে যেতে না পারে, তার জন্য এই ব্যবস্থা। সরকার পাটকল ব্যবস্থাপনা প্রশাসন দিয়ে অতি সহজে এ কাজটি করতে পেরেছে। ফলে শ্রমিকদের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন কলোনী এখন আর চোখে পড়ে না। কোলাহলপূর্ণ মাঠ এখন নিষ্প্রাণ মাঠে পরিণত হয়েছে। ঝকঝকে বাতি এখন আর প্রজ্বলিত হয় না। কলোনী বিরান প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। কলোনীগুলো শুনসান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, পাটকল কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা আছে। কর্মচারীরা শ্রমিক কলোনীতেই থাকে। তাদের জন্যও আলাদা আবাসিক ব্যবস্থা আছে। আর শ্রমিকদের জন্য কলোনীতে বিশাল খোলা মাঠের ব্যবস্থা আছে। কাঁচা ঘরবাড়ী তৈরির ব্যবস্থা তাদের নিজেদের করতে হয়। এই ঘরবাড়ীতে শ্রমিক পরিবার থাকে। আবার সরকার কর্তৃক নির্মিত পাকা ঘরবাড়ীতেও শ্রমিক পরিবার থাকে। এক্ষেত্রে বাসা ভাড়ার পার্থক্য রয়েছে।
শ্রমিকদের জীবন – জীবিকা সম্পর্কে এখানে একটি উদাহরণ দিলে অত্যুক্তি হবে না। মানব শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধলে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে ধাবিত হয়। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনা সাধ্য কারো নেই। রোগগ্রস্থ মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি এলে শরীর একেবারে শুকিয়ে যায়। পরিশেষে মানুষের প্রাণ থাকে ঠিকই কিন্তু জীবন প্রাণবন্ত থাকে না। দুঃশাসনের ওপর দাঁড়িয়ে মানবরূপী দানব সৃষ্ট ক্যান্সার আক্রান্ত পাটকলগুলোকে কবর দেয়ার প্রস্তুতি চলছে যার পুরোটাই দৃশ্যমান। এই দানবেরা পাটকল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে শ্রমিকদের। শ্রমিকরা অনাহারে থেকে তাদের শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে। শীর্ণকায় দেহে নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধলেও শ্রমিকরা চিকিৎসা করাতে পারছেন না। বিনাচিকিৎসায় শরীরে রোগ মাকড়োসার জালের মত বিস্তার লাভ করছে। মানবদেহে ক্যান্সারের মতই শ্রমিকদের জীবন – জীবিকার ওপর ক্যান্সার হানা দিচ্ছে। মানবদেহের ক্যান্সার মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও মানুষকে বাঁচানো যায় না। অঢেল অর্থ ব্যয় করেও ফলাফল সামান্যই থাকে। দুর্নীতির ক্যান্সার আক্রান্ত পাটকলগুলোর কবর রচনা করেও সরকার শ্রমিকদের জীবন – জীবিকার ক্যান্সার মুক্ত করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত পাটকল ধ্বংসের মরণখেলায় শাসকেরা বিজয় লাভ করবে নাকি শ্রমিক – কৃষক – জনতা বিজয় লাভ করবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বৈকি।
জীবন – জীবিকার বেড়াজালে আটকে থাকা শ্রমিকরা এখন দৃশ্যত নিশ্চুপ, নিশ্চল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ – বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। শুধুমাত্র গণবিস্ফোরণ ঘটার অপেক্ষা মাত্র। এইসব না খাওয়া শ্রমিকদের মাঝে জোরালোভাবে বলতে শোনা যায়, পাটশিল্পের সম্ভাবনা কী সরকারের এখন আর চোখে পড়ে না। সোনালী আঁশের দেশ এই বাংলাদেশে শাড়ি, স্যুট, জামা, জুতা, বিছানার চাদর, ফুলদানি, শোপিচ, হ্যান্ডব্যাগ, শপিংব্যাগ, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, ডোর ম্যাট,পর্দা, সোফা কভার, কুশন কভার, শতরঞ্জি, ঘোড়া, হরিণ, ভেড়া, কচ্ছপ, পাটপণ্য হিসেবে তৈরী করা যায়। পরিবেশবান্ধব, গুণগত মান ও নান্দনিক সৌন্দর্যের কারণে দেশী – বিদেশী যে কারোর মন কাড়বে এসব পণ্যে। তাই প্লাস্টিক দ্রব্য বর্জন করে পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। পাটের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জীবন্ত। অথচ সরকার প্লাস্টিক নয়, পাটপণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে প্লাস্টিক দেশে পরিণত করার চক্রান্ত করছে।
ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের চাপে পাটকল সচল রাখতে নিরুপায় ছিল সরকার। আবার পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে পাটকল আন্দোলনের চাপে পড়েছেও সরকার। বাধ্য হয়ে সরকার শ্রমিকদের কিছু অর্থ প্রদান করছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে, প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে প্রতারকের ভূমিকায় সরকার নাম লিখিয়েছে। স্থায়ী শ্রমিক ব্যতীত দৈনিকভিত্তিক ও বদলী শ্রমিকরা সোনালী করমর্দনের কোন সুযোগ – সুবিধা পাবেন না। অর্থ প্রদানের সময় উৎসব বোনাস ২০২০ অত্যন্ত সুকৌশলে সরকার স্থায়ী শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে প্লাটিনাম, ক্রিসেন্ট, স্টার, ইস্টার্ণ জুটমিলে শ্রমিকদের মাঝে অর্থ প্রদান করেছে। তাঁর মধ্যেও শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। এই শুভংকরের ফাঁকি হলো, সরকারের হিসাব অনুযায়ী প্রত্যেক স্থায়ী শ্রমিকেরা ৫০ ভাগ বকেয়া মজুরী পাচ্ছেন এটা সত্য। অবশিষ্ট ৫০ ভাগ বকেয়া মজুরীর কিঞ্চিৎ পাবে, সেটা ব্যাংকের সুদের অংশ। এক্ষেত্রে পরিস্কারভাবে বলা যায়, শ্রমিকদের পরিপূর্ণ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে না। অবশিষ্ট ৫০ ভাগ ঘোষিত অর্থের বৈশিষ্ট্য হলো, এই টাকা শ্রমিকের হাতে না গিয়ে ব্যাংকে জমা থাকবে। ৩ মাস পর এই টাকার যে সুদ হবে সেই সুদের টাকা শ্রমিকেরা পাবেন। এই ৩ মাসে সুদের টাকা ব্যাংক এর হিসাব অনুযায়ী কত টাকা হবে তা শ্রমিকেরা জানেন না। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের সঠিক হিসাব স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। হিসাব থাকছে অস্পষ্ট, শ্রমিকেরা থাকছে অন্ধকারে। এইভাবে শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করা হচ্ছে। শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে।
পাটকল বন্ধের ষড়যন্ত্রকারী সরকার কী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যের জঠরজ্বালা বন্ধ করতে পেরেছে ? পারেনি। পেরেছে বকেয়া বেতন আটকিয়ে রাখতে, পেরেছে গোয়েন্দা প্রশাসন দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে, পেরেছে কলোনী থেকে শ্রমিকদের উচ্ছেদ করতে। অসংখ্য সচল কর্মসংস্থান বর্তমানে অচল কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। কর্মহীনতার কারণে সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাবে বৈকি। ক্ষুধার্ত শ্রমিকেরা পরিবার – পরিজনদের নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। এমনকি শ্রমিকেরা অনৈতিক পেশায় যুক্ত হচেছন। এ দায় কে নেবেন ? পেশাগত কাজে পটু পাটকল শ্রমিকেরা অন্য পেশায় যেয়ে অদক্ষ উপায়ে জীবন – জীবিকা নির্বাহ করছেন। অসংখ্য শ্রমিকেরা রিক্সা, ভ্যান ও অটোরিক্সা চালাচ্ছেন। বহুসংখ্যক শ্রমিক তার পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। ফাঁকা প্রান্তরে, ফাঁকা কলোনীতে শ্রমিক সন্তানদের ছিল হাসি কান্না, আনন্দ – বেদনার কত স্মৃতি। শৈশব – কৈশোরের এই স্মৃতি কবর দিয়ে তাদের চির বিদায় নিতে হচ্ছে। এই পাটকল পল্লী ছিল শ্রমিকদের আপন গ্রাম, আপন ঘর। তারা ভুলে গিয়েছিলেন পিতা বা পিতামহের নিজ বসতভিটা, ভুলে গিয়েছিলেন প্রকৃত গ্রাম। আপন গ্রাম হয়েছিল অচেনা গ্রাম। সেই অচেনা গ্রামেই শ্রমিকদের যাত্রা করতে হয়েছে, এমনকি এখনও হচ্ছে। অচেনা গ্রামকে এখন আপন করতে হচ্ছে। অচেনা মানুষকে চিনতে হচ্ছে, আপন করতে হচ্ছে। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা এই পাটকল ছেড়ে, শিল্পাঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়া শ্রমিকদের বাঁধ ভাঙ্গা কান্না ঠেকাতে পারছেন না। হু – হু করে কান্না বন্ধ করতে পারছেন না। কী করবেন ভেবে না পেয়ে কখনও নীরব, কখনও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছেন। কখনও হতাশ হচ্ছেন, কখনও শাসকের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ হচ্ছেন। এই শ্রমিকেরা গ্রামের আপন শেকড়ে আশ্রয় নিলেও আশাহীন নন।
এই নিস্তব্ধ পাটকল শ্রমিকদের এতোদিন সোনালী আঁশই বাঁচিয়ে রেখেছিল। শুধু তাই নয়, সোনালী আঁশের আয় রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতির মূলচালিকা শক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। সোনালী আঁশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারে পরিচিতি লাভ করেছিল। অথচ আজ সোনালী আঁশের দেশের মান চূর্ণ – বিচূর্ণ করা হলো। যারা সোনালী আঁশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করতে তৎপর তারা ইতিহাসে নব্য মীরজাফর হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। তারা শ্রমিক – কৃষক – জনতার প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় মসনদ থেকে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আর যারা সোনালী আঁশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করেছেন, কারাগারে গিয়েছেন তারা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য ইতিহাসে স্থান পাবেন। তাদের নাম ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে।
মুনীর চৌধুরী সোহেল
আহ্বায়ক, গণসংহতি আন্দোলন, খুলনা
২০.১১.২০২০