বাংলাদেশে সর্বশেষ ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ লংমার্চ করতে হয় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে। লংমার্চ শুরু হয়েছিলো রাজধানী ঢাকা থেকে। তার অবব্যহিত পরে বাংলাদেশের বুকে আরেকটি লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে “প্রান্তিক” ও দূর্গম এলাকা থেকে। হ্যাঁ, অভিনব এক লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি টিভির খবরে বারবার চোখ বুলিয়েছি। লংমার্চের খবর দেখতে। দুঃখজনক হলেও সত্য লংমার্চের খবর দেখতে পাইনি। এই লংমার্চের সংবাদ মূল্য হয়তো নেই। কেন নেই তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য, পরেরদিন প্রথম আলো পত্রিকায় ৪র্থ পৃষ্ঠায় খুব ছোট করে খবরটি দেখতে পেলাম। এই ছোট খবর ছাপা হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছি। ছোট হলেও অন্তত খবরটা তো ছেপেছে! আমি জানি না, যে জেলায় লংমার্চ হয়েছে সে জেলার বাসিন্দারাও জেনেছেন কিনা।
বান্দরবান জেলায় আবার নির্বাচনের হাওয়া বইছে। ১৪ তারিখে পৌরসভা নির্বাচন। লংমার্চ বিষয়ে কেউ জানুক আর না জানুক, কাপ্রু পাড়া থেকে বান্দরবান রাজার মাঠ পার্যন্ত রাজপথ-তো জেনেছে। আমরা যারা ভয়ে জবান বন্ধ করে রেখেছি, এই ভদ্রলোকেরা হয়ত ভয় ভরা বিস্ময় নিয়ে জেনেছি। এও কি সম্ভব! ম্রোরা লংমার্চ করতে পারে? হুম, ম্রোরা আপাতত অসম্ভব কে সম্ভব করে দেখিয়েছে। এই লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশ তরুণ। তারা ভিটে, মাটি, জুম চাষের ভূমি থেকে তথা উচ্ছেদের ভয় থেকে এই লংমার্চ করেছে। পাঁচ তারকা হোটেলের জন্য প্রতিটি ইট আর রড সিমেন্টের গাঁথুনির তালে তালে চিম্বুকের ম্রোদের পায়ের তলার মাটি সরে পরেছে।
প্রশ্ন থেকে যায়, পাঁচ তারকা হোটেলের আলোকচ্ছটায় কী তবে পুড়ে যাবে এই শান্তিপ্রিয় ম্রো জনগণ? এই পাঁচ তারকা হোটেল নিয়ে অনেক সংবাদ সম্মেলন বিবৃতি দেখেছি। একদিকে, ‘উন্নয়ন’ কে ঢাল করে পাঁচ তারকা হোটেলের পক্ষে বলতে শুনেছি। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়ের বক্তব্যও শুনলাম। কেমন জানি খাপছাড়া আর গা-বাঁচানো অসহায় বক্তব্য। আর ম্যারিয়ট জানালো, তাদের নাম নাকি জুরে দিয়ে নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীরা এই নির্মানের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এমনকি জাতিসংঘকে বিবৃতি দিতে দেখলাম। তবুও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। তবে সমস্ত বিবৃতি ব্যাখ্যাকে ছাপিয়ে ঐ ম্রোদের চিৎকার, উচ্ছেদ আতঙ্ক, ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা, লংমার্চে ক্লান্ত পায়ে হেটে চলা আর মাদলের গানের সেই শালবৃক্ষের মত “বুক টান” করা বুকে সাহস নিয়ে প্রতিবাদের সাথে সাথে প্লুং বাঁশির বিদ্রোহী সুর সমস্ত বিবৃতিকে ছাপিয়ে গেছে। অসত্যের বুলি সত্যের বাতাসে উড়ে গেছে।
ম্রো জাতি খুবই শান্তিপ্রিয় । রাষ্ট্র যেমনটি বলেছে তেমনটিই করেছে। একটা সময় লাল বাহিনী হয়ে রাষ্ট্রের হয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তারা উচ্ছেদ হয়েছে। জুম ভূমির পরিসর হয়েছে ছোট। রাংলাই ম্রো এই কথাগুলো বলতে গিয়েই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছ। চিম্বুক পাহাড় ম্রোদের অন্যতম আবাস। এই পাহাড়ে মেঘ ছুঁয়ে যায়। পাহাড়ের দৃশ্য মনোরম। বহমান নির্মল বাতাস। মন ও শরীরে প্রশান্তি এনে দেয়। যান্ত্রিকতা দূর করার প্রাকৃতিক দাওয়ায় রয়েছে প্রকৃতিতে। এই প্রাকৃতিক সম্পদ-ই কী তবে ম্রো দের জন্য মরণ ফাঁদ? পুঁজির তো নেশা মুনাফা। লুন্ঠন পুঁজি, দেশী পুঁজি, নষ্ট পুঁজি, বিদেশী পুঁজি- এই পুঁজির যাতাকালে ম্রো জনগণের নিঃশ্বাস ক্রমাগত বন্ধ হয়ে আসছে। অাচ্ছা, ম্রো জনগণ তবে কী এই পুঁজির সাথে এই আমলার (সামরিক, বেসামরিক),এই রাজা-মন্ত্রীর নেক্সাস বুঝে? হয়তো বুঝে, হয়তো বুঝে না!
তবে আমার মনযোগ ভিন্ন জায়গায়। চীনাদের লং মার্চের কথা শুনেছি। শুনেছি লং মার্চের কারণে চীনা বিপ্লব সফল হয়েছিল। এ দেশের সফল, অসফল অনেক লং মার্চ হয়েছে। ফারাক্কা লংমার্চ বাঁধ বন্ধ করতে পারেনি। সুন্দরবন লংমার্চ কী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে পেরেছে? ম্রোদের লংমার্চ কী তাদের দাবী মানতে বাধ্য করতে পারবে? আপাত ব্যর্থতার উপমা ফারাক্কা লংমার্চের মাহাত্মকে খাটো করতে পারে না। ফারাক্কা লংমার্চ জনমানসে এক অনুপ্রেরণা, সংগ্রামের দিশা। তেমনি সুন্দরবন রক্ষার লংমার্চও বটে। কাপ্রুপাড়া থেকে বান্দরবান রাজার মাঠের লংমার্চ অনুগত থেকে দ্রোহের পরিণত মহাকাব্য। শত্রু-মিত্র চিনতে শিখাবে। বন্ধু আর বিশ্বাসঘাতকের তফাৎ দৃশ্যমান করবে। নতুন অনেক বোঝাপড়া তৈরি করবে। এতদিনের ঝাপসা প্রশ্নগুলি স্পষ্ট হয়ে উঁকি দিবে। অনেক প্রশ্নের পুরনো উত্তরে নতুন বিন্যাস হবে। সর্বোপরি, সফলতা – ব্যর্থতা বা জয়-পরাজয় নয়; লংমার্চ আগামীর দিশা হয়ে হাজির হবে। এই লংমার্চের রেশ থেকে যাবে। বৈষম্যহীন, জাতিবাদী সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় এই লংমার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
উবা থোয়াই মার্মা
আইনজীবী, বান্দরবন জেলা আদালত
সাবেক রাজনৈতিক শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন