অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, এই একবিংশ শতাব্দীতেও কিছু মানুষ আছে, যারা মনে করে পৃথিবী গোলাকার নয়, বরং সমতল। এদেরকে বলা হয় ফ্ল্যাট র্আথার। উন্নত বিশ্বে এমন আরেকটি গোষ্ঠী আছে, যারা ভ্যাক্সিনকে একটি সম্প্রসারিত ধাপ্পাবাজি বলে মনে করে। এদেরকে বলা হয় অ্যান্টি ভ্যাক্সার্স। এদের বদৌলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা অনেক দেশেই জনগণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ টিকা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। আমাদের সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এসব প্রবণতা এতদিন তেমন দেখা যায়নি, যার প্রমাণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে হামের টিকা গ্রহণের হার ৯০ শতাংশ, বাংলাদেশে তা ৯৭ শতাংশ। কিন্তু কোভিড-১৯-এর টিকা সম্প্রতি বাংলাদেশে আসার পর থেকে পাশ্চাত্যের অ্যান্টি ভ্যাক্সারদের অনুকরণে এদেশেও কিছু মানুষ বুঝে, না বুঝে অথবা বেশি বুঝে এর বিরোধিতা করছেন।
এ বিষয়ে ভুল ভাঙ্গাতে, বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতামূলক আলোচনা নিচে তুলে ধরছি।বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে টিকা বিষয়ক যে আলোচনাগুলো এখন তুঙ্গে, সেগুলো হলো:
১) কোভিড-১৯-এর টিকা অল্প সময়ে তৈরি হওয়ায় এবং তড়িঘড়ি করে তার অনুমোদন দেওয়ায়, এগুলো নিরাপদ নয়।
২) টিকা কেবল বাণিজ্যিক লাভের কথা চিন্তা করেই তৈরি করা হয়েছে, এবং অতীতের অসংখ্য রোগের মতো কোভিড-১৯ও নিজ থেকেই, অর্থাৎ টিকা ছাড়াই বিদায় নেবে।
৩) এমআরএনএ টেকনোলজি দিয়ে টিকা তৈরি হওয়ায় তা মানুষের শরীরে ঢুকে মানুষের জেনেটিক গঠনকে পরিবর্তন করে দেবে, মানুষ আর মানুষ থাকবেনা।
এর বাইরেও অনেক আজগুবি আলোচনা আছে, যেমন বিল গেটস ইচ্ছাকৃতভাবে কোভিড-১৯ ভাইরাস তৈরি করেছেন পরে টিকা বিক্রি করার জন্য, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস তৈরি করেছে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য এবং যে টিকা দেওয়া হবে তা চীনের ফাইভ-জি টেকনোলজির মাধ্যমে মানুষের শারীরবৃত্তকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলমাত্র ইত্যাদি। শেষের এই আজগুবি ষড়যন্ত্র-তত্ত্বগুলো সঙ্গতশারণেই উপেক্ষা করছি, তবে উপরের তিনটি প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর এখানে দিচ্ছি।
অনেক ভ্যাক্সিনের তুলনায় কোভিড-১৯-এর ভ্যাক্সিন কম সময়ে তৈরি হলেও, করোনাভাইরাস বিষয়ক গবেষণা সেই ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণের সময় থেকেই জারি আছে, কারণ, সেটিও ছিল একধরণের করোনাভাইরাস। অতীতে ভ্যাক্সিনোলজির অনেক আধুনিক টেকনোলজি আবিষ্কার হয়নি, যা বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে এবং ভ্যাক্সিন তৈরির সময়কে তাৎপার্যপূর্ণভাবে কমিয়ে এনেছে। তাছাড়া ভ্যাক্সিন তৈরির কিছু ট্রায়াল ফেইজকে যুগপৎভাবে সম্পন্ন করায় এবং রেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু নিয়মকানুন শিথিল এবং ত্বরান্বিত করায় টিকা তৈরি করতে কম সময় লেগেছে। কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেন না থাকে তার জন্য তৃতীয় ফেইজের ট্রায়াল সম্পন্ন করে, যোগ্যতাসম্পন্ন গবেষকদের মাধ্যমে সূক্ষ্ম নীরিক্ষা করে তবেই এগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় ভ্রান্ত মতামতটির খন্ডন হলো, যদিও ভ্যাক্সিন কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক স্বার্থের ঊর্দ্ধে নয়, তবুও ভ্যাক্সিন ছাড়াও তাদের প্রচুর ওষুধ বাজারে আছে, যেগুলো তাদের ব্যবসার মেরুদন্ড। কাজেই তারা একটি ভুয়া ভ্যাক্সিন বানিয়ে নিজেদের প্রতি জনগণের আস্থাকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে মনে করাটা কষ্টকল্পনা, বিশেষ করে যখন অসংখ্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রত্যেকটি ভ্যাক্সিনের প্রতিটি খুঁটিনাটির প্রতি প্রতিনিয়ত নিবদ্ধ আছে। ভ্যাক্সিন না নিলেও যে শরীরে রোগপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সেকথা সত্য, কিন্তু সেসব অ্যান্টিবডি শরীরে কতদিন থাকে তা নির্দিষ্ট নয়। তা মানুষ থেকে মানুষে তারতম্য হয়, যা কী পরিমাণ ভাইরাস দ্বারা শরীর আক্রান্ত হয়েছিল তা সহ আরো অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। পক্ষান্তরে, ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ডোজে, বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত পরিমিত পরিমাণে মানব শরীরে প্রয়োগ করা হয়, যাতে তা দীর্ঘদিন মানুষকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে।
তৃতীয় মতটির খন্ডন হলো, এমআরএনএ হলো মেসেনজার আরএনএ-র সংক্ষিপ্ত রূপ, আর কোন আরএনএ মানুষের শরীরের জেনেটিক গঠনকে পরিবর্তন করতে পারেনা। ডিএনএ পারতে পারে, তাও সুনির্দিষ্ট কিছু শর্তে এবং পরিস্থিতিতে। যে ভ্যাক্সিনগুলো এখন পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে, যথা ফাইজার-বায়োনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, এদের কোনটিই ডিএনএ ভিত্তিক ভ্যাক্সিন নয়।এবার আসছি দেশীয় প্রেক্ষাপটে যে বিভ্রান্তিমূলক আলাপ আলোচনা বাজারচলতি হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে:
১) ভারত থেকে আসা টিকাগুলোর গুণগতমান প্রশ্নসাপেক্ষ।
২) টিকা নিলে লিঙ্গ পরিবর্তিত হয়ে যাবে বলে একজন প্রখ্যাত ইসলামী বক্তা তাঁর ওয়াজে উল্লেখ করেছেন। তিনি সবগুলো ভ্যাক্সিনের পেছনে ইসলামবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রেরও ইঙ্গিত দিয়েছে।
৩) ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরও অনেকের কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে এবং অনেকের মধ্যে ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা দিয়েছে।প্রথম প্রশ্নটির জবাব হলো, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরণের কারখানা দরকার। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলা ব্যবহার করে ভ্যাক্সিন উৎপাদন করে বাংলাদেশ সহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে তা সরবরাহ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ভ্যাক্সিনটি ভারতের মাটিতে উৎপাদিত হলেও তা ভারতীয় ভ্যাক্সিন নয়। ভ্যাক্সিনটির নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত এবং ল্যানসেট নামক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্বাস্থ্য জার্নালে তা বিচার বিশ্লেষণের পর প্রকাশিতও হয়েছে।
দ্বিতীয় অভিযোগের বিষয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আসলে বলার কিছু নেই। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন আজগুবি কথা শুনতে হবে এটাই হতাশায় আক্রান্ত হবার জন্য যথেষ্ট। ভ্যাক্সিন বা মানব শরীর এবং এর গঠন ও কার্যপ্রণালী সম্পর্কে যারা সামান্যতম অবগত আছেন, তারাই বুঝবেন ভ্যাক্সিন কাজ করে শরীরে রোগপ্রতিরোধব্যবস্থা তথা ইমিউন সিস্টেমের উপর। লিঙ্গ পরিবর্তন বা অন্যকোন আজগুবি ষড়যন্ত্রের এখানে কোন বালাই নেই।তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে, পৃথিবীর কোন ভ্যাক্সিনই ১০০ ভাগ কার্যকর নয়, ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারকগণ এমন দাবি করেনওনি। কাজেই ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরও অল্প কিছু মানুষ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, এখন পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া প্রত্যেকটি ভ্যাক্সিনই দুই ডোজের ভ্যাক্সিন। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মাঝে যে সময়, সে সময়ে এর কার্যকারিতা পূর্ণমাত্রায় থাকেনা। এসময় সাবধানে থাকতে হবে, কারণ আক্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তৃতীয়ত, বিশে^র সব ওষুধের মতোই ভ্যাক্সিনেরও কিছু গৌণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। এসবের প্রভাব নগন্য এবং ভ্যাক্সিন না নিলে এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ যে করবেন তাও পরিসংখ্যানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত।কাজেই আপনারা নির্দ্বিধায়, নিঃশঙ্কচিত্তে টিকা গ্রহণ করুণ। আর স্মরণ রাখুন, ”অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী”।
-ড. তৌফিক জোয়ারদার
গবেষক, শিক্ষকজন
হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়