সাম্প্রতিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ আন্দোলন কিছু পুরনো প্রশ্ন আবার সামনে এনে দিয়েছে। উচ্চ শিক্ষার বানিজিকিকরণ হচ্ছে বলে যে অভিযোগ অনেক আগে থেকে ছিল তা আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মত অসহিষ্ণু আচরণ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক কদম এগিয়ে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনকারী ছাড়াও বিভিন্ন সাংবাদিক ও শিক্ষকের ফেসবুক আইডি বিটিসিএল এর মাধ্যমে নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে ঘোষণাও দিয়েছে- যা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। এই সুযোগে হয়ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গোয়েন্দা ট্রেনিংও হয়ে যাবে! কোন কোন শিক্ষক নির্লজ্জভাবে এই অবৈধ নজরদারির পক্ষে সাফাই গাইছেন। তারা ভুলে যাচ্ছেন, তারা নিজেরা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেন, বিশ্ববিদ্যালয় তাদের তালুক নয় আর শিক্ষার্থীরা তাদের প্রজা নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে নৈর্বাচনিক স্বৈরতন্ত্র থাকলে তার প্রভাব অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের মানস পটেও যে পড়ে তা বোঝা গেল।
যত বাধা আর চাপই থাক না কেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে, কোথাও কোথাও শিক্ষকরাও সেই আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন, পুলিশের হাতে মার খাচ্ছেন, পুলিশ কখনোবা নির্বিচারে গুলি ছুড়ছে শিক্ষার্থীদের দমনের নামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ ফেব্রুয়ারি নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ ও সরকারী দলের অঙ্গ সংগঠনের ছাত্রদের ছোড়া গুলিতে ২৭ জন শিক্ষার্থী আহত হয় যাদের মধ্যে অন্তত ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে যানা যায়। এছাড়া, রাজীব নামের এক শিক্ষার্থীর চোখে গুলি লাগার ফলে তার একটি চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সাম্প্রতিক এই যে বিক্ষোভ আর আন্দোলন এর পেছনে কি কারণ তা একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের জানার আগ্রহ রয়েছে। সেই সূত্রে কিছুটা পেছন ফিরে দেখা।
স্বাধীনতা উত্তর কিংবা পরবর্তীত সময়ে আমাদের দেশে রাজনীতির যে চিত্র আমরা দেখি তাতে সর্বগ্রাসি একটি রূপ দেখা যায়, যাতে ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের বোধ করি এটিই মূল চরিত্র। যে রাজনীতির মুলে কেবল ক্ষমতা দখল আর লুন্ঠন, তার পরিচালনার নীতির সাথে সব কিছুকে নিজের মত করে তৈরি করার বা দখল করার প্রবণতার ফলে রাষ্ট্রের তিন মৌলিক স্থম্ভ যথাঃ আইন, বিচার ও শাসন বিভাগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে লুন্ঠন প্রক্রিয়া জারি রাখার প্রয়াস চালায়। তবে এই লুণ্ঠন যে কেবল দেশীয় তা নয়, রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকা, আদর্শ ভিত্তিক রাজনৈতিক নীতি না থাকাসহ প্রভুত কারণে দেশ পরিচালনাকারীরা ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করতে বিদেশী শক্তি ও টাকার কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে তাদের লুন্ঠনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইসলামী দেশগুলোর আর্থিক সহায়তা লাভের আশায় ও,আই,সি, এর সদস্য হওয়া শুরু করে পরবর্তী সকল অরাজনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সরকার এই ধারাবাহিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। একাত্তরে পাকিস্তানের জাপান সরকারের প্রতি যে ঋণ ছিল তা পরিশোধের বোঝা নিয়েই এদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই থেকে আজ অবধি আমরা চাই বা না চাই ঋণ আমাদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতই চেপে বসেছে। আমাদের দারিদ্র তাই ক্ষেত্রবিশেষে একটি আরোপিত সমস্যা। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশীয় বিষয়ে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী। আমাদের তেল, গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা আমাদের গ্যাস বিদেশীরা উত্তোলন করে অধিক মুল্যে আমাদেরকেই বিক্রি করা, শিক্ষার বানিজ্যিকিকরণসহ সব কিছুর পেছনেই আছে বিদেশী বেনিয়াদের ইচ্ছার প্রতিফলন। জগৎ শেঠ, রায় বল্লভরা তাদের চেহারা পাল্টে বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা অন্য কোন বহুজাতিক কোম্পানির নাম নিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে আমাদের নিয়ে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এবং যতদিন সুবিধাভোগী মির জাফররা থাকবে ততদিন এই বাণিজ্য চলবে।
এই বাণিজ্যের একটি অবশ্যম্ভাবী দিক হচ্ছে- সমস্ত সরকারী ব্যবস্থাপনায় চলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারিকরণের পরামর্শ ও চাপ দেয়া। একারনেই আমরা দেখেছি আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিকমিউনিকেশন, শিক্ষা, ব্যাংক, বীমার মত খাতগুলো একে একে এই বেনিয়াদের চাপে বেসরকারিকরণ হয়েছে। আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে গ্যাস উত্তোলনে সক্ষমতা থাকলেও বিদেশী চাপে তা ভারত কিংবা আমেরিকার হাতেই চলে গেছে। আমাদের দেশে শাসকশ্রেণী এসব বেনিয়াদের পরামর্শে সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূলভাবে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন- উন্নয়ন মানেই বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা। জনগণ দেখে নির্মাণ কাজ চলছে- হোক সে রাস্তা, হোক সে সেতু- নির্মাণ কাজ চালু থাকলেই জনগণ নিরব থাকে। এসবের আড়ালে চলতে থাকে বেনিয়াদের মূল বাণিজ্য- লুন্ঠন।
আগেই বলেছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কারের নামে এর বানিজ্যিকিকরণের ক্ষেত্রে বিদেশী বেনিয়াদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে আর এরই অংশ হিসেবে বিগত ২০০৬ সালে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র অর্থায়নে এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে যা মোট চারটি স্তরে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই তথা কথিত কৌশলপত্রের ভেতরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে এর পেছনের কিছু কথা সেরে নেয়া যাক। আমাদের জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাফল্যের সাথে মানবসম্পদ উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেও কারো কারো স্বার্থে এটিকে “অসফল, অকার্যকর কিংবা বিপুল সংস্কারের প্রয়োজন” এমনভাবে তুলে ধরতে পারলে এসব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে “চাহিদা” সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। আর সেই কৃত্রিম চাহিদা পূরণে সংস্কারের নামে লুণ্ঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তাকারী হিসেবে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা মুখিয়ে থাকেন। খাত সৃষ্টি করতে পারলে লাভ উভয়বিধ- জনগণ বুঝবে উন্নয়ন হচ্ছে আর তলে তলে দেশী বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে হালুয়া রুটি ভাগাভাগি করা যাবে। উচ্চ সুদে ঋণের ব্যবসাতো আছেই। ইউজিসি’র এই তথাকথিত কৌশলপত্র তেমনই একটি খাত ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবার আসা যাক- কৌশলপত্রের অন্তর্গত বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনায়। এই কৌশলপত্রে যা বলা হয়েছে তার সারাংশ হল- ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বিশ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেবে না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজের আয়ে চলতে হবে, উচ্চশিক্ষা অধিকার নয় সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হবে, যার টাকা আছে কেবল সে-ই উচ্চশিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে, বাজার নির্ভর বিষয়গুলোর প্রাধান্য থাকবে এবং মানবিক ও বিজ্ঞান শিক্ষার মত বিষয়গুলো উচ্চশিক্ষার তালিকা থেকে বাদ যাবে, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল নির্মাণ করা যাবে না, শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক পুলিশ তথা ক্যাম্পাস পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী গঠন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাসহ আরও বেশ কিছু সুপারিশ রয়েছে এই কৌশলপত্রে। ২০ বছর মেয়াদি চার স্তরে বাস্তবায়নযোগ্য এসব সুপারিশগুলোর ধাপগুলো হল- প্রাথমিক পর্ব- ২০০৬-০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২৬। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হয়ে কৌশলপত্রের সুপারিশমালা সরকারের উচ্চ মহলের স্বীকৃতি পেয়ে ইতিমধ্যে তার দুটি ধাপ অতিক্রম করেছে। এই ধাপে ধাপে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মুলে ছিল ছাত্র আন্দোলনের ভয়। কৌশলপত্র প্রণয়নকারীরা বেশ বুঝেছিলেন যে হটাত করে সমস্ত জনবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি ও বেসরকারিকরণ করলে তীব্র আন্দোলন হতে পারে। তাই তারা কৌশলী হয়েছেন। আমাদের সরকারগুলো বিদেশী বেনিয়া বা বিদেশের স্বার্থসংরক্ষণকারী এনজিওদের পরামর্শ যতটা শোনেন ততটা নিজেরটাও শোনে না। ফলে তাদের প্রেসক্রিপশনই শেষ ভরসা! তাদের পরামর্শে একসময় কলকারখানা লোপাট হত এখন নাহয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে।
আগেই বলেছি কৌশলপত্রে শিক্ষা খাতে সরকারের ভর্তুকি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে এবং এর পাশাপাশি শিক্ষার ব্যয় মেটাতে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক ঋণের সুপারিশও করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিক্ষালাভ করাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যা প্রত্যেক নাগরিকের “অধিকার” হিসেবে বিবেচিত কিন্তু এই কৌশলপত্রের সুপারিশগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষা আর অধিকারের কাতারে থাকবে না বরং এটি সুযোগে পরিণত হবে। যার কাছে টাকা আছে সে-ই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে। শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রের যে ব্যয় তা রাষ্ট্রের নিজের প্রয়োজনেই মানবসম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ। এটি ব্যবসায়ীদের মত পুঁজির বিনিয়োগ নয় যেখান থেকে রাষ্ট্র মুনাফা লুটবে। উচ্চশিক্ষা ব্যয় দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে তা আপাতদৃষ্টিতে কেবল এই দুই শ্রেণীর সমস্যা মনে হলেও পরিনামে তা সমগ্র রাষ্ট্রের সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হবে। তাছাড়া, এটি একটি দেশের মৌলিক নীতি নির্ধারণের ব্যাপার। যেসকল মূলনীতির উপর আমাদের রাষ্ট্র জন্মলাভ করেছে তার নিরিখে এই নীতি নির্ধারণ করতে হবে, কোন বেনিয়ার চাপে নয়। তাই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত কেবল উচ্চ বেতন নির্ধারণ কেবল অসামঞ্জস্যপূর্ণই নয় তা সকল বিচারে অগ্রহণযোগ্য।
মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ অর্থ আসতে হবে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খাতে আয় বাড়ানোর দিকটায় জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনের এ সুপারিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেদবাক্য মেনে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সরাসরি বেতন বৃদ্ধি না করেও বিভিন্ন ফির নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকই টাকা নিচ্ছে। এসবের মধ্যে আবাসন ও খাবার খরচ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ভাড়া দেয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া, দোকান ভাড়া, কনসালটেন্সি সার্ভিস ইত্যাদি অন্যতম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাম্প্রতিক সময়ে আরো যেসব সরকারী নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরামর্শক্রমে নিজের আয়ে চলার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। উদাহারণস্বরূপ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৭(৪) ধারার বক্তব্য অনুযায়ী, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয় যোগানে সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাইবে এবং পঞ্চম বৎসর হইতে উক্ত ব্যয়ের শতভাগ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় ও উৎস হইতে বহন করিতে হইবে।” এই আইনের ফলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সরকারী ব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও এর মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যেকোন ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মত। মিঞ্জুরি কমিশনের আবাসন হল নির্মাণের বিরোধিতার পূর্ণ বাস্তবায়ন দেখছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে- তাদের মোট বারটি আবাসিক হলের মাত্র দুটি তাদের দখলে- বাকী সব রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের দখলে আছে বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়। আর্থিক সক্ষমতা প্রসঙ্গে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও অন্যান্য ফির নমুনা দেখা যেতে পারে- ভর্তি ফি ২০,২০০, ডাইনিং ফি ১৮০০, বিদ্যুৎ বিল ও সেমিস্টার ফি ৫০০০ টাকা প্রতি শিক্ষার্থীকে গুনতে হবে। এই যদি হয় জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি এর নমুনা তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষালাভের অধিকার রাষ্ট্র কিভাবে নিশ্চিত করবে? ব্যাপারটা দিরিয়ে যাচ্ছে এরকম- যদি এত উচ্চ বেতন দিতে হয় তবে জনবিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়বে তাহলে তো ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়া যায়। প্রকারান্তরে, উদ্দেশ্য হয়ত এটাই- ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রমোট করা।
কৌশলপত্রের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর অন্যতম নজির হল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্য কোর্স চালু করা। যার নগ্ন উদাহারণ আমরা সম্প্রতি দেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আপত্তিটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্য কোর্স চালু করার বিরুদ্ধে যেখানে কেবল সার্টিফিকেট বিক্রি করা হবে, শিক্ষা দান যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। দিনে পাঠরত শিক্ষার্থীদেরই যেখানে গবেষণার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে গবেষণা নেই, সেখানে সান্ধ্যকালীন কোর্সে যারা সারাদিনের কাজ শেষে পড়তে আসবে তারা কোন উদ্দেশ্যে আসবে তা সহজে অনুমেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স এর একটি সার্টিফিকেট কোন কর্মজীবীর চাকুরিতে পদোন্নতি পাবার সুযোগ সৃষ্টিতে যতটা সহায়ক হবে ততটা জ্ঞানার্জনে নয়। তাছাড়াও সান্ধ্যকোর্সের মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তার যদি প্রাধান্য পেত তাহলে একই বেতন ও সিলেবাসে পড়ার সুযোগ থাকত। অথচ সান্ধ্যকোর্সে যারা পড়তে আসবেন তারা উচ্চ ভর্তি ফি গুনবেন এবং ভিন্ন সিলেবাসে পড়বেন। এতেই বোঝা যায় কি উদেশ্যে এই সান্ধ্য কোর্সের আয়োজন। ব্যবসায়ের মূলনীতি হল- বিনিয়োগ আর মুনাফা। শিক্ষার্থীরা উচ্চ অর্থ বিনিয়োগ করবে আর মুনাফা চাইবে না এটাতো হয় না। আর মুনাফার ভাগীদার শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়েই থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের গায়ে তো লাগবেই। এপ্রসঙ্গে বলে নেয়া দরকার, আমদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবীও অত্যন্ত ন্যায্য। বিশ্বের যেকোন দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন কম। এতে আমাদের শিক্ষকদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয় না। তবে এই বেতন বৃদ্ধি মৌলিক কাঠামোভুক্ত হওয়া উচিত, যেন তাঁদেরকে বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজতে না হয়।
শিক্ষাব্যয় নির্বাহের জন্য কৌশলপত্রে ব্যাংক ঋণের পরামর্শও একটি হটকারী সিদ্ধান্ত। এখানে মনে রাখা দরকার- ব্যাংক ঋণ যেকোন ব্যাংকের একটি প্রোডাক্ট। এখানে ব্রান্ডিং এর প্রশ্ন জড়িত। ব্যাংক তখনই একজন গ্রাহককে ঋণ দেয় যখন তারা নিশ্চিত হয় যে, সেই ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে- হোক সে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বা অন্য কারো ব্যক্তিগত গ্যারান্টি। যে শিক্ষার্থী নিজের এবং পারিবারিক আর্থিক দৈন্যের কারণে উচ্চ বেতন দিতে পারবে না ব্যাংক কেন তাকে ঋণ দেবে? তার ঋণের টাকা ফেরত দেবার নিশ্চয়তা ব্যাংক কিভাবে নিশ্চিত করবে? এরপরও কথা থাকে- কোন শিক্ষার্থী যদি এই ঋণ নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে পরবর্তীতে তার কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা কতটুকু? রাষ্ট্র সে দায় নিচ্ছে কিনা? যদি না নেয়- তবে কোন যুক্তিতে শিক্ষার্থীর ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপাবে?
রাষ্ট্র জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তুকি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও কৌশলে ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঠিকই ভর্তুকি দিচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক লাভের টাকার উপর সরকার করারোপ না করার সিদ্ধান্তের ফলে কার্যত জনগণের করের টাকায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তুকি পাচ্ছে। অথচ জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থাভাবে আবাসন, পরিবহণ, গবেষণার প্রয়োজনীয় উপকরণ ঘাটতিসহ প্রভুত সমস্যায় জর্জরিত হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তাছাড়া, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ২০০৮ সনে একনেকের এক সভায় “Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP)” নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় যাতে ৬৮১ কোটি টাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এই প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ ব্যয় বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়। এতেই বোঝা যায় আমাদের উন্নয়নের ধারণাগুলো কাদের ইচ্ছায় গড়ে উঠেছে।
কৌশলপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর পূর্ণনিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুবিধার্থে “ক্যাম্পাস পুলিশ” নামক এক নতুন ধারণা দেয়া হয়েছে। একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিটের শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করবে পুলিশ! সভ্য দেশে নাগরিক জীবনে পুলিশের হস্তক্ষেপ যত কম হয় ততই সেদেশ আরো সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমরা তথাকথিত সেসব সভ্যদের প্রেসক্রিপশনে পুলিশি রাষ্ট্রের দিকে হাঁটছি। কৌশলপত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে ক্যাম্পাস পুলিশের নেতৃত্বে থাকার সূপারিশ করা হয়েছে- একদিক থেকে চিন্তা করলে- ভালই হবে- প্রক্টরদের মুখোশ পরে শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়তে হবে না। আইন অনুযায়ী লাঠি হাঁকানোর সুযোগ পেয়ে যাবেন। তবে প্রক্টরদের পুলিশের ইউনিফরম পড়তে হবে কিনা সেবিষয়ে কৌশলপত্রে কিছুই বলা হয়নি।
ক্যাম্পাসে পুলিশ বাহিনী গঠনের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করারও সুপারিশ করা হয়েছে। দুটি চিন্তাই একে অপরের পরিপূরক। বিষয়টি ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে না হয়ে দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠন হিসেবে রাজনীতি করার বিরুদ্ধে হওয়া উচিত। শিক্ষার ভূমিকা কি তারা যদি প্রশ্ন করতে না শেখে? শিক্ষার্থীরা যদি সংঘবদ্ধ না থাকত তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন বৃদ্ধির যে অপচেষ্টা তা সফল হয়ে যেত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এত সহজে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করত না। কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে না থেকেও শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান এবং ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ সবটাতেই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ছাত্ররাজনীতির এই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় ১৯৭৬ সালে বিচারপতি আবু সায়েম কর্তৃক “পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন” নামের আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে। এই আইনের প্রবিধান ২(ঘ)অনুযায়ী, “রাজনৈতিক দল বলতে কোন এ্যাসোসিয়েশন বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বোঝায় যারা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করে বা কার্যক্রমে লিপ্ত থাকে, যার মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার অন্তর্ভুক্ত এবং এতে অন্তর্ভুক্ত হবে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ, সংশ্লিষ্ট বা ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন, যেমন ছাত্র, শ্রমিক, সাংস্কৃতিক, কৃষক এবং যুব সংগঠন।” এই রেগুলেশন পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাতিল করলেও ১৯৭৮ সালে “রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ, ১৯৭৮” জারি করেন, যার মাধ্যমে কার্যত রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের আইনি বৈধতা প্রদান করা হয়। এই আইনের ফলে ছাত্রসংগঠনগুলো মূল রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতির এহেন অপরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ কিন্তু সেজন্যে ছাত্ররাজনীতির মূলধারণা ভ্রান্ত হতে পারে না। দরকার এই লেজুড় বানানোর আইনের সংস্কার। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কোন সমাধান নয়। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন না থাকার ফলে কি অন্যায় অনিয়ম চলছে তার দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে- যদি তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকত তাহলে, তাদের বেতন বৃদ্ধিসহ আরো যেসকল দাবী দাওয়া, তা পূরণে মালিক ও সরকারপক্ষ বাধ্য হত। আমাদের দেশের দাবী আদায় বা সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্রই হল আন্দোলন। সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও একথা জানেন, তাই তাদের মনগড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সুবিধার্থে সরকার দৃশ্যত সবক্ষেত্রেই সংগঠিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে সচেষ্ট থাকে। শিক্ষাঙ্গন এর বাইরে থাকবে কেন? এর কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ, ২০০৮, যার ৯০বি (১)(বি)ধারায় নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে- “(b) In addition to comply with the terms and conditions referred to in clause (1), political party, desiring to be registered with the commission, shall have the following specific provisions in its constitution, namely⎯
(i) to elect the members of the committees at all levels including members of the central committee;
(ii) to fix the goal of reserving at least 33% of all committee positions for women including the central committee and successively achieving this goal by the year 2020;
(iii) to prohibit formation of any organization or body as its affiliated or associated body consisting to the teachers or students of any educational institution or the employees or labourers of any financial, commercial or industrial institution or establishment or the members of any other profession:
Provided that nothing shall prevent them from organizing independently in their respective fields or forming association, society, trade union etc. and exercising all democratic and political rights, and individual, subject to the provisions of the existing laws, to be a member of any political party.” পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার ২০০৯ সালে সংশোধিত আকারে এই অধ্যাদেশ “গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ, ২০০৯” আকারে অনুমোদন দিলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করেনি। তাই প্রয়োজন এসব আইন প্রয়োগে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা।
উপরের ধারাটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এখানে স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হবার অথবা সংগঠন, সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি করবার এবং সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা করবার এবং ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যমান আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হবার ক্ষেত্রে কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি। এটি আমদের সংবিধানের মৌলিক ধারণাগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আমাদের ২০০৬ সালের কৌশলপত্রের বদৌলতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ মতে ক্যাম্পাসে সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এটি আমাদের সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী, তাই আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। এতদসত্ত্বেও চলছে এই স্বেচ্ছাচার। যদিও এটি সরকারী দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে, কোন এক অজানা কারণে, কোন সময়েই প্রযোজ্য ছিল না। তাই মূল রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি যে কেবল ছাত্রসংগঠনগুলো করছে তা নয়- শিক্ষকরাও সমান তালে একই কাজ করছেন। এটি রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সুবিধাবাদের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়- তাই পরবর্তী ধাপের পচনরোধে সবারই সচেষ্ট হওয়া দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বেচ্ছাচারিতা যে কেবল শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার হরণ করছে তা নয়, এর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে জন্ম দিচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংস ঘটনার। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ ও সরকারী দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালায়। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের বেদখলকৃত আবাসিক হলগুলো পুনরুদ্ধারের ন্যায্য দাবী তুললে একই রকম হামলার শিকার হন। অতি সম্প্রতি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে বাঁধা দান এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে বলে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী হামলা আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়, যা বরাবরেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে উপেক্ষিত। উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এসব সুনির্দিষ্ট ফৌজদারি অপরাধ ঢাকতে অপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন, ফলে যা হবার তা-ই হয়- অপরাধের তদন্ত ও বিচার মুখ থুবড়ে পড়ে। পুলিশের বিষয়ে একটু আলাদা করে বলা দরকার- রাজশাহী কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়- দুটো ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি পুলিশ নগ্নভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপর হামলা চালিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশই উস্কানিদাতা হিসেবে কাজ করছে। পুলিশ বরাবরেই ক্ষমতাশালীদের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই তাদের চোখ কান অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধ রেখে কাজ করতে হয়। গত কদিনে এমন তর্কও শুনেছি যে, সমস্যায় না পড়লে কেউ আইন ঘেটে দেখে না। পুলিশও এর ব্যতিক্রম নন! এই যুক্তিকে মেনে নিলে দেশে আইনের শাসন বলতে আর কিছুই থাকে না। অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, “পুলিশ প্রবিধান, ১৯৪৩” এ বর্ণিত বিধি-বিধানসমুহ মানা হচ্ছে না। গুলি করার মত চরম একটি ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে পুলিশের যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার উপরের কোন পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার কথা সেখানে অধস্তনরাই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। গুলি চালানোর পর পুলিশের যে দুটি তদন্ত করার কথা তাতো হচ্ছেই না অনেক ক্ষেত্রে নির্বাহী তদন্তের যে বিধান আছে তা-ও উপেক্ষিত। সাধারণ শিক্ষার্থী কিংবা দেশের সাধারণ জনগণ এসব আইন জানেন না বিধায় খুব সহজেই তাদের উপর গুলি চালানো যায় এবং এর জন্যে কাউকে দায় নিতে হয় না। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হলও কার্যত এটি একটি কেতাবি কথা। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা শ্রেণীভেদে আচরনে বৈষম্য করে বিধায় সমান অধিকার চাওয়া বাতুলতা মাত্র। তাই পুলিশের গুলি, লাঠি, লাথি আর টিয়ারগ্যাস সমাজের এমন শ্রেণীর চোখে জল আনে যা উঁচুতলার মানুষগুলো সারা জীবনেও মুখোমুখি হননা, তা সে যত আইনই ভাঙ্গুক। শিক্ষার্থীরাও এই বৈষম্যের শিকার হন তারা জনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে, নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বলে। এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদেরই সচেতন হতে হবে- আওয়াজ তুলতে হবে। আইন বেদ পুরাণ নয়, মানুষের জীবন ন্যায়সঙ্গতভাবে নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্যেই আইন। তাই সেটি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তন তখনই আসে যখন সমাজে এর চাহিদা সৃষ্টি হয়। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলোতে সরকার জনকল্যাণের স্বার্থে নিজেরাই পরিবর্তন আনে আর অপরাপর রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণের চাপের মুখে পরিবর্তন আনে। তাই শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে- তারা কোনটির পরিবর্তন চান।
আবারও ফিরে আসি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রের আলোচনায়। জনগণের করের টাকায় সরকার কোন কোন খাতে ভর্তুকি দেবে আর দেবে না সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের হাইব্রিড গণতন্ত্রে সে সুযোগ কোথায়? যদি জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব থাকত তাহলে এটা নিশ্চিত যে, জনগণ তার দেয় করের টাকায় সমরবহর বৃদ্ধি কিংবা সেনা খাতে ব্যয় সংকোচন করত, শিক্ষা খাতে নয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতির কলকাঠি যারা নাড়েন তারা বেশ ভালই বোঝেন যে, উত্তর পাড়াকে চটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। অগত্যা সাধারণ জনগণেরই কপাল পোড়ে।
অভিযোগ আছে- যেসব শিক্ষক এই কৌশলপত্র প্রণয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের মধ্যে আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে মঞ্জুরি কমিশন ইতিমধ্যেই কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এই কৌশলপত্র প্রণয়নে “স্বার্থের সংঘাত” বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অবশ্য এ আর নতুন কি? বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনার সাথে জড়িত অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ভূমি ও আবাসন ব্যবসার সাথে জড়িত, যাদের মুখ্য উদ্দেশ্যই থাকে মুনাফা অর্জন। নগরের বা নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধা দেখা তাদের ব্যবসায় নীতির সাথে সংঘাতপূর্ণ। তারা ব্যবসা করেন মুনাফার জন্যে আর নগর পরিকল্পনা নগর ও তার নাগরিকের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস উপযোগী ব্যবস্থার কথা বলবে। এই পরস্পর স্বার্থ বিরোধী অবস্থান নিয়ে এসব আবাসন ব্যবসায়ীরা যখন আমাদের নগর পরিকল্পনা করেন তখন তারা কাদের সুবিধা চিন্তা করেন বা করবেন এটি বুঝতা অসুবিধা হয় না। “স্বার্থের সংঘাত” যাকে ইংরেজিতে বলে “Conflict of Interest” বহির্বিশ্বে একটি গুরুতর নৈতিক অবক্ষয়ের ব্যাপার। একে সর্বোচ্চ নৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করা হয় বলে এটি বিভিন্ন দেশে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়ে “স্বার্থের সংঘাত” এর ধারণা আজ বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশের আইন ব্যবস্থায় স্বীকৃত একটি বিষয়। সাধারণের সুবিধার্থে বিষয়টাকে আর একটু খোলাসা করি- এও ব্যবহার বহুবিধ হতে পারে- এটি হতে পারে কর্মক্ষেত্রে, ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে, যে কোন পেশাজীবীর আচরণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, এমনকি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দেখা যায়। উদাহয়ারণ হিসেবে ধরা যাক- আমরা মাঝে মাঝে শুনি মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি কোন একটি মামলা শুনতে বিব্রত বোধ করেছেন। এই বিব্রত বোধ তিনি অনেক কারণেই করতে পারেন, তবে যেটি প্রায়শ দেখা যায় তা হল- হয়ত তিনি আইনজীবী থাকা কালে বিবাদমান পক্ষদ্বয়ের কোন এক পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন, কিংবা মামলার বিসয়বস্তুর সাথে তাঁর কোন আত্মীয় জড়িত, বা মামলার ফলাফল থেকে তাঁর নিজের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিচারক হিসেবে তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারবেন না বা অন্তত প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে। দ্বিতীয় উদাহারণ হিসেবে ধরা যাক একজন আইনজীবী সব কিছু জেনে শুনে কোন এক পক্ষের মামলা পরিচালনার জন্যে গ্রহণ করলেন অথচ তিনি অপরপক্ষের বক্তব্য সমর্থন করেন, এটি তার পেশাগত বিধিবিধান ভঙ্গের পাশাপাশি স্বার্থের সংঘাতও সৃষ্টি করে। আইনজীবীদের পেশাগত স্বার্থের সংঘাত নিয়ে বিখ্যাত একটি মামলা “বোর্ডম্যান বনাম ফিপস” যা ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের হাউজ অফ লর্ডস আইনজীবীর বিপক্ষে রায় দেন তা একটি উল্লেখযোগ্য উদাহারণ হয়ে আছে। একইভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণ করবেন তাতে স্বার্থের সংঘাত থাকবে এটা সহজেই অনুমেয়। জনবিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি আরথের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় বা তাদের শিক্ষার মান ধরে রাখতে না পারে তবে শিক্ষার্থীরাতো ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকবে, এই ধারণা এইসব নীতি নিরধারকদের মাথায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কার্যত আমরা তা-ই দেখছি।
মঞ্জুরি কমিশনের দেয়া হিসেব মতে বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে অথচ ভারতে এই সংখ্যা ১১.৯, থাইল্যান্ডে ৩৭.৩ আর মালয়েশিয়াতে ২৯.৩ শতাংশ। আমাদের জনবিশ্ববিদ্যালয় আর দরিদ্রশ্রেণীর বিকাশ আজ সমার্থক। কেবল আর্থিক মানদণ্ডে যদি উচ্চশিক্ষাকে মাপা হয় তাহলে সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনের যে প্রত্যয় নিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা সুদুর পরাহতই রয়ে যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই- উচ্চশিক্ষাকে বানিজ্যকিকরণ না করে এই খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষক কেন একে অপরের মুখোমুখি হবে? তারা তো একে অপরের পরিপূরক হওয়ার কথা। আমাদের শিক্ষানীতিতে যে শুভংকরের ফাকি আছে তা আমরা বুঝি। প্রতি বছর শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের যে চিত্র তাতেও আমরা সন্তুষ্ট নই। এ ব্যয় বরাদ্দ দুই শতাংশ থেকে আট শতাংশে উন্নীত করা গেলে অনেক সমস্যাই তড়িৎ গতিতে সমাধান করা সম্ভব।
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
তথ্য সুত্রঃ
১। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অর্ডার, ১৯৭৩।
২। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩।
৩। জনপ্রতিনিধিতত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯।
৪। পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮।
৫। পত্রিকার রিপোর্ট- প্রথম আলো, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ, সমকাল, শীর্ষ নিউজডটকম।