ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ‘ভিয়েতনাম দিবস’ উপলক্ষে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলায় নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মতিউল ইসলাম এবং মীর্জা কাদেরুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর সেই প্রথম বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে প্রকাশ্যে ছাত্রহত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল। পুলিশ লাঠিপেটা বা টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ না করেই বিনা হুঁশিয়ারিতে এই গুলিবর্ষণ করে। প্রেসক্লাবের খুব কাছেই উল্টোদিকে এই গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে, পুলিশ ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। ছাত্রহত্যার সংবাদে সারা শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, ইট দিয়ে মতিউল-কাদের নিহত হওয়ার স্থানটি গোল করে চিহ্নিত করা হয়। হাজার হাজার মানুষ ওই স্থানটি এক পলক দেখার জন্য জড়ো হয়, গলিতে-গলিতে মানুষ মৌন মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে এ ঘটনা অভাবিত ছিল, গোপন হত্যা যিদো ছিল তখন বহুগুন বেশি, প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ তখনও শুরু হয়নি, আর নতুন দেশের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষার তখনো অবসান ঘটেনি।
কিন্তু মতিউল-কাদেরের মৃত্যু শুধু স্রেফ পুলিশের একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে নয়, এ ঘটনার ফলে ঘটে যাওয়া আরো কিছু ঘটনার কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশীশক্তির প্রদর্শনী, প্রগতিশীল শক্তির আপসকামিতা, রাষ্ট্রের পুলিশীকরণ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার অবসানের মতো অনেক পরবর্তী বৈশিষ্ট্যের সব লক্ষণ মতিউল-কাদের হত্যাকাণ্ডের পরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির মধ্যে পাওয়া যাবে। মতিউল-কাদের দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গূরুত্বপূর্ণ বাঁক।
৭ তারিখের প্রতিবাদ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়নি
২ জানুয়ারি, ১৯৭৩ এ ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু ছাত্রহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে সাত দফা দাবি উত্থাপন করে, যার মধ্যে ছিল ছাত্রহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও মন্ত্রীর অপসারণ ও শাস্তি প্রদান, বাংলাদেশে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র বন্ধ, দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ১ জানুয়ারির মিথ্যা প্রেস নোট প্রত্যাহার, দমনীতি বাতিলসহ আরো কিছু দাবি।
ন্যাপপ্রধান মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্য ঘটনার প্রতিবাদে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের এ বর্বরোচিত ছাত্রহত্যা ইয়াহিয়া- মোনায়েম স্বৈরাচারী সরকারের কার্যকলাপের নামান্তর। যে সরকার ছাত্র-জনতার রক্তে হাত কলুষিত করেছে, সে সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর সংগ্রামকে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দেশবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে খুনি আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করছি। সব দেশবাসী ভাইবোন, গণতান্ত্রিক শক্তি ও ব্যক্তির প্রতি আমাদের আহ্বান, ঐক্যবদ্ধভাবে এ সংগ্রামে এগিয়ে আসুন।’ ৩ জানুয়ারির সংবাদপত্র অনুযায়ী তিনি ঘোষণা করেন: নুরুল আমিনের সরকারের যে পরিণতি ঘটেছিল, শেখ মুজিবের সরকারের ভাগ্যেও সেই পরিণতি অনিবার্য।
৩ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা করেন, দরকার হলে আরো রক্ত দেব, তবু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবই। এ সভাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারের ঘোষণা দেন এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি ডাকসুর পক্ষ থেকে দেওয়া ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটিও প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন, এখন থেকে সেটি আর ব্যবহার করা যাবে না।
ন্যাপ (মোজাফফর) ও ছাত্র ইউনিয়ন এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এভাবে সরকার পতনের মতো চড়া কর্মসূচি দিলেও প্রধানতম মিত্র সিপিবির গলার স্বর অবশ্য বেশ নমনীয়ই ছিল, সরকারকে সম্পূর্ণ অযোগ্য ঘোষণা করলেও ৪ জানুয়ারির সংবাদে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রথম থেকেই তারা সমঝোতার মাধ্যমে সংকট এড়ানোর রাস্তাই গ্রহণ করে; তাদের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয় : ‘পহেলা জানুয়ারির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রদের হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনা, তৎপরবর্তী মিথ্যা সরকারি প্রেসনোট ও বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর শাসক দলের হামলা বর্তমান সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমরা মনে করি, সরকার পাকিস্তান আমলের মতো পিচ্ছিল ও দমননীতির পথে না গিয়ে এখনো পল্টন ময়দানে ঘোষিত ছাত্র সমাজের সাত দফা দাবি মেনে নিয়ে পরিস্থিতিকে জাতীয় স্বার্থে স্বাভাবিক করতে পারে।’ বলা প্রয়োজন ন্যাপ (মোজাফরর) ও সিপিবি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধানতম মিত্র।
সরকারী প্রতিক্রিয়াও খুব দ্রুতই শুরু হয়ে যায়, ৩ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের বিপরীত দিকে অবস্থিত মোজাফ্ফর ন্যাপের অফিসে হামলা হয়, তাদের নেতা-নেত্রীদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগকর্মীরা। শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সমাবেশে শেখ শহীদুল ইসলাম ঘোষণা করেন, ক্ষমা না চাইলে ন্যাপ মোজাফ্ফর ও ছাত্র ইউনিয়নের কোনো সমাবেশ বাংলার মাটিতে অনুষ্ঠিত হতে দেওয়া হবে না। সারা দেশে অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের ওপর। এ ঘটনায় দুখঃপ্রকাশ করার আদৌ কোনো লক্ষণ সরকারি মহলে দেখা যায়নি, বরং ৬ জানুয়ারি গোপালগঞ্জে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিদেশ থেকে যাতে কোনো সাহায্য না আসতে পারে সেই উদ্দেশ্যে ‘ওরা’ বিশ্বে বাঙালি জাতির মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন্ন করার চেষ্টা করছে।” প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায় এটাই পরিষ্কার হয় যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দলগত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা রক্ষা এবং উন্নয়নে সরকার ও সরকারি দল উদগ্রীব, ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে ছাত্রহত্যার বিষয়ে সরকার তাই এমনকি ঘনিষ্ঠতম মিত্রদেরও দমন করতে দ্বিধাহীন-বেপরোয়া।
৬ জানুয়ারি এক সাংবাদ সম্মেলন ডেকে ন্যাপের মোজাফ্ফর আহমেদ তাঁদের ৭ তারিখের প্রস্তাবিত জনসভা বাতিলের ঘোষণা দেন। সরকার সমর্থিত বাংলার বাণী বিশেষ ঔদ্ধত্যের পরিচয় দেয় কমরেড মোজাফফর আহমেদ ‘ভয় পেয়েছেন’ এমন ইঙ্গিতপূর্ণ শ্লেষ করে। এই সংবাদ সম্মেলনে কমরেড মোজাফফর ছাত্রহত্যার বিচার বা ভিয়েতনামের প্রসঙ্গটি আর উত্থাপন করেননি। একই দিন কমিউনিস্ট পার্টি কার্যালয় থেকে বলা হয়, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী, চীনা ও পাকিস্তানি চররা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে; মস্কোপন্থী এই নেতারা নানা মহলে তদব একটি আপসের চেষ্টা করেন এবং ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পান। তাঁরা আপসের শর্ত হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করবেন না, এমন গুজব প্রচারিত হয়। সেটা সত্যি কি না তা জানা না গেলেও ৭২-৭৫ এই শাসনামলে মতিউল-কাদেরের প্রাণদান প্রসঙ্গটি মস্কোপন্থীদের দিক থেকে আর উত্থাপিত হয়নি।
স্বাধীন সাংবাদিকতার অবসান
১ জানুয়ারির ঘটনা নিয়ে দৈনিক বাংলা পত্রিকা একটি তাৎক্ষণিক টেলিগ্রাম বের করে, সেখানে সরকারের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করা হয়। এই টেলিগ্রাম বের করার দায়ে দৈনিক বাংলার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান এবং সম্পাদক তোয়াব খান চাকরি হারান। দৈনিক বাংলার কর্মচারীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ দুজনের চাকরি পুনর্বহালের দাবি জানালে তিনি তা করেননি, ৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহীদুল ইসলাম পল্টন ময়দানে বলেন, ‘দৈনিক বাংলা থেকে দুজন পাকিস্তানি দালালকে অপসারণ করা হয়েছে।’ সেই সংবাদ ছাপা হয় ৬ জানুয়ারির দৈনিক বাংলাতেই। ওই সমাবেশে শেখ শহীদ অন্যান্য পত্রিকা থেকেও কথিত এই ‘দালাল’দের অপসারণ না করা হলে ছাত্রলীগের অভিযানের হুমকিও প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজপথে পুলিশের গুলিবর্ষণে ছাত্রহত্যা নিশ্চিতভাবেই অচিন্ত্যনীয় ছিল সাংবাদিকদের কাছে, মুক্ত বাংলাদেশে তাঁরা যে পাকিস্তান আমলের মতো প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেননি, সেটা তাঁদের তৎপরতায় স্পষ্ট। চাকরিচ্যুতি আর অভিযানের হুমকি অবশ্য তাঁদের অচিরেই বাস্তব জগতে নিয়ে এল, স্বাধীন সাংবাদিকতার বেলায়ও যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই সমূলে বহাল থেকে গেছে, সেটা তাঁরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন। বস্তুত এ ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো, তার ধারাবাহিকতা পরবর্তীকালের সাংবাদিকতার জগৎকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে, সৎ-সাহসী সাংবাদিকতার বদলে পদলেহনই ক্রমেই পরিপুষ্ট হয়েছে। তোয়াব খান পরে যথাযথভাবেই পুনর্বাসিত হন, কিন্তু হাসান হাফিজুর রহমান ক্ষমা প্রার্থনা না করায় তাকে অনেকটা নির্বাসনে যেতে হয়, পরবর্তীতে হাসান এই শাস্তিকে শেকড় থেকে উপড়ানো বলে মন্তব্য করেন।
রুশ-মার্কিন-ভারত সংযোগ
বহুল প্রচারিত হলেও বাংলাদেশে সোভিয়েত স্বার্থ আসলে খুব কমই ছিলো, প্রত্যক্ষ স্বার্থ যা ছিলো তা মূলত ভারতের। অন্যদিকে শুধু ছাত্রলীগের পিটুনি বাহিনীর মুখে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলো, সেটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওই একই সময়ে অন্যান্য কমিউনিস্ট দল ও জাসদ প্রবল নিপীড়নের মধ্যেও রুখে দাঁড়িয়েছিল; শুধু তা-ই নয়, তাদের বিকাশও ঘটছিল দ্রুত। কাজেই পরিস্থিতির মোড় বোঝার জন্য আমাদের ন্যাপ-সিপিবির আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। ভারত বিশ্বরাজনীতির সেই সময়ে ছিল সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তার একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সব সময় বহাল ছিল। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ সোভিয়েত ইউনিয়নের আজ্ঞাবহ থাকায় ভারত সহজেই দল দুটিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে বাধ্য করে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব-নিকাশে ভারতকে নিজ বলয়ে রাখার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নও অনুকূলে নবীন এই রাষ্ট্রটির সব ভবিষ্যৎ বলি দেয়, ন্যাপ-সিপিবিও তার শিকার হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের প্রসঙ্গটির জটিলতা কে সরলীকৃত করে দেখারও সুযোগ খুব সেই, ওই একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও গভীর এক মিত্রতার বন্ধনে তারা ছিল। কিন্তু সেটা অন্য আলোচনা।
সে সময়কার সিপিবির বহু দলিলপত্রে তাই দেখা যাবে যে কোনো ঘটনাকে তারা বিচার করার ক্ষেত্রে রুশ-ভারত মৈত্রীর বিষয়টির বিবেচনাই প্রথমে করত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কাগমারী সম্মেলনের পর থেকেই মার্কিন বলয়ের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দল, ঐতিহাসিকভাবেই তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা যে তীব্র মার্কিন বিরোধিতা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচকতার জন্ম দিয়েছিল, তার ফলে আওয়ামী লীগ রুশ বলয়ে অবস্থান নিতে বাধ্য হলেও তার ঐতিহ্যিক নাড়ির বন্ধন তাকে ক্রমেই আবারও মার্কিনিদের দিকেই ধীরে হলেও টেনে নিয়ে আসছিল। মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণকে তাই এই জটিল পরিস্থিতিতে একদিকে জনগণের মধ্যে ধূমায়িত ক্ষোভের প্রতি সাড়াও দিতে হয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নির্যাতক চরিত্রকে শেষ পর্যন্ত মেনেও নিতে হয়েছে ভারতীয় চাপে রুশ-আনুগত্যের কারণে। রাজনীতির এই সমীকরণে সব সময় লাভবান হতো ভারত, সদ্য স্বাধীন দেশটি ছিল তার সস্তা কাঁচামালের উৎস, শিল্পপণ্যের বাজার এবং এই বাজারে আধিপত্য ও লুণ্ঠন চালানোর প্রয়োজনে দেশীয় শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলে তারা।
এই জটিল আবর্তেই মতিউল-কাদের হত্যাকাণ্ড, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম ছাত্রহত্যা (ছাত্রহত্যার আলাদা রাজনৈতিক তাৎপর্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবেই আছে, জনগণের অপরাপর অংশে হত্যার সংবাদ এটি প্রথম নয়, সেই যুগের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে শাহরিয়ার কবীর রচিত ওদের জানিয়ে দাও গ্রন্থটি) চাপা পড়ে গেল। মতিউল-কাদেরের সংগঠন অচিরেই তার দায় পরিত্যাগ করে, শুধু তা-ই নয়, অবিলম্বে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ত্রিদলীয় ঐক্যজোটে তারা অন্তর্ভুক্ত হয়, যার একটি প্রধান অঘোষিত কাজ ছিল অন্য বিরোধী দলগুলোকে দমন। এর পর থেকে তারা আর কখনোই পুরো আওয়ামী লীগের আমলে বড় ধরনের বিরোধিতায় যায়নি শুধু নয়, ওয়ালিউর রহমান (লেবু ভাই) ও কমলেশ বেদজ্ঞর মতো তাদের জাতীয় স্তরের নেতা হেমায়েত বাহিনীর হাতে খুন হলেও এই মৈত্রীতে খুব একটা চিড় ধরেনি। বরং যে দলগুলো ওই সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করছিল, তাদের বিরোধিতাই তার প্রধান রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায়। এরই একটা ধ্রুপদী উদাহরণ পাওয়া যাবে জাসদের ঘেরাও মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় তাদের বক্তব্যে : ‘সুপরিকল্পিতভাবে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনা সৃষ্টির রাজনীতি করিয়া আসিতেছিল…এই অবস্থায় আইনরক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেন।’
মতিউল-কাদের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অসংখ্য রাজনৈতিক শহীদের দুজন মাত্র। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুবরণ যে জটিল চক্রাবর্তের উন্মোচন করে, সেটা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি আজও বেরোতে পারেনি।
মতিউল কাদের পরবর্তী ছাত্র রাজনীতি
আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতির একটা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, এবং সেটার ধারাবাহিকতা যদি আমরা স্মরণ রাখি, বিশেষ করে ডাকসু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশের একটা সূচক হিসেবে খুব কার্যকর ছিল, অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনগুলোও কমবেশি রাজনৈতিক জাতীয় বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই সক্রিয় ছিল। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে প্রগতিশীল শক্তি ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসুতে বিজয়ী হয়, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও মাহবুব জামান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপরেই “পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন-মুজিববাদী ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়েছিল। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ। নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল লেনিন-গামা যৌথ পরিষদের। তখন পরাজয়ের বেদনা ও গ্লানি মুছতে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালটবাক্স হাইজ্যাক করা হয়েছিল।” (আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুজ্জান মান্নার ৪ জানুয়ারি ২০১২, প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত) সম্ভবত এই প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে এই যে, যাদের ভরাডুবি হয়েছে বলা হচ্ছে, তাদের একটা সংগঠন স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগে ডাকসুতে ছিল, অপরটি স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী প্রথম ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা যাদের বিপুল হারে ভোট দিয়েছিল, ডাকসুতে যারা বিজয়ী হতে যাচ্ছিল, তারা সেই তুলনায় ছাত্রলীগেরই একটা বিদ্রোহী অংশ, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যারা নতুন আকাঙ্ক্ষায় জারিত হয়েছে এবং সেই স্বপ্ন অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। খুবই সম্ভব যে, মতিউল-কাদের ভিয়েতনাম দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, এবং এই ঘটনার প্রতিবাদ করে ছাত্র ইউনিয়ন দেশজুড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার সম্মুখীন হয়; এরপরও ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ প্যানেল শিক্ষার্থীদের অবিশ্বাস উদ্রেক করেছিল, আওয়ামী ছাত্রলীগ ভোট পায়নি স্রেফ তার মুক্তিযুদ্ধোত্তোর নিপীড়ক ভূমিকার জন্য, ছাত্র ইউনিয়ন পায়নি ছাত্রলীগের সাথে জোট বাধার জন্য। এরপর আওয়ামী লীগের ওই আমলে আর কোন ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন সঙ্গতকারণেই করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানের একচেটিয়া দখলদারিত্বের এই চেহারা স্বাধীনতার আগে দেখা যায়নি। পাকিস্তান আমলের এনএসএফের গুন্ডামি সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের একটা প্রতিরোধী মনোভাব সর্বদাই ছিল। কিন্তু, কমলকুমার মজুমদারের সেই গল্পের মত– বাঁচার জন্য রামনাম জপি, রামই যখন মারেন, তখন আর কার নাম নেই— স্বাধীনতাউত্তর কালটিতে অচিরেই স্থায়ী ছাত্রাবাস দখলের রাজনীতি শুরু হয়। ’৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে আর কোন ডাকসুর আয়োজন করা হয়নি, বরং মনোনীতদের হাতে শিক্ষাঙ্গন ইজারা দেয়া শুরু হয়। আবারও উদ্ধৃত করি: (সোহরাব হাসান,৩০-০৪-২০১১, প্রথম আলো) “মুহসীন হলের এ ঘটনা ৩৬ বছর আগের আরেকটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। ১৯৭৪ সালে এই মুহসীন হলেই ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাতজনকে হত্যা করেছিল ব্রাশফায়ারে। সেই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি ছিলেন শফিউল আলম প্রধান, তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বিচারে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান তাঁকে সসম্মানে জেলখানা থেকে বের করে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। সেই থেকে এককালের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক জিয়া-খালেদার আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছেন এবং সুযোগ পেলেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষবাণ ছুড়ছেন। ছাত্রলীগ করার সময় প্রধানরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বাইরের সবাইকে দেশদ্রোহী মনে করতেন। অন্য সংগঠনের কর্মী কিংবা সাধারণ ছাত্রদেরও ছাত্রলীগের মিছিলে যেতে বাধ্য করতেন। ছাত্রলীগ প্রধানকে ত্যাগ করলেও তাঁর আদর্শ ত্যাগ করেনি। কয়েক মাস আগে ফজলুল হক হলে সংগঠনের মিছিলে যোগ না দেওয়ার শাস্তি হিসেবে বেশ কিছু ছাত্রকে তাদের আশ্রয়স্থল অতিথিকক্ষ থেকে মধ্যরাতে বের করে দিয়েছিল ছাত্রলীগ হল শাখার নেতৃত্ব। ১৯৭৪-এ সাত খুনের আসামি না হলে প্রধান এখন আওয়ামী লীগই করতেন এবং বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলতেন। যাক, সাত খুনের বিনিময়ে কিছু জিহ্বা তো রক্ষা পেল!”
(২০১২ সালের জানুয়ারিতে কালের কণ্ঠের রাজনীতি পাতায় প্রকাশিত; সামান্য সম্পাদিত ও পরিবর্ধিত)
ফিরোজ আহমেদ,
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ,গণসংহতি আন্দোলন