এই ভয়ঙ্কর নারকীয় ঘটনার মুখে দাঁড়িয়েও শান্ত হতেই অনুরোধ করবো। আমাদের দেশে আমাদেরকে যে কোন নিপীড়কের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, সহিষ্ণু সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের যে যেখানে যে পরিচয়ে নিপীড়িত সেখানে তার সেই পরিচয়ের পক্ষেও দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশে কেউ হিন্দু হিসেবে, বৌদ্ধ হিসেবে, কিংবা স্রেফ ভিন্ন বিশ্বাসের কারণে কেউ আক্রমণের শিকার হলে তার পক্ষে দাঁড়ানো হলো ইনসাফ। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেয়া নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না, যায় না। এটা হলো গণপিটুনির হাত থেকে সকলকে রক্ষা করবার রাষ্ট্রনৈতিক দিক। এই ন্যূনতম ঐক্যটুকু ছাড়া এই রকম হত্যাকাণ্ড কিংবা আক্রমণ বারবার ঘটাবার ক্ষেত্র তৈরি হবে। আক্রমণকারীর সংখ্যা যত জন হোক, তাদের উন্মত্ততা যত তীব্রই হোক, আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্ষায় শক্তি ব্যবহার করতে হবে, সম্ভব হলে কম শক্তি ব্যবহার করেই তাকে উদ্ধার করতে হবে, এইটুকু রাষ্ট্রনীতির অংশ হতে হবে।
গণপিটুনিতে মানুষ হত্যার জনমনস্তত্বের একটা বড় উৎস হলো আইন শৃঙ্খলার ওপর মানুষের কোন আস্থা না থাকা। রুটি চুরি থেকে ধর্ম অবমাননা, যে কোন অভিযোগেই কাউকে খুন করে ফেলা সম্ভব, যদি স্থানীয় মানুষেরা মনে করে বিচার করাটা তাদেরই এখতিয়ার। বাংলাদেশের আমজনতা এই গনপিটুনির মনস্তত্বে এখন দেশটার ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ঙ্করতম অবস্থানে আছে। যে প্রশাসের ভাবমূর্তি আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্তের, তারা কি উন্মত্ত হয়ে ওঠা জনতার মুখোমুখি হবার মানসিক শক্তি রাখেন? না রাখলে এই রকম ঘটনা হয়তো আরও বৃদ্ধি পাবে ভবিষ্যতে।
জনমনস্তত্ব নিয়ে আরও একটা পর্যবেক্ষণ বলি। মানুষ যদি রাজনৈতিক মত প্রকাশ না করতে পারে, যদি জানে যে তার মতের কোন দাম নাই, কিংবা তার মতামতের জন্য গুম খুন থেকে শুরু করে আইনী হয়রানির মুখোমুখি হতে হবে, তখন তাদের একটা বড় অংশেরই মনোজগত এমন রন্ধ্রে সহজে প্রকাশিত হবে, যেখানে রাষ্ট্র অসহায় বোধ করবে, যেখানে সে নিজেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মনে করবে। পিটিয়ে হত্যার এটাও একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি। আইনশৃঙ্খলার ওপর অনাস্থার সাথে যদি যুক্ত হয় রাজনীতিহীনতা, এই বিকারগ্রস্ততা আরও বহুগুন বৃদ্ধি পেতে থাকবেই।
ষড়যন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ করছি না। উড়িয়েও দিচ্ছি না। কিন্তু এই ঘটনা বাংলাদেশের ঠিক সেই ভাবমূর্তি তৈরি করবে, যেটা বাংলাদেশের শত্রুরা চায়। যেটা দেখাতে পারলে তাদের বিরাট উপকার। এই রকম ঘটনা আমরা আর একটাও ঘটতে দিতে পারি না, তার প্রধান কারণ এটা নৃশংস, বর্বর কিংবা অমানবিক। কিন্তু গৌণ কারণ এটাও যে, এটা আমাদেরকে এমনকি সারা পৃথিবীর সাথে সম্পর্কেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে এইসব ঘটনা রাষ্ট্র ঠেকাতে পারবে না, বরং দিনকে দিন আরও অসহায় হতে থাকবে। কারণ মানুষের সামনে দাড়াবার কোন নৈতিক শক্তি তার নাই। এই সব ঘটনা প্রতিরোধের দায় তাই সাধ্যমত আপনাকে-আমাকেই অনেকখানি নিতে হবে।
লেখকঃফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন