( সম্পাদকের নোটঃ ২০১৪ সালের জুলাই মাসে গণসংহতি আন্দোলনের বর্তমান নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এই নোট প্রকাশ করেন, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই লেখা অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় প্রাসঙ্গিক আকারে হাজির হয়েছে )
বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আমার চেনা কারও অভিজ্ঞতাই খুব সন্তোষজনক নয়। ভুল চিকিৎসা, বিপুল ব্যয়, সরকারি হাসপাতালে চাহিদার তুলনায় চিকিৎসার অপ্রতুল ব্যবস্থা, নানা ধরনের হয়রানি, অপ্রয়োজনীয় ওষুধের লিস্টি ধরিয়ে দেয়া, অধিক দামের ওষুধ, নকল ওষুধ, ডাক্তার-ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর যোগসাজসে পকেট ফাঁকা হওয়া এগুলো আমাদেও নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রশ্নটা যেহেতু জীবন-মৃত্যুর কাজেই তার পরেও আমাদের চিকিৎসার জন্য যেতে হয়। আমরা যাই এবং সবকিছু দেখেশুনে রাগ হয়, সবকিছুর ওপর অশ্রদ্ধা চলে আসে। প্রতারিত বোধ করি। কিন্তু তারপরও অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়। আর এই অসহায়ত্বের ওপর ভর করেই গড়ে ওঠে ব্যবসা, ফুলে ফেঁপে ওঠে মুনাফা। রাষ্ট্রের দিক থেকে আমাদেও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি কালো অক্ষর হয়ে আমাদেও দিকে ঠাট্টার হাসি হাসে। সেবার পরশ নয় বরং মুনাফার আঁচটাই জনগণের গায়ে লাগে। তারপরও সাফল্যের, উন্নয়নের বয়ান শেষ হয় না। চারপাশে যাকেই জিজ্ঞেস করি তাদেও প্রায় প্রত্যেকেরই এ বিষয় নিয়ে বলবার মত অনেক অভিজ্ঞতা জমা হয়ে আছে। আর সেই অভিজ্ঞতাগুলো অসহায়ত্বের, অব্যবস্থাপনার, প্রতারণার, হাসিমুখে সেবা গ্রহণের নয়। কিন্তু মন্ত্রীদের আত্মবিশ্বাসী পরিতৃপ্ত মুখ, আর নানা পরিসংখ্যান দেখে সন্দেহ হয়, যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমরা হচ্ছি তা সত্যি, না উন্নয়নের যে বয়ান আমরা শুনছি তাই সঠিক। নিজের অভিজ্ঞতাকেও সন্দেহ করতে হয় কেননা অনেক সময় তো এরকম হয়েই থাকে যে আমরা গাছ দেখতে গিয়ে বনটা আর দেখতে পাই না। হয়ত এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে! সেটা একটু বুঝে দেখার চেষ্টা করব আমরা এখানে।
একটা বিষয় হয়ত অনেকেরই নজরে পড়ে না যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোন আলোচনার শুরু হয়ে থাকে চিকিৎসা দিয়ে আর শেষও হয় তাই দিয়ে। অথচ রোগের অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত নিরোগ থাকা নিশ্চিত করা। সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পরও রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে তা থেকে উত্তরণের প্রশ্নটা আসার কথা পরবর্তী বিবেচনার বিষয় হিসাবে। অথচ আমরা করছি তার বিপরীতটা। এই বিপরীত করাটা কোন অসচেতন প্রক্রিয়া কিংবা অজ্ঞতার ফল নয়। স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের যে খন্ডিত ধারণা তৈরি করা হয় তার সাথে যুক্ত একটা বিশাল বাণিজ্য। ওষুধ কোম্পানি, বিভিন্ন ডাক্তারী যন্ত্রপাতি কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের ব্যবসা আছে এই ধারণার পেছনে। এক কথায় গোটা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথেই মোটা মুনাফার প্রশ্নটা যুক্ত। বিপরীতে নিরোগ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের নিশ্চয়তা তৈরি করা, কিংবা ভেজাল- বিষমুক্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা তৈরির সাথে যুক্ত মুনাফার হ্রাস। ফলে আমাদের স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা এক করে ফেলার ভেতরে একটা মুনাফার স্বার্থ যুক্ত আছে। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গার জন্যই সত্য। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই এই মুনাফার লাগাম টেনে ধরার একটা ব্যবস্থা আছে। মুনাফা যাতে জনগণের জীবনকে জিম্মি করে ফেলতে না পারে সেটার জন্য ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্র এ বিষয়ে টাকা খরচ করে, একে একটা সেবা হিসাবে, জনগণের অধিকার হিসাবে বিবেচনা করে। সেখানেও চিকিৎসা মুনাফার যোগান দেয়, কিনতু তার একটা সীমা আছে । মুনাফাটা সেখানে একটা ব্যবস্থার অর্ন্তগত, আমাদের দেশের মত যার যেভাবে ইচ্ছা লুটেপুটে খাবার স্বাধীনতা সেখানে নাই। অর্থাৎ আমরা মরছি দুই দিক থেকেই এবং ব্যবস্থার দ্বারা এবং অব্যবস্থার দ্বারা।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যখাতে নানা দুর্নীতি অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে টিআইবি পরিচালিত এক গবেষণায়। সেখানে বলা হয়েছে, ”দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা এতোটাই বেহাল যে একজন ডাক্তারের বিপক্ষে সেবা গ্রহীতার সংখ্যা ৩২৯৭ জন। অথচ বশ্বি স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লউিএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী ডাক্তার ও রোগীর অনুপাত হওয়ার কথা ১ : ৬০০ জন। স্বাস্থ্য খাতরে এই নাজুক দশার প্রধান একটি কারণ হলো এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না দেয়া। স্বাস্থ্য খাতে আর্ন্তজাতিক মান অনুযায়ী জিডিপির পাঁচ শতাংশ ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যয় হচ্ছে দশমিক ৮৪ শতাংশ। এবং এ খাতে বরাদ্দ দিন দিন কমছে। এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অনয়িম র্দুনীতরি তথ্য রয়েছে। তথ্যানুযায়ী, ডায়াগনস্টকি সেন্টার থকেে চিকিৎসকরা ৩০ থকেে ৫০ শতাংশ কমশিন নিয়ে থাকেন। আর দালালরা নিয়ে থাকেন ১০ থকেে ৩০ শতাংশ।” ডায়াগনস্টকি সেন্টার ও চিকিৎসকদের মধ্যকার কমশিন বাণিজ্য সবার জানা। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতাল থকেে বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে নেয়া, প্রত্যন্ত জনপদে সরকারি ডাক্তারদরে র্কমস্থলে না থাকা, ঠিকমতো দায়ত্বি পালন না করা- এসব তথ্যও জানা।
প্রতিবেদন বলছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি পদায়ন ও পদোন্নতি র্সবত্রই অনয়িম দুরনীতিতে ছেয়ে গছে। যে কোনো টেন্ডার বা ছোটখাটো যে কোন কাজরে জন্যও গুনতে হয় ঘুষ। এক্ষত্রেে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থকেে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা র্পযন্ত ঘুষ দিতে হয় ভুক্তভোগীদের। স্বাস্থ্য অধদিপ্তর, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা এ অর্থ নিয়ে থাকেন। পদোন্নতির ক্ষেত্রে জেষ্ঠতা লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত রয়ছে। টিআইইবি বলছে, নভেম্বর-২০১৩ থকেে আগস্ট-২০১৪ র্পযন্ত সময়ের দেশের ৬৪টি জেলায় গবষেণার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচ্য প্রতবিদেনটি প্রণয়ন করা হয়ছে। এতে আরাে বলা হয়, উপজেলা পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার নিয়ম থাকলওে চিকিৎসকদের অনকেইে কর্মস্থলে নিয়মতি যান না। জেলা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে অধিকাংশ চিকিৎসক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্মস্থলে থাকেন না। রােগীকে ব্যাক্তিগত চেম্বার বা ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন স্বয়ং চিকিৎসকরা। রােগীর একটা বড় অংশ ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে বেড পায় না। এক্ষত্রেে অনয়িম, দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া ও রাজনতৈকি প্রভাব খাটানাে হয়ে থাকে।
গবষেণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে পদােন্নতির ক্ষেত্রে চাকররি অভিজ্ঞতা, জেষ্ঠতা ও উচ্চতর শিক্ষাগত যােগ্যতাকে বিবেচনা করা হয় না। এছাড়া প্রকাশনাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন, সিনিয়র স্কুলে পরীক্ষায় পাস বা বার্ষিক গােপনীয় প্রতিবেদনে সন্তোষজনক কি না, তা-ও সব ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। এতে কােন কােন ক্ষেত্রে রাজনতৈকি প্রভাবকে প্রাধ্যান্য দেয়া হয়ে থাকে।
” টিআইবির এই প্রতিবেদন নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন সবাই স্বাস্থ্যখাতের উন্নতির প্রশংসা করলেও একা টিআইবিই নাকি সমালোচনা করছে। মন্ত্রীর কথিত এই প্রশংসাকারীরা আর যেই হোক এদেশের সাধারণ নাগরিকরা যে নন সেটা নিশ্চিত। আমাদের অভিজ্ঞতা বরং বলছে তাদের এই রিপোর্ট সত্য কিন্তু আংশিক চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষত ওষুধ নিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতি এই প্রতিবেদনে প্রায় অনুপস্থিত। বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল ওষুধের কারখানা আবিষ্কার এর খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকায় দেখে থাকি। এর সাথে মোড়ক বদলিয়ে এক ওষুধকে অন্য নামে চালিয়ে দেয়া, যথার্থ মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকা, যখন তখন ওষুধের দাম বৃদ্ধি, বিকল্প ওষুধের নামে প্রতারণা ইত্যাদির সাথে সাথে ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির যোগসাজসের এক ভয়ঙ্কর চক্র গড়ে ওঠার বিষয়ে একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকাল পত্রিকায়। এই যোগসাজসের প্রক্রিয়াটা কীভাবে চলে তার একটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এক রিপোর্টে ”মেডিকেল প্রমোশন কর্মীদের মাধ্যমেই একশ্রেণীর চিকিৎসকের কাছে উৎকোচ ও উপঢৌকন পৌঁছে দেয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। উৎকোচ ও উপঢৌকন গ্রহণকারী চিকিৎসকরা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে সুবিধাদানকারী কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কি-না তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারাদারের ভূমিকায় পাঠানো হয় মেডিকেল প্রমোশন কর্মীদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মেডিকেল প্রমোশন কর্মী বলেন, চিকিৎসকদের ভিজিটের উদ্দেশে তিনি মোটরসাইকেলে করে দুটি ব্যাগ ও দুটি হেলমেট নিয়ে বের হন। প্রথমে মোটরসাইকেলটি কোনো একজন চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে রেখে জানান দেন যে, তিনি এখানে আছেন। পরে ব্যাগ দুটি রাখেন অন্য দু’জন চিকিৎসকের জিম্মায়। হেলমেটগুলোর একই গতি করেন। সবশেষে নিজে গিয়ে হাজির হন অন্য কোনো চিকিৎসকের সামনে। এভাবে একাই তিনি ছয় জন চিকিৎসককে পাহারা দেওয়ার কাজ করে থাকেন।
সরেজমিনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, রোগীরা চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বের হওয়ার পথেই মেডিকেল প্রমোশন কর্মীরা তা দেখার চেষ্টা করেন। কোনো চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে তার কোম্পানির ওষুধ না লিখলে সঙ্গে সঙ্গে তারা ওই চিকিৎসকের কাছে অনুযোগ নিয়ে হাজির হন। চিকিৎসকদের টার্গেট করে ওষুধ বাজারজাতকরণে মেডিকেল প্রমোশন কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে এ পন্থা অবলম্বন করে আসছেন। চিকিৎসকভেদে উপহার ও উপঢৌকনে তারতম্য করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। নামিদামি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যারা দিনে গড়ে ৫০ থেকে ৭০ জন রোগী দেখেন, তাদের স্যাম্পল ওষুধ ও প্রতি সপ্তাহে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়। কোম্পানিগুলোর তালিকায় এই চিকিৎসকদের ‘এ’ গ্রেডে রাখা হয়। দিনে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী দেখেন এমন চিকিৎসকদের ‘বি’ গ্রেড বলে বিবেচনা করা হয়। তাদের স্যাম্পল ওষুধ এবং প্রতি সপ্তাহে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়। দিনে ১০ থেকে ১৫ জন রোগী দেখেন এমন চিকিৎসকদের ‘সি’ গ্রেডে রাখা হয় এবং তারাও স্যাম্পল ওষুধ ও সপ্তাহে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পান। তবে এর বাইরেও রয়েছে বিশেষ একটি গ্রেড এবং ওই গ্রেডে রাখা হয় দেশব্যাপী যাদের সুনাম ও খ্যাতি আছে, সেই সব চিকিৎসককে। তাদের মাসে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকাও দেওয়া হয়ে থাকে। এর বাইরে দেওয়া হয় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ। কোনো কোনো চিকিৎসককে উপঢৌকন হিসেবে গাড়ি কিনে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে রাজধানীর একটি বিশেষায়িত ও একটি জেনারেল হাসপাতালের দু’জন পরিচালককে ৫০-৬০ লাখ টাকা দামের দুটি গাড়ি কিনে দিয়েছে একটি ওষুধ কোম্পানি। নামিদামি চিকিৎসকদের কাছে ঘেঁষতে না পেরে মাঝারি ও ছোট কোম্পানিগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাতুড়ে চিকিৎসক এবং ওষুধের দোকানকে টার্গেট করে ওষুধের বিপণননীতি গ্রহণ করেছে। হাতুড়ে চিকিৎসক ও দোকান মালিকদের নগদ অর্থ ও উপঢৌকন দিয়ে ওষুধ বিপনণ করে এ কোম্পানিগুলো। প্রত্যন্ত, গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি গার্মেন্ট পল্লী ও বস্তি এলাকায় এসব কোম্পানির ওষুধ বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। ”
আর এই প্রক্রিয়ার সরাসরি শিকার হন রোগীরা। ডাক্তাররা এখন অনেক বেশি ওষুধ লেখেন ব্যবস্থাপত্রে, অনেক বেশি পরীক্ষা দেন। এমনকি একই পরীক্ষা কিছুদিন আগে করা থাকলেও আবারো দেন। নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম লিখে দেন অথবা মৌখিকভাব নির্ধারণ করে দেন। ওষুধের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক নাম ব্যবহার না করে জেনেরিক নাম ব্যবহার করার রীতি অন্যান্য বহু দেশে থাকলেও আমাদের দেশে তা একেবারেই অনুপস্থিত। আর সেটা করতে আইন করতে গেলে কায়েমী স্বার্থে যে আঘাত লাগবে তা দেবার সাহস কিংবা সংকল্প আমাদের সরকারের আছে বলে মনে হয় না।
এর বাইরেও রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। বড় শহরগুলোর বাইরে কোন জটিল রোগের চিকিৎসা দূরে থাক রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও অনুপস্থিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড়সড় রোগের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরে আসা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। সেখানে এসে সরকারি হাসপাতালে জায়গা হয় না অনেকেরই। তাদের পড়তে হয় দালাল আর বাণিজ্যের খপ্পরে। এমনকি টাকা খরচ যারা করতে পারেন তারাও যে সঠিক সেবা পান তেমনটি নয়। দুর্ব্যবহার, রোগীর প্রতি যথার্থ মনোযোগ না দেওয়া, ভুল চিকিৎসা, অপারেশনের সঠিক ব্যবস্থাবলি গ্রহণ না করা, ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়া দিন দিন বাড়ছে। আর প্রায় কোন ডাক্তারই এখানে রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে তেমন কিছু জানান না, রোগীরা থাকেন অন্ধকারে। ফলে যাদেও আর্থিক সঙ্গতি আছে তারা দেশে চিকিৎসা না করে চলে যান দেশের বাইরে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণ হলো চিকিৎসা। যে মন্ত্রী- এমপিরা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তাদের কিংবা তাদের পরিবারের দেশে চিকিৎসা গ্রহণের উদাহরণ বিরল। এভাবে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের ফলে এদেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থেও একটা অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশে।
আর সামগ্রিকভাবে এই খাতে দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং এক নৈরাজ্যিক লুটপাটের মাধ্যমে মুনাফা তৈরির প্রবণতা জারি আছে। সরকার এই খাতকে অথবা জনগণের স্বাস্থ্য অধিকারকে কতটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন তা এই খাতে তাদের অর্থ বরাদ্দের ধরন দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে যেখানে জিডিপির ১ ভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এই খাতে বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে কমে তা এসে দাঁড়িয়েছে ০.৮৪ভাগ। অথচ আর্ন্তজাতিক ভাবে স্বীকৃত ৫ভাগে পৌঁছতে গেলে তা আমাদেও দিনে দিনে বাড়ানো দরকার ছিল। অর্থাৎ আমরা চলছি উল্টো দিকে। সম্ভবত মন্ত্রীর দাবি নয় আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাই সত্য; তথ্যও তাই বলছে। আর এই বেপরোয়া মুনাফার লোভে যেভাবে খাবারে ভেজাল, বিষ মেশানো চলছে, যেভাবে কীটনাশক, রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে জমিতে, যেভাবে মাটি, পানি , বাতাস দুষিত হয়ে পড়ছে তাতে মানুষ আরও বেশি করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বদলে অসুস্থ মুনাফার কবলে পড়া অসুস্থ ব্যক্তি বানাচ্ছে তাদের। অনেকেরই মনে থাকবে একসময় চিকিৎসার সাথে হাওয়া বদল ও পথ্যের একটা যোগাযোগ ছিল যাতে করে মানুষ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজেরা সুস্থ থাকার অভ্যন্তরীন সক্ষমতা বাড়াতে পারে। উন্নত দুনিয়ায় এগুলোকে ফিরিয়ে আনার কিংবা শক্তিশালী করবার নানা চেষ্টা নতুন করে শুরু হয়েছে। আর আমরা এই গোটা প্রক্রিয়াটাকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছি। বহুযুগ ধরে চলে আসা কবিরাজী, হেকিমি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত না করে সেকেলে, অবৈজ্ঞানিক তকমা দিয়ে আমরা এগুলোকে অচল ঘোষণা করেছি। আমাদের জীবন যাপন, বসবাসের এই অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ উপযোগী স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করেছি অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আর জীবনযাপন দিয়ে। আমরা পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবসাকে গ্রহণ করেছি, সকল নাগরিকের চিকিৎসা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় দায়কে না নিয়ে। স্বাস্থ্য হারিয়েছি, চিকিৎসাও নিশ্চিত করতে পারিনি। নগদ মুনাফার কারবারে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতকে, স্বাস্থ্যকে জলাঞ্জলি দেবার এই তৎপরতা জাতিগতভাবে আমাদের আত্মবিধ্বংসী প্রক্রিয়ারই প্রকাশ। প্রশ্ন হচ্ছে এই নৈরাজ্যিক অসুস্থ মুনাফার চক্রে আমরা আর কতকাল বাঁধা থাকব? আমাদের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে ব্যবসা আর কতটা ফুলেফেঁপে উঠবে? উন্নয়নের এই বোলচাল আমাদের আর কতকাল শুনতে হবে? আমাদের হুঁশ ফিরবে কবে, কিভাবে? যখন ফিরবে তখন কি আর সময় থাকবে সংশোধনের?
আবুল হাসান রুবেল
নির্বাহী সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন