You are currently viewing বাজেট প্রতিক্রিয়া ২০২০-২০২১ অর্থবছর

বাজেট প্রতিক্রিয়া ২০২০-২০২১ অর্থবছর

সংবাদ সম্মেলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকার ঘোষিত বাজেটে দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো সক্ষমতা নেই, জনগণ হতাশ, ক্ষুব্ধ। জনগণের প্রতি সরকারে কোনো অঙ্গিকার নেই। সরকারের লক্ষ্য কিছু গোষ্ঠীর প্রতি। দুনীতিকে আরো অবারিত করার পুরো ব্যবস্থা বহাল আছে এই বাজেটে। জনসেবার খাতগুলো পুরোপুরি আমলাতন্ত্র নির্ভর, জনগণের সেবার প্রতি ন্যূনতম মনোযোগ নেই। এই বাজেটে তার পরিবর্তনের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সরকার আসলে এই মহাদুর্যোগ ও সংকটে নিপতিত জনগণের জীবনের কল্যাণের বিষয় ভাবারই সামর্থ্য রাখে না। সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মন্দামুখি। বাংলাদেশেও বিনিয়োগ ও ভোগ নিম্নমুখী, রফতানি কমছে, রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে যাবে। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে এই বাজেটের আকার বৃদ্ধি করা যেতে পারতো। অন্ততপক্ষে এই মাহামারীর ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর জন্য বাজেটে যে গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিলো তার কোনা নমুনা ঘোষিত বাজেটে দেখা গেল না।

আজ ১৩ জুন ২০২০, শনিবার বেলা সাড়ে ১২ টায় গণসংহতি আন্দোলনের উদ্যোগে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অনলাইনে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের প্রধান সমন্বয়কারী জননেতা জোনায়েদ সাকি। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। সংবাদ সম্মেলনের অংশগ্রহণ করেন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য ফিরোজ আহমেদ, হাসান মারুফ রুমী, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য জুলহাসনাইন বাবু।

তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত মুখ থুবরে পড়েছে। মহামারী মোকাবেলায় এখন জরুরি ভিত্তিতে দরকার পিসিআর ল্যাবে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৫০ হাজার টেস্ট করার সক্ষমতা। একইসাথে গণস্বাস্থ্যর কিট অনুমোদন দিয়ে গণহারে এ্যান্টিবডি টেস্টের ব্যবস্থা করা। এন্টিবডি টেস্ট করলে অনেকেই ঝুুঁকিমুক্ত এটা নিশ্চিত হয়ে কাজে যেতে পারতেন। দরকার শ্রমিক এলাকায় এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পর্যাপ্ত কোয়ারিন্টাইন সুবিধা নিশ্চিত করা। একজন মানুষও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান সেজন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা, ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি অত্যন্ত জরুরি। আনুপাতিক হারে ভ্যান্টিলেটরের ব্যবস্থা দরকার। এইসব বিষয়ে কোনো উদ্যোগের কথা বাজেটে নেই। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা চালু করতে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য হেলথ কার্ড চালু করা দরকার। স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালনায় নিয়ে আসতে হবে। সরকারি বেসরকারি উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই জনগণের কাছে জবাবদিহীতার জায়গায় আনার আর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি চিকিৎসা নির্ভর, জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তেমন কোনো অগ্রাধিকার নেই। পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এই করোনা কালেও চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। এইসবের প্রতিকারের কোনো নীতি ও পরিকল্পনা ও নির্দেশনা বাজেটে নেই। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কমপক্ষে বাজেটের ২০ ভাগ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নীতি বদলাতে হবে।

জোনায়েদ সাকি আরো বলেন, বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা নীতিকে সৃজনশীলভাবে ঢেলে সাজানো দরকার যাতে সংকটাপন্ন দরিদ্র মানুষ এবং নতুন করে দরিদ্র হয়ে যাওয়া এবং জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গীয় ভিত্তিতে সকল প্রান্তিক মানুষেরা এই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নিশিশ্চতভাবে পান। বিনা সুদে কৃষককে ঋণ দেয়া দরকার। কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র চালু করা এবং সরকার ঘোষিত দামে ফসল ক্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই করা চলবে না। নতুন কর্মসংস্থানের বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ছাঁটাইসহ প্রবাসী শ্রমিকরা যে বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন তা মোকাবেলার জন্য সরকারের জরুরি নীতি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে অনলাইন মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে পারে তার জন্য ইন্টারনেটের দাম কমাতে হবে। গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে যাতে গবেষকরা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভালভাবে গবেষণা কাজ পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু বাজেটে এইসব বিষয়ে জনগণ কেবল হতাশই হননি, বহুক্ষেত্রে উল্টোযাত্রা খুবই স্পষ্ট।  

সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, এই বাজেটে রাষ্ট্র ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে চুরি দুর্নীতির যে আয়োজন আছে তার সবকিছুই একইভাবে বহাল আছে। জ্বালানি খাতে রেন্টাল-কুইক রেন্টালকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া, মেগা প্রজেক্টের লাগামহীন ব্যয়ের জবাবদিহীতার ন্যূনতম জায়গা না রাখা, ব্যাংক-শেয়ার বাজার লোপাটকারীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, মাথাভারী প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তাদের পেছনে অপচয়মূলক ব্যয় অব্যাহত আছে সমানভাবে। সরকার বিদেশী ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও ক্রমাগত সাপ্লায়ারস ক্রেডিট ও উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে লুটপাট গণবিরোধিতার সকল বৈশিষ্টই পুরো মাত্রায় বহাল আছে।

নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকার ঘোষিত বাজেটের মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণ করলো জনগণের জীবনের প্রতি, এই মহামারীকালেও তাদের ন্যূনতম কোনো পরোয়া নেই। তিনি বলেন, অবিলম্বে এই বাজেট পুনর্বিন্যস্ত করে জনদাবি পূরণ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে কার্যকর না করতে পারলে সরকারের উচিত হবে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া।

budget 2020

নিচে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য যুক্ত করা হলো।

বার্তা প্রেরক-
বাচ্চু ভূঁইয়া
সদস্য, কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী
গণসংহতি আন্দোলন

সংবাদ সম্মেলন
১৩ জুন ২০২০, শনিবার
বাজেট প্রতিক্রিয়া ২০২০-২০২১ অর্থবছর

প্রিয় সংবাদিক বন্ধুগণ,
আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আজকের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। গত ১১ জুন ২০২০ তারিখে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। এর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যই আমাদের সংবাদ সম্মেলন।

প্রিয় বন্ধুগণ,
ইতোমধ্যেই প্রায় সকল মহলই এবারের বাজেটকে গতানুগতিক বলে অভিহিত করেছে। বিগত বছরগুলোতে যেভাবে জনস্বার্থের অগ্রাধিকারগুলোকে উপেক্ষা করে খাতওয়ারি বরাদ্দের অনুপাতে বড় ধরণের পরিবর্তন না করে নিছক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, এবারও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সচেতন মহল সঙ্গত কারণেই আশা করেছিলেন করোনা মহামরির ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং প্রায় অচল হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্বারের লক্ষ্যে এবারের বাজেট প্রস্তাবে অন্তত বরাদ্দ পুনর্বণ্টনের একটি চেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে। এক কথায় বলতে গেলে বাজেট প্রস্তাবে করোনা পরিস্থিতিকে প্রায় উপেক্ষাই করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবের শিরোনামেই বলা হয়েছে- “অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা”র কথা। অর্থাৎ করোনার স্বাস্থ্য ঝুঁকি সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনার মূল জায়গাতেই যেন নেই, তাদের মূল ভাবনা করোনা পরবর্তি ভবিষ্যৎ নিয়ে। অথচ বাস্তবতা হলো করোনার ঝুঁকি এখনো বিদ্যমান, প্রতিদিন ভাইরাসে আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর বাড়ছে। ফলে বাজেট প্রস্তাব বৃহত্তর জনগণের আশাভঙ্গের কারণই হয়েছে কেবল।


দুর্যোগ মোকাবিলার সুপরিকল্পিত আর্থিক নীতি নয়, এ বাজেট কেবল আয়-ব্যয়ের গতানুগতিক হিসাব
মন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চিরায়ত কৌশল হলো সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি। সরকারের আর্থিক নীতি তথা ঋরংপধষ চড়ষরপু’র মাধ্যমে নাগরিকদের হাতে টাকা পৌঁছানো। কারণ নাগরিকদের হাতে টাকা থাকলেই তারা জীবন ধারণের জন্য কেনাকাটা করবেন, বাড়বে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা, সচল হবে অর্থনীতির চাকা। করোনাকালে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করতে তাই বাজেটে মানুষের হাতে বেশি করে টাকা পাঠানোর প্রস্তাবনা/নির্দেশনা থাকার কথা। বিশেষ করে যাদের আয় কমে গেছে বা যাদের আয় আক্ষরিক অর্থে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের হাতে টাকা পৌঁছানোর বিশেষ কর্মসূচি থাকার কথা এবারের বাজেটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো গতানুগতি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোই বহাল আছে। এসব কর্মসূচিতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও বাজেটের শতাংশ হিসেবে বরাদ্দ বাড়েনি।
অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে তারা করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যাপ্ত “তথ্য-উপাত্ত” ছাড়াই নিজেদের মতো করে বাজেট প্রস্তাব করেছেন। অথচ করোনা মহামারির কারণে অতীতের যে কোন বছরের তুলনায় এবারের বাজেটে বাস্তব তথ্য-উপাত্ত এবং যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে খাতওয়ারি বরাদ্দ বণ্টন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আর জাতীয় আয়-ব্যয় সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত অর্থমন্ত্রীল কাছে না থাকাটা নিছক অজুহাত মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন “অতীতের অর্জনের ধারাবাহিকতা” বিবেচনায় রেখে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু আমরা অতীতে বসবাস করছি না। আমরা এমন এক বর্তমানে বসবাস করছি যার সঙ্গে অতীতের কোন সময়ের কোন তুলনা করা চলে না।


বাজেটের আকার আরও বড় হতে পারতো
আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি হবে- বাজেট প্রস্তাবে এমন প্রাক্কলনের পর থেকেই একে অযৌক্তিক উচ্চাভিলাষ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাপি মহামারির ফলে সবগুলো দেশের অর্থনীতিই যখন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমেছে ও আরও মারাত্মক মাত্রায় কমার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং প্রবাসী আয়ও ব্যাপক হুমকির মধ্যে পড়েছে, তখন স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা আসলেই অযৌক্তিক। এমন অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কারণ হতে পারে যে অর্থমন্ত্রী কেবল রাজনৈতিক ‘ফাঁকা আওয়াজ’ দিচ্ছেন এবং/অথবা বিদ্যমান বাস্তবতা যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রয়োজনীয় দক্ষতা এই আমলাতন্ত্র নির্ভর সরকারের নেই।


আমরা মনে করি প্রবৃদ্ধির হার কম বা বেশি হওয়া এই মূহুর্তে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়। সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায় মূল বিবেচ্য হতে হবে মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এই বিবেচনার জায়গা থেকেই এবারের বাজেটের আকার আরও বড় করা প্রয়োজন ছিলো। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ১৩ শতাংশ বেড়েছে। আমরা মনে করি বাজেটের এ আকার আরও বাড়ানো যেত, যাতে ওই বাড়তি অর্থ স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোতে ব্যয় করার মাধ্যমে কার্যকরভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যয় করা যায়। এক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি চাইতে বড় প্রসঙ্গটি হচ্ছে যে, বাজেটের ব্যয়টি কোথায় হচ্ছে। কিভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা মানুষেরর জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে ব্যয় করা যায়
কারণ এখন প্রধানতম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্য যা করা প্রয়োজন তা করা। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কেবল মুখেই বলছেন যে সরকার ‘মানুষকে বাঁচাতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে’ যে অর্থ লাগবে তা বরাদ্দ করতে প্রস্তুত।


স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ নিতান্ত হতাশাজনক
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পরিচলন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। অথচ মোট বাজেটের আকার বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সঙ্গত কারণেই নাগরিকরা আশা করেছিলেন এ বছর বাজেটের আকার যতোটা বাড়বে তার একটি বড় অংশই স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজিয়ে মহামারি মোকাবিলার জন্য ব্যয় করা হবে। অথচ বাস্তবে মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে ওই অর্থে কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না (সংশোধিত বাজেটে ৪.৭ শতাংশ থেকে প্রস্তাবিততে ৫.১ শতাংশ হয়েছে)। কভিড মোকাবেলায় আলাদা করে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও এটা থোক বরাদ্দের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই অর্থের কতোটা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হবে, বা আদৌ হবে কি-না তা বলা যাচ্ছে না।


করোনা পরিস্থিতির আগে থেকেই স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকে দিতে হচ্ছিল। করোনাকালে যে পরিস্থিতির আরও অবনতি  হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য খাতকে আমলাতন্ত্র থেকে মুক্ত করে ঢেলে সাজানো একান্ত প্রয়োজনিয়। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া, হাসপাতালে আইসিইউসহ করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত সরবরাহ করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা পরীক্ষা সকলের জন্য সুলভ করা, শিল্প এলাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন, প্রয়োজন বোধে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আত্মিকরণ এবং সর্বোপরি করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য সেবা যাতে বাঁধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যই বিপুল অর্থের প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দে সে দিকে ভ্রক্ষেপ না করায় বোঝাই যাচ্ছে যে সরকার করোনা সঙ্কট দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে এবং আর খুব বেশি প্রাণহানি হবে না বলে ধারণা করে নিচ্ছে। এই মারাত্মক অনুমাননির্ভর নীতি নির্ধারণের ফলে পুরো দেশ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নাগরিকরা মহা বিপদে পড়তে পারেন।


করোনা মহামারি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুকতা নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। এই দুর্যোগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নতুনভাবে ভাবা দরকার নীতিনির্ধারকদের। যে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপগুলোর কথা আগে উল্লেখ করা হলো, সেগুলোর পাশাপাশি মধ্যম থেকে দির্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিয়ে ‘সবার জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা’কে নিছক রাজনৈতিক স্গালোন থেকে বের করে এনে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজ এখনই শুরু করার দরকার। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের তরফ থেকে সে রকম কোন ইচ্ছার বহি:প্রকাশ ঘটেনি।
সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দে মানবিক সৃষ্টিশীলতা পুরোপুরি অনুপস্থিত


প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে মাত্র ৪ শতাংশ বেশি। অথচ সরকারি হিসাবেই আশঙ্কা করা হচ্ছে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসাকারি নাগরিকের অনুপাত ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশের বেশি হবে করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে (অর্থাৎ দারিদ্র্য বাড়বে অন্তত ৫০ শতাংশ)। ফলে নতুন করে দরিদ্র হওয়া পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ যে হয়নি তা খালি চোখেই ধরা পড়ছে।
কেবল বরাদ্দের অপ্রতুলতাই নয়, এই নতুন সঙ্কট মোকাবিলায় যে মানবিক সৃষ্টিশীলতা দরকার ছিলো তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতের বরাদ্দে। পুরোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর কলেবর বাড়িয়েই সঙ্কট উত্তরণের চেষ্টা করতে চাইছে সরকার। অথচ করোনার কারণে বেকার হয়ে দেশে ফিরছেন/ফিরবেন প্রবাসী শ্রমিকরা, অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত নাগরিকদের আয় কমেছে বহুলাংশে, বেকার হচ্ছেন শ্রমিকরা, নিম্ন মধ্যবিত্ত এমন কি মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের আয়ও হুমকির মধ্যে পড়েছে। আর সর্বোপরি স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাড়তি ব্যয়ের চাপ তো রয়েছেই। এ পরিস্থিতিতে এমন নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেয়া দরকার ছিলো যেগুলো এই নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে নাগরিকদের সহায়তা করবে।


কৃষিও পায়নি প্রয়োজনিয় মনযোগ
যে কোন আর্থিক মন্দা অবস্থা মোকাবিলায় কৃষিই বাংলাদেশের রক্ষা কবচ। কারণ এ খাতে কেবল শ্রমশক্তির বৃহত্তম অংশটি যুক্ত তাই নয়, জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণের মাধ্যমে শিল্প ও সেবা খাতকে চলমান রাখতেও এ খাত অপরিহার্য। অথচ করোনা পরিস্থিতির মাস দেড়েকের মধ্যেই দেশের কৃষি খাত ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই এ খাতের ওপর নির্ভরশীল শ্রমশক্তি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যই প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো দরকার ছিলো। অথচ এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২৯ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ৫.৩ শতাংশ। গত ছয় বছর ধরে এ খাতে ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকায় আটকে আছে। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে বাজেটের শতাংশ হিসেবে কৃষি ভর্তুকির অনুপাত ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে বিপন্ন কৃষি রক্ষার্থে এ খাতে এবার অন্তত ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো দরকার ছিলো। কেন তা করা হয়নি সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় পাওয়া যায়নি।


কৃষি খাতে গতানুগতিকতা কেবল বরাদ্দের ক্ষেত্রে নয়, বরং নতুন সঙ্কট মোকাবিলার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় কোন কর্মসূচি বা প্রকল্পও বাজেট বক্তৃতায় অনুপস্থিত। যেমন: কৃষক যেন উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পান যে সে জন্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফলস কেনার জন্য সরকারি বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি, সারা দেশে ফসল সংরক্ষণাগার নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব গত কয়েক মাস ধরেই করা হয়ে আসছে। অথচ বাজেট প্রস্তাবে এগুলোর কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।
শিক্ষা বরাদ্দে গতানুগতকিতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা নেই


করোনার কারণে কয়েক মাস ধরে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয় পুরোপুরি বন্ধ অথবা সীমিত পরিসরে অনলাইনে ক্লাস নেয়া চলছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারিরা অনেক ক্ষেত্রে বেতন পাচ্ছেন না, আবার অনেক ক্ষেত্রে মেসে থেকে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীরা মেস ভাড়া দিতে পারছে না, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো শিক্ষা ব্যয় নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছে। শিক্ষাবিদরা আশঙ্কা করছেন বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে পড়ালেখা করছে এমন অনেক শিশু অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে স্কুলে ফিরবে না। এ অবস্থায় অন্য কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোই সমিচীন হতো। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও জিডিপির শতাংশ হিসেবে এ খাতে বরাদ্দ আসলে কমেছে (মোট বাজেটের শতাংশ হিসেবেও চলতি বছরের মতোই প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশের সামান্য বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে)।
করোনা পরিস্থিতির আগে থেকেই শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব দেশের প্রধানতম সামষ্টিক অর্থনেতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির ছিলো। করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় বেকারত্ব বাড়বে, বাড়তি চাপ হিসেবে যুক্ত হবে প্রবাস ফেরত শ্রমিকদের অনেকেই। করোনা পরবর্তি বিশে^ শ্রমশক্তির চাহিদাতেও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। নতুন বিশ্ববাস্তবতায় নিজেদের শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে শিক্ষা কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা এখনই নেয়া দরকার ছিলো। প্রস্তাবিত বাজেটে এমন সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো ‘সাধারণ ছুটি’তে যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে পড়ালেখা করানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে বা চেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন ইন্টারনেটের ব্যয় বাজেটের মাধ্যমে আরও বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে কোন পরিকল্পনা/নির্দেশনা না থাকা নিতান্ত অবিমৃষ্যকারিতা।


পরিকল্পনাহীন অযৌক্তিক রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা
বাড়তি ব্যয় করার জন্য সরকারের আয় পরিকল্পনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। অথচ এক্ষেত্রে যেনতেনভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ৩ লক্ষ ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব (অনুদানসহ) আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ জানা গেছে যে, গত জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত (অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে) ১ লক্ষ ২৬ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে সরকার। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে সংশোধিত বাজেটে যে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা পূরণ করতে ২ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি আহরণ করতে হবে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই, যা নিতান্ত অসম্ভব। কেবল সংশোধিত বাজেটেই নয়, আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একই রকম যুক্তিহীনতা দেখা যাচ্ছে। করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেও সরকার আসন্ন অর্থবছরে ৩ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব (অনুদানসহ) আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বোঝাই যাচ্ছে এই লক্ষ্য অর্জনও অসম্ভব হবে এবং শেষ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি আরও বাড়বে।


আমরা আগে বলেছি বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি নিয়ে এ মূহুর্তে খুব বেশি ভাবিত হওয়া প্রয়োজনিয় নয়। তবে তার মানে এই নয় যে, বাজেট ঘাটতি নিয়ে সরকারের কোন পরিকল্পনা থাকার দরকার নেই। অবাস্তব রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ফলে অর্থবছরের মাঝামাঝি গিয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে ঋণ নিতে হবে। তড়িঘড়ি করে ঋণ নিতে গেলে চড়া সুদে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে হবে। বরং আগে থেকে বাজেট ঘাটতি ব্যবস্থাপনার যথাযথ পরিকল্পনা করতে পারলে আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া যাবে, কমানো যাবে জনগোষ্ঠির ওপর সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ।


অনেক অগ্রাধিকারকে উপেক্ষা করা হয়েছে
দেশের শ্রমশক্তির ৮০ ভাগেরও বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। এরাই করোনার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরে ও গ্রামে অনানুষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের বড় অংশটিই সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’র কারণে ব্যবসা করতে পারেননি। অধিকাংশই পুঁজি ভেঙে সংসার চালিয়েছেন বাধ্য হয়ে। তাদের ব্যবসার অনানুষ্ঠানিকতার কারণে প্রথাগত ঋণভিত্তিক প্রণোদনার সামান্য সুফলই তারা পাবেন (যদি আদৌ পান)। এই অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায় শ্রমিক-কর্মচারি হিসেবে নিযুক্ততের অবস্থাও তথৈবচ। এ অবস্থায় বাজেটে এদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ত করার মতো কোন কর্মসূচি আদৌ নেই। সরকার বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করে আসন্ন অর্থবছরে ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে’র যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রতি এই উপেক্ষা নিতান্ত হতাশাব্যঞ্জক।
আয়-রোগারের সুযোগ হারিয়ে অনেক পরিবারই শহর থেকে গ্রামমুখী হচ্ছে। প্রবাস থেকেও গ্রামে ফিরছেন অনেক প্রবাসী শ্রমিক। নতুন করে গ্রামে ফেরা এই মানুষগুলোও গ্রামের জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছেন আয়হীন বেকার হিসেবে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। এদের পুনর্বাসন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ার কথা। তবুও বাজেট বক্তৃতায় এদের জন্য আলাদা কোন উদ্যোগের কথা না থাকাটা সরকারের পরিকল্পনাহীনতার বহি:প্রকাশ।
এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় করোনার সঙ্কট সহসাই কাটছে না। আর তার চেয়েও বড় কথা এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অন্তত আরও দুই-তিন বছর সময় লাগবে বলেই মনে হচ্ছে। বিশে^র অন্যান্য অর্থনীতিগুলো সেভাবেই তাদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। অথচ আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করোনার প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতিকে আবার সচল করার মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামী অন্তত দুই তিনটি অর্থবছরের বাজেট কাঠামোর কেন্দ্রীয় জায়গায় থাকা উচিৎ মহামারি মোকাবিলা ও অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার বিষয়গুলো।


উল্টো পথে যাত্রার বাজেট
করোনায় সকল শ্রেণীর নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ কথা ঠিক। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এই অভিঘাত উচ্চবিত্তরা সহজেই সামাল দিতে পারবেন, এবং নিম্বত্তদের সে জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ অবস্থায় স্বভাবতই জনকল্যাণের বিবেচনায় বিত্তশালীদের থেকে কর আহরণ করে সে টাকায় বিত্তহীনদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়ের মধ্যে পড়ে। অথচ আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে দেখা যাচ্ছে যে উচ্চবিত্তরা আয়করের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি ছাড়  পাবেন। যেমন: একজন অতিধনী সর্বোচ্চ ২ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পেতে পারেন, যেখানে নি¤œবিত্তের কর কমবে মাত্র ৫ হাজার টাকা। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। দ্রুত ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশে^র বহু দেশকে পেছনে ফেলেছে। এ অবস্থায় অতিধনীদের কর ছাড় দেয়া নিতান্তই অযৌক্তিক।
জন-চাহিদার বিপরীতে আরও বহু প্রস্তাবনা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে দেখা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বভাবতই নাগরিকরা আগের তুলনায় অনলাইন কেনাকাটার ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করছেন। বড় বড় শহরগুলো ছাড়াও অন্য জেলাগুলোতেও অনলাইন কেনাকাটা ও লেনদেনের চাহিদা বাস্তবতার কারণে আগামী মাসগুলোতে আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেট প্রস্তাবে অনলাইন কেনাকাটার খরচ বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেও ইন্টারনেটের ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মোবইল ফোন ও সিম কার্ডের দামও। গণপরিবহন ব্যবহারে করোনা সংক্রমণের বাড়তি ঝুঁকি বিবেচনায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকদের মধ্যে যখন বাইসাইকেল কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সে সময়ই এবারের বাজেট প্রস্তাবে বাইসাইকেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।


উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে যে সমস্ত পণ্য ও সেবার বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়েছে সরকারের উচিৎ ছিলো সেগুলোকে আরও সহজলভ্য করা। অথচ তা না করে কর আরোপের মাধ্যমে এগুলোর মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। এ থেকে বোঝা যায় বাজেট তৈরির সময় জনগণের জরুরি চাহিদা নয়, মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা।


খাতওয়ারি বরাদ্দ পুনর্বণ্টনে যা করা যেতো
সকলেই এ বাজেটকে গতানুগতি বলছেন, কারণ লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের যে অনুপাত ছিলো, এবারের বাজেট প্রস্তাবে তার খুব অদল-বদল হয়নি। অথচ করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের যে ভয়াবহ দৈন্য দশা স্পষ্ট হয়েছে সেগুলো সামাল দেবার জন্য এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া যেতো (৫.১ শতাংশ দেয়া হয়েছে)। একইভাবে করোনাজনিত অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বিপন্ন মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক সুরক্ষার কলেবর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর জন্য এবং নতুন কর্মসূচি নেয়ার জন্য এ খাতে মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া যেতো (৫.৬ শতাংশ দেয়া হয়েছে)। একইভাবে কৃষিতেও মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া যেতো, যাতে গ্রামীন অর্থনীতি সচল থাকার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় (অথচ দেয়া হয়েছে ৫.৩ শতাংশ)।


এ খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়াতে অবশ্যই অন্যান্য খাতে ব্যয় সঙ্কোচন করতে হতো। এবং সেটা খুবই সম্ভব। জন প্রশাসন এবং পরিবহন ও যোগাযোগ এ দুটি খাত মিলিয়ে বরাবরের মতো এ বছরও মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন এ বছর কাটছাট করা মোটেও অযৌক্তিক হতো না। একইভাবে সদিচ্ছা থাকলে জনপ্রশাসনের ব্যয় কমানোও কঠিন হতো না। সকল খাতে অপচয় ও দূর্নীতি রোধের সংকল্প থেকে বাজেট করা হলে অন্যান্য খাতগুলোর জন্য বরাদ্দও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা যেতো বলে সচেতন মহল মনে করেন।


বাজেট চ‚ড়ান্ত করার আগে যা করা যেতে পারে
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়- প্রস্তাবিত বাজেট থেকে চ‚ড়ান্ত বাজেটে খুব বেশি রদবদল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাজেট প্রণয়ন ও চ‚ড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ায় জনগণ এমন কি সংসদ সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ কখনোই থাকে না। ফলে বড় ধরনের পরিবর্তণ প্রত্যাশা করা যায় না। তবে বিদ্যমান বিশেষ অবস্থার নিরিখে সরকারকে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন বাজেট প্রস্তাবে আনতেই হবে বলে আমরা মনে করি। যেমন: রাজস্ব আহরণের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এসে এখনই ঘাটতি অর্থায়নের একটি বাস্তব পরিকল্পনা হাজির করতে হবে, যাতে তড়িঘড়ি উচ্চ সুদে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের দারস্থ না হতে হয়। বরং এখন থেকেই কোন কোন উৎস থেকে তুলনামূলক সহজ শর্তের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
ইতোমধ্যে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোও মূলত ব্যাংক ব্যবস্থা নির্ভর। এ অবস্থায় সরকারের পরিচলন ব্যয়ের জন্য দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আরও ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। ফলে বাঁধাগ্রস্ত হবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান, যা এই দুর্যোগ পরিস্থিতি একেবারেই কাম্য নয়। কাজেই কেবল এ বছরই নয়, বরং মধ্যমমেয়াদে এই ব্যাংক-নির্ভরতা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় তার একটি ছক মধ্য মেয়াদি বাজেট কাঠামোতে থাকতে হবে।


কর প্রস্তাবে ‘উল্টো পথে যাত্রা’র যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, বাইসাইকেলের মতো যে সমস্ত পণ্য ও সেবার চাহিদা করোনা দুর্যোগের কারণে বেড়েছে বাড়তি করারোপ করে সেগুলোর দাম বাড়ানোর অযৌক্তিক ও অমানবিক নীতি থেকে সরে আসতে হবে।


অগ্রাধিকার খাতগুলোতে আদর্শ অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ পুনর্বণ্টন এ মূহুর্তে আর সম্ভব না হলেও অন্তত কম অগ্রাধিকার খাতগুলোর বাজেটে কিছুটা কাটছাট করে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও শিক্ষায় বরাদ্দ কিছুটা হলেও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আগামী অর্থবছরগুলোতে বরাদ্দ দেয়ার গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসার একটি ইঙ্গিত এবারের বাজেট প্রস্তাবেই থাকতে হবে।
বিগত বছরগুলোতেও সরকার বিশ^ বাস্তবতা এবং দেশীয় অর্থনীতির সামষ্টিক চ্যালেঞ্জগুলোকে উপেক্ষা করে বাজেট পাশ করেছে শত সমালোচনা-প্রতিবাদ সত্তে¡ও। এবারের বাজেটে সেই ধারাবাহিকতাই বহাল রয়েছে। ওই অর্থে এই বাজেট প্রস্তাবকে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার বাজেটও বলা যায়। কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় এবারের এই গতানুগতিকতার প্রভাব শতগুণ বেশি নেতিবাচক হতে পারে করোনাজনিত বিশেষ পরিস্থিতির কারণে। করোনায় যখন প্রাণহানির খবর আসছে প্রতিদিন, যখন কোটি কোটি মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত তখন সরকারের এমন উদাসিনতা ইতোমধ্যেই জনগণের মধ্যে যে আস্থার অভাব ছিলো তা তীব্রতর করবে। কেবল মুখে ‘জীবন ও জীবিকা রক্ষা’র বাজেটের কথা বলে এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। তাই আমাদের দাবি- সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে জাতিকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে সরকার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সকল অংশীজনের ন্যায্য অভিমতকে ন্যূনতম মাত্রায় প্রতিফলিত করে এমন একটি বাজেট প্রস্তাবনা হাজির করবে।

ধন্যবাদসহ
আবুল হাসান রুবেল
নির্বাহী সমন্বয়কারী (ভারপ্রাপ্ত)
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি

Leave a Reply