(গণসংহতি আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে গত ২২ জুলাই ২০১১ ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংবিধানের লড়াই’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার সূচনা বক্তব্য। ঈষৎ পরিমার্জিত।)
কমরেড সভাপতি, উপস্থিত শ্রদ্ধেয় আলোচকবৃন্দ এবং সুধীবৃন্দ, আপনাদের সকলকে গণসংহতি আন্দোলন কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সংবিধান এখন রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে এটা আপনারা সবাই জানেন। তবে যেভাবে এটা এখন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে সেটা আমাদের জন্য সুখকর নয়। কিন্তু এটা সুখকর বিষয় যে সংবিধান আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। একটা দেশে সংবিধান যদি নাগরিকদের আলোচনার মধ্যে না থাকে, নাগরিকদের অভিপ্রায়ের সনদ হিসেবে সংবিধান যদি নিয়ত আলোচনা না হয়, রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে না থাকে, তাহলে সেই ক্ষেত্রে গণতন্ত্র কিংবা সাধারণভাবে নাগরিকদের অধিকার কার্যকর থাকতে পারে না। আজকের দিনে সে কারণে সংবিধানের আলোচনা আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক ব্যাপার। আমরা কীভাবে এই আলোচনাকে পূর্ণতা দিতে পারবো তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। সংবিধান নিয়ে আলোচনা এক দিনে শেষ হবার নয়। আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নতুন করে এই আলোচনার সূত্রপাত করেছি। এই আলোচনাকে এবং একে কেন্দ্র করে যে সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই জনপদের মানুষের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামকে কীভাবে আরো ব্যাপকভাবে সংগঠিত করা যায় তার চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখবো।
গত ১৬ জুন এবং ৩০ জুন বাংলাদেশে দু’টি ঘটনা ঘটেছে। ১৬ জুন মার্কিন কোম্পানি কনকো-ফিলিপসের সাথে সাগরের গ্যাস ব্লক চুক্তি করা হয়েছে। ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাশ করা হয়েছে। এই দু’টি ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই দুই ঘটনা বাংলাদেশের যে সাধারণ ভবিষ্যত নিয়ে আসছে তাকে আমরা আলাদা করতে পারবো না। এই সাধারণ ভবিষ্যত অন্ধকার। আমরা এই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যেতে পারবো কি না এটা নির্ভর করবে জনগণের ওপরে, জনগণের আন্দোলন কীভাবে সংগঠিত হতে পারছে, কীভাবে তাদের নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরা নির্ধারণ করতে পারছেন তার ওপরে। ৩০ জুন যে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাশ করা হয়েছে সেই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, “এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং এই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবেন”। পরে বলা হয়েছে, “এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্যে নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন”। রাষ্ট্রদ্রোহিতার ঝুঁকি এবং মৃত্যুদণ্ডের হুমকি, এই নিয়ে আমাদের সংবিধান বিষয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। সংবিধান যদি নাগরিকদের অভিপ্রায়ের আইনী সনদপত্র হয়, তাহলে সেই সংবিধান নিয়ে আলোচনা, তার বিধান নাগরিকদের পক্ষে কি পক্ষে নয়, এই আলোচনা করা যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় তবে কোন্ দেশে আমরা বসবাস করছি সেটা এই একটি বিধান দ্বারাই প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু আমাদেরকে ঝুঁকি নিতেই হবে। কেননা ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আমাদের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে আমাদের যত বড় ঝুঁকি হোক না কেন গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান নিয়ে আলোচনায় প্রথমে আজকের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। বিদ্যমান সংবিধানের জাতিবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী এবং সংসদীয় স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। আমি সেই প্রসঙ্গ ধরে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আপনাদের সামনে আলোচনা করবো। বলা বাহুল্য, যথাসম্ভব সংক্ষেপে। কেননা এই সভা আমাদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।
একটি দেশের সংবিধান কীভাবে প্রণীত হতে পারে? কিংবা সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কাদের কাছে, কীভাবে থাকতে পারে? সংবিধান প্রণয়ন কেবল বাংলাদেশেই হয়নি। সংবিধান প্রত্যেকটি দেশেই, আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে মৌলিক আইন হিসেবে হয় লিখিত কিংবা আধা লিখিত কিংবা কনভেনশন আকারে জারি আছে। মৌলিক আইন হিসেবে সংবিধানের মর্যাদা এবং সে কারণে সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিশেষভাবে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক লক্ষকে সামনে রেখে লড়াই করে, একটা যুদ্ধ করে লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেই রাষ্ট্রে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্ন কোন মামুলি প্রশ্ন নয়। আপনারা ইতিমধ্যেই শুনেছেন ১৯৭০ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের জন্য নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিরা, যারা মূলত আওয়ামী লীগ দলের ছিলেন, তাদেরকে নিয়েই ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে কী ঘটলো? প্রথমত ১৯৭১ সালটাকে হাওয়া করে দেয়া হলো। কেননা ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে একটা নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়টি ছিল সেই সময়ের রাজনীতির একটা রণকৌশলগত প্রশ্ন। সেই সময়ে তৎকালীন রাজনীতির যে সমীকরণ ছিল, সেই সমীকরণ অনুযায়ী কোন কোন দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অনেকেই অংশ নেয়নি। কিন্তু ১৯৭১ সাল ‘৭০ সালের ইতিহাসকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। কেবল পাল্টে দেয়নি, তার মৌলিক চরিত্রকে একেবারে অন্য স্তরে নিয়ে গেছে। ৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রশ্নটা ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং জামাতের মতো রাজাকার-আলবদররা ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ, রাজনৈতিক দল এই জাতীয় যুদ্ধে, এই মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। সে কারণেই ‘৭১ সাল ‘৭০ সালকে মৌলিকভাবে গুণগত জায়গা থেকে পরিবর্তন করেছিল। ‘৭১ সালের এই পরিবর্তনকে ‘৭২ সালে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কেননা ‘৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত দলকে যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলই নয়, জনগণের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিরা কীভাবে তাদের ‘অভিপ্রায়ের সনদপত্র’ প্রণয়ন করবেন, তাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। সেটা কেবলমাত্র হতে পারত একটা সংবিধান সভা গঠনের মাধ্যমে। সংবিধান সভা নিছক কেবল পার্লামেন্ট নয়। পার্লামেন্ট সদস্যরা যেভাবে নির্বাচিত হন কিংবা তাতে যে রকম আসন বরাদ্দ থাকে, সেটা দিয়েই কেবল সংবিধান সভার নির্বাচন করা যায় না। সংবিধান সভায় জনগণের ব্যাপক অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তার আলাদা কাঠামো তৈরি করতে হয়। সেই আলাদা কাঠামোর নির্বাচন করতে হয়।
কিন্তু সেই কোন কাজই ‘৭২ সালে করা হয়নি। ‘৭২ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে অধ্যাদেশ জারি করে গণপরিষদ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ব্যাপক জনগণের সংগ্রামের যে ইতিহাস, জামাতে ইসলামীসহ যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে তাদের বাইরে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলের লড়াইয়ের যে ইতিহাস, তাদের অংশগ্রহণ, তাদের আত্মত্যাগ সেটা অস্বীকার করা হয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র দল। ইতিহাসের বিকৃতি এবং তাকে দখল করা শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে এবং যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে একটি দলের ইতিহাসে পরিণত করে, একজন ব্যক্তির ইতিহাসে পরিণত করে আজকে এই অবস্থায় নিয়ে আনা হয়েছে। ‘৭২ সালের সংবিধানে যে একজন ব্যক্তিকে ক্ষমতা দেয়ার জন্য নানানভাবে বিধান করা হয়েছে সেটা আমরা পরে আলোচনায় পাবো। কিন্তু এই যে ইতিহাসকে পুরোপুরি ধামাচাপা দিয়ে, ‘৭১ সালকে হাওয়া করে দিয়ে সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থা কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে না। এই ব্যবস্থা চরম স্বৈরতান্ত্রিক। ‘৭২ সালেই, একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরপরই জনগণের আকাক্সক্ষাকে, জনগণের আত্মত্যাগকে পায়ে দলে এই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। এই গোড়ার গলদকে যদি আমরা চিহ্নিত করতে না পারি, এই গোড়ার অগণতান্ত্রিকতাকে যদি আমরা চিহ্নিত করতে না পারি, আমাদের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। আমাদেরকে যদি মুক্তি অর্জন করতে হয়, ফাঁকিজুকি দিয়ে আমরা তা করতে পারবো না। সুতরাং গণতান্ত্রিক সংবিধান কীভাবে প্রণীত হতে পারে তার জন্য-এই গণতন্ত্র মানে হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের গণতন্ত্র-সেই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটা কেবল বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এই অংশগ্রহণের ব্যাপারটি ঘটেছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদাহরণ দেখেন, এমনকি ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশে, এমনকি ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় জনগণের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি ছাড়া সংবিধান কার্যকর নেই। তার দৃষ্টান্তগুলো কার্যকর নেই। ফলে আজকের দিনে বাংলাদেশে এই অগণতান্ত্রিকতাকে চিহ্নিত করা আমাদের জন্য একটা জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সংবিধানের সামগ্রিক অগণতান্ত্রিকতা, এই মৌলিক প্রাথমিক অগণতান্ত্রিকতাকে আমাদের স্পষ্ট করেই চিহ্নিত করতে হবে।
দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তা হলো, সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কার কাছে থাকবে? এই যে অগণতান্ত্রিক কায়দায় সংবিধান প্রণীত হলো তাতে বলা হলো, পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই সংবিধান সংশোধন করা যাবে। এভাবে কি সংবিধান সংশোধন করা যায়? যায় না। আপনারা যদি আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্র বলে যা আছে-আমরা এখানে বুর্জোয়া গণতন্ত্র নিয়েই আলোচনা করছি-সেই গণতন্ত্রের ইতিহাস দেখেন, দেখবেন এটা করা যায় না। ইংল্যান্ডে ম্যাগনা কার্টার মধ্য দিয়ে লিমিটেড গভর্নমেন্ট মানে সীমিত সরকারের যে ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তার মূল কথাই ছিল, রাজা কিংবা সরকারের হাতে এ্যবসোলুট ক্ষমতা থাকতে পারবে না। কনস্টিটিউশনাল গভর্নমেন্ট আবশ্যিকভাবেই লিমিটেড গভর্নমেন্ট। যদিও ম্যাগনাকার্টার অনেক কিছুই পরবর্তীকালে পরিত্যক্ত হয়েছিল, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক গণতন্ত্রের, আধুনিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল-এর মূল স্পিরিটকে সাথে নিয়ে। আর তা ছিল আইনসভার কাছে এ্যবসোলুট ক্ষমতা থাকতে পারবে না। জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ যদি হয় সংবিধান, তার স্বাধীনতা রক্ষার সনদ যদি হয় সংবিধান, তাহলে জনগণের ঊর্ধ্বে কারো অবস্থান হতে পারে না। সুতরাং জনগণ তার অভিপ্রায় হিসেবে যা ঠিক করবেন সেটা সংশোধনের এখতিয়ার কোনোভাবেই আইনসভার কাছে থাকতে পারে না। তার মানে জনগণের অনুমোদন ছাড়া সংবিধান সংশোধন হতে পারে না। আমেরিকার বিপ্লবের সময়, তার স্বাধীনতার সময় আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের যিনি রচয়িতা সেই থমাস জেফারসন পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে, সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার সাধারণ পার্লামেন্টের হাতে থাকতে পারে না। আইনসভার সদস্যরা তো নিজেরাই এই সংবিধানের, অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের আইনী সনদ কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত। সুতরাং তারা নিজেরা যদি সংবিধান সংশোধন করতে যান তাহলে তাদের নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যা উৎস তাকেই অস্বীকার করেন। কাজে কাজেই তারা নিজেদেরকেও অস্বীকার করেন। সুতরাং সাধারণ পার্লামেন্টের কাছে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার থাকতে পারে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলে আবশ্যিকভাবে জনগণের অনুমোদন নিতে হবে। এটা কোন হাওয়াই ব্যাপার নয়। আজকের দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যেমন পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধন করতে পারে না, তেমনি ইউরোপের বহু দেশেই সংবিধান সংশোধনে জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সেদিন সংবাদপত্রে দেখলাম ড. কামাল হোসেন, সংবিধান প্রণেতাদের একজন, তিনি বলছেন যে এই সংশোধনীর জন্য গণভোটের দরকার ছিল। অথচ এর বিধান কিন্তু তারাই রাখেননি। সংবিধানের ফ্যাসিস্ট চতুর্থ সংশোধনীর সময়েও গণভোটের দাবি তিনি তোলেননি। এই স্ববিরোধিতাই আমাদের ধনিক শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য।
যাই হোক, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে কি জনগণের অনুমতি নেওয়া হয়েছে? আওয়ামী লীগ তাদের ম্যানিফেস্টোতে বলেছিল যদি দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ করে তারা ক্ষমতায় যায় তাহলে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধানকে সংশোধন করবে। এটা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধান সংশোধন হয়ে থাকে তাহলে এই মুক্তিযুদ্ধ বোধ হয় বাংলাদেশের জনগণ করতেন না। তাহলে আজকের দিনে কোনটা মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সংবিধান, কোনটা মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সংবিধান নয় সেটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়। এটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বা ক্ষমতা জনগণের। এই স্বীকৃতি ছাড়া আজকের দিনে এই রকম সংবিধান সংশোধন করার এখ্তিয়ার কারো কাছে আমরা দিতে পারি না। যদি আমরা দেই তাহলে স্বৈরতন্ত্রকেই আসলে কার্যত অনুমোদন করা হয়। জনগণের ওপরে পার্লামেন্টকে স্থাপন করা হয়, সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়। তাহলে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার যেভাবে এরা অগণতান্ত্রিক পন্থায় কুক্ষিগত করেছে, সেই অগণতান্ত্রিক পথেই আজকে পঞ্চদশ সংশোধনী কায়েম করা হয়েছে। এই সংশোধনীর সাথে জনগণের অধিকারের সম্পর্ক নেই। এই সংশোধনীর সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও কোন সম্পর্ক নেই। ফলে এইভাবে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রণীত সংবিধান এবং অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংশোধিত সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির সংবিধান হতে পারে না।
এদতসত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান বলা হচ্ছে। এমনকি আমাদের অনেক বামপন্থী বন্ধুরাও এই সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান হিসেবে বলে থাকেন। কী তাদের ভিত্তি, কোন বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে তারা বলেন যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে? মূলত চার মূলনীতির (সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেতা) ওপরই তারা ভর করেন। এর মধ্য দিয়ে নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা খুব বিস্তারিত আলোচনায় এখানে যেতে পারবো না। সংক্ষেপে এটা বলবো যে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এগুলো একেকটি নাম, একেকটি চিহ্নমাত্র। নাম এবং চিহ্ন দিয়ে কী চিহ্নিত হয়, কী অর্থ উৎপাদন করে সেটা খুব জরুরি প্রশ্ন। কেননা নাম দিয়েই সমস্ত অর্থকে চিহ্নিত করা যায় না। ফলে একটি নাম একটি চিহ্ন নানানরকম অর্থকে চিহ্নিত করতে পারে। যেমন সমাজতন্ত্রের কথা বলবেন? কমিউনিস্ট ইশতেহারে কার্ল মার্কস আজ থেকে ১৫০ বছরের বেশি সময় আগে পাতি-বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীদেরকে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই যে জনগণের প্রকৃত বিপ্লবী সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হবে-সেই দিশা দেখিয়েছিলেন। সুতরাং সমাজতন্ত্র লেখা থাকলেই সেটা সমাজতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে জনগণের সমাজতন্ত্র হচ্ছে এটা নির্ধারণ করা যায় না। আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র করছে, এর চাইতে হাস্যকর ব্যাপার আর কী হতে পারে? আজকে এই সংবিধানের সংশোধনী অনুযায়ী আমরা সমাজতন্ত্র, এমনকি সাম্যবাদ কায়েমের সংবিধানের পৌঁছে গেছি যখন বাংলাদেশ তুলে দেয়া হচ্ছে মার্কিন-ভারত অক্ষশক্তির হাতে। দেশে চলছে অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে ধারণ করে আছি। এই সমাজতন্ত্রের চরিত্র কী? খেয়াল রাখবেন হিটলারে দলের নামও ছিল সমাজতান্ত্রিক দল। নাম দিয়ে সমস্ত কিছু চিহ্নিত করা যায় না। আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র ছিল মূলত জাতীয়করণের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দ্রুত ধনসম্পদ আহরণের একটা ব্যবস্থা। এবং এই ব্যবস্থা যে দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মস্ত এক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল সেটা পরবর্তীকালে সকলেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কাজেই ‘সমাজতন্ত্র’ নামের প্রতারণামূলক ব্যবহারের বিষয়টি যেখানে উন্মোচন করা কর্তব্য, তা না করে একেই সমাজতন্ত্র বলে আকড়ে ধরে কি করে আমরা জনগণকে মুক্তির পথ দেখাবো?
আমরা যদি বলি এই সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া দরকার ছিল গণতন্ত্র সেটাও এখানে নামে আছে। কিন্তু গণতন্ত্র কী চেহারায় আছে সেটা সংবিধানের পরবর্তী ধাপগুলোতে পাওয়া যাবে। একটা সাধারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যেহেতু জনগণ হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, জনগণের স্বাধীনতা এবং জনগণের মঙ্গল নিশ্চিত করার জন্য সরকার গঠন করা হয়, রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক হিসেবে। এটা একটি চুক্তির মতো যেখানে জনগণ তাদের নিজেদের মঙ্গল, সামষ্টিক মঙ্গল সাধনের জন্য একটা চুক্তি করেন, সরকার গঠনের একটা পদ্ধতি তৈরি করেন। কাজেই সরকার এখানে জনগণের উপরে উঠতে পারে না। যদি তাই হয়, তাহলে সরকারের হাতে এমন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে পারে না যা স্বৈরতন্ত্রের শামিল, ফ্যাসিতন্ত্রের শামিল। আমরা জানি বুর্জোয়া গণতন্ত্র মানে ধনিক শ্রেণীর গণতন্ত্র। জনগণের নাম নেওয়া হলেও এতে জনগণের বিরাট অংশকেই আগেই বাদ দিয়ে রাখা হয়। আমরা এই ধনিক শ্রেণীর গণতন্ত্র নিয়েই আলোচনা করছি। ধনিক শ্রেণী যখন গণতন্ত্রের প্রশ্ন তোলে তখন তারা নিজেদের মধ্যকার গণতন্ত্রের প্রশ্নটাকেই প্রধানত বিচার করে। নিজেদের মধ্যেকার গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে ক্ষমতার এমন পৃথকীকরণ, যে পৃথকীকরণ এমন ধরনের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখে যার মাধ্যমে রাষ্ট্রেরই একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র যে আজকে একটা ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা এটা আমরা জানি। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে, নিজ শ্রেণীর মধ্যে এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ক্ষমতার এমন এক পৃথকীকরণ কায়েম করতে পেরেছিল যেটা অন্ততপক্ষে তাদের নিজেদের শ্রেণী ঐক্য ধরে রাখতে পেরেছিল এবং পুঁজিতান্ত্রিক যে ব্যবস্থা তারা কায়েম করতে চেয়েছে, সেই চাহিদার পরিপূরক হিসেবে সংবিধান তাদের দেশে কায়েম হয়েছিল। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী প্রতিনিয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেবাদাসত্ব করে। মার্কিনি গণতন্ত্রকেই তারা তাদের আদর্শ হিসেবে হাজির করতে চায়। কিংবা যা কিছুই করুন না কেন ইউরোপ-আমেরিকাই হচ্ছে এদের কাছে মডেল। কিন্তু যখন কার্যক্ষেত্রে প্রশ্নটা আসে তখন ধারেকাছেও তারা যায় না। মার্কিনী সংবিধানে যে সেপারেশন অব পাওয়ারের ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ-আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যকার যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ, একের কাছে অপরের যে জবাবদিহিতা এবং একের ওপর অন্যের যে নির্ভরশীলতা এই প্রশ্নকে এখানে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আপনারা দেখুন, আওয়ামী লীগ সরকার তারা এখন গণতন্ত্রের কথা বলেন এবং বিচার বিভাগকে খুবই ঊর্ধে তুলে ধরেন। বিচার বিভাগ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গিয়ে তারা বলেন যে বিচার বিভাগ রায় দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করতে হবে। যদিও বিচার বিভাগের রায়কে তারা খুবই আংশিকভাবে এখানে প্রচার করছেন। বিচার বিভাগ আগামী দুই নির্বাচন কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে করতে বললেও তারা সেটাকে উপেক্ষা করে শুধু ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ’ এই অংশটাকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করেছেন। এই একই কাজ করছেন তারা বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়েও। আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে স্বাধীন করার জন্য ‘৭২ সালের সংবিধানে যা কিছু বিধান ছিল সেগুলিকে পুনঃস্থাপন করার কথা বললেও জিয়াউর রহমান যা যা করেছিলেন, বিচার বিভাগকে পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়ে আসা-প্রথমত চতুর্থ সংশোধনী তারপর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এটা পুরো রাষ্ট্রপতির হাতে আসলো-এখন এই পুরো কর্তৃত্বটাকে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের রায়ের কোনো ধার তারা ধারেন না। ফলে বিচার বিভাগের কথা শোনাটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য বা এই ধরনের সরকারের জন্য খুবই সিলেক্টিভ। নিজেদের স্বার্থে যা লাগছে তখন বিচার বিভাগ অনুযায়ী সবকিছু করছি। আর যেটা নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী, তখন সেটা পুরোপুরি চেপে যাচ্ছেন এবং বিচার বিভাগকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। এখানে বলে নেয়া দরকার যে আমরা বিচার বিভাগের সুপ্রিমেসির নামে আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে নই। কিন্তু এই যে বাংলাদেশে এখন বিচার বিভাগের কোনো স্বাধীন ক্ষমতা নেই, এটা যে নির্বাহী বিভাগেরই একটা অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, এর মূল ‘৭২-এর সংবিধানেই নিহিত আছে।
কেননা এই যে নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা, এর মধ্যে সম্পর্ক একেবারেই প্রায় দাসের সম্পর্ক। কারণ আপনারা দেখুন আইন সভা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ। ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোনো সদস্য যদি দল থেকে পদত্যাগ করেন কিংবা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন তাহলে তার সদস্যপদ থাকবে না। অর্থাৎ কেউ প্রধানমন্ত্রীর মানে সংসদ নেতার বিরুদ্ধে, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা কিংবা দলীয় নেতার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। পরিস্থিতি এমনই যে আজকে মহাজোটের অংশীদার বামপন্থী এমপিরা নিজেরা তাদের নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে-আমরা ধরে নিচ্ছি তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে এসেছেন। এই গণতন্ত্রের মধ্যেই আমরা আছি। তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল মূলত বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করা। তাকে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এমনকি জনগণের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা। ফলে আইন সভা বলে যে জিনিসটা আছে পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ হয়ে গেলো এবং আবার তার অধীনেই কার্যত রাষ্ট্রপতি এবং বিচার বিভাগ। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই প্রধানমন্ত্রীকে আবার ইমপিচও করা যাবে না। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচ করা গেলেও প্রধানমন্ত্রী অপরিসীম ক্ষমতাসম্পন্ন। তাকে ইমপিচ করার কোনো বিধান এই সংবিধানে নাই। এইরকম চরম স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে অনুমোদিত এবং এই ব্যবস্থা নিয়ে আমরা গণতন্ত্র কায়েম করছি। এই গণতন্ত্রের চেহারাই চল্লিশ বছরে দেখা যাচ্ছে। কাজেই এরকম ব্যবস্থায় যে ব্যাপক জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার কার্যকর থাকবে না সেটা বলাই বাহুল্য।
আসলে সংবিধান হচ্ছে বিরাজমান শ্রেণী সম্পর্কের, ক্ষমতা সম্পর্কের একটা আইনী প্রকাশ। সংবিধানের মধ্য দিয়ে আধিপত্যকারী শ্রেণীর চরিত্রও ধরা পড়ে। সুতরাং সংবিধানকে আমরা পাচ্ছি বাস্তবত আমাদের দেশে কী ধরনের ক্ষমতা সম্পর্ক বিরাজমান তার একটা প্রতিফলন আকারে। এই বাস্তব সম্পর্ক বাদ দিয়ে সংবিধান কেবল ভালো ভালো কথার সমষ্টি, এইভাবে দেখলে সংবিধান পাঠ করা ঠিকমতো হয় না। সংবিধানে অনেক ভালো কথা আছে। এই ভালো কথার সমষ্টি তার আসল বৈশিষ্ট্যসমেত পাঠ না করলে এর মৌলিক যে চরিত্র, স্বৈরতান্ত্রিক যে চরিত্র তা আমরা অনুধাবন করতে পারবো না। তাহলে মুক্তিযুদ্ধে যে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চেতনা, যে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম হবে, তার কোনো ব্যবস্থা কিন্তু ‘৭২ সালের সংবিধানে নেই। সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ হবে কি না এই নিয়ে অনেক মতপার্র্থক্য থাকতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা কী হবে তা নিয়েও এমনকি মতপার্থক্য হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ যে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হবে, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে এইটুকু স্বীকৃতি তো তর্কাতীত। সেটারই বাস্তবায়ন কোথায়?
বলা হয়ে থাকে ‘৭২ সালের সংবিধানের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার আসল চরিত্র কী, যদি আমরা বাঙালী জাতিয়তাবাদের আসল চরিত্রটা দেখি, তাহলে পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাঙালী জাতিয়তাবাদ বলে কেবল শেখ মুজিবুর রহমান চাকমা-মারমাসহ সকল সংখ্যালঘু জাতিকে বাঙালী হয়ে যাবার কথাই বলেননি। আসলে কী কথা বলেছিলেন সেটা এইবারে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। ‘৭২ সালে কী বলতে চেয়েছিলেন এইবার তারা পরিষ্কার করে বলেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালী হিসেবে পরিচিত হবেন। মানে নাগরিকত্বের পরিচয় হবে বাংলাদেশী এবং তার জাতিয়তা হবে বাঙালী। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে আপনি যদি বাঙালী না হন তাহলে আপনি নাগরিক হতে পারবেন না। এখন একজন চাকমা যখন নিজের জাতিয়তার পরিচয় বাঙালী হিসেবে দেবেন তাহলেই কেবল তিনি নাগরিক হতে পারবেন, নতুবা নয়। প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে আপনার জাতিয়তা বাঙালী হতে হবে। তাহলে আপনি জাতিয়তা বাঙালী বলে তাদেরকে নাগরিক হিসেবে খারিজ করে দিয়েছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই একই জাতিগত ফ্যাসিবাদ স্বাধীন বাংলাদেশ তার ভূ-খণ্ডভুক্ত বাঙালী ভিন্ন আর সব জাতিসমূহের ওপর সংবিধানসম্মত উপায়ে পরিচালনা করছে।
অন্যদিকে এই বাঙালী জাতিয়তাবাদ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কথা বললেও কার্যত যে বাঙালী মুসলমানের জাতিয়তাবাদ হয়েছে এই স্বীকৃতি এই সংবিধানেই দেওয়া হয়েছে। এই বাঙালী মুসলমানের জাতিয়তাবাদ করতে গিয়েই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটা যে একটা গোজামিল হিসেবে ছিল, সেইটা আজকে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। আসলে একটা রাষ্ট্র নিজেকে সেক্যুলার করতে পারে তখনই যখন সে কেবল রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পারে। আর একটা রাষ্ট্র রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পারে তখনই যখন ধর্ম যে জাগতিক-মানবিক প্রেক্ষাপট হাজির করে সেটাকে জাগতিক-মানবিক রূপেই প্রকাশ করতে, বাস্তবায়ন করতে সফল হয়। ইউরোপে তাই দেখা গেছে পুঁজিতন্ত্রের বিকাশকালে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে ধর্মের যা কিছু জাগতিক-মানবিক প্রেক্ষাপট তাকে অতিক্রম করে যেতে। যদিও সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান কালে এসে তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আবার প্রশ্নের সম্মুখীন। কিন্তু বাংলাদেশ তো এখনও প্রাথমিক স্তরই পার হয়নি। বাংলাদেশে যদি আমরা ইসলামের কথা বলি, ইসলাম যে ইনসাফের কথা বলে সেটুকু ইনসাফও যদি এই শাসকশ্রেণী কায়েম করতে পারতো, তাহলে তাদেরকে রাষ্ট্রের লেবাস আকারে ধর্মকে হাজির করতে হত না। রাষ্ট্র হিসেবেই নিজেকে জাহির করতে পারতো। কিন্তু যখন তারা ধর্মের পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রকে হাজির করে তার মানে ভুয়া ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে তা হাজির হয়। মার্কসের ভাষায় এ হচ্ছে অসম্পূর্ণ রাষ্ট্র আর ধর্মের লেবাসটা হচ্ছে পবিত্রতা আরোপ করে তার অসম্পূর্ণতা পূরণের ভণ্ডামী। আসলে বিগত চল্লিশ বছর ধরে আমরা দেখে আসছি এই শাসকশ্রেণী জনগণের ন্যূনতম মানবিক বিষয়গুলির ফয়সালা, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপূরণ করতে পারেনি। তার মানে হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম প্রশ্নের যে মীমাংসা তা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। বরং গণ-আকাক্সক্ষার চাপে ধর্মনিরপেক্ষতা ‘৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে রাখলেও মর্মবস্তুতে তা যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই, সেটা আজকের দিনে খোলাসা হয়ে গেছে। আসলে পঞ্চদশ সংশোধনী ‘৭২ সালের অবস্থাকে এখন স্বীকৃতি দিয়েছে মাত্র।
ফলে এই যে চার মূলনীতিকে কেবল নাম আকারে দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হচ্ছে, সংবিধানে এর প্রকৃত যে চেহারা এবং বাস্তবে যা বিরাজমান সেসব সমেতই কি একে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হচ্ছে? এটা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে থাকে তাহলে আমাদের মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জনগণের মধ্যে যা ছিল তার সাথে বেঈমানী করা হবে।
সময় সংক্ষিপ্ত। অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে শেষ কথা বলি, সংবিধানের প্রশ্ন কোন রণকৌশলগত প্রশ্ন নয়। আমরা যখন মৌলিকভাবে সামগ্রিকভাবে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব করবো তখন এটা একটা রণনৈতিক প্রশ্ন আকারে হাজির হয়-কোন্ ধরনের সংবিধান আমরা কায়েম করতে চাই। একটি রাজনৈতিক দল যদি একটি সংবিধান প্রস্তাব করে তাহলে এটা তাদের মৌলিক আদর্শিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই প্রস্তাব করতে হবে। ১৯৭২ সালে পাতি বুর্জোয়া, উঠতি ধনিক শ্রেণীর দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, এখন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাকে তারা সঙ্গতিপূর্ণ ভাষায় হাজির করেছে। সমাজতন্ত্রের নামে তখন তারা নিজেদের ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল, এখন বিএনপি-জামাত জোটসহ সমগ্র শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিবাদ কায়েমের হাতিয়ার হয়েছে বিদ্যমান সংবিধান। সেইরকম একটি সংবিধানকে আজকে মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান বলার কোনো রকম সুযোগ নাই। আমরা যদি সেই সংবিধানকে জনগণের গণতান্ত্রিক সংবিধান বলি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধান বলি, শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধি হয়ে আমরা যদি আওয়ামী লীগের প্রণীত সংবিধানকেই আজকে সংবিধান আকারে প্রস্তাব রাখি, আমাদের আরেকবার ভাবা দরকার। আমরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই? আমরা বাংলাদেশের কোন্ ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে চাই? আজকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হতে পারে। এই সংশোধনী জনগণের সম্মতি নিয়ে করা হয়নি। এই সংশোধনী কেবল নয়, সংবিধানও জনগণের সম্মতি নিয়ে প্রণয়ন করা হয়নি। বাংলাদেশের জনগণের একশভাগ অধিকার আছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে যে অধিকারের বিষয়গুলি এখনো পর্যন্ত আকাক্সক্ষা আকারে জারি আছে, তার এই আকাক্সক্ষার সনদপত্র আকারে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার। সে কারণে মৌলিক মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তাসমেত একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের দাবি তাই এখন জনগণের প্রধান রাজনৈতিক দাবি। এটা ঠিক যে, এই রকম সংবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংবিধান সভার নির্বাচন দরকার, তার বাস্তবতা তৈরি ব্যাপক জনগণের বিপ্লবী উত্থান ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের মধ্যে এই চৈতন্য গড়ে তোলা, তার এই সংগঠিত অবস্থা গড়ে তোলা, সেই বাস্তবতা, সেই শক্তিটা গড়ে তোলা আজকের দিনে প্রধান কর্তব্য। আমাদের দেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি, সমাজের রূপান্তর চান এমন সকল শক্তি, বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তি প্রত্যেকের আজকে দায়িত্ব হচ্ছে ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক অগণতান্ত্রিক চরিত্রকে উন্মোচন করা এবং জনগণের নিজের সনদকে সংগঠিত করার জন্য এবং তাকে কায়েম করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করা। সেই লড়াই, সেই লক্ষ্যে সকলেই আরো সক্রিয় হবেন এই আশাবাদ রেখে বক্তব্য শেষ করছি। আপনাদের ধন্যবাদ।
জোনায়েদ সাকি
প্রধান সমন্বয়কারী,
গণসংহতি আন্দোলন