পূর্বাবস্থা বহাল রেখে, শুধু ঢাকা শহরের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘শর্ত সাপেক্ষে’ গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা প্রতারণামূলক! তারপরও হয়তো এই ঘোষণার মাধ্যমে এ দফার ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’কে স্থিমিত করতে পারলো! কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এতে করে সড়কগুলো কি নিরাপদ হলো?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে প্রথমেই পরিষ্কার হয়ে নেয়া ভাল যে, গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার দাবি আর নিরাপদ সড়কের দাবি মোটেও এক নয়; দুইয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। এমনকি এই আশংকাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার প্রতিক্রিয়ায় সড়কের নৈরাজ্য আরো বাড়বে না তো! কিংবা শিক্ষার্থীদের বাইরের অন্যান্য শ্রেনী-পেশার মানুষ, যারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন- তাদের ওপর বাড়তি চাপ আসবে না তো! এই আশংকা করছি এই জন্য যে, যেসকল অব্যবস্থাপনা, ভুলনীতি ও দুর্নীতির কারণে আমাদের সড়কগুলো ‘অনিরাপদ’ রয়ে যাচ্ছে- তার কোন বদল, এমনকি বদলের প্রতিশ্রুতিও আমরা দেখতে পাইনি।
সড়ক, মহাসড়ক কেন অনিরাপদ?
এই প্রশ্নে উত্তর খোঁজার মধ্যেই সড়ক নিরাপত্তার সমাধানসূত্র নিহিত আছে। এ কারণেই নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের ফোকাস ঠিক করা জরুরী। চলুন, আগে ওই ‘কেন’ গুলো খুঁজি, উত্তর বের হয়ে আসবে।
কলেজছাত্র নাঈমের মৃত্যুর শোকের মধ্যেই গত ২৯ নভেম্বর রাতে আবারো ঢাকার রামপুরায় বাস চাপায় স্কুলছাত্র মাঈনুদ্দিন ইসলাম নিহত হন। পত্র-পত্রিকার খবর বলছে, দুইটি বাসের প্রতিযোগিতায় ওই ছাত্র চাপা পড়েছে। আরেকটা খবর বলছে, ভাড়া নিয়ে বাসের কন্ডাক্টরের সাথে বাহাস এবং একপর্যায়ে মাঈনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে পিষ্ট করা হয়। নাঈনের সাথে ঠিক কী ঘটেছিল তার পরিষ্কার তথ্য না থাকলেও এই ধরনের ঘটনার অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে।
ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, বাসে বাসে প্রতিযোগিতা হয় এবং ভাড়া নিয়েও যাত্রীদের সাথে হেলপার-কন্ডাক্টরদের রেষারেষি হয়। তাহলে এই প্রশ্নটা করা তো জরুরী যে, বাসগুলো প্রতিযোগিতা করে কেন?
খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, বাসে বাসে প্রতিযোগিতা একই রুটের, একই নাম্বারের বাসগুলোর মধ্যেই হয়। যারা বাসে যাতায়াত করেন, তারা প্রায় প্রত্যেকেই ড্রাইভারকে দেয়া হেলপারের ওই সংকেতবার্তা শুনে থাকবেন- ‘ওস্তাদ, পেছনে নাম্বার’। এই সংকেতের অর্থও সবাই আমরা বুঝি যে, পেছনে একই রুটের আরেকটি বাস আছে বা আসছে। হেলপারের সংকেত পাবার পরই ড্রাইভারের চিন্তা থাকে পেছনের বাসকে সামনে আসতে না দেয়া, যাতে যাত্রীদেরকে সে তার বাসেই তুলতে পারে। ড্রাইভারের চোখ তখন থাকে লুকিং গ্লাসে অন্য বাসের দিকে, আর হেলপারের নজর থাকে যাত্রী উঠানোর দিকে। দ্বিতীয়ত, ড্রাইভার আবার একই সাথে অন্য বাসটির আগে যাওয়ারও চেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং দ্বিতীয় বাসের চিন্তাও তাই।
ওরা এমন করে কেন?
এবার অতি সরল প্রশ্ন- ওরা এমন করে কেন? সড়ক তো রেস করার জায়গা নয়! কারণটা মর্মান্তিক। ড্রাইভার, হেলপার কাম কন্ডাক্টর মিলে মালিকের কাছ থেকে বাসটা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দেয়ার শর্তে রাস্তায় নামায়। যেটাকে সাধারণত ‘দৈনিক জমা’ বা ‘দৈনিক ইজারা’ বলে আমরা জানি। ওই দৈনিক ‘জমা’র পরিমাণ রুট ও বাস ভেদে পনেরো শত থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। আর আরেকটা সিস্টেম হলো- যত ট্রিপ, তত টাকা। এই দুই ব্যবস্থাতেই বাস ড্রাইভারদের প্রতিযোগিতা করতে হয় তার আয় বৃদ্ধির জন্য। ফলে প্রতিযোগিতার অবসান চাইলে তার কারণগুলোরও অবসান লাগবে, লাগবে ড্রাইভার -হেলপারদের নির্দিষ্ট মজুরি ও স্থায়ী নিয়োগ, যাতে করে তারা আয়ের ন্যূনতম নিশ্চয়তা পান।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মজুরি বোর্ড শাখার ২০২০ সালের ২১ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ‘হেভি উইথ পিএসভি’ (Public Service Vehicle) লাইসেন্সপ্রাপ্ত বিভাগীয় ও সিটি কর্পোরেশন এলাকার ড্রাইভারের মাসিক ন্যূনতম মোট মজুরি ২০২০০ টাকা, হেভি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারের মোট মজুরি ১৭৮০০ টাকা। এই বেতন নিশ্চিত করার পাশাপাশি, তার দিনে ৮ ঘন্টা (সারা দুনিয়ায় কার্যকরি, বাংলাদেশও আইএলও’র ওই ঘোষণায় স্বাক্ষরদানকারী দেশ) কর্মঘন্টা ও সাপ্তাহিক ছুটির হিসাবটাও যুক্ত, যুক্ত ওভারটাইমের ব্যবস্থাও। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন- একজন ড্রাইভার-হেলপার যদি নির্দিষ্ট বেতনে চাকুরী হিসেবে বাস চালনা পেশায় যুক্ত থাকে, তাহলে কতজন যাত্রী সে পেলো কী পেলো না তাতে কিন্তু সে চিন্তিত হবে না। সে তখন দায়িত্ব আকারে রাস্তায় নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা অনুযায়ী গাড়ি চালাবে। মালিক টিকিটের ব্যবস্থা রাখবেন, গাড়ি রাস্তায় চলছে কিনা তার তদারকি করবে। তখন শখ করে ড্রাইভাররা প্রতিযোগিতা করবে না।
পেশা হিসেবে বাস চালনা তুলনামূলক অত্যন্ত জরুরী ও জননিরাপত্তামূলক পেশা। এই পেশা শুধু পেশা নয়; অন্যের জীবনের নিরাপত্তার সাথেও সম্পর্কিত। ফলে যিনি এই পেশায় যুক্ত হচ্ছেন তাকে তো বটেই, নিয়োগকর্তাদেরও মাথায় রাখতে হবে যে, এর সাথে মানুষের জীবন-স্বপ্ন জড়িত। আইনে এই কারণেই আলাদা করে ‘পিএসভি লাইসেন্স’ উল্লেখ করা আছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন! সরকারি হিসেবের বরাত দিয়ে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে ‘বিবিসি’ বলছে, সারাদেশে ৩২ লাখ গাড়ির নিবন্ধন আছে কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ২৫ লাখ। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক গাড়ি যথাযথ লাইসেন্স ছাড়াই রাস্তায় চলছে। এমনকি বাস চালকদের অনেকেরই পিএসভি লাইসেন্স নেই। ফলে লাইসেন্স না থাকা ড্রাইভারের সাথে সাথে তার নিয়োগকর্তা মালিকও সমান অপরাধী, বরং অধিকতর অপরাধী। বিআরটিএ নিজেও সরকারি সংস্থা হিসেবে এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
সড়কে নৈরাজ্য কেন?
কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করলেই বোঝা যাবে যে, একই রাস্তায় একই লেনে ভিন্ন ভিন্ন গতির যানবাহন চলা বিপদের কারণ। দেশের সড়কগুলোতে সর্বদাই দেখা যায় এই নৈরাজ্য। নির্দিষ্ট গতির জন্য নির্দিষ্ট লেন ব্যবস্থা করার কাজটা কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপকদের, এবং এটা না থাকার দায়টাও তাদের ওপরই বর্তায়। কল্পনা করে দেখুন- শহরের সড়কে চলাচলকারী বাসগুলো একটা নির্দিষ্ট লেন ধরে চলছে এবং একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর ‘বাস-বে’তে বাস স্টপেজ দিয়ে যাত্রী তুলছে ও নামাচ্ছে! ব্যাপারটা কিন্তু অসম্ভব নয় মোটেই। এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে ‘রকেট সায়েন্স’ বোঝার প্রয়োজন নেই। যেটা দরকার সেটা হলো- জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, যার ব্যাপক অভাব রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ব্যবস্থাপকদের।
ড্রাইভার–হেলপারদের কী ধরণের জীবন যাপন করতে হয়, সেটা জানাটাও জরুরী আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠে তারা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন, রাত ১ টায় ঘরে ফিরতে পারেন। যানজটের শহরে যাত্রী হিসেবে বাসে ৩/৪ ঘন্টা বসে থাকা আর ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা ওই বাসে স্টিয়ারিং হাতে ড্রাইভ করার কষ্টের মধ্যে কোনো তুলনাই চলে না। একজন ড্রাইভারের পর্যাপ্ত বিশ্রাম অন্য অনেক পেশার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যা তারা পান না। অমানবিক, অসম্মানের জীবনে ঠেলে দিয়ে তাদের কাছ থেকে ‘অতিমানবিক’ আচরণ ও কর্মকাণ্ড আশা করাটা অন্যায্য।
একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির আঁচ তাদের গায়েও লাগে! আবার একই সাথে ভাড়া বৃদ্ধির আঁচে যাত্রীরাও ঝলসে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২৯ নভেম্বরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী দেশে মুদ্রাস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওদিকে আমাদের মাথাপিছু আয়ও নাকি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার! আবার আমাদের মন্ত্রীরা বলেন, আমরা নাকি নিজেদের অজান্তেই ধনী হয়ে যাচ্ছি! এই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি’র উর্ধ্বমুখী উলম্ফন, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার- এসবই দেশের বিপুল অধিকাংশ মানুষের শ্রম নিংড়ানো অর্থ! বেশির মানুষকে শুষেই কতিপয় মাফিয়ারা সরকারি মদদে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। আর বিভিন্ন নিপীড়িত পক্ষ নিজেদের মধ্যেই বিবাদে লিপ্ত। যেমন, ছাত্রদের বেতন-ফি-ভাড়া বৃদ্ধি, শ্রমিকদের মজুরি না পাওয়া, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, চিকিৎসা না পাওয়া, বেকারদের চাকুরী না পাওয়া ইত্যাদি সবই একই সূত্রে গাঁথা। এসকল পক্ষই আসলে শিকার। আর নিপীড়ক ও শিকারি অভিন্ন এবং একপক্ষ।
পরিবহন মাফিয়া
পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া সিন্ডিকেটের কথাই ধরেন- দৈনিক প্রথম আলো’র গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে সড়ক পরিবহনে বছরে চাঁদাবাজি হয় ১ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন রঙয়ের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামে প্রতিদিন প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হয় ৭০ টাকা করে। সারাদেশের প্রায় পৌনে তিন লাখ বাস, মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে দিনে প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। শুধু তাই নয়, ওই প্রতিবেদন আরো বলছে, একটি বাস নামাতে গেলে ২ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দিতে হয়।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘দৈনিক দেশ রূপান্তর’ও ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, মাসে ৩০০ কোটি টাকা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো পরিবহন খাত থেকে চাঁদা নেয়। এ হিসেবে বছরে ৩৬০০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। বলা বাহুল্য, এর মধ্যেই আছে পরিবহন শ্রমিকদের ঘামের টাকা, ৮০ শতাংশ ছোট বাস মালিকের কষ্টের টাকা! ফলে ‘ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহর কথার সত্যতা হয়তো আসলেই আছে। গত ২৮ নভেম্বর রাজধানীর বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া বিষয়ে বৈঠক শেষে বলেন, ‘ঢাকায় চলাচলকারী পরিবহনমালিকদের ৮০ শতাংশ গরিব। একটি বাস দিয়ে নিজের সংসার চালায় কেউ কেউ। তারা কীভাবে ক্ষতি সামলাবে।’ আসলেই তো ছোট মালিকরাও তো বড় মালিকদের সিন্ডিকেটের শিকার। হয়তো তারাও পদে পদে চাঁদা দিতে দিতে ত্যাক্ত-বিরক্ত, টিকে থাকার চেষ্টায় সংগ্রামরত। ফলে মুনাফা বাড়াতে বা লোকসান কমাতে ড্রাইভার-হেলপারদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন আরো আরো লোড। এই মাফিয়াদের চাপে ড্রাইভার-হেলপাররা যাত্রীদের কাছ থেকে নিচ্ছে আরো একটু অন্যায্য বাড়তি ভাড়া। প্রতিদিন রেষারেষি লেগেই আছে যাত্রী আর বাসের স্টাফদের সাথে। এ যেনো এক প্রবল শক্তিশালী দুষ্টচক্র! যার নাম সিন্ডিকেট। যা আবার আরো আরো সিন্ডিকেটের সাথে সম্পর্কিত। ওই ৩৬০০ কোটি টাকার মধ্যেই আছে নাঈম, মাঈনদের রক্তের দাগ।
ফলে, সড়কের নিরাপত্তার দাবি তোলার সময় ঠিকঠাকমতো শত্রু চিহ্নিত করা জরুরী; সমানভাবে জরুরী মিত্রের সন্ধান আর মিত্রের সাথে ঐক্য স্থাপন। মাঈনুদ্দিন ইসলামের চা বিক্রেতা বাবাও যেমন মিত্র আবার একই সাথে কোনো এক বাস ড্রাইভারের সন্তানটাও হয়তো ক্লাসমেট!
সৈকত মল্লিক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন
#১১/০৯/উম