You are currently viewing স্থানীয় সরকার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

স্থানীয় সরকার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

[২০ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখে এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত প্রয়াত রাজনীতিবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের নিবন্ধ]

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ন্যায্যতার প্রধান ভিত্তি হচ্ছে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকদের অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা। আর নাগরিকদের এই অধিকারের অন্যতম প্রধান শর্ত, একজন নাগরিকের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে এবং নিজে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পরিচালনায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারা। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি স্তরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। জনগণের এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনস্বার্থবিরোধী কোনো ভূমিকা নিলে বা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে জনগণের এই প্রতিনিধি প্রত্যাহারের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। যেকোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনির্বাচিত ব্যক্তির দ্বারা পরিচালনার বিধান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। ফলে সব অবস্থাতেই অনির্বাচিত ব্যক্তি নিয়োগের আইনি ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এ ব্যবস্থা রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকরা অনুমোদন করতে পারে না।

এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থা আমাদের দেশে সাধারণভাবে জাতীয় সংসদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। এগুলো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার কথা বললেও তা সাংবিধানিকভাবে দলীয় প্রধান, দল ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিকভাবে বিকশিত ও পরিচালিত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে আছে। যার জন্য বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় কোথাও জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কোনো ব্যবস্থা জারি নেই। উপরন্তু ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, ঘুষ-দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, চোরাচালানি, কালোবাজারি, জনগণের সম্পদ দখল-লুণ্ঠন, শোষণ-নিপীড়ন মারাত্মকভাবে বাংলাদেশের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ অবস্থায় পরিবর্তন অতি অবশ্যম্ভাবী এবং এ পরিবর্তনের দায়িত্ব পরিবর্তনকামী জনগণের সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির। এ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটানোই এখন সময়ের দাবি।

এ লক্ষ্যে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের স্থানীয় প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের নির্বাচিত, জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য, স্বতন্ত্র কর্তৃত্বসম্পন্ন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমানে সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্থানীয় সরকার প্রশাসন হিসেবে পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার জন্য প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন করে দলগতভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এর ফলে এসব সংস্থায় আরো বেশি কার্যকরভাবে দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। কেননা, জাতীয় নির্বাচনের মতো নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন পাওয়া দলগুলোরই কেবল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিধান রাখা হয়েছে এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। তা ছাড়া যেসব শর্তে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে, তাতে নাগরিকদের অলঙ্ঘনীয় ভোটাধিকারকে শর্তযুক্ত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের ভোটাধিকার অস্বীকার করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত অকার্যকর অপরাজনীতির অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের আবশ্যক প্রয়োজনীয়তার অংশ হিসেবে নতুন বিকশিত রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দিয়ে বর্তমান স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করবে। একইভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার শর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট ভোটার এলাকার মোট ভোটের শতকরা এক ভাগ সমর্থনযুক্ত মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধানও একজন নাগরিকের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অলঙ্ঘনীয় গণতান্ত্রিক অধিকারকে নাকচ করে। ভোটের গোপনীয়তার যে অধিকার, সেটাকেও অস্বীকার করে। এটি গণতান্ত্রিক চেতনার পূর্ণ পরিপন্থী। এই গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আইনিভাবে কার্যকর আছে এবং এটাকে আরো ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে এসব সংস্থা গণতান্ত্রিকভাবে বিকশিত ও কার্যকর করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে সংবিধানের ৯ ও ৫৯ ধারায় যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিধানাবলি উল্লেখিত আছে, তা এযাবৎকালে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা হয়নি। ঐতিহ্যগত ও ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশিত শাসনামলে ইউনিয়ন পরিষদ যেভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক এবং স্থানীয় সরকারের চেতনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে এ সংস্থাগুলো কোনো সময়েই জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশে ও গণতান্ত্রিক চর্চায় কোনো ভূমিকা পালন করেনি। এগুলো সর্বদাই রাষ্ট্রযন্ত্রের ও রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার ও দলের নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হওয়ার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। প্রচলিত এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে এখন যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তা তৃণমূল পর্যায়ে দলতন্ত্র ও ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে আইনসংগত করার লক্ষ্যেই প্রণীত হচ্ছে। এতে তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চতর কোনো স্তরেই গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ও চর্চায় সহায়ক হবে না।

স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্য ও ক্ষমতা যেরূপ হওয়া উচিত :

১. স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, বাজেট প্রস্তুত করা, বাজেট অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা;
২. স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার তদারকি করা;
৩. স্থানীয় কৃষি-শিল্প পরিচালনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, হাটবাজার ও জলমহাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা ইত্যাদি।

স্থানীয় সরকার হতে হবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একমাত্র জনগণই তাদের কাজে ব্যর্থতার কারণে তাদের অপসারণ করতে পারবে; অন্য কোনোভাবে নয়। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যের মধ্যে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো অসমতা থাকবে না; সকলে সমান ক্ষমতার অধিকারী হবে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে চেয়ারম্যান হিসেবে বিশেষ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী হবেন না এমন আইনি বিধান নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার স্বতন্ত্রভাবে আমলাতন্ত্র, শাসন বিভাগ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে এবং একমাত্র জনগণের কাছে জবাবদিহির মধ্য থেকে তার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার অধিকারী হবে। এখানে কোনো আইনি বিধিনিষেধ আরোপ না করার বিধান থাকতে হবে।

অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম
প্রয়াত নির্বাহী সমন্বয়কারী, গণসংহতি আন্দোলন


#জ/উম-৫/১৬

Leave a Reply