( সম্পাদকীয় নোট: আজীবন সংগ্রামী রাজনিতিবিদ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম রাজশাহীতে অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাত্র ১৭(?) বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, মাইতি গ্রুপের সদস্য হিসেবে। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য পরবর্তী সময়েও তিনি আজীবন মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত থেকেছেন, মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সংবিধান প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ‘ ’৭২ এর সংবিধানের একটি পর্যালোচনা’ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম কর্তৃক ফেসবুকে প্রকাশিত একটি লেখা যা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে )
রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের উৎস যে জনগণ তা সামাজিক রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত এবং কোন না কোন ভোট বা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের মধ্য দিয়েই জনগণ একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যক্তি হিসেবে নিজের সার্বভৌমত্বকে স্বচ্ছন্দভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। এইভাবে জনগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তাই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন একটি ব্যক্তির ভেতর নিহিত সার্বভৌমত্ববোধের পরিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। ব্যক্তির এই সামাজিক বিকাশ ও রাজনৈতিক ঊত্থানকে নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিই স্বাধীন সার্বভৌম এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের এই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যক্তি যে সার্বভৌম – সে নিজেই যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস- নিজেই অধিকর্তা, শাসক বা পরিচালক তা সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। ব্যক্তিই সার্বভৌম বা ব্যক্তিই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস – গণতন্ত্রের এই মর্মবস্তুই অবশ্যই শাসনতন্ত্রের বা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত থাকতে হবে এবং শাসনতন্ত্র তার অলংঘণীয় – তাও পরিষ্কারভাবে স্বীকৃত থাকবে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরই এই মৌলিক ও অন্তর্নিহিত সার্বভৌম স্বত্ব রাষ্ট্র রক্ষা করবে এবং রক্ষা করার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করবে। ব্যক্তির সার্বভৌম সত্ত্বাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি গণতান্ত্রিক ব্যক্তি রাষ্ট্রের সকল স্তরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞায় নিজস্ব প্রতিনিধি অর্থাৎ গণপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার ক্ষমতা ভোগ করেন। এবং তার নিজের গণপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবার অধিকার থাকে। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি সর্বোচ্চ সংস্থা জাতীয় পরিষদ ন্যস্ত থাকে। একজন গণতান্ত্রিক ব্যক্তির সেই সার্বভৌম অধিকারকে কোন ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, সরকার বা রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই লংঘণ করতে পারবে না এবং সরকার বা রাষ্ট্র এমন কোন আইন, আদেশ, অর্ডিন্যান্স বা ফরমান অনুমোদন বা জারী করতে পারবে না যা ব্যক্তির অধিকারকে গৌণ করে, হস্তক্ষেপ বা লঙ্ঘন করে। গণপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে সবসময় জবাবদিহিতে বাধ্য থাকার এবং যে কোন সময় অপসারণের বা প্রত্যাহারের অধিকার জনগণের থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপরোক্ত উপাদানে আলোকে বাংলাদেশের সংবিধানের কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে।
বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা তার পক্ষে রাষ্ট্র জাতীয় সংসদের মাধ্যমে প্রয়োগ করার কথা বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানে এই জনগণের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার একটি সাধারণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে মাত্র। এর অলংঘণীয় তার কোন উল্লেখ নাই। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় পরিচালনার মূল নীতিকেও আদালত কর্তৃক বলবৎ যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় নাই।
বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করে তাদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এই গণপ্রতিনিধি নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণ কতটা স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে? তাদের এই ভোটাধিকারের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে তা পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশের সংবিধানের নির্বাচন সংক্রান্ত বিধানবলীর পর্যালোচনার মাধ্যমে। এটা একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই জন্যে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে জনগণের অংশগ্রহণ ও তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি মাত্র মাধ্যম হলো তার স্বাধীন নিরপেক্ষ ভোটাধিকারের প্রয়োগ। এখন দেখা যাক বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের এই ভোটাধিকার প্রয়োগের এই স্বীকৃত পদ্ধতি কি আছে? বাংলাদেশের সংবিধানের জনগণের এই ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থার জন্য একটি নির্বাচন কমিশনারের ব্যবস্থা আছে। এই নির্বাচন কমিশন তার সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা বলে দেশে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। যাতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন গঠন, তার ক্ষমতা, নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিমালার ইত্যাদি যে বিধানবলী রয়েছে তাতে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে তাদের এই ভোটাধিকার প্রয়োগ ও এই ভোটাধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ তাদের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কোন সুযোগ নাই। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮তে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন। সংবিধানের ১১৮ (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) উপঅনুচ্ছেদ সমূহে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ অপসারণের পদ্ধতি বর্ণনা আছে। এই নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকায় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে কার্যাবলী ও দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। কারণ রাষ্ট্রপতি কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকেন। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, সুরাপিশ, মতামত ছাড়া কোন ক্ষমতা প্রয়োগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী নহে। ফলে দলীয় আনুগত্য নাই এমন কোন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগদানে সুপারিশের প্রশ্ন আসেনা। কারণ দলীয় প্রধানই প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন। এখানে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার কোন গ্যারান্টি নাই। তাই এর নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়। ফলে নিরপেক্ষ নয় এমন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় জনগণের স্বাধীন নিরপেক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করা একটি অবাস্তব কথা। তাছাড়া নির্বাচনে কারচুপীরোধ, ভোটারদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি প্রতিরোধের কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহণের নির্বাচন কমিশনের তাৎক্ষণিক কোন কার্যকরী ক্ষমতা না থাকায় এগুলি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে- এদেশের বিগত নির্বাচনগুলিতে। ফলে এসব নির্বাচনগুলিতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভোটারদের ভোটাধিকার লংঘিত হয়েছে। নির্বাচনের কারচুপি হয়েছে এই কারণে যে, কারচুপি করা যায় সে ব্যবস্থা সংবিধানে থাকার কারণে। সংবিধান প্রণয়নকারী সরকার ক্ষমতার নিজ উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার আকাঙ্ক্ষায় সন্নিবেশ করেছে গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধানে এমন সব অনুচ্ছেদ, যার ফলে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণহীনতা পেয়েছে, নির্বাচনে কারচুপি, ভোটা ডাকাতি ইত্যাদির ভোটের বৈধতা-অবৈধতা সংক্রান্ত সকল প্রশ্ন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই সকল বিষয়কে সচেতনভাবেই বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২৫ নং অনুচ্ছেদে সচেতনভাবেই এই সকল বিষয়ে প্রশ্ন তোলা বিচার বিভাগের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে। অনুচ্ছেদে ১২৫ নির্বাচনী আইন নির্বাচনের বৈধতা: এই সংবিধানে যাহা বলা হয়েছে তাহা সত্ত্বেও (ক) এই সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত বা প্রণীত বলিয়া বিরোধীয় নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ কিংবা অনুরূপ নির্বাচনী এলকার জন্য আসন বন্টন সম্পর্কিত যে কোন আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন ঊত্থাপন করা যাইবে না।
(খ) সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইনের দ্বারা বা অধীন বিধান অনুযায়ী কোন কর্তৃপক্ষের নিকট এবং অনুরূপভাবে নির্ধারিত প্রণালীতে নির্বাচনী দরখাস্ত ব্যতীত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন বা সংসদের কোন নির্বাচন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন ঊত্থাপন করা যাইবে না। সংবিধানের এই বিধান এখনো বলবৎ আছে ফলে নির্বাচন সংক্রান্ত কোন বিরোধ প্রচলিত আদালনের মাধ্যমে মীমাংসার এখতিয়ার নাই। সংবিধানে সচেতনভাবেই নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী বৈধতা সম্পর্কে আদালতের এখতিয়ার খর্ব করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত আইন (গণপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭২ পি. ও ১৫৫/৭২) বলবৎ করা হয় এবং এই আইনের সংসদ সদস্যগণের নির্বাচনের বিধি প্রণয়ণ করা হয়। সংসদ সদস্যগণের নির্বাচনী বিরোধ সম্পর্কে সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদের প্রশ্ন সমূহ নিষ্পত্তির জন্যই এই আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাচন ট্রাইবুন্যাল প্রতিষ্ঠা ও সেই ট্রাইবুন্যালে নির্বাচন বিরোধ এবং এই সংক্রান্ত সকল প্রশ্ন মীমাংসার বিধান করা হয়। এই বিধান পরবর্তীতেও ক্ষমতাসীন সরকার নিজ ক্ষমতার স্বার্থে সংশোধন করেন। (রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭৮। অধ্যাদেশ ১৪/৭৮)।
এই উভয় আইনের শুধুমাত্র তিনটি বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে এবং শুধুমাত্র প্রার্থীই নির্বাচনী ট্রাইবুন্যালে দরখাস্ত দাখিল করতে পারেন। এই প্রতিকারসমূহ হলোঃ
১) কোন নির্বাচিত প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করণ।
২) কোন নির্বাচিত প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করে দরখাস্ত প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার ঘোষণা করা দেয়া।
৩) সম্পূর্ণ নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী, দলগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে বা অন্য কোন নাগরিক ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্বাচনী বিরোধ ঊত্থাপনের অধিকারী নহেন। এই অধিকার একজন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিকে তার ভোটাধিকার রক্ষার অধিকার হিসেবেও প্রদান করা হয় নাই। এখানে ভোটাধিকার সম্পূর্ণ প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ।ট্র কখনো করতে পারে না। রাষ্ট্রের এই অধিকার নাই, থাকতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে আছে। তাছাড়া সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত প্রশ্নসমূহ নিজ উদ্যোগে মীমাংসার জন্য কোন এখতিয়ার কোন নির্বাচন ট্রাইবুন্যালকে দেয়া হয়নি। নির্বাচন বৈধতা এবং অবৈধতা সম্পর্কীত প্রশ্ন সরাসরি বিচার বিভাগের নিকট দাখিলের বিধানের অনুপস্থিতি এবং সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিয়োগকৃত ও রাষ্ট্রপতি বা উপ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত নির্বাচন ট্রাইবুন্যালসমূহ কর্তৃক এই সর্বপ্রশ্ন মীমাংসা কতটুকু জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার পক্ষে যায় তা সহজেই অনুমেয়। সংবিধানের ১৯৮ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দান, কাজের শর্তাবলী নির্ধারণ ইত্যাদির বিধানবলীর সুযোগ নিজ ইচ্ছামত ব্যক্তির নিয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনারের কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যদিও সংবিধানের ১১৮ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীনে থাকবেন কিন্তু বাস্তবে নির্বাচন বিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশন গ্রহণে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতা ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক নির্বাচন ট্রাইবুন্যাল এবং নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণেরই ফল।
এছাড়া সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের কোন নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয় নাই। এ গেল জনগণের ভোটাধিকার স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক বিধানের বিধি বিধান। যার দ্বারা কোন রাজনৈতিক সচেতন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিই দাবী করতে পারে না যে, বাংলাদেশের সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান।
রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যাবলীতে জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আরো একটি অন্যতম দিক হলো রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের ও বাজেট প্রণয়নের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কতটুকু ব্যবস্থা রয়েছে তার উপর। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যয় হিসাব নিকাশ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানের একটি সাংবিধানিক পদ রয়েছে। তা হলো মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। একটি মহা হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ অপসারণ কার্যাবলী ও ক্ষমতা সংবিধানের ১২৭, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩১, ১৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে। এতদসংক্রান্ত ১৩২ অনুচ্ছেদে ব্যবস্থা রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের হিসাব সম্পর্কিত মহা হিসাব নিরীক্ষকের রিপোর্ট সমূহ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে। এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংবিধানের পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন এবং ১৩১ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে মহা হিসাব নিরীক্ষক যে রূপ নির্ধারণ করিবেন সেই রূপ আকার ও পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষিত হইবে। যেহেতু মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত ও অপসারণযোগ্য সেহেতু রাষ্ট্রপতি তথা রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের স্বেচ্ছাচারী ব্যয়, দুর্নীতি ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি দুর্নীতিযুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয় সম্পর্কে কার্যকরী বিপরীত কোন রিপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। তেমনিভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীগণের উপর রাষ্ট্রীয় নির্বাহী প্রধানের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যবস্থা থাকায় এই পদে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা সুযোগ থাকায় এইসব পদে নিয়োজিত সরকারী কর্মকর্তাগণ প্রায়ই জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের উপর জনগণের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ থাকে না; রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের জন্ম হয়। আর এই আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধী। বাংলাদেশের সরকারী কর্ম কমিশন, এডভোকেট, জেনারেল ইত্যাদি পদগুলির নিয়োগ পদ্ধতির কারণের এইসব পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে জনগণের পক্ষে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে কোন কার্যকরী প্রতিরোধ করার সাংবিধানিক সুযোগ খুবই সীমিত থাকার কারণে সরকার ও সরকারী কর্মকর্তাগণ গণবিরোধী ভূমিকা পালনের সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে যে, এই সংবিধানের দ্বারা অন্যরূপ বিধান না করা হইয়া থাকিলে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। সংবিধানের এই বিধান বলে সরকারী কর্মকর্তাদের স্বাধীন নিরপেক্ষভাবে জনগণের স্বার্থে কাজ করার স্বাধীনতাকে ও আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করা হয়েছে। এইসব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ অপসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনগণের বা সংসদ সদস্যের কোন নিয়ন্ত্রন নাই। এই সমস্ত বিষয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ইত্যাদি বিস্তারের সীমাহীন সুযোগ রয়েছে। বিগত নির্বাচনগুলি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেও এই নির্বাচনে জনগণ তার স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়নি এবং নির্বাচন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নাই। নির্বাচনকে ঋণখেলাপি, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজদের অংশগ্রহণ মুক্ত রাখা যায়নি।
সরকার যদি স্বেচ্ছাচারী হয় দুর্নীতিবাজ হয় জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করে, জনগণের উপর দমন নিপীড়ন চালায়, জাতীয় স্বার্থ বিলিয়ে দেয় তাহলে সেই সরকারকে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার থাকবে অপসারণের বা উচ্ছেদের। এই অধিকার বাংলাদেশের জনগণকে বাংলাদেশের সংবিধানের বিধি বিধানে দেয়া হয় নাই। অনুরূপভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি গণপ্রতিনিধি হিসাবে জাতীয় সংসদ সদস্যরা যদি জনগণের পক্ষে কথা না বলেন, জনস্বার্থে কাজ না করে ব্যক্তিস্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে কাজ করে, দুর্নীতিবাজ হয় এবং তিনি এলাকার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন যে, এলাকার অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নে কোন ভূমিকা পালন না করেন তবে সে এলাকার জনগণের সেই সদস্যকে অপসারণ বা প্রত্যাহারের কোন অধিতার বাংলাদেশের জনগণের নাই। বা কোন জবাব দিহির ব্যবস্থা নাই। অথচ জাতীয় সংসদ সদস্যগণের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য এটা একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।
অবশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কল্পে নিয়োগকৃত খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যগণ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে একমত পোষণ করতে পারেন নাই। ফলে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান এই কমিটির সংখ্যার গরিষ্ঠের মত হিসাবে গণ পরিষদে পেশ করা হয়। এবং এই গণ পরিষদ তা আলোচনান্তে কিছু সংশোধনীসহ অনুমোদন করেন। এবং এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সংখ্যালঘু সদস্যগণ সংবিধানের যেসব বিধান অন্তর্ভূক্ত বা বাতিল করার পক্ষে মত প্রদান করিয়াছিলেন তার মূল্যায়ণ করা হয় নাই। ফলে শুরুতেই এই সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন ছিল এবং সংবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদনকারীগণ পরিষদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন সেইদিন রাজনৈতিক মহলে বিদ্যমান ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আজকের বাংলাদেশের বর্তমাণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সার্বিক বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের এই সাংবিধানিক প্রশ্ন সমূহ মীমাংসা হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম
প্রথম নির্বাহী সমন্বয়কারী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
জন্ম: ২৯ নভেম্বর ১৯৪৯, মৃত্যু: ২৬ মে ২০১৭