গার্মেন্ট শ্রমিকদেরকেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মতোই ঈদের ছুটি তিন দিন বরাদ্দ করেছে সরকার। ছুটিতে কর্মস্থলেই থাকতে হবে শ্রমিকদের- এমন নির্দেশনাও দিয়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। ইতিমধ্যেই সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঘরমুখো মানুষের স্রোত সৃষ্টি হয়েছে। সেই জনস্রোত ঠেকাতে ইতিমধ্যেই ফেরী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, ঘাটগুলোতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না জনস্রোত। এই জনস্রোতের বড় অংশই খেটে-খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ‘ঘরযাত্রা’ এখনো শুরু হয়নি, শুরু হবে। ঠাসাঠাসি করে গ্রামে ছুটে গেলে দেশময় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবার আশংকার জায়গা থেকে সরকারি নির্দেশনা, মাত্র তিন দিন ছুটি এবং দূরপাল্লার বাস বন্ধ- এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভাবনা কী? এ বিষয়গুলো নিয়ে গত শুক্রবার ঢাকার মিরপুরের শ্রমিক এলাকায় বেশ কয়েকজন গার্মেন্ট শ্রমিকের সাথে কথা হলো, একসাথে ইফতার করলাম। তাঁদের প্রত্যেকেই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে গার্মেন্টে কাজ করেন। প্রত্যেকের কথাতেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেলো, কারো কথায় আক্ষেপ, কারো মধ্যে তীব্র হতাশা। তাঁদের কথা ও যুক্তিগুলোর সারসংক্ষেপই তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে এই লেখার মধ্যে।
- ছুটি দিবে না, তবে গত ২ মাস ধরে অতিরিক্ত কাজ করালো কেন? এই প্রশ্নটা সকল শ্রমিকের, আমাদেরও। এমননিতেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা ডিউটির কোনো বালাই নেই। ১২ ঘন্টা, ১৪ ঘন্টা, শিপমেন্টের দোহাই দিয়ে মাঝেমাঝে আঠারো ঘন্টা ডিউটিও করেন তারা। গত ২ মাস ধরে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনও ডিউটি চলছে বেশিরভাগ কারখানাতেই। গত মে দিবসের আগের দিনও সারারাত ডিউটি করেছেন অনেক শ্রমিক, আবার দিনের বেলা ঘুমিয়ে সন্ধ্যায় আবার যোগ দিয়েছেন ডিউটিতে; যাতে মালিকের খুব বেশি ‘লস’ না হয়! সেজন্যই এই ব্যবস্থা। সামনে ঈদ বলে তা মেনেও নিয়েছেন শ্রমিকরা।
সারাবছর তাঁদের ক্যাজুয়েল লিভ, মেডিকেল লিভ, জাতীয় দিবসগুলোর ছুটির কী হাল- তা অনেকেরই জানা। এমনকি অর্জিত ছুটি প্রাপ্তিও শূন্য। বেশিরভাগ কারখানার চিত্রই একই। এমনকি নিকট আত্মীয় মারা গেলেও ছুটি পাওয়া যায় না- এমন অভিজ্ঞতা আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিকেরই। এমনও হাজারো ঘটনা আছে যে, বাবা মারা যাওয়ায় বাড়ি গিয়েছেন ২ দিন পরে কারখানায় আসার পর স্থানীয় প্রশাসনের স্বাক্ষর করা ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ আনতে তাকে আবার বাড়ি পাঠানো হয়েছে। মালিকরা নাকি মনে করে শ্রমিকরা মিথ্যা অজুহাতে ছুটি নেয়, কাজে ফাঁকি দেয়। নিজের বাবার ডেথ সার্টিফিকেট যোগাড় করতে হয় শ্রমিকদের, যাতে তার চাকুরী টিকে থাকে। এবং ওই বেদনার দিনগুলোও ১৪ দিনের ক্যাজুয়েল লিভের মধ্যে ঢোকে না, তাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়, বেতন কাটা হয়। এই তো অবস্থা!
এবার আসি ঈদের ছুটির প্রসঙ্গে। সাধারণত ঈদের সময় তাঁরা সব মিলিয়ে ৭ দিন, ১০ দিন, ১২ দিন, এমনকি কেউ কেউ ১৫ দিনও ঈদের ছুটি কাটিয়ে আসেন গ্রামের বাড়ি থেকে। মালিকরা তা অনুমোদনও করে। কারণ ছুটির আগেই শ্রমিকরা অতিরিক্ত কাজ করে তা পুষিয়ে দিয়ে যান। এবং এসেও অতিরিক্ত ডিউটি করেন যদি বাকি থাকে কিছু। শুধু তাই নয়- ওই ছুটির মধ্যে শ্রমিকের পাওনা ছুটিগুলো কাগজে-কলমে মিটিয়ে দেন মালিকরা, যাতে অফিসিয়াল ডকুমেন্টস পরিষ্কার থাকে। এবারো গার্মেন্টের শ্রমিকরা ঈদে ছুটি কাটানোর জন্য অনেকদিন ধরেই অতিরিক্ত কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাত করে ঈদের কিছুদিন আগে তাঁদেরকে সরকারি নির্দেশনা দিয়ে বলা হচ্ছে- ৩ দিনের বেশি ছুটি দেয়া হবে না এবং ঈদের মধ্যে কর্মস্থলেই থাকতে হবে। এর জবাবে শ্রমিকদের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন- ঈদ বোনাস কি অতিরিক্ত দিবেন, যদি ছুটি না দেন? না দিলে এতোদিন খাটালেন কেনো?
- ‘মালিকরা এবার বিদেশে ঈদ আনন্দ করতে পারবে না বলে ছুটি কমিয়ে দিয়েছে’, এমনও মনে করছেন শ্রমিকরা। আসলেই যুক্তিযুক্ত কথা। সাধারণত দেখা যায়- অন্যান্য ঈদে গার্মেন্ট মালিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করতে যান দেশের বাইরে, বা যদি আগে থেকেই পরিবার বিদেশে বসবাস করে তাহলে সময় কাটাতে, দেখা করতে যান। শ্রমিকদের যুক্তি হলো- এবার যেহেতু করোনার কারণে বিদেশে যাওয়া ‘ঝামেলাপূর্ণ’ তাই মালিকরা দেশেই থাকবেন এবং তিনদিন পরেই আবারো প্রডাকশন চালু করে ‘শ্রমিকশোষণ’ করবেন। একজন তো বলেই ফেললেন, ‘তারা তো ঈদের আনন্দের চাইতে টাকা কামানোতেই বেশি মজা পান’। আরেকজন বললেন, তাদের তো আর শ্রমিকদের মতো গ্রামে শেকড় নাই তেমন। আমাদের যেমন ‘এক পা কারখানায় আর আরেক পা থাকে গ্রামে’, আর তাদের তো উল্টো- ‘এক পা এই দেশে আর আরেক পা বিদেশে’।
- ‘করোনা সংক্রমণ রোধে ঈদে গ্রামে যাওয়া বন্ধ রাখাই তো ভালো, ছুটি বেশি দিলেই তো আপনারা গ্রামে দৌড় দিবেন’- এই কথা শুনেই ক্ষেপে গেলেন শ্রমিকরা। বললেন- ‘হ, করোনা তো শুধু শ্রমিকরাই ছড়ায়! আবার সুবিধামতো করোনা খালি শ্রমিকদেরকেই ভয় পায়’।
আসলেই তো তাই! লকডাউনের সময় দেখা গেলো, প্রায় সকল সেক্টরেই লকডাউন বা সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছে কিন্তু গার্মেন্ট কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। এবারো তাই এর আগেরবারও তাই। যেনো করোনা শ্রমিকদের হয় না। বিজিএমইএ’র আগের সভাপতি তো এক অদ্ভূত তত্ত্ব ফেঁদে বসলেন! বললেন- শ্রমিকদের কী যেনো একটা শক্তি আছে, যাতে করোনা তাঁদের আক্রান্ত করতে পারেনা। এবং ফলাও করে তারা বলে যাচ্ছেন- শ্রমিকদের আক্রান্ত হবার হার অনেক কম। কিন্তু একবারও এটা বলেন না যে, ৪০ লক্ষ শ্রমিকের জন্য করোনা পরীক্ষার কয়টি পিসিআর মেশিন আছে? করোনার উপসর্গ দেখা দিলে ওই শ্রমিককে কি স্ববেতন ছুটি দিয়েছেন/দিবেন? করোনা পরীক্ষার জন্য যে টাকা লাগে তা কি বরাদ্দ দিয়েছেন/দিবেন? করোনা পজিটিভ হলে ১৪ দিনের ‘কোয়ারেন্টিন’ শেষে সে কি আবার চাকুরিতে জয়েন করতে পারবে? এগুলোর উত্তর তারা দিবেন না। তারা এই ব্যাখ্যাও দিবেন না যে, বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের গড় বয়স ৩০-৩৫ বছর। তারমানে, বেশিরভাগই তরুন-যুবা। ফলে, হয়তো করোনা পজিটিভ হলেও তারা এমননিতেই সেরে উঠছেন, বা মরে গেলেও ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবেই ধরে নেয়া হচ্ছে। আমাদের সামনে সেই তথ্যও নেই। কারণ রেকর্ড রাখার তো কোনো বালাই নাই! ফলে কারখানা চালানোর সময় তারা বলবে- করোনায় শ্রমিকদের কিছু হয় না। আবার যখন ঈদ আসবে, ঈদের বাড়ি যাওয়ার প্রশ্ন আসবে তখন বলবে- করোনা ছড়িয়ে যাবে দেশময়। এই দ্বৈতনীতির মূলনীতি একটাই ‘শ্রমিক মারা’, শ্রমিকের জীবনকে অন্যের জন্য ‘খরচযোগ্য’ হিসেবে বরাদ্দ দেয়া। এই করোনাকালে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি বিনা কাজে বেতন নিচ্ছেন, বিভিন্ন ভাতা নিচ্ছেন। তারাই নাকি শ্রমিকদের ঈদের ছুটি বাড়ানোর কথা শুনলেই বিরক্ত হন! কই, তারা তো কখনো বলেন না- ‘আমি তো কোনো কাজ ছাড়া বেতন পাচ্ছি, তাই আমার বোনাসটা শ্রমিককে দিয়ে দেই’? তারা তো লকডাউনের মধ্যে বৈশাখী ভাতাও ছাড় দেন নাই! তারা যদি এতোই করোনা নিয়ে সচেতন থাকেন তাহলে তারাই ঈদ করা বাদ দিয়ে বাসায় বসে থাকুক। তা তো তারা করবেন না, তারা তো ঠিকই প্রাইভেট গাড়িতে, প্লেনে করে বাড়ি যাবেন বা বাড়ি থেকে আত্মীয়-স্বজন আনিয়ে, অনলাইনে শপিং করে ঈদ উৎযাপন করবেন। আসলে তারা ভীত এই কারণে যে, শ্রমিকরাও যদি বাড়ি যায় তাহলে পথে ভীড় বাড়বে, ফেরীতে প্রাইভেট গাড়ির জায়গা হবে না, তাদের আরামে ব্যাঘাত ঘটবে! পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ করেছেন ভালো কথা, কিন্তু প্রাইভেট গাড়ি খোলা কেনো? অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট গুলো চলছে কেনো? নাকি এখন বলবেন- বড়লোকের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না?
করোনাকালে তিন লক্ষাধিক গার্মেন্ট শ্রমিকের চাকুরি গেছে। অনেকেই তাঁদের আইনগত পাওনা অর্থ, এমনকি বকেয়া বেতন পর্যন্ত পাননি। বেতন-পাওনা না দিয়ে বন্ধ হয়ে কারখানার সংখ্যাও আছে। কিন্তু ঠিকই আবার গার্মেন্ট মালিকরাই সবচেয়ে বেশি সরকারি প্রণোদনা নিয়েছে। কয়েক দফায় সেটার পরিমাণ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। সেই টাকা পেয়েও তারা শ্রমিকদের বেতন ঠিকঠাকমতো দেয়নি। এবছরও তারা আবার আরো ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে। অথচ বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছরের সার্বিক রপ্তানি জুলাই থেকে এপ্রিলের মধ্যে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেড়ে ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
করোনার অজুহাতে, অর্ডার না থাকার কথা বলে শ্রমিক ছাঁটাই করেছে তারা। বেশিরভাগ কারখানাতেই এখন হেলপারের কাজও অপারেটরদের করতে হচ্ছে, কারণ হেলপারদের ছাঁটাই করা হয়েছে। প্রোডাকশান টার্গেট বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিপুল মাত্রায়। শ্রমিকরা চাকুরী হারানোর ভয়ে নিজেকে আরো বেশি মেশিন বানিয়ে, জানের ওপর জুলুম করে, করোনার ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করে যাচ্ছে। ইউএনডিপি তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছে, গত বছরের লকডাউনের সময় গার্মেন্ট শ্রমিকদের আয় কমেছে ৩৫ শতাংশ। অন্যান্য আরো গবেষণায় উঠে এসেছে তাঁদের দুর্দশার কথা। গত বছর কয়েক মাস ধরে শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করেছে।
কিন্তু প্রাপ্তি কী? লকডাউন চলছে, বাস বন্ধ কিন্তু কারখানা খোলা, ডাক্তার জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রেখে বিশেষ প্রণোদনা পায়, পুলিশ মাঠে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা’র জন্য ভাতা পায়, ব্যাংকার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার জন্য বিশেষ সুবিধা পায়; কিন্তু করোনাকালে সরকারের ভাষ্যমতে অর্থনীতি বাঁচানোর কাজ করে ভ্যাক্সিনের অগ্রাধিকার তালিকাতেও নাম যুক্ত হয় না গার্মেন্ট শ্রমিকদের। বোনাস-ভাতা-প্রণোদনা তো দূরের কথা! এগুলো নিয়ে কখনো কোনো কারখানা মালিকপক্ষের নেতাদের কোন বক্তব্যও শোনা যায় না। তারা খালি শ্রমিকের মধ্যে ‘কী একটা শক্তি’ খুঁজে বেড়ায়!
- এতো আবেগের দরকার কী? একবার ঈদ না করলে কী হয়? এই প্রশ্নগুলো তারাই যৌক্তিক মনে করেন, যারা শ্রমিকের জীবন সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা রাখেন না। ৪০ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিক ও আরো ৪০ লক্ষ বস্তিবাসী কিভাবে থাকেন, কিভাবে বাঁচেন, কী ধরনের জীবনদর্শনে তারা বিশ্বাসী, কী ধরণের আবেগ তাদের মধ্যে কাজ করে- এগুলো দেশের সরকারি নীতিনির্ধারক ও উপরমহলের মানুষদের কাছে অজানা এবং তারা হয়তো জানার প্রয়োজনটাও বোধ করেন না। তারা তো মানুষ দেখে না, দেখে মেশিনের মতো শরীর!
টিনের ১০ ফিট বাই ১০ ফিট ঝুপড়ি ঘরে জামাই-বউ, পোলাপান, বাবা-মা, ভাই-বোন কিভাবে চৌকির উপরে-নীচে, মেঝেতে ল্যাপ্টাল্যাপ্টি করে বসবাস করেন! ৪০-৫০ জনের জন্য ২/৩ টি টয়লেটে পেশাব-পায়খানার কাজ সারেন তারা। ৩ টি চুলায় রান্নার কাজ সারেন সিরিয়াল দিয়ে। নারী শ্রমিকরা সূর্য্য ওঠার আগে উঠে চুলা জ্বালেন। ওরা সূর্যের আলো দেখতে পায় না; ভোরে বের হন আর রাতে ফেরেন। সারারাত ডিউটি থাকলে পরেরদিন সারাদিন টিনের ঘরের গরমে সিদ্ধ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন…! এই তো তাদের জীবন! যারা ব্যাপক ‘প্রাইভেসি’ নিয়ে জীবনযাপন করেন, তাদের কাছ থেকে ওইসব প্রশ্নই আসবে। যারা রিসোর্টে ঘুরতে যান ফ্রেস বাতাস খেতে, সমুদ্রে যান স্নান করতে; তাদের আবেগ আর শ্রমিকের আবেগ মিলবে কিভাবে? শ্রমিকদের ‘এক পা থাকে শহরে আর এক পা থাকে গ্রামে’। বছরে দুই ঈদই তাঁদের নিঃশ্বাস নেয়ার সময়, গ্রামই তাঁদের রিসোর্ট, পুকুরে-নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করে গোসল করাই তাঁদের জন্য সমূদ্রস্নান। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা চেয়ে থাকে ঈদে একটা সস্তা কাপড় পাওয়ার জন্য। ভাই-বোনদের বিয়েসাদীর আয়োজন থাকে ঈদের পরে, যাতে তাঁরা উপস্থিত থাকতে পারি। বাড়ির উঠানকেই তাঁরা কমিউনিটি সেন্টার বানিয়ে অনুষ্ঠান করেন। ঈদের এই কয়দিন তাঁদের জন্য সারাবছরের মেশিনের জীবনে তেল-মোবিলের মতো কাজ করে।
- গ্রামীণ অর্থনীতির যোগানদাতাও শহুরে শ্রমিকরা। ঈদের সময় শহরের বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রামে ঢোকে। দেশীয় অনেক ব্যবসার সবচেয়ে বড় মৌসুমও এই ঈদের সময়টাই। ধরেন, ৪০ লক্ষ গার্মেন্ট শ্রমিক আর ৪০ লক্ষ বস্তিবাসীর হিসেবটাই যদি করেন- তাহলে দেখা যাবে, তাদের ৯৫ ভাগই ঈদের সময় বাড়ি যান। পরিবারের আত্মীয়-পরিজনদের জন্য জামা-কাপড়, উপহারসামগ্রী সাথে নিয়ে যান। একজন শ্রমিক যদি গড়ে ৫ জনের জন্যও ৫ টা পোশাক নিয়ে যান; তাহলে তাঁরা ৪০+৪০=৮০ লক্ষ শ্রমিক ৪ কোটি জামা-কাপড় ক্রয় করেন এই ঈদের সময়। আয়না-চিরুনী-জুতা-স্যান্ডেল-লিপস্টিক, খেলনা— ইত্যাদির কথা বাদই দিলাম। এবং তারা গ্রামে গিয়ে যে কয়দিন থাকেন সেই কয়দিন সবাই মিলে ‘ভালো-মন্দ’ খান। মিস্টি-মিঠাই কিনে নিয়ে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যান বেড়াতে। অর্থাৎ গোটা গ্রামীন অর্থনীতিতে বিপুল অংকের অর্থের সঞ্চালন ঘটে। আবার ফেরার সময় চাল-ডাল নিয়ে আসেন সাথে করে। অন্যদিকে ‘বড়লোক’রা, মালিকরা, উচ্চবিত্তরা কী করে? তাদের বেশিরভাগই, এমনকি কিছু উঠতি মধ্যবিত্তও ঈদের শপিং করতেও দেশের বাইরে যায়, ঈদের ছুটি কাটাতেও অন্য আরেকটা দেশে যায়। টাকাটা ঢেলে দিয়ে আসে আরেক দেশে। এই হিসেবটা শ্রমিকরা এইভাবে না মিলালেও আবেগ দিয়ে দেশের গ্রামীন অর্থনীতির ব্যাপক উপকারটা করে যান।
সোজা-সাপ্টা কথা:
ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে, ছুটি নিয়ে টালবাহানা করে শ্রমিকদের আবেগের জায়গাতে আঘাত করবেন না- এই ন্যায্য দাবিটা জানাই। করোনা সংক্রমণ রোধ করেও কিভাবে তাঁদেরকে নিরাপদে গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদ করার সুযোগ করে দেয়া যায় সেটার ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। কমপক্ষে ১০ দিন ছুটি দিন। শ্রমিক অঞ্চল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকদের জন্য ডেডিকেটেড বাসের ব্যবস্থা করুন। ভাড়া শ্রমিকরাই দিবে, গার্মেন্ট মালিক ও সরকার শুধু ব্যবস্থা করে দিবেন। ফেরার সময়ও একই ব্যবস্থা করা সম্ভব। দরকার স্বদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধ। খেয়াল রাখা দরকার- মালিকদের রাষ্ট্র ও সরকারগুলো শ্রমিককে তো ইতিমধ্যেই ‘মেশিন’ বানিয়েছে, সেই মেশিনেরও বিশ্রাম দরকার উৎপাদনের জন্য। যান্ত্রিক মেশিন বিগড়ে গেলেও কথা বলে না, কিন্তু শ্রমিক নামের জীবন্ত মেশিন কথা বলে, কথা বলায়ও।
সৈকত মল্লিক
শ্রমিক অধিকার কর্মী
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।