( ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে দেশ রুপান্তরে প্রকাশিত ফিরোজ আহমেদের কলাম)
[জন্ম : ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০; মৃত্যু : ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬]
আশ্চর্য শোনালেও সত্যি যে, একজন মাত্র রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে তাদের জীবদ্দশায় শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছিলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এঁকেছিলেন ছবি। পূর্ব বাঙলার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা তার মতো করে আর কেউ বলেননি, যেন তিনিই ছিলেন সাধারণ জনতার প্রতিচ্ছবি। তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প বলতেই মনে আসে ঢাকায় গণহত্যা আর গ্রেপ্তারের কথা শোনা মাত্র বয়োবৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর পায়ে হেঁটে আসামের উদ্দেশে যাত্রা, যেন তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা না পড়েন। যেন মানুষের মনোবল ভেঙে না যায়। তার বয়স তখন প্রায় ৯০!
ঘরে বসে থেকে হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে দেশবাসীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধেই অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বর্ষীয়ান এই নেতার বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে হয়নি। এই দৃশ্যটা এঁকেছিলেন সৈয়দ ইরফানুল বারী, তার যাত্রাসঙ্গী মওলানা ফসকে গেছেন টের পেয়ে ক্রুদ্ধ পাকিস্তানি সেনারা সন্তোষে মওলানার কুড়েঘরটা ছাই করে দিয়ে তাকে খুঁজতে নেমেছে গ্রেপ্তার করার জন্য। পথে পথে দগ্ধ গ্রাম, পলায়নপর অসংখ্য মানুষ। একবার দুবার মওলানার দেখাও পেল হানাদাররা, কিন্তু অতিচেনা মুখটাকে আলাদা করতে পারল না আরও বহু গ্রামীণ বৃদ্ধের চেহারার সঙ্গে; সেই তালপাতার টুপি, সে ঢোলা পাঞ্জাবি তো আরও বহু মানুষেরই পরিধানে। কেউই চিনিয়েও দিল না, ধরিয়ে দিল না তাকে। পাকিস্তানিরা খুঁজছে মওলানা কোথায়, আর জনতার মাঝে মিশে পায়ে হেঁটে মওলানা চলেছেন যমুনার দিকে, নৌকা করে সীমান্ত পেরিয়ে যাবেন আসামে। পথে এক দরিদ্র চাষি অনুনয় করলেন তার বাড়িতে একবেলা দাওয়াত নিতে। সামান্য ভাত আর সালুন তিনি আয়োজন করতে পেরেছেন, তাই
তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে তিনি সঙ্গী ইরফানুল বারীকে বলছেন : সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।
এই হলেন মওলানা ভাসানী, যার গোটা জীবন ছিল সংগ্রামের অপর নাম। কৃষক পরিবারের সন্তান, জন্ম সিরাজগঞ্জের ধনপাড়া গ্রামে। মাঠে গরু চরিয়েছেন, দরবেশের সাথী হয়ে চলে গেছেন দেশান্তরে। দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়েছেন কিছুকাল। কিন্তু বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকের জীবন সংগ্রামই ছিল তার আসল শিক্ষক। তাদের রাজনীতিই তিনি করে গেছেন আজন্মকাল।
২. মওলানা রাজনীতির জীবন শুরু করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন দিয়ে। ব্রিটিশদের কারাগারে দশ মাস কাটিয়েছেন রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই। কংগ্রেসে বেশ কিছুকাল যুক্ত থাকলেও তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব ছিল জমিদার শ্রেণির হাতে। জমিদারদের বড় অংশ সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ কৃষকরা তাদের হাতে নির্যাতিত হতেন। ভাসানী এই সাধারণ কৃষকের পক্ষে একের পর এক কর্মসূচি দেওয়ার কারণে কংগ্রেসের সঙ্গে তার স্থায়ী ছাড়াছাড়ি ঘটল ১৯৩৭ সালে। এরপর যোগ দেন মুসলিম লীগে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হক, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী মিলে আওয়ামী মুসলিম লিগ গঠন করেন, এবং দলটির নাম থেকে সম্প্রদায়গত পরিচয় বাদ দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য অসাম্প্রদায়িক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সেটাকে গড়ে তোলায় মওলানা একক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
সাধারণ কৃষকের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যেমন কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন, তেমনি আমলা-সামরিকতন্ত্র-জোতদারতন্ত্র আর বাঙালিদের ওপর জাতিগত শোষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি অনায়াসে মুসলিম লিগ ত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লিগ গড়ে তুলতে। এই আওয়ামী লিগকে যখন কৃষকের স্বার্থরক্ষায় অগ্রণী মনে হয়নি, এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে তৎপর দেখা গেল, নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগও ত্যাগ করে তিনি গড়লেন নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ।
৩. আসামে এখন যে এনআরসি’র নামে নিপীড়ন চলছে, তার পুরনো একটা সংস্করণ গত শতকের শুরু থেকেই চলছিল। ভাসানী ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল এলাকায় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়াও আসামে নিপীড়িত কৃষকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন। সেখানে তিনি বহুবার হামলা-হুমকি এবং আইনগত নিপীড়নের মুখোমুখি হন। অন্যদিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এলাকার জমিদাররা কেউ কেউ তাদের এলাকায় মওলানাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, তার বিরুদ্ধে বহুবার লাঠিয়াল লেলিয়ে দেওয়া হয়। কৃষকের জেগে ওঠার চেতনার ওপর ভরসা করেই অকুতোভয় মওলানা তার কাজকর্ম অব্যাহত রাখেন, তারাই ছিলেন তার প্রধান পাহারাদার।
একইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নতুনভাবে শোষকের চেহারা নিয়ে আসা মানুষদেরও প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করেননি। ভাষা আন্দোলনে তিনি অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও তার ভূমিকা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম পাকিস্তান বঞ্চিত করা অব্যাহত রাখলে তাদের ‘সালামুআলাইকুম’ জানিয়ে দেওয়া হবে। স্মরণীয় যে, এই ভূখণ্ডের প্রথম কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলায় তার ভূমিকা ছিল অবিকল্পের। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠা শিল্প শ্রমিকরা তাকে নেতা মানতেন, সেগুলোর অধিকাংশেরই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার অনুসারী ছাত্র সংগঠনের নেতারা অধিকাংশ সময়ে ডাকসুসহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হতেন।
’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত উপকূলে দ্রুত সফর করে ফেরত এসে তিনি পল্টনে যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তা অমর হয়ে আছে শামসুর রাহমানের কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ আর জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্মে।
৪. ভাসানী মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারত সরকার তাকে প্রায় অন্তরীণ দশায় বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এর ফলে বলা যায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা অনালোচিত কিন্তু সুদূরপ্রসারী ঘটনা এটি। মুক্তিযুদ্ধের পর অনতিবিলম্বে মওলানা নতুন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গড়ে তোলার দাবি জানান, যারা নতুন দেশের সংবিধান রচনা করবেন। তার সেই দাবি অগ্রাহ্য করা হয় এবং পাকিস্তানের সংবিধান গড়ে তোলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের নিয়েই সংবিধান রচনা করা হয়। মওলানা এই আমলেও অন্তরীণ দশার শিকার হন।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে মওলানার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি সাপ্তাহিক হককথার প্রকাশ। সরকারের দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের বিস্তারিত বিবরণ, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও অত্যাচার এবং স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠতে থাকায় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়। সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নিষিদ্ধ জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক হককথা। এছাড়া
পাকিস্তান আমলে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। মওলানার শেষ গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি ছিল ফারাক্কা লংমার্চ।
ফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনোইতিক পরিষদ
গণসংহতি আন্দোলন