খুব নিবিড়ভাবে কালকের ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ড যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে একজন মানুষ হিসেবে মূল্যবোধের নির্মম পরাজয় ও ভীষণ দীনতা আমাকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য করছে। পরিষ্কারভাবে লেখার শুরুতে বলতে চাই, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমার কাছে ধর্ম হলো মানুষের বিশ্বাসের সাথে যুক্ত একটি মূল্যবোধ, যা কিনা সামাজিকতা ও মানবিকতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো, ভেদাভেদ সৃষ্টি করা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে রাজনীতিকরণের এই প্রক্রিয়া যে বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে চলে আসছে তার প্রতিকার আদৌ সম্ভব? শুরুতেই বলে রাখি ধর্মকে রাজনীতিকরণের এই প্রক্রিয়াটি একটি বৈশ্বিক ধর্মীয় রাজনীতির অংশ যা কিনা স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গত এক দশকে খুবই বিচক্ষণতার সাথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্বেও বলেছি, আবারো বলছি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামেগঞ্জে, হাটে বাজারে, যে বিভিন্ন সময় নিয়ন্ত্রনহীন বিদ্বেষপূর্ণ ওয়াজকার্য পরিচালনা করা হয় তারই একটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আজকের লালমনিরহাটের ঘটনা। দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামক আইন কেবলই রাজনৈতিক ব্যবহারকরণ ও নিয়ন্ত্রণ নিমিত্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউটিউব ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ ও কুরুচিপূর্ণ প্রচার-প্রচারণার জবাবদিহিতা না থাকায় সেখানে মানুষের মাঝে ইসলামকে বিদ্বেষ ও ভেদাভেদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয় এবং ধর্মানুভূতির নামে মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা হতে দূরে রাখার কুফল আজকের লালমনিরহাটের ঘটনা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে যুক্ত করে যে সকল বিদ্বেষপূর্ণ ওয়াজ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ছরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা নানাভাবে সাধারণ মনে ধর্মের একটি ভ্রান্তিমূলক চিত্র জনসাধারনের মনে প্রভাব বিরাজ করে চলেছে। লাগামহীনভাবে ব্যাঙের ছাতার মত গ্রামে গ্রামে শহরের অলিতে গলিতে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলোর যথোপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, চিন্তা ও মননশীলতার নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়, বিচার ব্যবস্থার স্থবিরতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অগনতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার ফসল আজকের বাংলাদেশ। ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে তৌহিদী জনতার সাথে আঁতাত, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও হঠকারিতাকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় দেয়ার কুফল আজকের লালমনিরহাট। মনে রাখা প্রয়োজন, ধর্মানুভূতির রাজনীতি, বিদ্বেষপূর্ণ ধর্মীয় মনোভাব যখন একটি জাতির অর্ধেকেরও বেশি মানুষের চিন্তায় স্থান দখল করে নেয় তখন সেই জাতিকে উদ্ধার করতে পারে কেবল মাত্র রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আর জবাবদিহিতার সাংস্কৃতিক চর্চা। যদি গ্রামাঞ্চলের স্থানিক বিন্যাসে ধর্মীয় অপব্যবহার, কুরুচিপূর্ণ ও বিদ্বেষপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক ওয়াজের সেন্সরশিপের দিকে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ না দেয়া হয় তবে ভবিষ্যতে এই রকম আরো নৃশংসতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে। এবার আসি ভীষণ ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় ইসলাম প্রসঙ্গে। আমার জ্ঞানত পরিসরে মনে হয় না, ইসলামের মূল্যবোধে বিশ্বাসী মডারেট কোন মুসলিম কোন পরিসরে এই নৃশংস ঘটনার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করতে পারে। যে কোন অর্থে এই নৃশংস ঘটনাটি কেবল ধর্মান্ধতার ভয়াবহতাকে পরিবেশন করেছে, ইসলাম ধর্মের শান্তি ও সহিষ্ণুতার মূল্যবোধকে কলঙ্কিত করেছে। ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের বার্তাবাহক হিসেবে পরিবেশনের এই দায়ভার কি কোনভাবে উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে যেতে পারে?
একই সাথে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার নেপথ্যে কাজ করেছে দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক চর্চা, একটি অনির্বাচিত সরকারের কেবলই ক্ষমতায় টিকে থাকার লিপ্সা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সুচিন্তিত মতপ্রকাশে বাধা, প্রগতিশীল চর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে বাঁধাগ্রস্ত করা, পাঠ্যপুস্তক হতে শুরু করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হিসেবে পরিবেশনের ব্যর্থতা, দীর্ঘদিন ধরে মুক্তমনা, প্রগতিশীল, ও ভিন্ন চিন্তা ধারার ব্যক্তিবর্গের হত্যাকান্ডের বিচারহীনতা এদেশের জনগনের মাঝে উগ্রবাদী ধর্মীয় মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর প্রশাসনিক ব্যর্থতা এখানে মদদ যুগিয়েছে দিনের পর দিন। হাজার হাজার জনগণ উক্ত ব্যক্তি কে পিটিয়ে মারতে উদ্যত হয় এবং তার লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হয় প্রশাসনের সামনে। এতে করে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসন কতখানি দুর্বল এবং ভঙ্গুর।
ইতোমধ্যে জানা গেছে লালমনিরহাটে নিহত ব্যক্তির নাম জুয়েল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদপত্রের সূত্রে জানতে পারি যে, নিহত ব্যক্তি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তো এবং মানসিকভাবে কিছুটা চাপের মধ্যে ছিল। এমনকি সংবাদ পত্রে উল্লেখ করা হয়, তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে নিহত ব্যক্তি নামাজি ছিলো। প্রশ্ন হল নিহত ব্যক্তির নামাজি-বেনামাজি, মুসলিম-অমুসলিম হবার সাথে তাকে পিটিয়ে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলার অপরাধ নাজায়েজ বা জায়েজ হয়ে যায় কি? যদি উক্ত ব্যক্তি নামাজি না হতো তাহলে কি তাকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার বৈধতা দেয়া যায় কোন ভাবে? ধর্মীয় পরিচয় কি? বা তার ধর্মীয় আচরণ কি? সেটি কেনই বা তদন্ত কমিটির কাছে অথবা সাধারণ জনগণের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে? এর মধ্য দিয়ে কি পুনরায় ধর্মানুভূতির রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না?
নাকি পুরো বিষয়টিকে দুষ্কৃতকারীদের ষড়যন্ত্র এইরূপ ব্যাখ্যা দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত আছে প্রশাসন? দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল হতে শুরু করে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সে বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামী ও ধর্মানুভূতির নামে ধর্মীয় রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না? পরিশেষে শুধু এতটুকুই বলবো, উক্ত ঘটনায় যুক্ত শ’খানেক কেন, প্রয়োজনে হাজারখানেক লোকের বিরুদ্ধেও প্রশাসনিকভাবে মামলা দায়ের করা প্রয়োজন। তাদেরকে আইনের আওতায় বিচারভুক্ত করা প্রয়োজন এবং নজিরবিহীন শাস্তি প্রদানের মধ্য দিয়ে নিয়ে এই ধর্মীয় উগ্রবাদ এর বিপক্ষে রাষ্ট্রকে অবস্থান নিতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মানুভূতির রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংবিধানিক সংশোধনও এখন সময়ের দাবি, তা না হলে এই উগ্রপন্থী ধর্মীয় মূল্যবোধের রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা