লকডাউন কবে শেষ হবে? কবে করোনাভাইরাস আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে? মানুষ কবে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে? এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর কেউ নিশ্চিতভাবে দিতে পারছে না। অর্থাৎ এই পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ এক্সিট বা বেরুনোর পথটি এখনো আমাদের অজানা-অচেনা-অদৃষ্ট। এমনও সম্ভাবনা রয়েছে যে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারাই অগ্রগামী হবে, যারা অনেক আগেই লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের দূরদর্শিতা ও জাতীয় সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছে। আর যারা অবহেলা করেছে তাদের আরও বেশি মাশুল দিতে হচ্ছে। একটি বিষয় এখন সবাই নিশ্চিত যে কভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুকে লুকিয়ে রেখে কোনো দেশ আর সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না, না স্থানীয় না বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিসরে। এই বাস্তবতা বুঝতে যারাই দেরি করেছেন এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির ভুল হিসাব করেছেন তাদের মূল্য দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেড়ে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য লকডাউনকে এই মহামারী মোকাবিলায় প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচনা করা হচ্ছে। এর পরের পর্ব হলো শনাক্তদের আলাদা করা, সুচিকিৎসা দেওয়া, সজাগ থাকা ও আবার দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে এতদিনের শেখা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এর বিস্তার ঠেকানো। কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি না নিয়ে অপরিকল্পিত লকডাউন করায় সফলতা পাওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত হয়ে গেছে। একদিকে অভাবে ও খাদ্যের সন্ধানে মানুষ ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্য সহায়তার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত বিতরণব্যবস্থা ও দুর্নীতি এর বড় কারণ। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আগে থেকেই ভঙ্গুর ছিল এবং জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তুতিতে যারা পিছিয়ে ছিল, সেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে; বাংলাদেশ এর অন্যতম।
করোনাদুর্গতদের অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু সহায়তা দিলে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতি থেকে নিস্তার পেতে পারে সেটা নিয়ে কোনো হিসাব বা বিশ্লেষণ চোখে পড়েনি। অনেক অনিশ্চয়তা ও অজানাকে মাথায় রেখে অর্থনীতিবিদরা হিসাব করার চেষ্টা করছেন কত ক্ষতি হতে পারে। এর মধ্যে অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স১ ধারণা করছে প্রথমত অর্ধবছরের ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে জিডিপির ৭%, আর টুলুস স্কুল অফ ইকোনমিক্সের২ এর একটি গবেষণার হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে এর পরিমাণ ১০% এর বেশি হতে পারে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের৩ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে ১%। যেহেতু প্রত্যেকটি গবেষণারই নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এর কোনো হিসাবই পুরোপুরি বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটায় না। কারণ কতদিন লকডাউন অবস্থায় থাকতে হবে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। চায়নাতে তিন মাস লেগেছে বলে যে যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রেরও একই সময় লাগবে এমন কোনো কথা নেই। আবার একই কারণে বাংলাদেশে তিন মাসের মধ্যে অবস্থা পুরোপুরি বদলে যাবে কি না সে সম্পর্কেও আমরা অনিশ্চিত। কাজেই বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদরা যে নানান ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী দিচ্ছেন তা মাথায় নিয়েই আমি জিডিপির ১০% ও ৫% সম্ভাব্য ক্ষতি ধরে নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করতে চাই। ১০% ধরে নিচ্ছি এই হিসাবে যে, এখানে ধরে নিলাম যত বেশিদিন লকডাউন হবে তত বেশি ক্ষতি হবে। এই হিসাবে বাংলাদেশের ২০১৮-২০১৯ সালের জিডিপি যদি ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা হয়, তাহলে এর ১০% হবে ২.৫ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিন আমাদের জিডিপির ক্ষতি হবে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। যদি ক্ষতি ৫% হয় তাহলে প্রতিদিন ক্ষতি হবে ৩৫০ কোটি টাকা।
এখানে লক্ষণীয় যে লকডাউন অবস্থায় প্রতিদিন জিডিপির লোকসান পুরো বছর জুড়ে হওয়া জিডিপি লোকসানের চেয়ে বেশি। তাই প্রতিদিনের ন্যূনতম ক্ষতি ধরে নিয়েও যদি হিসাব করি লকডাউন অবস্থায় ক্ষতির পরিমাণ ৭০০ কোটির অনেক ওপরেও হতে পারে। একদিন বেশি লকডাউনের কারণে একটি কাজ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, তখন মাশুল হতে পারে আরও অনেক বেশি। আর তাছাড়া মাল্টিপ্লাইয়ার এফেক্ট তো আছেই। এই হিসাবে প্রতিদিন যদি ৭০০ কোটি টাকা বা তার কম খরচ করে আমরা ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দিই, এবং অল্প দিনের লকডাউনকে বেশি কার্যকর করতে পারি, তাহলে যতদিন আগে আমরা করোনামুক্ত হব সেদিন থেকে প্রতিদিন ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে আমরা দেশকে রক্ষা করতে পারব।
এখন যদি দুই কোটি পরিবারকে প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা করে তিন মাস ধরে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিদিন এর খরচ পড়ে ৬৬৬ কোটি টাকা। যদি এক কোটি পরিবারকে তিনমাস ধরে ১০,০০০ টাকা দেওয়া হয় তাহলে খরচ হয় ৩৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিদিনের ক্ষতির চেয়ে কম টাকা খরচ করে আমরা রক্ষা করতে পারি একেকটি কর্মদিবস, শুরু করতে পারি উৎপাদন। এই খরচটি আমরা যত দ্রুত করতে পারব এবং লকডাউন কার্যকরভাবে সফল করতে পারব তত বেশিদিনের ক্ষতি থেকে আমরা বেঁচে যাব। অথচ যত দিন যাচ্ছে ক্ষতি আমাদের ততই বাড়ছে।
লকডাউন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একযোগে দিনমজুর ও শ্রমিকদের আগাম বেতন দিয়ে বাড়িতে থাকার অনুরোধ করলে এবং উপরোল্লিখিত অর্থ সহায়তা প্রদান করতে পারলে বিচ্ছিণ্ণভাবে আজ এখানে লকডাউন, কালকে ওখানে লকডাউন করে ভাইরাস ছড়ানোর পথটি অনির্দিষ্টকালের জন্য খোলা রাখতে হতো না। যতই দিন যাচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও ততই বাড়ছে। এই সত্যটি না অনুধাবন করছে সরকার, না ব্যবসায়ী মহল। সরকারের কাছে লকডাউন শুধুই কালক্ষেপণ। আর ব্যবসায়ীদের মনোভাব হলো কোনোভাবেই একটা দিনও তারা হারাতে চান না। অথচ তাদের এখন হিসাব করা উচিত কত দ্রুত লকডাউন কার্যকর করে কত দ্রুত এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা যায়। কালক্ষেপণের পরও যে ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হবে না তার নিশ্চয়তা যে নেই তা কি তারা ভেবে দেখেছেন? প্রতিদিনের দীর্ঘমেয়াদের ক্ষতি, তা ৭০০ কোটি হোক আর ৩০০ কোটি হোক, গোনায় না ধরে যারা শুধুই স্বল্পমেয়াদের খরচ হিসাব করে একটা প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়ে খুশি তারা কি বুঝতে পারছেন যে করোনাভাইরাস তাদের ইচ্ছায় নিরাপদ এক্সিট নেবে না। বরং তা ক্ষতির শেষ সীমায় নিয়ে যেতে পারে? তারা কি ভেবে দেখেছেন যত সময় যাবে প্রতিদিন লকডাউনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকবে এবং তার সঙ্গে জড়িত মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কত বাড়বে?
জিডিপির ক্ষতির হিসাব আমাদের দেশের নিমড়ববিত্তদের কখনোই কোনো কাজে লাগেনি। উপরোলিখিত ক্ষতি যদি নাও হয়, তবুও মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষতি তো কেউ অস্বীকার করবে না। এই ক্ষতির পরিমাণ হয়তো জিডিপির ক্ষতিতে ধরাই হবে না। তবুও আমরা জানি করোনাভাইরাস এমন এক ভাইরাস যা আমাদের জিডিপির হিসাবের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে, এবং দেখিয়েছে একটা মানুষও যদি আক্রান্ত থাকে তাহলে নিরাপদ এক্সিট সম্ভব নয়। তাই, এটাই সত্য যে ক্ষতি যাই হোক করোনাদুর্গত বিশাল জনগোষ্ঠীর এই মুহূর্তে প্রয়োজন খাদ্য ও অর্থ সহায়তা।
বাংলাদেশের মতো উণ্ণয়নশীল দেশগুলোতে লকডাউন থেকে সুফলতা পেতে হলে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য জোগান, কভিড-১৯ শনাক্ত করা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উনড়বয়ন করা ছাড়া কোনো গতি নেই। সবগুলো কাজ একসঙ্গে না করলে এই লকডাউনের কোনো অর্থ নেই। ধরুন একটি গাড়ি আছে। তাতে ইঞ্জিন (লকডাউন) ভালো চলছে, কিন্তু তেল (ক্ষুধার্তের খাবার) নেই, তেলের ট্যাংকে (বিতরণ কাঠামো) ছিদ্র আছে, চাকা (করোনা শনাক্ত) পাংচার হয়ে গেছে, আর ব্রেক (ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা) কাজ করছে না। এমন অবস্থায় গাড়িটা চলবে কীভাবে? কিছু তেল থাকলে ইঞ্জিন স্টার্ট নেবে। কিন্তু তেলের অভাবে গাড়ি থেমে যাবে। তেল ভরলে ট্যাংকে ছিদ্র থাকার কারণে তেল বারবার শেষ হয়ে যাবে। চাকা পাংচার হয়ে গেলে গাড়ি ভারসাম্য হারাবে, তারপর যখন ব্রেক কাজ করবে না তখন গাড়িটি খাদে গিয়ে পড়বে। কী একটা হযবরল অবস্থা!
করোনাভাইরাস হোক আর জ্ঞান হোক, তারা যতদূর থেকেই আসুক না কেন তারা কিন্তু পুষ্ট হয় ও বিস্তার লাভ করে ভৌগোলিক বা স্থানীয় পরিস্থিতির সাপেক্ষেই। করোনা নিয়ে সারা পৃথিবীতে এবার প্রচুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া গেল। কিন্তু একেকটি দেশের একেক সংস্কৃতি, আবহাওয়া, অভ্যাস, সামাজিকতা, জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় ব্যাবস্থাপনা, সংবেদনশীলতা, ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যমান বৈষম্য যেভাবে একই রোগ সম্পর্কে ভিণ্ণ বাস্তবতায় স্থানীয় করোনা-জ্ঞান উৎপাদন করেছে তা অভূতপূর্ব। তাই এটা মোকাবিলায় প্রতিটি দেশ নিজের দেশের সংস্কৃতি, সামর্থ্য, অবকাঠামোকে সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই এই সংকট মোকাবিলায় নেমে পড়েছে।
এখন বাংলাদেশের জন্য লকডাউন কার্যকর করতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের কাছে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্য ও অর্থ সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। দমন-পীড়ন করে, লুকিয়ে যেমন করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মেলে না, তেমন পেটের ক্ষুধা নিয়ে ঘুরতে থাকা মানুষকে দমন-পীড়ন করে, লুকিয়ে লকডাউন সফল করা যাবে না। লকডাউন কতদিন চললে করোনাভাইরাস থেকে আমরা মুক্ত হব তা না জানলেও এতটুকু বলা যায় যে, যথাযথ সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে লকডাউন কার্যকর করতে পারলে, একটা সময় করোনা আক্রান্তদের সফলভাবে আলাদা করে ফেলতে পারলে, লকডাউনের প্রয়োজন কমে যাবে। শ্রমিক কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সহস্র অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে উৎপাদন ও সেবাদান শুরু করতে পারবে এবং প্রতিদিনের লকডাউনের ক্ষতি থেকে দেশ মুক্ত হবে। এই খাদ্য ও অর্থ সহায়তা যত দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যাবে তত দ্রুত শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। সদিচ্ছা থাকলে একটি দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি সুনিপুণ বিতরণ ব্যবস্থা দ্রুতই গড়ে তোলা সম্ভব। শুধু নিরাপদ এক্সিটের পথটি সুগম করতে দ্রুত খাদ্য ও অর্থ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং এর সঙ্গে ব্যাপক হারে করোনা পরীক্ষা করা, শনাক্তদের আলাদা করা, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা নিশ্চিত করতে হবে।
তথ্যসূত্র
1. https://www.oxfordeconomics.com/
2. https://www.tse-fr.eu/economics-coronavirus-some-insights
3. The Daily Star, March 2020
লেখক:
মোশাহিদা সুলতানা, সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়