soikot mollik
soikot mollik

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি একটি স্ট্রাকচারাল হত্যাকাণ্ড

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি একটি স্ট্রাকচারাল হত্যাকাণ্ড

Spread the love

আমাদের নরম বালিশে রক্তের দাগ, চারপাশে লাশের স্তূপ। প্রতিদিন গুম-খুন হচ্ছেন ডজন ডজন মানুষ। কেউ সরাসরি গুলি খেয়ে, কেউ চাকু-রামদা-চাপাতির কোপে কিংবা অন্য কোনো পন্থায় প্রত্যক্ষ খুনের শিকার হচ্ছেন। আর দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া গরিব, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ পরোক্ষভাবে খুন হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাঁরা খাদ্যে খুন হচ্ছেন, চিকিৎসায় খুন হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন ঘরে, পথেঘাটে, আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে কিংবা পানিহীনতায়; চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে মারা যাচ্ছেন ভবন চাপায়। এগুলো দুর্ঘটনা নয়, এই পরোক্ষ খুনের নাম ‘স্ট্রাকচারাল কিলিং’ বা ‘কাঠামোবদ্ধ হত্যাকাণ্ড’। ‘রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড’ এই চলমান কিলিংয়ের একটি অতি-সাম্প্রতিক নজিরবিহীন ও ভয়াবহতম উদাহরণ। যা আজও সংবেদনশীল যেকোনো মানুষকে আক্রান্ত করে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে। সেই ঘটনায় ১১৩৪ কিংবা তারও বেশি মানুষের লাশ হওয়া, ১৪৬ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হওয়া, শত শত মানুষ পঙ্গু হওয়া নেহাতই কোনো দুর্ঘটনা নয়, নয় কোনো দৈব ঘটনা।

রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ নেতা সোহেল রানার বিএনপি নেতা বাবা বিএনপির আমলে অন্যের জমি দখল করেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের আমলে রানার বাবার দখল করা জমি মাটি ফেলে দ্রুত ভরাট করে ভবন তোলা হয়। বেশি মুনাফার লোভে ‘বিল্ডিং কোড’ না মেনে নিজের ইটের ভাটার নিম্নমানের ইট দিয়ে নির্মীত ভবনে রানা স্থাপন করেছিলেন গার্মেন্ট কারখানা। হাই পাওয়ার জেনারেটর বসিয়েছিলেন ছাদের ওপর। কারণ ছাদটি খালি ফেলে রাখার প্রয়োজনীয়তা রানা দেখতে পাননি। দ্রুত অবহেলায় মাটি ভরাট করা ভূমিতে নিম্নমানের ইটের তৈরি ভবন বেশি ভর আর জেনারেটরের জার্কিং সহ্য করতে না পেরে ফেটে যায়। সেই ফাটল শনাক্তও করা হয় এবং ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিতও করা হয়। কিন্তু এক দিনের মুনাফাও বাদ দিতে রাজি ছিলেন না রানা। পরের দিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের জোর করে ঢোকানো হয় কারখানায়। সময়টা ছিল সকাল পৌনে ৯টা, ধসে পড়ল রানা প্লাজা।

হাজারেরও বেশি শ্রমিকের জীবন-স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ, তাদের প্রিয়জনের স্বপ্ন এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল! এই ‘স্বপ্ন হত্যা’ কোনো বিচারেই ‘দুর্ঘটনা’ হতে পারে না। এটা স্পষ্টতই স্ট্রাকচারাল কিলিং। ২৪ এপ্রিল ঘটনা ঘটার পর থেকেই মানুষের জন্য মানুষই শুরু করেছিল উদ্ধার কাজ। শ্রমিক, হকার, এলাকাবাসী, সংবেদনশীল ছাত্র, মানবিক ও বিপ্লবী ধারার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনগুলো উদ্ধার কাজে যথাসম্ভব অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি টাইপের লুটেরা রাজনৈতিক দলগুলোর ‘বিশাল’ কর্মীবাহিনীর সাংগঠনিক দায়িত্বশীল ভূমিকা সেদিন দেখা যায়নি। তবে এসব দলের মধ্যেও আবশ্যই সংবেদনশীল মানুষ আছে। যারা সাংগঠনিকতার বাইরে, এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ান, রানা প্লাজা বিপর্যয়ের সময়ও নিশ্চয়ই দাঁড়িয়েছেন। উদ্ধার কাজের একপর্যায়ে যুক্ত করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের। তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন মৃতের সংখ্যা কমিয়ে জীবিত মানুষ উদ্ধার করতে। কিন্তু দেখা গেল উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জোগান তাঁদের কাছে নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র সেনাবাহিনীর এই লড়াকু জওয়ানদের জীবনকে জাতিসংঘের তথাকথিত ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করতে পারে, কিন্তু পারে না নিজের দেশের মানুষ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে। ফলে রানা প্লাজার ঘটনায় দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের দিয়ে গণ্ডগোল সামাল দেওয়া ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সাধারণ উদ্ধারকর্মীরা ধসে পড়া ভবনের ভেতর থেকে মৃত কিংবা জীবিত পঙ্গু মানুষগুলোকে উদ্ধার করছিলেন তাঁদের তালিকা তৈরির কাজ করানো হলো। উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা এবং অগ্রাধিকারমূলক যথেষ্ট উদ্যোগের অভাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলল। এই সচেতন উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি হয়তো মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমাতে পারত। রাষ্ট্রের এই ব্যাপক অব্যবস্থাপনার কারণে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা কিভাবে দুর্ঘটনা হয়? ভবনধসের কারণ জিইয়ে রাখা, ধসের পরে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা, আগুন লাগার মতো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা ও আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের যথেষ্ট সক্ষমতা বৃদ্ধি না করা ইত্যাদি ‘খুন হয়ে যাওয়া লাশের মিছিল’ দীর্ঘ করারই নামান্তর। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায়ও দেখা গেছে এসব রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা। স্পেকট্রাম, ‘তাজরিন’সহ অসংখ্য গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে শ্রমিক পুড়িয়ে মরার ঘটনায়ও একই চিত্র দেখা গেছে।

ছবিঃ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি

আরো আরো ভবিষ্যৎ ‘রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড’ ঘটার কারণ বর্তমান

দেশে শিল্প ‘দুর্ঘটনায়’ হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এ ধরনের দুর্ঘটনায় ২০০৫ সালে হতাহত হন এক হাজার ২৭৬ জন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার ৮২৮। অর্থাৎ ৯ বছরে শিল্প দুর্ঘটনায় হতাহতের হার বেড়েছে ২০০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওএসএইচই) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সংরক্ষিত তথ্যে কর্মক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এই চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। এসব হতাহতের ঘটনাকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নাই। রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে ‘কেইস স্টাডি’ আকারে বিশ্লেষণ করলেই এর প্রমাণ মিলবে যে এগুলো স্রেফ স্ট্রাকচারাল কিলিং। রানা প্লাজা ধসে পড়ার অনেক কারণ ছিল। জলা ভরাট করা ভূমি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ছিল অপ্রস্তুত, নির্মাণসামগ্রী ছিল নিম্নমানের, মাত্রাতিরিক্ত লোড চাপানো হয়েছিল সেই দুর্বল ভবনে, জেনারেটরের ধাক্কা ছিল অতি তীব্র ইত্যাদি অনেক কারণ হয়তো ছিল। কিন্তু এসব কারণের মূলে ছিল ‘লুটপাট-লুণ্ঠন-দখলদারিত্ব, আগ্রাসী লোভ, দানবীয় মুনাফা ও সীমাহীন দুর্নীতি।’

মোদ্দা কথায় শাসকশ্রেণির লুটপাটকেন্দ্রিক রাজনীতি। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বাবা জমি দখল করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রানা রাতারাতি গার্মেন্ট মালিক হয়েছিলেন রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। ধসের দিন ফাটল ধরা ভবনে জোর করে শ্রমিক ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই। জনতার ক্রোধ থেকে রানা রেহাই পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এমপি মুরাদ জংয়ের ক্ষমতার জোরেই।

১১৩৪ জন মানুষের হত্যাকারী এখনো বেঁচে আছেন রাজনৈতিক কারণেই। একই কারণে এখনো আহত কোমরভাঙা শ্রমিক ক্ষতিপূরণের আশায় বিজিএমইএ ভবনে গিয়ে বিজিএমইএর সভাপতির ঠাট্টা-মশকরা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। গার্মেন্ট শ্রমিকদের শ্রম শোষণকারী নিপীড়ক মালিকরা শ্রমিকদের অসহায়ত্ব নিয়ে ভয়ংকর ঠাট্টা করে টিকে থাকতে পারেন রাজনীতির জোরেই। নূ্যনতম মূল মজুরি আট হাজার টাকার দাবিতে মাঠে নেমে হামলার শিকার হয়ে, মামলা খেয়ে শেষমেশ পাঁচ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ হয় রাজনৈতিক কারণেই। রাজনীতির এই লুটপাটকেন্দ্রিকতা স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তা কখনো কম মাত্রায়, কখনো বা লাগামহীন।

আমাদের নরম বালিশে লেগে আছে রক্তের দাগ

এক বছর পার হচ্ছে অথচ এখনো রানা প্লাজার শ্রমিক পরিবারগুলো যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি। নিখোঁজ শ্রমিকদের খোঁজে আজও তাদের প্রিয়জন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া সব হাড়-কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা এখনো করা হয়নি, এমনকি এরই মধ্যে ডিএনএ শনাক্তকারী কবরগুলো এখনো বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এ ধরনের রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণটি কি এই যে এরা মানুষ নয় বরং ‘শ্রমিক’ কিংবা ‘শুধুই সংখ্যা’? এই প্রশ্নটি বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতিদিনের প্রশ্ন। প্রতিদিন তাঁরা টের পাচ্ছেন যে এই রাষ্ট্র জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়া তো দূরে থাক, লাশ হস্তান্তরের নূ্যনতম দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে। প্রয়াত রাজনীতিক ও সাংবাদিক নির্মল সেন বহু বছর আগে লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। এই দাবি আজ গণদাবিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাওয়ার জন্য আইন হওয়া দরকার গণমুখী। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তাদের উপযুক্ত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার তৎপরতাই বেশি মাত্রায় চলছে। কেন না ভবন মালিকের জামিনের খবর পাওয়া যায়, প্রতিবাদের কারণে জামিন বাতিল হয় কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে সাধারণ জনগণ খবর পায় না। স্ট্রাকচারাল কিলিংয়ের ঘটনা চলমান এই স্ট্রাকচারের মধ্যেই ঘটে। এই স্ট্রাকচারটিও এমনি এমনি টিকে থাকে না। নরম বালিশে মাথা রেখে যে ‘কুম্ভের ঘুম’ আমরা ঘুমাচ্ছি, সেই ভয়ংকর ঘুমের ‘শক্তি’ নিয়েই এই অমানবিক স্ট্রাকচার টিকে থাকে। ফলে রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের দায় কেবল দেশি লুটেরা মালিক, বাংলাদেশের সস্তা শ্রমিক শোষণকারী বিদেশি বায়ারদেরই নয়, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই দায় আমরাও এড়াতে পারি না। দেশি-বিদেশি লুটেরা শ্রমিক শোষকদের যেমন ‘জনগণের কাঠগড়া’য় দাঁড়াতে হবে, তেমনি জনগণকেও ‘জনগণের কাঠগড়া’য় দাঁড়াতে হবে। বিশেষ করে সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণীকে তো বটেই। প্রায় ৫০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের রক্ত পানি করা শ্রম যে অর্থনীতির একটা বড় অংশ চালাচ্ছে, তাদের প্রতি করণীয় কর্তব্য পালন করার অর্থ এই স্ট্রাকচারটাকে আগাগোড়া বদলে ফেলে ‘স্ট্রাকচারাল কিলিংবিহীন’ ও ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর শতভাগ গ্যারান্টিযুক্ত’ স্ট্রাকচার বিনির্মাণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া। যে ব্যবস্থায় শ্রমিকরা সংখ্যার মর্যাদা নয়, মানুষের মর্যাদা পাবে। সেখানে লাশের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না বরং মৃত্যু হবে স্বাভাবিকভাবে ও প্রিয়জনের কোলে মাথা রেখে। স্ট্রাকচারাল কিলিংয়ের স্ট্রাকচারে আমরা যে ‘নির্লিপ্ত ঘুম’ ঘুমাচ্ছি তা মানবিক নয়। আমরা যে নরম বালিশে ঘুমাচ্ছি সে বালিশও পরিষ্কার নয়; সে বালিশে শ্রমিকের রক্ত লেগে আছে। নতুন মানবিক সমাজ নির্মাণই পারে সেই রক্তের দাগ মুছে ফেলতে।

(২৪ এপ্রিল ২০১৪ কালের কন্ঠে প্রকাশিত)


Spread the love