You are currently viewing রাজসিক শাসকের দেশ ও নিরন্ন মানুষের কথা
Munir Chowdhuri Sohel Ganosamhati Andolon

রাজসিক শাসকের দেশ ও নিরন্ন মানুষের কথা

করোনাকালে নিরন্ন মানুষের কঠিন জীবন সংগ্রামের মর্মস্পর্শী একটি সংবাদ দৈনিক সমকালে ১৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রকাশিত সংবাদটি লিখেছেন সাংবাদিক হকিকত জাহান হকি। সংবাদটির মর্মার্থ নিম্নরূপঃ ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় বয়স্ক সমলা বললেন, ‘কিছু খাওন দিবাইন, আজ কিছু পাই নাই, এখনও কিছু খাই নাই।’ সমলা যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই ফরিয়াদ করছিলেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৩টা। প্রায় সারাদিন এই নিরন্ন শ্রমজীবী নারীর পেটে সামান্যতম খাবার জোটেনি। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর এসব মানুষদের কিছুদিন আগেও কাজ ছিল। এতে তাদের জীবিকা নির্বাহে সামান্য গতি পেত। করোনা ভাইরাসের মরণ কামড়ে তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। শ্রমজীবীদের কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছে। তাদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে।   ক্ষুধার্ত সমলা তার  জবানিতে সারাদেশের  কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি এঁকে দিয়েছেন।

সমলার গ্রাম ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। গ্রামে তার কেউ নেই, বাস্তুভিটা নেই, ঘর নেই। গ্রামের পরিচয় থাকলেও অবর্ণনীয় অভাবের তাড়নায় তাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। নিষ্প্রাণ ঢাকা শহরে সমলা এসেছিলেন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ প্রয়াস হিসেবে। ঢাকায় এসে বিভিন্ন বাসায় গৃহ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বয়সজনিত কারণে মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ার পরও অর্থাভাবে ডাক্তার দেখাতে পারেননি। তাঁর ওষুধ কেনার সামর্থ নেই। ফলে তিনি গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার এটাই ছিল তার শেষ চেষ্টা। খাবার সংগ্রহে তাই অবস্থান নিয়েছেন রাজধানীর হচ্ছে ‘মন্ত্রীপাড়া’ নামে খ্যাত হেয়ার রোডে। তিনি একা নয় মন্ত্রীপাড়ায় অসংখ্য  না খাওয়া মানুষের ঢের উপস্থিতি লক্ষ  করা গেছে। এসকল ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী  প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী  গানকে।  তিনি গেয়েছিলেন, শোনো, বন্ধু, শোনো, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারণ মর্মব্যথা। ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় মর্মব্যথার মানুষগুলোর কঠিন বাস্তব অবস্থা এই অবিষ্মরণীয় গানকেও ছাড়িয়ে গেছে।  

কালজয়ী এই গানের বাস্তব ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর আর্তনাদ রাজসিক শাসকের বৃহৎ অট্টালিকা ভেদ করে না। প্রাসাদসম অট্টালিকার মালিকরা এদের আর্তনাদ শুনতেও  পান না। অথচ নিরন্ন মানুষের ক্রন্দন সাধারণ মানুষ শুনতে পায়। সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত হলেও শাসকেরা মোটেই বিচলিত নন। তারা খাদ্য না পেয়ে অস্থির হলেও প্রাণহীন শহরের উচুতলার মানুষরা কোনরূপ ভাবেন না।

শাসকরা না ভাবলেও জীবিকা নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের ভাবতেই হয়। কারণ জীবন সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের, রাজসিক শাসকদের নয়। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দারিদ্রপীড়িতদের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। তারা এখন জীবন-জীবিকা থেকে পথভ্রষ্ট। জীবনের অনিশ্চয়তায় ডুবছে অভাবগ্রস্ত মানুষেরা। করোনা দমনের জয়গান আর উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে আত্মতুষ্টিতে আছে  সরকার।

ডুবন্ত মানুষদের ‘অভিভাবক’ হিসেবে সরকার পাশে নেই। নিজেদের সমস্যা, সঙ্কট বা বিপদ নিজেদেরই সমাধান করতে হয়। সরকার সমাধান করে দেয় না।

 করোনাকালীন নিজেদের বিপদ যে নিজেদের সামলাতে হবে এটি বুছে ফেলেছেন ইয়াসমিনের মতো মানুষেরা। প্রথম আলোর সাংবাদিক গোলাম রব্বানীর নিকট ইয়াসমিন আরা (২৭) নামের এক নারী শ্রমিক এই সত্য কথা বলে ফেলেছেন। ১০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তিনি এবং তার ছোট বোন জেসমিন আরা (২৩) দুজনেই হোশিয়ারী শ্রমিক। ঢাকার ডেমরায় হোশিয়ারী কারখানায় চাকরী করেন। গত ঈদে দুজনে বাড়ী যাচ্ছিলেন। তাদের বাড়ী ফেনীর দাগনভূঞায়। যাত্রাপথে তিনি ঐ সাংবাদিককে বলছিলেন, ‘মরি-বাঁচি বাবা-মা ছাড়া ঈদ করমু না। করোনা তো এমনিই বিপদে ফেলছে। লকডাউন দিছে, খাবার কি দিছে? খাই না খাই, নিজের বিপদ নিজে সামলাইছি। এহন কিছু হইলেও ওই বিপদ আমাগোরেই সামলাতে হইব।’     

করোনার আগে খুলনাসহ সারাদেশে নিচুতলার মানুষেরা জীবনের তাগিদে ছোটখাটো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে অসংখ্য শ্রমিক পাটকল-চিনিকলে কর্মরত ছিলেন। শিল্পসংশ্লিষ্ট পাটচাষী, আখচাষী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও কর্মে যুক্ত ছিলেন। কর্মসংস্থান থাকার কারণে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে দু‘বেলা দু‘মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন।

কিন্তু গণবিরোধী, অনির্বাচিত বর্তমান সরকার করোনা মহামারীর সুযোগ নিয়ে ২৫টি পাটকল ও ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে ৫০ হাজার শ্রমিকসহ প্রায় ৩ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কর্মহীন হওয়া সিংহভাগ মানুষের বাস্তুভিটা পর্যন্ত নেই। বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন সম্ভাবনাও নেই।

 করোনার পূর্বে পাটকল-চিনিকল শ্রমিক ছাড়াও খুলনা মহানগরীতে কেউ,কেউ বহুতল ভবনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। কেউ বাসায় গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কেউ পথে-পথে ফুল বিক্রি করতেন। কেউবা জোগালি মিস্ত্রী বা ভাঙাড়ী দোকানে কাজ করতেন। এমনি ভাবে পরিবহন শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, গৃহ নির্মাণ শ্রমিক, বিপণি শ্রমিক, নারী শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, ইজিবাইক চালকসহ অন্যান্যরা বিভিন্ন  ছোটখাটো পেশায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তারা সকলে জীবিকায়  বুঁদ ছিলেন। এখন তারা পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের আয়ও বন্ধ। কারণ তারা কেউই সরকারি কর্মচারী নন যে নিয়মিত বেতন পাবেন। কবে তারা আবার কাজে ফিরতে পারবেন  তার কোন নিশ্চয়তা নেই। 

করোনার যাত্রাকালে বাংলাদেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। করোনার পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশে ২ কোটি ২৯ লাখ হতদরিদ্র মানুষ ছিলেন। করোনা অতিমারীকালে মানুষের মৃত্যুর মিছিলের ভয়াবহতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কর্মহীনতাও অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে ২ কোটি ৫০ লাখের ওপর মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। তবে বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো- দেশে কোটিপতির সংখ্যা তো কমেনি বরং আরো বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা কত তার একটি হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। ব্যাংকের তথ্যমতে. করোনাকালীন সময়ে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ১০ হাজার ৫১ জন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯ জন। সেখানে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০ জন। কোটিপতির এই সুদীর্ঘ তালিকা স্বাধীনতার শুরুতে ছিল না। ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে যা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮ জন, ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ জন, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ জন, ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩ জন এবং ২০০৯ সালের মার্চের শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬ জন (২০ এপ্রিল ২০২১, জাগো নিউজ২৪.কম)।

কোটিপতি আমানতকারীর এই সংখ্যা আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। করোনা অতিমারীকালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ এক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছিলেন,‘করোনা পরিস্থিতিতে  সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু বড়লোক বা ধনীদের আয় বেড়েছে। ব্যাংকে কোটিপতি বেড়ে যাওয়া তারই প্রমাণ ।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘দেশের কোটি কোটি লোক নিঃস্ব হয়েছে বলেই করোনার সময়ও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। ব্যাংক থেকে লুট করে একটি শ্রেণি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। আবার তারাই হয়ত সেই টাকা ব্যাংকে রাখছেন ( বাংলা ট্রিবিউন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০।’

 হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে  অথচ কোটিপতির সংখ্যা কমছে না বরং আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রতিতে দেশে ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কোটিপতির সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ঠ অর্থ বিভাগের দায়িত্ব কোটিপতিদের অস্বচ্ছ আয়ের উৎস খতিয়ে দেখা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

করোনার বর্তমান অবস্থায় শুধু নিরন্ন মানূষরাই নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পর্যন্ত ভীষণভঅবে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। এ অবস্থায় সরকারের কর্মহীন মানুষদের দীর্ঘমেয়াদী নগদ অর্থ ও খাবারের ব্যবস্থা করা জরুরী ছিল। উচিৎ ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য স্বল্পমূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। কিন্তু জনগণ দেখতে পেল সরকারের স্বেচ্ছাচারী ও গণবিরোধী ভূমিকা। লকডাউন চলাকালে সুবিধাবঞ্চিতদের জীবিকার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

দেশের বর্তমান অবস্থায় জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে, দেশটা কী রাজসিক শাসকের দেশে পরিণত হলো? দেশটাকে তারা কী মগের মুলুকে পরিণত করেছেন? দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তো তাই মনে হয়। তারা তো রাজনীতিকে নেই করে দিয়েছেন। জনগণের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছেন। জনগণের বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করেছেন। এক্ষেত্রে অসংখ্য মানুষের মনে হতেই পারে পরিবর্তন আর সম্ভব নয়। কারণ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে শাসকদের ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাই দেশের অবস্থা অনড় থাকাটাই স্বাভাবিক।

ফলে নিশ্চুপ থেকে জীবনে যেটুকু পাচ্ছি সেটুকু নিয়ে ভালো থাকাটাই তো উত্তম। যারা এই চিন্তা করছেন তারা একটু ভেবে দেখুন, আপনার অধিকার কেড়ে নিয়েই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী বিলাসী জীবন-যাপন করছেন। শাসনযন্ত্রে থেকে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের ভোগ-বিলাস স্থায়ী করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এসব ঘৃণিত শাসকদের স্থায়ীভাবে শাসনযন্ত্র থেকে উচ্ছেদ ঘটাতে না পারলে আপনার অধিকার আলোর মুখ দেখবে না।

এজন্য আপনাকে অসম্ভবের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে খুঁজে বের করতে হবে। অসম্ভবকে হটিয়ে সম্ভাবনার পথ খুঁজতে হলে সাহস ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। পথহীন এক প্রকাণ্ড উঁচু পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেই বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়। বৃহৎ পাহাড়ের মধ্যে পথ তৈরি করাটাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। এই নতুন পথই আপনাকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাবে।  

লেখক: মুনীর চৌধুরী সোহেল, আহ্বায়ক, খুলনা ।

তারিখঃ ২০-০৭-২০২১

#১১/৩/উম

Leave a Reply