You are currently viewing রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে

রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে

( দেশ রুপান্তরে প্রকাশিত ফিরোজ আহমেদের কলাম, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাকাঠামোর প্রশ্নে বর্তমান পরিস্থিতিতে লিখাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ )

আমার এক শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপকের সঙ্গে একটি বিষয়ে আমার মতামতটি কখনোই মেলে না, সেটা ছাত্ররাজনীতি বিষয়ে। ‘রাজনীতিমুক্ত’ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশংসা করে প্রিয় এই অধ্যাপকের একটি লেখা দেখেছিলাম পত্রিকায়। কাকতালীয়ভাবে এর পরপরই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদ্য-সাবেক শিক্ষার্থী বন্ধু যোগাযোগ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ নিয়ে। কীভাবে রাজনীতিমুক্ত রাখার নামে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং কবরের শান্তির আয়োজন সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে করা হয়েছে, সব ধরনের সৃজনশীল চর্চার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তার যে বর্ণনা তার মুখে শুনলাম, তা মর্মান্তিক। এবং খেয়াল করে দেখলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত পত্রিকার সংবাদ হচ্ছে নির্মাণ বা নিয়োগে দুর্নীতির জন্য অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে কথা বলার ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকু নেই, সেই কথাটা কোনো পত্রিকার শিরোনাম হয় না।

কেন হয় না?

আমাদের গণমাধ্যম কী শুধু টাকা চুরিকেই খারাপ বলে মনে করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে দুগ্ধপোষ্য শিশু নন এবং তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ আর চিন্তার বিকাশ ঘটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব, তাদের সমাজমনস্ক করার পরিবেশ তৈরি করা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শর্ত, এগুলোকে রুদ্ধ করাটা যে রীতিমতো ভবিষ্যৎটাকে ধ্বংস করা, সেটা তারা সাধারণত দেখতে চায়, দেখাতে চায় না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি ভবনের ছাদ নির্মাণে এত ভয়াবহ দুর্নীতি করা হয়েছিল যে, সেটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আস্ত শিক্ষাটাও যে এই রুদ্ধ পরিবেশে ধ্বংস হয়, সেটা কে বলবে?

২.দেশ রূপান্তরে ১ জানুয়ারি দেখলাম : আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দাবির সঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তচিন্তা বিকাশে সহায়ক অধ্যাদেশের দাবিতে নতুন বছরের রেজিস্ট্রেশন বর্জন করেছেন।

মুক্তচিন্তা বিকাশে সহায়ক? অদ্ভুত দাবি না? যে কারণটা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সদ্য-সাবেক শিক্ষার্থী বন্ধুটি জানিয়েছিলেন আগেই, সেটা মর্মান্তিক। ‘রাজনীতিমুক্ত’ হিসেবে প্রশংসিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত রাখতে হিটলারীয় সব কায়দা অবলম্বন করা হয়। শিক্ষার্থীরা কোনো পত্রিকা-সাময়িকী এসব প্রকাশ করতে গেলে বিষয়বস্তু প্রশাসনকে দেখিয়ে নিতে হয়। লেখাপত্র মর্জিমাফিক না হলে প্রশাসন নিজ কর্র্তৃত্ববলে সেগুলো বন্ধও করে দিতে পারেন! বন্ধুটি এমনকি এও জানালেন, একটা নাটকের আয়োজন করতে গেলেও প্রশাসনকে পা-ুলিপি দেখিয়ে নিতে হয়।

এই কী বিশ্ববিদ্যালয়! এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা তৈরি হবেন?
এই দমবন্ধ করা ‘রাজনীতিমুক্ত’ অবস্থার অবসান চাইতেই তারা দাবি করেছেন ‘মুক্তচিন্তা বিকাশে সহায়ক অধ্যাদেশের ব্যবস্থার’।

৩.
কিন্তু ছাত্ররাজনীতি মানেই তো হানাহানি-সন্ত্রাস!
এ ধারণাটার মধ্যেই আসলে একটা বিভ্রান্তি আছে। সন্ত্রাস কথাটার মধ্যে যে ‘ত্রাস’টা আছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম-জাহাঙ্গীরনগর-জগন্নাথ-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বাংলাদেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কিছু কলেজ হয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থির ওপর অবস্থিত অথবা সেখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এত বিপুল যে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র জরুরি প্রয়োজন হিসেবে নিয়েছে। কারণ ইতিহাস থেকে তারা জানে, সার্বক্ষণিক নজরদারি ছাড়া এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না। আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে না রাখা গেলে দেশের নিয়ন্ত্রণ তারা হারাবে। নিজের ভালো পাগলও বোঝে। এই বাস্তব রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান থেকেই লুণ্ঠন ও দুর্নীতিপ্রবণ যে দলই ক্ষমতায় আসুক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করাটাকে তারা অন্যতম করণীয় হিসেবে নেয়।

‘রাজনীতিমুক্ত’ বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা আছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, হয় সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, কিংবা যেগুলো এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থির ওপর অবস্থিত না, যাকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাই গুণ্ডাতন্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না, সেখানে উপাচার্য, প্রক্টর এবং প্রশাসনই যথেষ্ট শিক্ষার্থীদের তটস্থ রাখতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অদ্ভুত অধ্যাদেশ সেই বেত উঁচানো পাঠশালার দপ্তরির বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণ মাত্র। বলা যায়, রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ত্রাসেরই আরেকটি সংস্করণ। অর্থাৎ, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত : গুণ্ডাতন্ত্রকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা প্রশাসনকবলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনমিতি নির্ধারণ করে দেয় কোনটির পরিণতি কী হবে। রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাই একটা মায়া, একটা অলীক প্রপঞ্চ। শিক্ষা দর্শনগতভাবে তা শতভাগ অন্তঃসারশূন্য। বরং বলা উচিত, রাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ, সরকারের এই দুর্নীতি এবং সমাজের এই গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে জনগণের রাজনীতি বিকাশের সম্ভাবনার বিরুদ্ধেও একটা মতাদর্শিক ছায়াযুদ্ধ হলো এই রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কল্পনা।

গুণ্ডাতন্ত্র কিংবা প্রশাসনীয় স্বৈরতন্ত্রমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষমতাসীনদের জন্য আত্মঘাতী হবে, এটা তারা ভালোই জানেন। কোনো কিছু কখনোই রাজনীতিহীন থাকে না বলেই তারা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মাত্র ছেলেমেয়েরা মুক্ত পরিবেশে তাদের ন্যায্য ক্ষোভ ও দাবি-দাওয়া নিয়ে যে সত্যিকারের রাজনীতিটা শুরু করবেন, তার পরিণামে রাষ্ট্রের মুঠো আলগা হয়ে যাবে। রাজনীতিমুক্ত করার আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে আমরা কেউ কেউ বরং গুণ্ডাতন্ত্রকে চিরস্থায়ী করার আদর্শিক ফাঁদেই পা দিচ্ছি।

৪.
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যেসব কাগজপত্র পাঠিয়েছেন, সেখানে দেখতে পাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতায়াত বাবদ রাখা হয় ১৮০০ টাকা, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ১০০০ টাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬০ টাকা! ‘সাংস্কৃতিক’ ফির নামে শোষণ করা হয় ৩০০ টাকা, কিন্তু সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এমনি আরও বহু জমিদারি খাজনা তারা তোলেন, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেগুলোর হয় অস্তিত্বই নেই অথবা তা খুবই কম। ছাত্রদের কাছ থেকে এ ধরনের খাজনা আদায়ের ‘সংস্কৃতি’র চর্চা কতটা লাগামহীন, তা দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়া বেতন ফির বহর দেখে বোঝা যায় : গত চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২৩ ভাগ বেতন ফি বৃদ্ধি পেয়েছে! কী ভয়াবহ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই শিক্ষার্থীরা এবার আন্দোলনে নেমেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের একটা বড় অংশও মুখ খুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি বিষয়কে প্রমাণপত্র তারা কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি আকারে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে শিক্ষকদের এই উদ্যোগও অবশ্যই প্রশংসনীয়।

৫.
কিন্তু কেন সরকারগুলো ধরেই নেয় শিক্ষার্থীরা তার শত্রু হবে, সে বিষয়ে অতীতে এই স্তম্ভেই বহুবার বলেছি, বরং পুনরাবৃত্তি করতে চাই ছাত্ররাজনীতি ও সন্ত্রাসের প্রসঙ্গটি। প্রথমেই খেয়াল রাখা দরকার, রাজনীতির নামে যে বিষয়টাকে বিরোধিতা করা হচ্ছে, তা আসলে সন্ত্রাস। সন্ত্রাস তো একটা ফৌজদারি সমস্যা। কেউ যদি অন্য কোনো শিক্ষার্থীকে জোর করে মিছিলে নিয়ে যায়, কেউ যদি ছাত্রাবাসের দখল নেয় কিংবা কাউকে আহত করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়া, পুলিশের দায়িত্ব তাকে গ্রেপ্তার করা, তদন্ত করা, আদালতের দায়িত্ব প্রয়োজনে তাকে দণ্ড দেওয়া। এর মধ্যে রাজনীতির কিছু নেই। কিন্তু এই দেশে একদিকে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রবল এবং ভীতিকর একটা গুণ্ডাতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে; অন্যদিকে গুণ্ডাতন্ত্রের এই দখলদারিত্বকে রাজনীতি নামে চালিয়ে দিচ্ছে গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের একটা বড় অংশ এবং শিক্ষার্থীদের এভাবে রাজনীতির বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে আসলে দার্শনিক-মতাদর্শিক চর্চা থেকেই তাদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ‘আইয়ুবী ফরমান’-এর বিরুদ্ধে লড়ছেন, সেই অধ্যাদেশটি যারা বানিয়েছেন, তারা কখনো একটা সহজ প্রশ্নের জবাব দেন না, একটা দ্বিচারিতাকে তারা সর্বদা আড়াল করেন। সেটা হলো, বাংলাদেশের সংবিধান যে প্রতিটি ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণি-নির্বিশেষে নাগরিককে সংগঠন করার, মতপ্রকাশ করার, চিন্তা করার স্বাধীনতা দিয়েছে, সেটা থেকে একজন সাবালক শিক্ষার্থীকে তারা কীভাবে বঞ্চিত করার বাসনা প্রকাশ করেন? তেমন মতাদর্শিক সৎসাহস থাকলে ওই সংবিধানটাকে বদলানোর কথা বলে দেখুন না কেন?

এই চক্রটা তাই ভয়াবহ, দুর্নীতি যাদের পেশা, দুর্নীতি করার জন্যই তাদের কায়েম করতে হয় ত্রাসের রাজত্ব, গুণ্ডাতন্ত্রের কিংবা প্রশাসনতন্ত্রের। কিন্তু এই ত্রাসের রাজত্বের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা যদি জেগে ওঠেন? কাজেই তাদেরও নিষ্ক্রিয় রাখাটা একটা বড় কাজ। তাই আসবে মতাদর্শিক যুদ্ধ : রাজনীতিই খারাপ। ফলে দুর্নীতির আসন হচ্ছে পাকাপোক্ত। ফলে আরও বড় গুণ্ডাতন্ত্র, কারণ দেশে চলমান দুর্নীতি, বাক-স্বাধীনতাহীনতা, সুন্দরবন ধ্বংস এসব নিয়ে না ভেবে শিক্ষার্থীরা পারেন না। ফলে এই যে উৎকট বিরাজনীতির চক্রে আমরা আজ আটকা পড়ে আছি, তা ক্রমাগত আরও বড় ব্যাধি সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

ফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ
গণসংহতি আন্দোলন

Leave a Reply