১৮৮২ সালে–তাঁর মৃত্যুর প্রায় বছরখানেক আগে–কার্ল মার্কস গিয়েছিলেন আলজেরিয়াতে। সেখানে থেকেছিলেন টানা দুই মাস। আর সেখানে থাকাকালীন তিনি ইসলামি সভ্যতার নানা দিক অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
শুধু তাই নয়। আফ্রো-আরব মুলুকে ভূমি ও সম্পত্তির রূপ ও ধরন আর আলজেরিয়াতে জেঁকে-বসা ফরাসি উপনিবেশবাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস নিয়েও সেই সময়কার দেওয়ানি বিধি-বিশেষজ্ঞ ও বিখ্যাত বিচারক আলবেয়ার ফেখ্মে-এর সঙ্গে তুমুল আলোচনায় মেতে উঠেছিলেন মার্কস। এছাড়া ১৮৭৯ সালে মার্কস গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন কতোগুলি বিশেষ বিষয়ঃ ১) উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের গতিপ্রকৃতি ও ফলাফল; ২) আলজেরিয়াতে এজমালি জমির ধরনধারণ ও ভূমি-বৈশিষ্ট্য এবং ৩) এমনকি ইসলামি আইনশাস্ত্রের হানাফী মতবাদ। মার্কসের এইসব অধ্যয়নের প্রমাণ মেলে তাঁর সেই সব নোটবই-এ, যেগুলো তিনি লিখেছিলেন রুশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সিম কোভালেভসস্কি’র কাজ নিয়ে।
বলা দরকার, কোভালেভসস্কি বেশ সময় ধরে গবেষণা করেই উত্তর ভারত আর উত্তর আফ্রিকার ভূমি নিয়ে লিখেছিলেন আর তাঁর সেই কাজকে গভীর মনোযোগ দিয়ে খতিয়ে দেখেছিলেন মার্কস। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছর মার্কস ভারতীয় সমাজ ও এমনকি ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান সমাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন ও নোট লিখেছেন। উদাহরণ হিসাবে বিশেষ করে বলা যাবে মার্কসের ১৮৮০ সালের অক্টোবর নোটগুলোর কথা। ওই নোটগুলো তিনি লিখেছিলেন ভারতের ইতিহাসের ওপর, যে-ইতিহাসের সময়কাল–ভাবা যায়?– ৬৬৪ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত। এমনকি ১৮৮১ সালে বিশ্বইতিহাসের ওপর মার্কস লিখেছিলেন ১৭ নয়, ১৭০-ও নয়, একেবারে ১৭০০ পৃষ্ঠা! অবশ্য এগুলো এখনও ইংরেজি অনুবাদে সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় নাই, যদিও উল্লিখিত বিভিন্ন নোট মোটেই দুর্লভ নয়।
এখানে এও বলা দরকার, মার্কসকে ইয়োরোপপকেন্দ্রিক, প্রগতিবাদী ও রৈখিক চিন্তার ধারক ও বাহক হিসাবে চিহ্নিত করার রেওয়াজ উত্তরআধুনিকতাবাদী ও উত্তরঔপনিবেশিক সমালোচকদের মহলে বেশ ঘটা করেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু মার্কসকে সমালোচনা করার জন্য এঁরা প্রায়শ নির্ভর করেছেন ১৮৫৩ সালে লিখিত মার্কসের কিছু রচনার ওপর, যেন ১৮৫৩ সালের মার্কসই ভারত বা পূর্ব নিয়ে সব কথা চূড়ান্তভাবে বলে ফেলেছেন! আরও বলা প্রয়োজন, অ-পশ্চিমা মুলুক নিয়ে মার্কসের কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৫৩-এর আগেই, অর্থাৎ ১৮৪০-এর দশকে। ১৮৪৬ সালে মিসর, তুরস্ক, সিরিয়া, আলজেরিয়া, এমনকি আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া এবং দক্ষিন আফ্রিকার ওপর মার্কস বিস্তর নোট লিখেছিলেন, যার প্রমাণ মেলে মার্কস-কৃত গুস্তাভ ফন গুলিচের কাজের পর্যালোচনায়; এই সময় মার্কস ১,০০০ পৃষ্ঠারও বেশি নোট লিখেছিলেন।
তবে আরও জোর দিয়ে বলা দরকার, উত্তরাধুনিকতাবাদী ও উত্তরঔপনিবেশিক সমালোচকদের অনেকেই–এবং তাঁদের বাইরেও মার্কসবিরোধীরা–শুধু ১৮৪০ দশকের মার্কসকেই নয়, ১৮৭০-১৮৮২ সালের মার্কসকেও সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন (এই এড়িয়ে-যাওয়া অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই অজ্ঞতাপ্রসূত), যে মার্কস তুমুলভাবে মুসলমান সমাজসহ অ-পশ্চিমা জগত বা পূবকে কেবল গবেষণার বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে ক্ষান্ত হন নাই; একইসঙ্গে তিনি অ-পশ্চিমা জগতের বিশ্লেষণে ও বিবেচনায় পশ্চিমা ধারণা ও ক্যাটাগরির প্রয়োগকেও সমালোচনা করেছেন বিস্তর এবং রৈখিক প্রগতির ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তীব্রভাবে। এমনকি মার্কস চিহ্নিত করেছিলেন ওইসব ইয়োরোপীয় পণ্ডিতকে, যাঁরা সম্পত্তি- সম্পর্ক নিয়ে কুরআন শরীফের ভুলভাল প্রাচ্যবাদী ব্যাখ্যা সামনে এনেছিলেন। এডওয়ার্ড সাঈদের মেলা আগেই সেই উনিশ শতকে মার্কস ওইসব পণ্ডিতকে সমালোচনা করে বলেছিলেন ‘”লাউজি ওরিয়েন্টালিস্ট”! হাঁ, মূল জর্মনেই নেতিবাচক বর্গ হিসাবে “ওরিয়েন্টালিস্ট” বর্গটি মার্কস প্রয়োগ করেছিলেন নির্দ্বিধায়।
এই মার্কসকেও ভালো করে চিনে রাখা দরকার ।
সূত্রঃ পিটার হুডিস, “মার্কস অ্যামাং দ্য মুসলিমস,” ক্যাপিটালিজম, নেইচার, সোশ্যালিজম, ভল্যুম ১৫, সংখ্যা ৪ (ডিসেম্বর ২০০৪)। কেভিন অ্যান্ডারসন, মার্কস অ্যাট দ্য মারজিনস [এক্সপ্যানডেড এডিশান] (শিকাগোঃ ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, ২০১৬)।
অধ্যাপক ও লেখক ড. আজফার হোসেন