৩০ বছর আগে, আজকের এই দিনে এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মুখে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘৬ ডিসেম্বর’কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন নাম দিয়ে পালন করেন- ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, ‘সংবিধান সংরক্ষন দিবস’ ইত্যাদি। যদিও ৬ ডিসেম্বরকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবে পালন করাটাই তুলনামূলক বেশি যুক্তিযুক্ত। তবে আরো বেশি পরিপূর্ণ হতো এরশাদের নাম উল্লেখ করে ‘স্বৈরাচার এরশাদ পতন দিবস’ হিসেবে পালন করলে। কারণ হলো- ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরে আসলে গণতন্ত্রের কোনও নীতিগত-কাঠামোগত-সাংবিধানিক পরিবর্তন ঘটেনি। সেদিন শুধু ব্যক্তি এরশাদের পতন ঘটেছিল, যিনি ছিলেন স্বৈরাচার। কিন্তু যে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র জারি আছে, যার কারণে ব্যক্তি এরশাদ ‘স্বৈরাচার’ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, এবং যার কারণে এখনো ‘স্বৈরতন্ত্র’ জারি আছে- তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে ৬ ডিসেম্বরকে পালন করার কারণ নাই। বরং এই দিনকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ বললে মনে হতে পারে- ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে যেনো দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে! আসলে বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো!
৯ বছর এরশাদ স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করেও তিনি পরবর্তীতে বিভিন্ন দলের সাথে জোট করেছেন শাস্তি এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দেই। বেশিরভাগ সময়ই তিনি মূলত ক্ষমতার সাথেই ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মাঝেমাঝে সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের সাথে শরীক হয়ে, মাঝেমাঝে ‘পোষা বিরোধী দল’ হয়ে। ফলে গণতান্ত্রিক দেশের আইনের ফাঁক গলে এরশাদ ঠিকই শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায়। যার পতনকে ‘গণতন্ত্রের মুক্তি’ বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে সেই স্বৈরাচার ব্যক্তিই আবার পতনের পর লেপ্টে আছেন আখ্যাদাতা ‘গণতান্ত্রিক’ দলগুলোর সাথে! তাহলে বোঝাই যাচ্ছে- কেমন পরিবর্তন ঘটেছে ৬ ডিসেম্বরের পরে!
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর গণতন্ত্রের কী হাল হয়েছে তা বুঝতে ডিএমপি’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি থেকেই বোঝা যায়। গত ২ ডিসেম্বর ডিএমপি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন সভা, সমাবেশ, গণ-জমায়েতের কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের কর্মসূচি পালন করতে রাস্তায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় যান ও জন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
বিদ্যমান আইনে বৈধ কোনো দল বা গোষ্ঠীর সমাবেশের স্বাধীনতা থাকলেও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জন-শৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের নাগরিক সুবিধা অক্ষুণ্ণ রাখা, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে এ ধরনের কর্মসূচি পালন এবং শব্দযন্ত্র ব্যবহারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশ অনুসারে ডিএমপি কমিশনারের পূর্বানুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে একদিকে যেমন মিছিল বা সমাবেশকারী ব্যক্তিদের শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অপরদিকে কোনো কোনো দল বা গোষ্ঠী বেআইনি সমাবেশ আয়োজন করে জানমালের ক্ষতি সাধনসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করার সুযোগ পায়।
ঢাকা মহানগরীর নাগরিকদের জানমালের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো মিছিল, সভা-সমাবেশসহ কর্মসূচির গ্রহণ এবং শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করছে। অনুমতি ছাড়া কেউ এরূপ কার্যকলাপে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
ডিএমপি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে যা বলেছে তা যদিও নতুন কিছু নয়। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে তা ১৯৭২ সাল থেকেই অবিকৃতই আছে। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাঁধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ ফলে সংবিধান অনুযায়ীই ডিএমপি ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাঁধানিষেধ’ জারি করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন করা যেতে পারে- এই নির্দেশনা জারি করার এখতিয়ার ডিএমপি’র আছে কিনা। দেশের পুলিশ বাহিনী তো আদালতের আদেশ পালনকারী সংস্থার ভূমিকায় থাকার কথা। কিন্তু গণতন্ত্রের এখন এমনই হাল যে, আদালতের আদেশ আর লাগে না, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীই আদেশদাতা হয়ে উঠেছে! ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এই ৩৭ তম অনুচ্ছেদকে সরকারি দল তাদের মতো করে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রয়োগ করেছে। সরকারি দলের জন্য আইন একধরণের আর বিরোধী দলগুলোর জন্য আইন অন্য ধরণের। যদিও দুইটাই সংবিধান দ্বারা সিদ্ধ। এখানেই গণতন্ত্রের মুক্তির প্রশ্ন- মুক্ত গণতন্ত্রে সাংবিধানিক আইন হবে সকলের জন্য একই এবং বিরোধী মত থাকবে অবারিত ও রাষ্টীয় নিরাপত্তা প্রাপ্ত।
কিন্তু দেশের সংবিধানই আইন করে দলীয় আনুগত্যের জমিন তৈরি করে রেখেছে। প্রায় সকলেরই জানা যে, কোন আইন প্রণয়নকারী সাংসদ তার মতামত সংসদে উত্থাপন করার আগে সদস্য পদ থাকবে কিনা তা ভেবে কথা বলেন। দলীয় প্রধানের মতের বাইরে তার কোন মতামত থাকলেও ‘৭০ অনুচ্ছেদ’ এর কথা মাথায় রেখে ঢোক গিলে চেপে যান আর হাত তুলে উচ্চস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলতে বাধ্য হন। আর তারপর মাননীয় স্পীকার ঘোষণা দেন- ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে, হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে’। এই তো চলছে! সাংসদের ওই আচরণও সংবিধান সিদ্ধই বটে।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না”।
এই আইন যদি একটা গণতান্ত্রিক দেশের আইন হয় তাহলে খুবই স্বাভাবিক যে, সাংসদদের ‘হাত তুলে চিৎকার দেয়া’ ছাড়া আর তেমন কিছু করার নেই। এ কারণেই আইন ও শাসন চলে যায় প্রথমে একদলের হাতে এবং তারপর এক ব্যক্তির হাতে। এ কারণেই স্বৈরতন্ত্র সাংবিধানিকভাবেই আসীন থাকে। একারণেই রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে চলতে পারে না, ফলে জবাবদিহিতার কোনো বালাই থাকে না কোথাও।
ফলে ৩০ বছর আগের সাথে আজকের বর্তমানকে তুলনা করলে গণতন্ত্রকামী মানুষ তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। পার্থক্য পাওয়া যাবে নামে, লেবাসে। কিন্তু পার্থক্য পাওয়া যাবে না গণতান্ত্রিক রূপান্তরে। ২০২০ সালের মানুষ নতুন আরেকটি সত্যিকার ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ প্রত্যাশা করে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি যেমন ৪৭ বছর পর নতুন করে তাদের সংবিধান প্রণয়নের কাজ হাত নিয়েছে; ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশকেও আজ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথেই হাঁটতে হবে। সেই পথেই অবসান হবে সকল স্বৈরাচারি আইন-কানুন, রাষ্ট্রের সকল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হবে স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক। রাষ্ট্রপ্রধান হবেন জনগণের আজ্ঞাবহ সেবাদানকারী। জনগণ হবে সাহসী আর সরকার হবে জনগণের হুকুমপালনকারী কর্মচারী।
সৈকত মল্লিক,
কেন্দ্রীয় সংগঠক, গণসংহতি আন্দোলন।
সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।