২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর, জ্বালানী তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বেশ কয়েক জন কেন্দ্রীয় নেতা মারাত্মকভাবে আহত হন। শুধুমাত্র হামলা চালিয়েই তারা শান্ত হতে পারেননি। ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈকত মল্লিকের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। খুব কাছে থেকে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে বুট দিয়ে পিষে সৈকত মল্লিকের পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। জ্বি ! ক্ষমতায় তখন “পাকিস্তানপন্থী” কোন সরকার ছিলো না, খোদ “মুক্তিযুদ্ধের চ্যাম্পিয়ন” দাবিদার আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় ছিলো।
আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলের শুরু থেকেই আমরা জ্বালানী তেল ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের স্বেচ্ছাচারীতার প্রতিবাদ করে আসছিলাম। কেন করেছিলাম, তার কারন এখন সকলের কাছে খুব পরিস্কার। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই খাত সরকার কার্যত ব্যক্তি মালিকানায় তুলে দিয়েছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে দলীয় নেতাদের হাতে কোটি কোটি টাকা তুলে দেয়ার বন্দবোস্ত করেছে। শুধু রেন্টাল-কুইক রেন্টালের ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া বাবদ জনগণের ৯০০০ কোটি টাকা দলীয় নেতাদের পকেটে তুলে দেয়ার বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেছে। (১৮ মে ২০২০; প্রথম আলো)।
শুধুই কি ৯০০০ কোটি টাকা? ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালের প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, “চাহিদা নাই, তবুও নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র”। সেই প্রতিবেদনে আরো বলা হচ্ছে, “মোট ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই অলস পড়ে আছে। এরপরও সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বিনা দরপত্রে দেওয়া এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে’ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনাও (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান) মানা হচ্ছে না।” অথচ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসানো আওয়ামীলীগ সরকার নিজেদের পরিকল্পনাও মেনে চলছে না।
পুলিশ গুলি করার পর প্রথম আলো ০৩.০১.২০১৩ তারিখে একটি ফলো-আপ রিপোর্ট করেছিলো। প্রতিবেদনটি এখন আর সার্ভারে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিন্ট সংস্করনে ছিলো। আসুন সরাসরি সৈকত মল্লিকের জবানীতে জেনে নেয়া যাক কী ঘটনা ঘটেছিলো,
“অর্জন করেছি সংগ্রাম করার সাহস আর আত্মবিশ্বাস, হারিয়েছি সাবলীল পদচারণার ক্ষমতা… গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার উদ্যোগে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জ্বালানী মন্ত্রনালয় ঘেরাও কর্মসূচী ছিল। সকাল সকালই গিয়েছিলাম জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। দেখলাম সচিবালয়ের লিংক রোডে পুলিশ তিন স্তরের বেড়িকেড জিআই তার দিয়ে বেঁধে রেডি করছে। আমাদের ঢাবি’র ছাত্রনেতা ইমন আর আমি প্ল্যান করলাম বাম দিকের জিআই তারগুলো শুরুতেই কেটে ফেলার। মিছিল বেড়িকেডের সামনে আসার সাথেসাথে কাজটা করেও ফেললাম সফল ভাবে। সাথেসাথে জোয়ারের মতো তরুণ নেতাকর্মীরা ঢুকতে শুরু করলো। আমার সামনে যাওয়ার প্ল্যান না থাকলেও স্রোতের ধাক্কায় পিছন ফিরতে পারলাম না। এক পর্যায়ে দেখলাম আমার সামনে পুলিশ ডানেও পুলিশ। কিছুক্ষণ পরেই শটগানের বিকট শব্দ, পরক্ষণেই বাম পায়ে তীব্র ব্যাথ্যা…। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, বাম কাত হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর রিকশায় মঞ্জুরুল ভাইয়ের কাঁধে নিজেকে আবিস্কার করলাম। বাম পাটা ততক্ষণে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, হাটুর নিচের অংশ থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে তখন। আমি আবার চেতনা হারালাম… তারপর ঢাকা মেডিকেল… তারপর মিরপুরের বাসা। ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট, ড্রেসিং,ক্রাচ, কমোডযুক্ত চেয়ার…। তবে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, প্রথম দফা অপারেশনের পর হিস্ট্রিতে দেখলাম ডাক্তার সীসা পেয়েছেন। অর্থাৎ গুলি করা হয়েছিলো। পরে ডাক্তার সেই পেসেন্ট হিস্ট্রি চেঞ্জ করে দেয়। ফলে মেডিকেল রিপোর্ট দিয়ে পুলিশের গুলি করার বিষয়টি প্রমান করার সুযোগ না থাকলেও পায়ে সেই ক্ষতচিহ্ন এখনো আছে। পরে আর এক দফা অপারেশন করা হয়।”
পুলিশ যে শান্তিপূর্ণ একটা সমাবেশে গুলি করলো সেই আলোচনা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেলো না। অথচ রাষ্ট্র বিকাশের স্বার্থেই পুলিশের গুলি করা বা না করার বিষয়টির রাষ্ট্রীয় তত্বাবধানে মিমাংসার প্রয়োজন ছিলো। এই ঘটনার পর মাত্র দুই বছর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। তারপর থেকে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে অযৌক্তিক বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। শেয়ার বিজে প্রকাশিত (১ মার্চ ২০২০) নিচের গ্রাফ লক্ষ করুন। (আগ্রহীরা এই প্রতিবেদন বিস্তারিত পড়ে দেখতে পারেন)।
মল্লিকদের পায়ে জনগণের পয়সায় কেনা গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়েই মুক্তির সংগ্রাম চলমান থাকবে ?
জনগণের পয়সায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত বেসরকারি মালিকানায় চলে যাচ্ছে। অথচ স্বাধীনতা সূত্রেই আমরা বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছিলাম। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা হচ্ছে। একভাবে সৈকত মল্লিককে সৌভাগ্যবান বলতেই হবে। সেটা ছিলো এই সরকারের প্রথম সময়কাল। তাছাড়া তাকে ক্রসফায়ারে দিলে বা দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখলেই বা কী হতো? এই সরকার ক্রমাগত ফ্যাসিস্ট ও জনস্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, আদিবাসীদের ভূমি দখলে সহযোগিতা করে, সরকারি সম্পত্তি জবরদখল, ব্যাংক লুটপাট, অবিচার প্রতিষ্টা, সরকারি বাহিনী দিয়ে হত্যাকান্ড, রাষ্ট্রীয় পাটকল-চিনিকল সব ধ্বংস করে, অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার, বিভিন্ন স্থাপনা এমনকি সুন্দরবন ধ্বংস করে ইন্ডিয়ানদের পরিত্যাক্ত প্রকল্প চালিয়ে ‘উন্নয়নের সেতু’ দেখাচ্ছে!
এই চরম নৈরাজ্যের মধ্যেও আশার ব্যাপার এই যে, জনগণের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ্য বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মালিক জনগন একে রক্ষাও করবে দেশের আপামর জনসাধারণ। বিভিন্ন প্রকার “ক্ষতচিহ্ন” নিয়েই স্বাধীনতা উত্তর মুক্তির সংগ্রাম অব্যহত আছে। অব্যহত সংগ্রামের মাধ্যমেই এই জাতি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। জাতীয় মুক্তির ইতিহাসও বীরজনতাই রচনা করবে। সৈকত মল্লিকেরা এখানে প্রতীক মাত্র। সৈকত মল্লিক তার জোড়াতালি দেয়া পা নিয়ে মুক্তির মিছিলে হাটবেন। আমরা কি করবো? আমরাও কি মুক্তির মিছিলে হাঁটবো? যদি মুক্তির মিছিলে যাই তাহলে কেন যাবো? চলুন দেখি একমতে পৌছানো যায় কিনা ! বিপুল সংখ্যক পাট্কল-চিনিকল-গার্মেন্ট শ্রমিক আছেন বাংলাদেশে। তারা যদি নায্য মজুরি পান তাহলে সেই টাকা তারা কোন খাতে খরচ করবেন? প্রথমত খরচ করবেন, সন্তানদের শিক্ষায়। বিপুল শ্রমিকদের সন্তানেরা যদি স্কুলে যান তাহলে প্রচুর স্কুল কলেজ প্রয়োজন হবে যেখানে আমি আপনি চাকরির সুযোগ পাবো। যদি তারা একাধিক পরিধেয় কাপড় কেনেন, বাড়ি তৈরি করেন অর্থ্যাৎ তারা যে কোন খাতেই টাকা ব্যয় করলে অর্থনীতির চাকা বিপুল বিক্রমে ঘুরতে থাকবে। অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কিন্তু এখন যারা ব্যাংক লুটপাট করে, চুরি-দূর্নীতি করে টাকা পাচার করছেন তা আমাদের জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে কোন কাজেই আসছে না!
সুতরাং শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন স্রেফ শ্রমিকের আন্দোলন নয়। একই সাথে এটা নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের আন্দোলন। কার্যত রাজনৈতিক দূবৃত্বপনা থেকে মুক্তির আন্দোলন। শ্রমিকরা মুক্ত হলে, আপনাকে সরকারি কর্মকর্তা হয়ে লোকাল নেতার অশ্রাব্য গালি শুনতে হবে না। গ্রাজুয়েট হয়ে বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আত্মহত্যা করতে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, আপনার পিতা-মাতাকেও কষ্টে-শিষ্ঠে দিনাতিপাত করতে হবে না। আপনি যদি সত্যিই আপনাকে আপনার পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তি, নিরাপত্তা ও সন্মাজনক জীবন নিশ্চিত করতে চান তাহলে কোন যুক্তিতেই এই লড়াই এড়িয়ে যেতে পারেন না। যদি এড়িয়ে যান তাহলে জেনে রাখবেন, আপনি আপনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব অবহেলা করে যাচ্ছেন। যদি প্রকৃত অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান তাহলে এই মুক্তির মিছিলে আপনাকে অংশগ্রহণ করতেই হবে।
২০১০-২০২০ সাল পর্যন্ত তালিকা করলে অসংখ্য সৈকত মল্লিকের দেখা মিলবে। সৈকত মল্লিকের বক্তব্য দিয়েই বলি “আমরা নিপীড়িত মানুষের স্বার্থের পক্ষে লড়াই করছি। আগামী দিনের লড়াইয়েও শামিল থাকবো। মৃত্যু ছাড়া আর কিছু আমাদের লড়াইকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।”
উৎসব মোসাদ্দেক
জাতীয় পরিষদ সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন
সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
আরোও পড়ুনঃ
চিনিকলের সংকট বনাম মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা
রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকল নিয়ে অসত্য বয়ান কার স্বার্থে?