মনের প্রাচুর্যতা এবং অর্থের প্রাচুর্যতা মানুষের জীবনে কোনটা কতটা অপরিহার্য ? মন এবং অর্থ মানুষের জীবনে প্রয়োজন এটা ধ্রæব সত্য। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অর্থের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত হলে জীবনটা নিয়ন্ত্রণহীন গতি পায় বৈকি। কারণ জীবনের প্রয়োজন সীমাবদ্ধ, আর চাহিদা সীমাহীন। এই চাহিদার সীমা-পরিসীমার কোন নির্দিষ্টতা নেই। ফলে জীবনে কোন শৃঙ্খলা থাকে না, থাকে না কোন রসবোধ। দুর্বিনীত চাহিদায় ভোগ স্পৃহা তীব্র হয়, সীমাহীন বিলাসিতায় নিমগ্ন হয় জীবন। যিনি প্রয়োজন এবং চাহিদার তারতম্য বিচার করতে পারেন তিনি জীবনে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারেন। আর যিনি চাহিদাকে জীবনের সফলতার মাপকাঠি মনে করেন তিনি মেকি জীবনে গাঁ ভাসিয়ে দেন। বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্যতা থাকলেও তাদের মধ্যে অধিকাংশের মন-মানসিকতার অপমৃত্যু ঘটে, ভোগেন হীনমন্যতায়। অর্থের প্রাচুর্যতা তাদের কদর্য মনের মানসিকতায় রূপান্তরিত করে।
শৈশব প্রত্যেক মানুষের অমূল্য সম্পদ। শৈশব চলে গেলে আর ফিরে আসে না। ছোটবেলায় শিশুর জীবনে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। শিশুকে যা শেখাবেন তাই শিখবে। ছোটবেলায় নীতিবাক্য যাই শেখাবেন না কেন তাই সে শেখে এবং সত্য বলে গ্রহণ করবে। অথচ বাস্তব সত্য যে, পরিণত বয়সে অনেকেই তা অস্বীকার করেন। বিদ্যমান রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, সংস্কৃতির প্রভাবের ফলে ছোটবেলার সেই নীতিবাক্য মস্তিষ্ক থেকে অপসারিত হয়। আমরা কী একবারও বোঝার চেষ্টা করি, জীবন থেকে কি হারিয়ে গেল ?
ছোটবেলায়-ই তো আমরা পড়েছি ‘অর্থ অনর্থের মূল। বড় হয়ে এখন আমার কাছে মনে হয়Ñআমরা ছাত্রাবস্থায় শুধুমাত্র পরীক্ষা পাশের জন্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করতাম, অর্থ কেন জীবনের জন্য অনর্থের মূল ? বড় হয়ে ব্যবহারিক জীবনে আমরা এ অকাট্য সত্য প্রবাদকে অন্তর থেকে স্বীকার করি না। বাড়ি-গাড়ী, কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে ছুটতে যেয়ে আমরা শোষণ-লুণ্ঠন-লুটপাট-দুর্নীতিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি। জীবনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধনাঢ্য হবার এটাইতো পথ। ফলে ছোটবেলার সেই নীতিবাক্য বড়বেলায় আপ্তবাক্যে রূপান্তর ঘটে। তখন নীতিবাক্য হয় জীবন থেকে কুপোকাত।
অর্থের প্রাচুর্যভরা জীবন যে প্রাণবন্ত হয় না, তার বাস্তব উদাহরণ দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের মিষ্টি মেয়ে নামে খ্যাত সারাহ বেগম কবরী। মৃত্যুর পরবর্তীতে তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান জানিয়েছে ‘আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল। জীবনে চলার পথে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। মন্দ মানুষের সঙ্গেও পরিচয় ঘটেছে। ওরা আমাকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের লাভ খুঁজেছে। অথচ এ জীবনে আমি ভালো বন্ধু পাইনি। ভালো স্বামী পাইনি। সঙ্গ দেওয়ার মত একজন ভালো মানুষ পাইনি। যাঁকে এ জীবনে বলতে পারি এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি।’
কথাগুলো কত কষ্টের, কত বেদনার তা তিনি জীবনাবসানের পূর্বেই প্রকাশ করে গেছেন। অথচ এই সু-অভিনেত্রী নাটক, চলচ্চিত্রে অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনা করতে গিয়ে শুধু চলচ্চিত্রের নায়ক, গায়ক, পরিচালক, অভিনেতাই নয়; এর বাইরেও বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। তিনি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি জীবনে বহু অর্থ আয় করেছেন, ব্যয়ও করেছেন। অর্থের প্রাচুর্যের মধ্যেই তিনি জীবন কাটিয়েছেন। তিনি জীবনভর খুঁজেও মনের মানুষ পাননি।
বাস্তবসম্মত এই উদাহরণ দেয়ার অর্থ হলোÑজীবনে বিত্ত-বৈভবের চেয়ে মনটাই বড়। মনের প্রাচুর্য বৃদ্ধি করতে পারলে পাহাড়সম বিত্তের প্রয়োজন হয় না। অথচ সম্পদের চুড়ায় আরোহনকারী অভিজাতবর্গরা বিশ্বাস করেন নিম্নবিত্ত থাকলে চিত্তের অভাব হয় না। অর্থ-বিত্তে টইটম্বুর থাকলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন কোনটাই অপূর্ণ থাকে না। ফলে শ্রমজীবী মানুষেরাই অভিজাতবর্গের উপরে ওঠার সিড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মন্ত্রী, আমলা, সংসদ সদস্য, ভ‚স্বামী, গার্মেন্ট মালিক, ব্যবসায়ী, লুটেরা রাজনীতিবিদ সকলেই সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের রক্ত চুষে অন্তহীন অর্থ-সম্পদের মালিক হচ্ছেন, রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করছেন, বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। তারাই কঙ্কালসার দেহের মানুষদের হাঁড়-মাংস এক করে ফেলছেন। জনগণের অর্থ লোপাট করছেন। বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। এই দানবীয় শাসকদের শরীরে নীল বা আভিজাত্যের রক্ত প্রবাহিত। যুগ যুগ ধরে সেই নীল রক্ত তাবৎ পৃথিবীর নিরন্ন শ্রমজীবী মানুষদের মানুষ বলে সম্মান দেয় না, মর্যাদা দেয় না। এই রক্তের উত্তরাধিকারীরাও খেঁটে খাওয়া মানুষদের প্রতিনিয়ত অপমান করে, অপদস্ত করে। কুলহারা এই মানুষেরা প্রদীপের আলোর নিচে অন্ধকারে থাকে। এসব মানুষেরা খাবার না খেতে পেয়ে যখন যন্ত্রণাকাতর হয়ে চিৎকার দেয়, রোগে তিলতিল করে যখন ভোগে, তখন তাদের সেই কান্না প্রদীপের আলোর ওপরে থাকা টাইস্যুট পরা অভিজাতদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। শোষকেরা এই শঙ্কায় শঙ্কিত হয় না যে, তারা একদিন তাদের আলিশান প্রাসাদ দখল করে নিতে পারে। তাদের সমস্ত বিত্ত, সমস্ত অহংকার রাজপথে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। শাসকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে শঙ্কিত নাও হতে পারেন। তবে স্মরণ রাখবেন, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী।
অথচ এই শাসকেরাই জনগণের কল্যাণের কথা বলে ধোঁকাবাজির রাজনীতি করছেন তথাকথিত রাজনীতিবিদেরা। এই রাজনীতিবিদেরাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণকে প্রতারণা করে, জনগণকে ঠঁকিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে আকাশছোঁয়া প্রতিপত্তির মালিক হন। আবার এও দেখা যায়Ñনিজেদের গণবিরোধী ভ‚মিকার জন্য জনগণের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে না পারলে, শাসকগণ দিবা-রাত্র ভোট ডাকাতি করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছেন। একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বিগত কয়েক যুগে শাসকদের ভোট ডাকাতির দৃষ্টান্ত জনগণের স্মৃতিতে এখনো জ্বল জ্বল করছে। এই শাসকদেরই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। তাদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন, অর্থ ও ধন-সম্পত্তির জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়। বড় বড় সুরক্ষিত ব্যাংকের প্রয়োজন হয়। তখন এসবের জন্য তাদের নিরাপত্তা বেষ্টনি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু মনের প্রাচুর্য দ্যুতি ছড়ানোর মত বৃদ্ধি পেলে বা ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে গেলে এদের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কিত হতে হয় না। কারণ মনের সীমারেখা অসীম হলেও অহেতুক নিজের জীবনের নিরাপত্তাজনিত কোন ঝুঁকি থাকে না। মনের প্রাচুর্যই হচ্ছে এদের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ হারানো বা চুরি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
যারা মনের প্রাচুর্যের মৃত্যু ঘটিয়ে অর্থ, ধন-সম্পত্তি, ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন, তারা মনস্তাত্তি¡কভাবে অসুস্থ মানুষ। এরাই সমাজের গণদুশমন। অপরাধ, সন্ত্রাস জগৎ নিয়ন্ত্রণ, দেশের সম্পদ দখল ও দখলদারদের নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস, সত্য তথ্য প্রকাশে আটক, কারাগারে বন্দী বা জীবন বধ প্রভৃতি অপরাধের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে। এই শাসকেরাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস ও দুর্নীতিগ্রস্ত করছে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে দেশের মানুষকে শেকল পরিয়ে রাখছে। এইসব চোরাগলির অসুস্থ মানুষদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া উচিৎ।
মুনীর চৌধুরী সোহেল
তারিখ: ২১-০৫-২০২১
#জ/উম-৬/৬