You are currently viewing ভূমি-সংস্কার ও নারী-পুরুষের অধিকার-সমতা

ভূমি-সংস্কার ও নারী-পুরুষের অধিকার-সমতা

লেখার শুরুতে এ কথা বলা দরকার যে, পাঠক যদি আমার কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট উত্তর আশা করেন তাহলে হয়তো হতাশ হবেন। পাঠক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের জন্য কিছু প্রশ্ন তোলাই এ লেখার উদ্দেশ্য। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন আমাকে এ বিষয়ে লিখতে বলা হয় তখন আমি ধরে নেব বিষয়টি এভাবে আলোচনা হতে পারে-যেমন, নারী-পুরুষের অধিকার সমতার ইতিহাস এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি জড়িত হওয়ার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। এ আলোচনা বিশ্ব ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল সম্ভব-কেননা নারী-পুরুষের অধিকার সমতার প্রশ্নটি ইউরোপেই জোরালোভাবে হাজির হয় ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যদিও অধিকার ঘোষণা বা ডিক্লারেশন অব রাইটসে খুব স্পষ্টভাবে সেটা আসেনি; তবে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, শ্লোগানে তা স্পষ্ট হয়। বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নারী নেতৃত্ব সমতার ধারণাকে লিঙ্গ সমতা পর্যন্ত প্রসারিত করতে চেয়েছেন। বুর্জোয়া বিকাশের সাথে সাথে, বিশেষত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশের সাথে যৌন সমতার প্রশ্নটি স্পষ্ট হতে থাকে।

১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস এলাকায় পুরুষ ও নারীদের এক কনভেনশনে নারীর ওপর পুরুষের শোষণের বাস্তবতা স্বীকার করা হয় এবং এই শোষণমুক্তি ও সমতা অর্জন নারী আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়। তখন ভারতে ইংরেজ শাসনের নব্বই বছর চলছে।

সমতা বা ইকুয়ালিটি শব্দটি ১৫ শতকে ফরাসি Egalité থেকে নেয়া, যেটার মানে তখন গাণিতিক সমতা বোঝাত অর্থাৎ টাইম, স্পেস এবং ডিসটেন্সের ইকুয়ালিটি অর্থে। ১৭ শতকে ইংল্যান্ডের বিপ্লবী যুগে সমতা সামাজিক অর্থ ধারণ করে, অর্থাৎ ‘হোয়াট ইজ রাইট, প্রোপার, জাস্ট এবং রিজনেবল’ সেই অর্থ। লেভেলার-রা ১৬৪৯-এর ক্রমওয়েলের বিপ্লবের (চার্লসের বিরুদ্ধে) সময় এই সামাজিক সমতার ধারণাকে স্পষ্ট করে।

পুরুষের সমঅধিকারের কথা চিন্তা করেই ১৬৫১ সালে টমাস হবস তাঁর লেভিয়াথানে ‘Nature has made men so equal in the faculties of body and mind’ বক্তব্যটি হাজির করেন। আসলে অতীতে কোনো এক স্বর্ণযুগে এক কাল্পনিক মানবসমাজে বিদ্যমান সমতার ধারণাকে হাজির করা হয়েছিল ইউরোপের অসম সমাজ জীবনের বিরুদ্ধে জোরালো সমালোচনা হিসেবে। উনিশ শতকে দ্য সাবজেকশন অব উইমেন বইয়ের লেখক জন স্টুয়ার্ট মিল লিখেছিলেন, যে সমতার আইন তৈরি করার মধ্য দিয়েই নারীর মুক্তি আসবে।

প্রত্যেক মানুষের একটি করে ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমতা আনা অনেকখানি সম্ভব হলেও এবং শাসনতন্ত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত হলেও যখন সম্পত্তির অধিকারে সমতার দাবি ওঠে তখন বিষয়টি বেশ জটিল আকার ধারণ করে, যা কিনা ১৮৪৮-এর মার্কিন নারীরা সেনেকা ফলস অধিবেশনে দাবি করেছিল।

আসলে প্লেটো এবং প্রথম যুগের ক্রিশ্চানরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তা হচ্ছে, একমাত্র সাম্যবাদী সমাজেই, যাকে কমিউনিটি অব গুডস বলা যায়, সমতার দর্শন কার্যকরী হতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রাঁসোয়া বেবুফও কমন প্রপার্টির দাবি করেছিলেন। মার্কসবাদের আবির্ভাবে একদিকে সাম্যবাদের দাবি অন্যদিকে প্রজাতন্ত্রনির্ভর ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-অধিকারের লড়াই স্পষ্ট হয়। From each according to his abilities, for each according to his needs – এটা সাম্যবাদী সমাজের মূল কথা। অর্থাৎ ক্ষমতাবান ব্যক্তি একজন দুর্বল ব্যক্তির প্রয়োজনের আওতাধীন হবে এবং সামাজিক দায়িত্ব ব্যক্তি অধিকারের ওপরে স্থান পাবে।

সমালোচকরা বলতেন, এই ধরনের সমতা আসলে আরেক ধরনের অসমতা সৃষ্টি করবে। সবল যদি দুর্বলের সমান হয় তাহলে নতুন অসাম্য তৈরি হবে। তাই অ্যাডাম স্মিথ প্রতিযোগিতাকে সাম্যসৃষ্টিকারী প্রক্রিয়া হিসেবে তত্ত্ব দিলেন। প্রতিযোগিতা যত তীব্র হবে সামাজিক সম্পদ তত বাড়বে এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি চাহিদা পূরণের সম্ভাবনাও বাড়বে। অনেকে প্রশ্ন উঠালো সত্যিই কি সব পুরুষ ও নারীকে সম্পদের অধিকারে সমান করা সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তাহলে কোন আইন বা কি ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় তা সম্ভব? আমাদের মনে রাখতে হবে এই পরিপ্রেক্ষিতেই নারী-পুরুষের সমতার আলোচনা এগুচ্ছে। অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞান, নেহাৎ যুক্তির সাহায্যে উত্তর আসে। তবে কোনটা আমাদের জন্য গ্রহণীয়?

আমাদের জন্য কি আলাদা কোনো উত্তর আছে? না এবং হ্যাঁ? দুটোই। পুঁজিবাদ, আর একটু ব্যাপক অর্থে আধুনিকতার যে প্রক্রিয়া ইউরোপে শুরু হয়েছে তা আমাদের চেতনা, চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। জাতিরাষ্ট্রের মডেলটি আমাদের কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি, যেটা ইউরোপ আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে হাতে তুলে দিয়েছে। সত্যি বলতে কী এ প্রবন্ধের বিষয়টিও আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের মঙ্গলচিন্তা, এ আলোচনাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে। অর্থাৎ সমতার ধারণা গ্রাহ্যতা এবং ভূমি সংস্কার অর্থাৎ ভূমিজ সম্পর্কের পরিবর্তন, যা কিনা আধুনিক জগতে, যে জগত ইউরোপ তৈরি করেছে-আমাদের যোগাযোগকে শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক করবে। দাবিটি পুঁজির বিশ্বকরণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ পুঁজির বিশ্বায়ন বলতে যা বোঝান হয়। পুঁজির সঙ্গে মানুষের অন্যান্য সামাজিক বন্ধনের অন্যতম সমঝোতার চেহারা হলো রাষ্ট্র। অন্যভাবেও বলা যায়-বুর্জোয়া সভ্যতা যদি পুঁজি ও রাষ্ট্র দুই’ই দিয়ে থাকে তবে এ দুটি যৌগিক বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক কাঠামোগতভাবে দ্বন্দ্বমূলক। কেউ যদি বলেন রাষ্ট্রের বিকল্পই বা কী? এর কোনো নির্দিষ্ট জবাব নেই। সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের এই ফারাক আমাদের সুযোগ দেবে, আধুনিক রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ও পুঁজির সমঝোতার চরিত্র নিয়ে ভাবতে। কথাগুলি দীপেশ চক্রবর্তীর পুঁজি, পণ্য সংস্কৃতি ও ইতিহাসের চেতনা থেকে নেয়া। তবে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এখানেই আমাদের স্থান করে নিতে হবে। এ লেখায় দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে আনার প্রক্রিয়া এখানেই শুরু। আমি যে কারণে ইউরোপের ইতিহাসে ফিরে গেছি তা হলো এটা বোঝানোর জন্য যে, সে সমাজে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি সামাজিক সংগ্রাম দীর্ঘদিন চলেছিল। আমাদের সমাজে তার উপস্থিতি ও গুরুত্বকে বুঝতে হবে। আমাদের সমাজে ইউরোপীয় চেতনার প্রসার ঘটেছে।

এ লেখার পেছনে একটি সিদ্ধান্ত আছে, তা হলো উন্নয়নের স্বার্থ। বর্তমানে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি আছে কিনা। গত চার দশকের টেন্যান্সি রিফর্মসের পেছনে যে কল্যাণমূলক ধারণা ছিল তা সফল হয়নি। তার কারণ হিসেবে জমির স্বল্পতা ও জনসংখ্যার চাপকেই দায়ী করা হয়েছে এবং নীতিনির্ধারক, পণ্ডিত ও রাজনীতিবিদদের গণমুখী কর্মসূচির মোহকে চিহ্নিত করা হয়েছে। খুব সহজেই পরিসংখ্যানকে অবহেলা করা হয়েছে এবং কাগুজে নীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। টেন্যান্সি রিফর্মসের (Tenancy Reforms) বদলে অর্থাৎ পুনর্বণ্টনভিত্তিক ভূমি সংস্কারের বদলে কৃষি সংস্কারকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলছে আবার কেউ। অর্থাৎ স্বল্প উৎপাদনশীলতা থেকে বের হওয়াটাই আজকের মূল কর্তব্য। এসব লেখায় একটা বিষয় স্পষ্ট, রাষ্ট্রের ওপর সত্যিকার অধিকার না থাকলে ভূমি সংস্কার কোনো কাজে লাগে না। এই প্রেক্ষাপটে আজ ভূমি সংস্কারের প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনার দায়িত্ব এসে পড়ে এবং নারী-পুরুষের জমির ওপর অধিকার সমান হবে, এটা গণতান্ত্রিক অধিকারেরই অঙ্গ। এটা শহরাঞ্চলে ভূমি সংস্কারের জন্য ততখানি অসুবিধাজনক নয় যতখানি গ্রামাঞ্চলে ভূমি সংস্কারের জন্য। শহরাঞ্চলে ভূমি সংস্কারের জন্য যেটা রাখতে হবে সেটা হচ্ছে এর সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল সম্পর্কে আগের থেকেই ধারণা করা। একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গ্রামে শতকরা সাত ভাগ সন্ত্রাসই ভূমিমালিকানা নিয়ে বিরোধ সংক্রান্ত। ভূমি সংস্কারের প্রাথমিক পর্বে টেনান্সি বাড়বে, অন্তর্বর্তীকালে উৎপাদনশীলতা কমবে এবং সেই অনুযায়ী বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

পরিশেষে এ কথা বলা দরকার, যেহেতু জমির সমমালিকানার দাবি পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতালব্ধ সেহেতু ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করেই সেটা করতে হবে। তা না হলে কোনো রাজনৈতিক দল এই রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে না (যেহেতু এ সংস্কার শরীয়া ও পুরুষের বিরুদ্ধে)। অধিকারের সাথে ভোগের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এখন যতটুকু সম্পত্তি নারীর মালিকানাধীন সেই সম্পত্তিও বাবা, ভাই, স্বামী ব্যবহার করে। নারী আন্দোলন কর্মীরা এই প্রশ্নটিই সামনে আনলে ভালো করবে।

অধ্যাপক আহমেদ কামাল,
ইতিহাসবিদ ও সাবেক চেয়ারম্যান, ইতিহাস বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


#জ/উম-৬/৯

Leave a Reply