নূরের জাতীয় রাজনীতিতে আসার বিষয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা রাশেদের একটা দীর্ঘ স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। সম্ভবত বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাব হিসেবেই তিনি এই স্ট্যাটাস লিখেছেন। রাশেদের সাথে আমি অত্যন্ত একমত যে, নূরের জাতীয় রাজনীতিতে আসা কোন অন্যায় তো নয়ই বরং খুব ন্যায্য।
কিন্তু এই ন্যায্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি যেভাবে অপরদের তাচ্ছিল্য করেছেন, অস্বীকার করেছেন একজন ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তা আমাকে ব্যথিত করেছে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে দেশের আমূল পরিবর্তন হয়নি? ২০১৮ সালের আগে আপনি কথা বলতে পারতেন? কোন প্রতিবাদ করতে পারতেন? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো? রাজনৈতিকভাবে কতোজনকে হয়রানি করা হয়েছে, মেরে ফেলা হয়েছে, ধর্ষণ, গুম, খুন হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে, এর বিরুদ্ধে রাজপথে কাউকে সেভাবে প্রতিবাদ করতে দেখেছেন? হয়তো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ২-১ টা প্রতিবাদ হয়েছে, এরপর? সেখানেই লোকদেখানো প্রতিবাদ শেষ।
কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে ছাত্র অধিকার পরিষদ সকল অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজপথে ছিলো না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে খোঁজ নিন। এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ৮ই এপ্রিল রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো খেয়াল আছে? প্রতিটা প্রতিরোধ গড়তে সাহসী নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা লাগে। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে যখন শাহবাগ চত্বরে টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ করে সকলকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন এই আমরাই আবার ঘোষণা দিই, কেউ চলে যাবেন না, জীবন বাজি রেখে রাজপথে থাকতে হবে। পিজির মধ্যে জড়ো হওয়া প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদেরকে জড়ো করে কাটাবন নীলক্ষেত হয়ে আবার শাহবাগ আসি। এরপর আন্দোলন কোথায় গিয়েছে? এরাপর ঐতিহাসিক ১১ এপ্রিল। সেই ইতিহাস তো বলার দরকার নাই। সকলেই জানেন। এরপর ডাকসু নির্বাচনে কিভাবে ফিল্ডে থেকেছি, কারচুপির প্রমাণ জাতির সামনে তুলে ধরেছি। ডাকসু হামলাসহ অসংখ্য নির্যাতন সহ্য করে আমরা এখনো টিকে আছি। ২০১৮ থেকে ২০২০ ছাত্র অধিকার পরিষদের মত আর কাউকে এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে?
রাশেদ খাঁনের ফেসবুক স্ট্যাটাস
রাশেদ দাবি করেছেন তাদের জন্মের আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালের আগে বাংলাদেশে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয়নি,কেউ এমনকি প্রতিবাদ করবার সাহস পায়নি। উনারাই একমাত্র সাহস নিয়ে দাড়িয়েছেন,টিয়ারসেল খেয়েছেন, ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, রাষ্ট্রীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।
তবে রাশেদের সম্ভবত দোষ এখানে কম, কারণ কোটা সংস্কারের মতো ‘বড় অথচ অগভীর তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলনের’ আগে তিনি রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় চিন্তিত ছিলেননা, তাই অপরদের দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেননা। রাশেদ এবং তার হঠাৎ গর্জে ওঠা সংগঠনের নেতাকর্মীদের জানানোর জন্যই কিছু কথা শেয়ার করতে চাই।
বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলন বিশেষ করে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন ১ বছর নয় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে সরকারের জেল জুলুম,পুলিশের টিয়ারশেল, লাঠির আঘাত, ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, রাতের পথ রাত চিকা মেরে, দিনের পর দিন গণ চাঁদা উত্তোলন করে,আপনাদের মতো সাবেক এপলিটিকালদের টিপ্পনি সহ্য করে আমরা কেবল আমরাই লড়েছি এবং লড়ছি।
গ্যাস-বিদ্যুতের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আমরা দিয়েছি,যথারিতি নির্যাতন সইয়েছি। খুন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমরা লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছি,ভিক্টোরিয়া ছাত্রী তনুর ধর্ষণ এবং হত্যার বিচারের দাবিতে আমরা হরতাল দিয়েছি,তখন আপনাদের মতো সাবেক এপলিটিকালরা সহযোগিতা করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নববর্ষে টিএসসিতে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে লাগাতার একমাস ছাত্রলীগের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা কর্মসূচি পালন করেছি। এসব সাহস আমরা অর্জন করেছি সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদ দখল না করেও।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন এই সরকারের আমলে আমরাই সফল করেছি,এই আন্দোলনে আমরাই শিখিয়েছি শান্তিপূর্ণভাবে কীভাবে অবরোধ করা যায়, মানুষের সংহতি অর্জন করা যায়,তদোপরি প্রধানমন্ত্রীর তোষমদি না করেও আন্দোলনে সফল হওয়া যায়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে আমাদের নেতাকর্মীকে জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে,৫৭ ধারার মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমাদের অকৃত্রিম সহযোগিতা আর নিরলস শ্রম আছে। আপনারা যখন প্রধানমন্ত্রীর ‘গোসসা পূর্ণ’ বক্তব্য শুনে খুশি হয়ে মাদার অব এডুকেশন উপাধিতে ভূষিত করবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন,আমরাই তখন বলেছি এটা প্রতারণা এবং আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এমনকি আপনাদের উপর সংঘটিত হওয়া প্রত্যেকটি হামলার বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়িয়েছি। আপনাদের সমস্ত পথচলায় এই প্রগতিশীল শক্তিগুলোই নানান সহযোগিতা করে গিয়েছে।
শওকত আলি
সদস্য, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন