পুঁজি সচল থেকেও পুঁজিপতির আইন ভঙ্গ করার, অমানবিক কিছু করার বা আত্মঘাতী ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা যেন সমাজ ও সমষ্টিকেও হত্যা করার পর্যায়ে না পৌঁছায়, সেই ভারসাম্যটা যারা রক্ষা করবেন, তারাও যদি অর্থ বানাবার দৌড়ে ব্যবসায়ীদের সমকাতারে চলে আসেন, তাহলে অনেক বড় বিপর্যয় সমাজের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘তুমি খোদা সবই জানো যা আছে এই অন্তরে
চাকরি দিলে দিও খোদা জিয়া বিমানবন্দরে’
সাবেক জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপুল দুর্নীতির সংবাদ নিয়ে একটা কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিকে, সঙ্গে ছিল এই ছড়াটি; সময়কাল সম্ভবত আশির দশক, কিংবা নব্বই এর প্রথমভাগ। গত শতকের ষাট থেকে আশির দশকের সময়টুকু বিশ্বজুড়েই ছিল বিশেষভাবে স্বৈরশাসকদের সময়। তখন সামরিক শাসন কিংবা গৃহযুদ্ধে যুগের পর যুগ পার করেছে এমন বহু দেশে এখন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক শাসন, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া বা চিলির মতো এমন উদাহরণের অভাব নেই।
আমাদের দেশেও আশির দশক জুড়ে ক্ষমতায় থাকা লেফটেন্যান্ট জেনারলে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের দুর্নীতির কমতি ছিল না। তবু আজকের দিনের দুর্নীতির সঙ্গে তা গুনে, মানে বা পরিমাণে আদৌ তুলনীয় না।
আশির দশকেও বাংলাদেশে দুর্নীতির খাতগুলো ছিল হাতেগোণা, কিংবা মাত্রায় যথেষ্ট কম, কিংবা নানান ধরনের রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক ভারাসাম্য সেখানে ছিল। মোট কথা দুর্নীতি যে এত লাগামহীন ছিল না, তার বহুবিধ নিদর্শন দেখতে পাই। দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা ছিল হাতেগোণা, তাদের প্রায় সবাই চিনত, ঘুষখোর কিংবা চোরাকারবারি হিসেবে তাদের একটা সামাজিক অবমাননাও একটা মাত্রায় ছিল এবং দুর্নীতি সমাজের সর্বস্তরে এতটা পরিব্যাপ্ত ছিল না। টাকা পাচার? খুব হাতে গোণা কিছু মানুষই এটা করতেন।
টাকা পাচার নিয়ে সম্প্রতি রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। দুর্নীতি নিয়ে আমরা সাধারণত জানি বা ভাবি, রাজনীতিবিদেরা তাদের ক্ষমতার সূত্রে আয় করা বিপুল দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার করেন। পাচার করেন ব্যবসায়ীরাও। চাকরিজীবীরাও কেউ কেউ দুর্নীতি করেন বটে, কিন্তু তারা নিশ্চিত ভাবেই তৃতীয় সারিতে থাকবেন।
সে জমানার অবসান ঘটেছে। ফিসফাস নয়, শোরগোলও চলছিল আগে থেকেই, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিটা দিয়েছেন মাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্যা রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক ভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেলো রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছে।’
কিন্তু অর্থপাচার নিয়ে ইতিমধ্যে বহু বছর ধরে যে শোরগোল চলেছে, এমনকি কানাডাতে প্রবাসী বাঙালিরাও যে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্তশূন্য করা এই দুর্নীতিবাজ অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন করছেন, সেই তুলনায় এই স্বীকৃতিটুকু কত সামান্য, তা বোঝা যাবে ডেইলি স্টারের গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ২০ নভেম্বরের সাক্ষাতকারে।
সেখানে মন্ত্রী জানিয়েছেন-
১. বিষয়টা কোন পর্যায়ে আছে সে বিষয়ে: ‘আমরা জানার এবং বোঝার চেষ্টা করছি। ইটস ভেরি ইনিশিয়াল স্টেজ। আমরা জাস্ট বোঝার চেষ্টা করছি।’
২. বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যে প্রবাসী আন্দোলন করছেন, তাদের প্রসঙ্গে: ‘না, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি।’
এত গুরুতর বিষয়ে এত বছর বাদেও কেন ‘ভেরি ইনিশিয়াল স্টেজ?’
দৈনিকে এই বিষয়ক প্রথম সংবাদটি পড়েছিলাম সম্ভবত ২০১৫ সালে, অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম কানাডায় অর্থপাচারকারীদের রমরমা বোঝাতে নির্দিষ্ট এই ‘বেগমপাড়া’ পরিভাষাটিই ব্যবহার করেছিলেন ‘রাজনীতিতে ব্যবসায়ী, দায় মুক্তবাজার অর্থনীতির’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে (লিঙ্ক t.ly/mg5T)।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ‘ওখানকার প্রায় ৮০ শতাংশই পোশাক মালিকদের পরিবার, বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে প্রকৌশলী, আমলা এবং রাজনীতিবিদদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনই সংখ্যাগুরু।’
অধ্যাপক মইনুল ইসলামের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি কিংবা সরকার ঘনিষ্ঠতার কারণে যিনি পরিচিত, তার মতো একজন মানুষও পুরো পাঁচটি বছর আগে শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রকৌশলী-আমলা-রাজনীতিবিদদের পাচারের টাকায় কানাডার টরেন্টোর বিবিপাড়ায় বসতি গড়ার কথা উল্লেখ করার পরেও যদি টনক না নড়ে, তা থেকেই বোঝা যাবার কথা শাসকদের সম্মতিক্রমেই অর্থপাচারের এই বন্দোবস্তটি গড়ে উঠেছে।
এরপরেও এই বেগমপাড়া শব্দটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অজস্রবার এসেছে অর্থনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখিতেও। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো বদল হয়নি, এখনও তাই অনুসন্ধানটি ওই ‘ভেরি ইনিশিয়াল স্টেজ’ এ আছে।
কিন্তু দুই সময়ের মাঝে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অধ্যাপক মইনুল ইসলাম তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বরাতে ওই লেখাতে লিখেছিলেন, ৮০ ভাগ বেগমপাড়ার বাসিন্দা পোশাকশিল্প ব্যবসায়ী। পাঁচ বছর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনানুষ্ঠানিক অনুসন্ধানে ব্যবসায়ীদের বদলে, রাজনীতিবিদদের বদলে সরকারি কর্মচারীদের যদি বেশি পাওয়া যায়, সেটা বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতার ভয়াবহ একটি অবনতিরই লক্ষণ। কেন?
পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালে মইনুল ইসলাম তার ওই লেখায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এই টাকা বানাবার দুর্নীতিগ্রস্ততার ধরনটিকে চিহ্নিত করে বলেছিলেন, আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া তারা এই দুর্নীতিগুলো করতে পারে না। ফলে কিছু আমলাও কানাডাতে বাড়ি বানাবার মতো বিত্ত অর্জন করেছিলেন তত বছরের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে। কিন্তু ২০২০ সালে বরং এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা অর্থবিত্তে ব্যবসায়ীদের ছাড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রদর্শন করছেন।
এতে সমস্যা কী? সমস্যাটা এই যে, ব্যবসায়ীরা টাকা বানাবার মনোবৃত্তি নিয়ে ঝুঁকি নেন। তার এই মনোবৃত্তি একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সচল রাখবার জন্য জরুরি। কিন্তু এই মনোবৃত্তি প্রায়ই সমাজের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। খাবারে চিনির বদলে যদি বিষাক্ত রাসয়নিক কিংবা কাপড়ের রঙ ব্যবহার করে যদি হাজার কোটি টাকা মুনাফা হয়, ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে তাই করবেন। দালান বানাবার নিয়ম না মেনে যদি কোটি টাকা আয় হয়, ব্যবসায়ীরা তাতে দ্বিধা করবেন না। সারে ভেজাল দিয়ে মুনাফা হলে তাও চলবে, খাদ্য মওজুদ করে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও। যথেষ্ট মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে আস্ত সুন্দরবনটাকে কেটে কেটে জমি হিসেবে বরাদ্দ দেয়াও তার জন্য কোন বিষয় না।
ঊনিশ শতকের একজন ব্রিটিশ লেখক ও শ্রমিক সংগঠক টি জে ডানিং এ বিষয়ে বিখ্যাত যে মন্তব্যটি করেছিলেন, তা সংক্ষেপে এমন: ‘মুনাফাহীনতা বা সামান্য মুনাফাকে পুঁজি এড়িয়ে চলে, আগেকার দিনে যেমন বলা হতো প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে… ১০০ ভাগ মুনাফার নিশ্চয়তা থাকলে পুঁজি সব মানবিক আইনকে পদদলিত করবে, ৩০০ ভাগ হলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করবে না, এমন কোনো ঝুঁকি নেই যা সে নেবে না, এমনকি তাতে যদি স্বয়ং পুঁজিপতিরও ফাঁসিতে ঝোলার ঝুঁকি থাকে, তাও সে নির্দ্বিধায় নেবে।’
পুঁজি সচল থেকেও পুঁজিপতির আইন ভঙ্গ করার, অমানবিক কিছু করার বা আত্মঘাতী ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা যেন সমাজ ও সমষ্টিকেও হত্যা করার পর্যায়ে না পৌঁছায়, সেই ভারসাম্যটা যারা রক্ষা করবেন, তারাও যদি অর্থ বানাবার দৌড়ে ব্যবসায়ীদের সমকাতারে চলে আসেন, তাহলে অনেক বড় বিপর্যয় সমাজের জন্য অপেক্ষা করছে।
ব্যবসাকে সচল রেখেও ব্যবসায়ীকে নিবারণের নীতিগত দিকটা আসে রাজনীতি থেকে। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের জনগণের সম্মতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রাষ্ট্রকে খানিকটা হলেও নীতিগত দিক দিয়ে ভারসাম্যে রাখে। অন্য ভারসাম্যটি আসে নানান কাজের তদারকি ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মচারীদের দিক থেকে। এমনকি শুধু সাবেক রাজনীতিবদের না, যখন সরকারি কর্মচারীরা বর্তমান মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদেরও আইনভঙ্গের বিষয়ে চাপমুক্ত তদন্ত করতে সক্ষম হবেন, তখন বোঝা যাবে দেশটি সর্বোতরকমের স্বচ্ছ আছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশেও নির্বাচনটা ঠিকঠাক হলে আমলারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে যেমন কখনো কখনো যৌথভাবে দুর্নীতি করেন, ঠিক তেমনি পরবর্তী আমলের দুশ্চিন্তাতেই একটা সীমাও বজায় রাখেন। সেই কারণেই প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় অল্প কিছু মানুষজনই গুরুতর দুর্নীতির বড় অংশটা সাধারণত করে থাকেন, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় একটা বড় অংশের চাকরিজীবীর দুর্নীতি না করারই কথা, যদি না দুর্নীতি করাটাই উর্ধতনদের হুকুম হয়ে থাকে।
এই বিষয়টা সব সময়েই নির্ভর করে একটা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর, যার অনেকগুলো শর্ত রাজনীতিবিদ ও আমলা উভয়ের আচরণের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে এমনিতেও দেখা গিয়েছে দ্রুত অর্থ কামাতে আগ্রহী এবং অযোগ্য মন্ত্রীরা আমলাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল থাকেন। কিন্তু যদি পরবর্তী আমলের, অর্থাৎ সরকারের গণতান্ত্রিক বদলের কোনো সম্ভাবনা না থাকে, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যত আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে তার অস্তিত্বের জন্য, সঙ্গতকারণেই আমলাতন্ত্রের একক প্রভূত্ব তৈরি হবে।
ব্যবসায়ী চিরকালই ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ চিরকাল ক্ষমতাসীন নন, এবং চাকরীজীবী সর্বদা চাকরিজীবী। ফলে ঝুঁকি না নেয়ার, সৎ থাকার সবচাইতে বড় চাপটা থাকার কথা চাকরিজীবীর ওপর। সেই চাপটার যদি অবসান ঘটে, তখন কে কাকে রুখবে! টাকা বানাবার জন্য সমাজে যে স্বীকৃত ব্যবসায়ী ও উদ্যৌক্তোকূল আছেন, তারা, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল পাওয়ার জন্য নানাবিধ ঝুঁকি যারা নেন, সেই রাজনৈতিকেরা- উভয়েই তখন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে গৌণ হয়ে যাবার কথা।
সেটা হলে তা হবে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত, কেননা ব্যবসায়ীরা যেন সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হয়ে উঠতে পারেন, রাজনীতিবিদরা যেন আইনের সীমার বাইরে গেলে বিচারের সম্মুখীন হন, সেটা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণের ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে একক ক্ষমতার অধিকারী হলে রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য অনেক বড় বিপর্যয়ের কারণ ঘটাবে তা। বিবিপাড়ার বাড়িগুলোর মালিকদের পরিচয় বদলের হিসেবটাতে কি সেই ইঙ্গিতটাই মিলছে খানিকটা? ২০১৫-এর পর ঠিক কী ঘটলো যাতে বেগমপাড়ায় বাড়িঘরের মালিকানায় সরকারি কর্মকর্তাদের অংশ বাড়লো অন্যদের চাইতে, সেটা নিশ্চিতভাবেই ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বড় রকমের বাঁকবদল ছাড়া বোঝা যাবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় কেউ বলতে পারেন, আশঙ্কাটাও ‘ভেরি ইনিশিয়াল স্টেজ’ এ আছে। কিন্তু যে মন্ত্রী ও সচিবদের ভবিষ্যত কানাডা বা আমেরিকাতেই, পাঁচ বছরেও যারা এত গুরুতর একটা বিষয়ে সাধারণ তদন্ত চালাতে পারেন না বা চান না, তাদের চিন্তা আর সাধারণ নাগরিকদের দুশ্চিন্তা এক হলে চলবে না। কর্কট ব্যাধিকে খুব প্রাথমিক স্তরেই চিকিৎসা করতে হয়, সামান্যতম ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই।
৩.বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র আকবর আলি খান এ দেশের আমলাতন্ত্রের অবক্ষয়কে তার ‘গ্রেশাম’স ল সিনড্রম অ্যান্ড বিয়ন্ড: অ্যান অ্যানালাইসিস অব দি বাংলাদেশ ব্যুরোক্রাসি’ গ্রন্থে এক কথায় প্রকাশ করেছিলেন বাজার থেকে ভালো মুদ্রাকে খারাপ মুদ্রার খেদিয়ে দেয়া দিয়ে।
স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র এখানে জাঁকিয়ে বসেছে। সরকারি চাকরিজীবীদের মাঝে সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও ক্রমাগতই ভালো মুদ্রাকে খারাপ মুদ্রা প্রান্তিকীকরণ করেছে, কোনঠাসা করেছে। মেলামেশার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত, অধিকাংশ সরকারি কর্মচারীই এখনো ব্যক্তিগতভাবে সৎ, কিন্তু গ্রেশামের সূত্র অনুযায়ীই তারা অসহায়ভাবেই অবলোকন করতে থাকেন চতুর্দিকের বিপর্যয়কর দুর্নীতিগ্রস্ততা। আমলা, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, শিক্ষক সবার বেলাতেই এটা হয়ত সংখ্যাগুরু একটা অংশের জন্য প্রযোজ্য।
তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। মন্ত্রী যখন বলেন সরকারি কর্মচারী, তখনও কি বিষয়টা বোঝা যায় পরিষ্কারভাবে? এই সরকারি কর্মচারীদের পরিচয় কী? তারা কি জনপ্রশাসন বিভাগের লোক? তারা কি সরকারি চিকিৎসক? তারা কি প্রকৌশলী? শিক্ষক বা কৃষি অধিদফতরের লোক? এই পরিচয় নির্দিষ্ট করে জানানোটা কিন্তু খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশে দুর্নীতি সব স্তরের সরকারি কর্মচারীদের মাঝেই কম কিংবা বেশি আছে। কিন্তু কোন দুর্নীতিটি ঊর্ধ্বতনের দুর্নীতি, যা দুর্নীতির পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করে, তাকে অনুমোদন দেয়, যথাযথ ‘অধস্তন’ স্থানগুলোতে অযোগ্য কিংবা দুর্নীতিবাজদের বেছে বেছে বসায়, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের করোনাকালের ব্যবস্থাপনাগত দুর্নীতি ও অযোগ্যতার কথাই বলা যাক। করোনাকালে বিপুল দুর্নীতি ও অযোগ্যতার দায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান ব্যক্তিরা দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন, হেনস্তার শিকারও হয়েছে। কিন্তু এই অধিদফতরের যাবতীয় কাজ যাদের অনুমোদন ছাড়া ঘটার সাধ্য নেই, অধিদফতরের গাছের পাতাও নড়ে না যে মন্ত্রণালয়ের হুকুম ছাড়া, সেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি/সচিব ন্যূনতম জবাবদিহি ও তদন্তের সম্মুখীন হননি। বরং বলা চলে তাদের পদোন্নতি হয়েছে। জবাবদিহি ও তদন্ত এবং স্বচ্ছতার বেলায় মন্ত্রণালয় আর অধিদফতরের এই পার্থক্যটি জরুরি।
আমরা অজস্র দুর্নীতির তদন্ত, অল্প কিছু ক্ষেত্রে বিচারের সংবাদ দেখতে পাবো। প্রায় সবগুলোই অধিদফতরের দায়িত্বশীলদের জন্য প্রযোজ্য- স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কৃষি-প্রকৌশল ইত্যাদি। মন্ত্রণালয়ের বেলায় এমন দৃষ্টান্ত দেখানো বেশ কঠিন হবে। অর্থাৎ, ঊর্ধ্বতনের দুর্নীতির বিচারের সম্ভাবনা খুব কম, অধস্তনের বেলায় তা খানিকটা আছে। এবং উল্লেখ্য যে, এই অধস্তনের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির বেলায় ঊর্ধ্বতনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের প্রভূত্ব একচেটিয়া। অর্থাৎ চিকিৎসক-শিক্ষক-কৃষিবিদ-প্রকৌশলীদের মাঝে কারা অধিদফতরে যাবেন, সেটার মূল সিদ্ধান্তটা মন্ত্রণালয় থেকেই আসে।
ফলে সরকারি কর্মচারী বললেই চলছে না কিন্তু। সরকারি কর্মচারিটি কে, কী তার পরিচয় ইত্যাদি খুব গুরুতর প্রশ্ন। এটা এমন একটা প্রসঙ্গ, যেখানে নিচের সারির দুর্নীতি ধরাটা একদমই অর্থহীন, উপরের সারির সিদ্ধান্তগ্রহীতাদের প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রেখে।
ব্রিটিশ ভারতের শেষদিককার একজন আইসিএস কর্মকর্তা স্টেফান হ্যাচ-বার্নওয়েল এর স্মৃতিকথা দি লাস্ট গার্ডিয়ান এর কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে পারা যাচ্ছে না। উপমহাদেশ জুড়ে প্রবল লুণ্ঠনের বাণিজ্য চালানো ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রটি তাদের আমলাদের প্রায় সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পেরেছিল। এটা প্রয়োজন ছিল তাদের শাসনের ধরনটি যথাসম্ভব বেশিদিন অব্যাহত রাখবার জন্যই। আকবর আলী খানের গ্রন্থেও এই দাবির ন্যায্যতা মেলে, তিনি জানিয়েছেন এই্ তদারকিটি সম্ভব হয়েছিল এই আমলাদের ওপর বিচার বিভাগ এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কল্যাণে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এই দুটো অংশও আদতে আমলাতন্ত্রেরই অধীনে এবং কর্তৃত্বে আছে। এই কারণেই বহু মানুষ যেটা মনে করেন, বেতন উচ্চহারে বৃদ্ধি হলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বরং দুর্নীতি বন্ধের প্রধান উপায় যে স্বাধীন বিচার বিভাগ, স্বাধীন তদন্তের ক্ষমতা (অর্থাৎ তদন্তকারীরা জনপ্রশাসন বিভাগ থেকে আসবেন না), এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা। সেই তিনটি দিক থেকেই বাংলাদেশ ক্রমশ খারাপতর দিকে যাত্রা করছে।
৪.দুর্নীতির জবাবদিহি ও তদারকি এবং দমনের প্রসঙ্গটা আসতেই আবার মনে পড়ে গেলো গৃহস্তের দুধে পানির বিখ্যাত গল্পটা। দুধে গোয়ালা যেন ভেজাল না মেশায়, তার জন্য একজনকে নিয়োগ দেয়া হলো। দ্বিতীয়জন যেন গোয়ালার সাথে ষড় করে দুর্নীতি না করে, তার জন্য তৃতীয় আরেকজনকে। এরপর চতুর্থ আরেকজনকে চাকরি দেয়া হলো এদের সবাইকে তদারক করার জন্য। ফলাফল হলো গৃহস্ত খানিকটা পানি মেশানো দুধের বদলে এখন ক্রমাগত বেশি হারে পেতে থাকলেন সম্পূর্ণ দুধমুক্ত কিছু একটা, কেননা তদারককারী সবাইকে বখরা দিতে দিতে বেচারা গোয়ালার পক্ষে আদৌ দুধ দেয়া সম্ভব হলো না।
বাংলাদেশের অবকাঠামোগুলোর দিকে তাকালে এই গল্পটাই বারবার মনে পড়ে, ঘাটে ঘাটে বখরা দেয়ার কারণেই কি নির্মাণের আগেই ফাটল ধরছে না, ভেঙে পড়ছে না রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, সেতু? সম্প্রতি আমরা তো দেখতে পাচ্ছি একাধিক দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে। সেগুলোর বড় অংশ আমরা আবার জানতে পারছি এই ক্ষমতাবান দুর্নীতিপ্রবণদের নিজেদের মাঝে ঝামেলার কারণে।
দুদক প্রশ্নে সবচাইতে বড় যে প্রশ্নটা আসে, সেটা হলো দুদকের যা গঠন, তার মধ্য দিয়ে তার পক্ষে কী কেন ধরনের দুর্নীতির তদন্ত সম্ভব? তাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা যদি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আসেন, এবং এই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরাই যেহেতু অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো পরিচালনা করেন সচিব ও কাছাকাছি মর্যাদার পদে থেকে, তাদের বিরুদ্ধে- অর্থাৎ নিজের সহকর্মী ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন, নিরপেক্ষ তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব? তেমন দৃষ্টান্ত কয়টা আছে? নিশ্চিতভাবেই, সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়েও যদি তেমন একটা হৈচৈ তৈরি হয়, দুদকের তেমন একটা তদন্ত সম্পন্ন হবে বড়জোর অধিদফতরের লোকজনকে কেন্দ্র করে, অতীতে যেমনটা হয়ে আসছে। অর্থাৎ, ঊর্ধ্বতনের দুর্নীতির তদন্ত হবে না, হবে অধস্তনের। এবারের করোনা ঠিক তেমনি একটা দৃষ্টান্ত।
অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা মিলিয়ে দেখুন: খুলনাতে রোগীর আত্মীয়ের হামলায় চিকিৎসকের মৃত্যুবরণের ঘটনায় মামলা নিতেও চিকিৎসকদের আন্দোলনের ডাক দিতে হয়েছিল, কিন্তু অবৈধ ক্লিনিকে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক গ্রেফতার হন। সব হত্যাই অপরাধ, সব মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু কার সঙ্গে কার সংঘাত ঘটলে বিচার হবে না, কার বেলায় অবিলম্বে ঘটবে, সেটা খুবই তাৎপর্যবাহী। হাজী সেলিমের দৃষ্টান্তেও একই ঘটনাই প্রকাশিত। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে ঝামেলায় না জড়িয়ে যে কোনো দুর্নীতি, যে কোনো লুণ্ঠন এবং যে কোনো দখলদারত্ব চলবে অনায়াসে। এরই ছাপ হয়ত আমরা দেখছি বেগমপাড়ার বাসিন্দাদের পরিচয়ের বদলেও।
৫.পাচার যারা করেন, তারা রাজনীতিবিদ হোন, ব্যবসায়ী হোন আর হোন সরকারি কর্মচারী, তাদের সুরক্ষার জন্য এবং তাদের পাচারের প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য সব বন্দোবস্তই এখানে এমনকি আইনিভাবেও তৈরি আছে। উদাহরণস্বরুপ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ‘নাগরিক ছাড়াও, কেবল বাংলাদেশের নাগরিক যাঁরা, বিদেশে সম্পদ থাকলে আয়কর বিবরণীতে তাও জানানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যেমন কুয়েতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের কোম্পানি রয়েছে। প্রতারণা ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে আটক শহিদ ইসলাম আয়কর বিবরণী বা নির্বাচনি হলফনামার কোথাও তা উল্লেখ করেননি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহজ যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশের কোনো নাগরিক আইনত বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না, তাই আয়কর বিবরণীতে এর জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি। অথচ পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এই ব্যবস্থা ঠিকই আছে। তারা এ থেকে করও পাচ্ছে।’
অর্থাৎ এমন একটি ফাঁক তৈরি রাখা হয়েছে যার মধ্য দিয়ে বিদেশে সম্পদ বাংলাদেশিরা রাখলেও তার হিসেব থাকবে না। এমনকি আরও বিস্ময়বোধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বিবিসি বাংলাকে দেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানের সাক্ষাতকারে, যেখানে তিনি বলেছেন:
‘আগে দেখতে তো হবে যে কারা বিনিয়োগ করেছেন। তারপর তদন্ত করে দেখা যাবে টাকা পাচার হয়েছে কি-না। কারণ বৈধ আয়ও তো বিনিয়োগ হতে পারে এবং সেটিতে তো পাচার বলা যাবে না। তবে মন্ত্রী যেহেতু পাচারের কথা বলেছেন তাই তিনি সে তথ্য কমিশনকে দিলে আমরা অবশ্যই পরবর্তী পদক্ষেপ নেব’- মিস্টার মাহমুদ বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে।
অর্থাৎ প্রথম আলোর সংবাদটি অনুযায়ী যেখানে রাজস্ব বোর্ড বলছে বাংলাদেশের নাগরিক আইনত বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারেন না, দৃশ্যত বিপরীতে বিবিসির সংবাদটি অনুযায়ী দুদকের চেয়ারম্যান বলছেন বৈধ আয়ও তো বিনিয়োগ হতে পারে! ইঙ্গিতটা হলো এই যে, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
ফলে দুদকের কারণে ঊর্ধ্বতন দুর্নীতিবাজদের আতঙ্ক জাগার বা ভয় পাবার কিছু নাই। কারণ দেশের দুর্নীতি দমন করার জন্য তার জন্ম হয়নি। তার কাজ হলো সরকারের বিরাগভাজন হওয়া কিংবা সুনজর থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের জীবন অতিষ্ঠ করা। অপরাধীর যথাযথ যোগাযোগ ও ক্ষমতা থাকলে দুদক যে ভেজা বেড়ালের মতোই আচরণ করে, তার হাজার খানেক উদাহরণ টানা সম্ভব, আবদুল হাই বাচ্চু সেখানে কোনো ব্যতিক্রম নন।
অন্যদিকে এই কেন্দ্রীয় দুর্নীতির কারণে সমাজে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির গ্রহণযোগ্যতার মানসিকতা তৈরি হয়েছে, এবং একইসঙ্গে বহুস্থলে অধস্তনের ওপর দুর্নীতি করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে, সেখানেই মাঝে মধ্যে ঢিল ছোড়া দুদকের প্রধান কাজ। বিপুল পরিমাণে ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ঋণখেলাপি এবং আরও বহু কিছুর মাঝে কোন চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির ঘটনাটা দুদকের উদঘাটন? কোন ঘটনাতে সরকারের সুনজরে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদক কুটোটি নেড়েছে? এবং আবারো সেই পুরোনো প্রশ্ন, জনপ্রশাসন বিভাগের যে কর্মচারীরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আসল দায়িত্বে থাকেন, তদারকি থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যারা কর্তা, তাদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা গ্রহণের নজির কয়টা?
৬.কানাডায় চাকরি কিংবা ব্যবসাসূত্রে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকরা বরং অনেক যৌক্তিক এবং আশাজাগানিয়া আচরণ করেছেন। খুবই সম্ভাবনা আছে তাদের আন্দোলনটা অব্যাহত থাকলে, আইনি চাপ তৈরি হতে থাকলে কানাডার বেগমপাড়া উচ্ছেদ হবে সে দেশের ব্যবস্থাগত কারণেই। তার আগ পর্যন্ত সভ্য ও সুশীল ভাব নিয়েই কানাডা এবং এমনি সব ধনী দেশগুলো গরিব দেশের রক্তশোষণ করা দুর্নীতির অর্থকে নিজের দেশে জায়গা দিতে থাকবে, চক্ষুলজ্জাহীনভাবে এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করবে। কারণ দেশে যাদের তা সামলাবার কথা, সেই দুদক অপেক্ষায় আছে মন্ত্রী কবে পাচারের তথ্য কমিশনকে দেবেন, তার জন্য। ওদিকে মন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে থাকা সেদেশের নাগরিকদের টাকার খবর জানাতে বাধ্য থাকলেও কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্র তেমন কাজে বাধ্য না!
এটা কি খুব অসম্ভব, প্রবাসীদের সাহায্য নিয়েই তালিকা ধরেই এই অর্থপাচারকারীদের খুঁজে বের করা, এবং তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা, কানাডা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে, মামলা করে তাদের সম্পদ ফিরিয়ে আনা, তাদেরকে শাস্তি দেয়া? সেখানে অর্থপাচার করা সরকারি কর্মচারীদের মাঝে কারা কোন স্তর থেকে এসেছেন, সেগুলোর যথাযথ একটা তালিকা ও ছক তৈরি করা? তাদের সঙ্গে কারা যুক্ত, কাদের প্রশ্রয়ে এই দুর্নীতিগুলো সম্ভব হয়েছে, তা তদন্ত করা? এমনকি শুধু কানাডা না, মালয়েশিয়া সহ আরও বহু দেশে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশিই বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারিরা সম্পদ পাচার করছেন কি না, তাও অনুসন্ধান জরুরি।
কাজটা অসম্ভব না। কিন্তু সেটা করার সম্ভাবনা খুব কম।
কারণ গোটা দেশটাই আজকে প্রবন্ধের শুরুতে বলা সেই জিয়া বিমাবন্দরের একটা বড়সড় সংস্করণ। আজকের দিনে ওই কার্টুনিস্ট ও ছড়াকার থাকলে নিশ্চয়ই একটু বদলে লিখতেন: ‘তুমি খোদা সবই জানো যা আছে এই অন্তরে, চাকরি দিলে দিও খোদা বাংলাদেশের সরকারে’।
লেখাটি Newsbangla.com এ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
ফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন
সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন