পৃথিবীর আগামী ১০০ বছর পরের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রায় আলোচনা শোনা যায়। জলবায়ু সমস্যা, দারিদ্র্য, অনিরাময়যোগ্য রোগের প্রকোপ, পৃথিবীর বাড়তে থাকা জনসংখ্যা নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। গত বছর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন এই আশংকা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এতে বলা হচ্ছে, পৃথিবীর জনসংখ্যা আগামী ১০০ বছরের মধ্যে কমতে শুরু করবে। ‘দি ল্যানসেট’ জার্নালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুসারে, পৃথিবীর জনসংখ্যা ২০৬৪ সাল পর্যন্ত বেড়ে ৯৭০ কোটি হবে, কিন্তু তার পরেই কমে ২১০০ সাল নাগাদ তা ৮৮০ কোটিতে নেমে আসবে। এখন অনেকেই বলতে পারেন, জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া তো ভালো বিষয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা কমলে পরিবেশ দূষণ কমবে, খাদ্যাভ্যাব কম হবে, দারিদ্র্য কমবে, জনগণ নিয়ে আরো কার্যকর পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
পৃথিবীর জনসংখ্যা পরিবর্তন বোঝার জন্য মোট প্রজনন হার বা Total Fertility Rate (TFR) ব্যবহার করা হয়। একজন নারী তার সারাজীবনে কতটি সন্তান জন্ম দিতে পারে তা পরিমাপ করার জন্য TFR ব্যবহৃত হয়(এটি জন্মহার না, জন্মহার হলো একটি অঞ্চলে বছরে কতজন জীবিত শিশু জন্ম হচ্ছে তার পরিমাপক)। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার মোট প্রজনন হার ২.১ এ স্থির রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি দেশে প্রজনন হার ২.১ থাকলে সে দেশের জনসংখ্যা স্থির রাখা সম্ভব। বাংলাদেশে জন্য সুখবর হলো, দেশে বর্তমানে মোট প্রজননের হার ২.০৩। তাই দেশের জনসংখ্যা স্থিতি অবস্থায় আছে। আবার প্রজনন হার <১.৪ অথবা >৩.০ হলে তা একটি দেশের জন্য আশংকা জনক। প্রজনন হার ১.৪ এর নিচে হলে তা একটি দেশের জনসংখ্যা বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেমন জাপান, ফিনল্যান্ডে জন্মহার খুবই কম এবং জনসংখ্যার বড় অংশের বয়স ৬০ বছর থেকে বেশি। জাপানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নারী পুরুষ বৈষম্য আর বেকারত্বকে প্রজনন কম হওয়ার জন্য দায়ী করা হয়। অন্যদিকে, আফ্রিকাতে প্রজননের হার ৪.৭ যা আশংকাজনক ভাবে বেশি। তার কারণ নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি বেশি, দূর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পরিবার পরিকল্পনার অভাব। ধারণা করা হচ্ছে, আফ্রিকার জনসংখ্যা ২১০০ সালের মধ্যে ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আবার ততদিনে মধ্য ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে জনসংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রজনন হারের পার্থক্য দেখা গেলেও পুরো পৃথিবীই আসলে একটা বড় সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনে পৃথিবীর জনসংখ্যার বড় একটা অংশের বয়স হবে ৮০+, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কমবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বর্তমান ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে এই ভবিষ্যতবাণীর আগাম ফল ভোগ করছে। নিজস্ব জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করায় অন্যান্য দেশ থেকে আগত অভিবাসীদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। হয়তো, ইউরোপ, আমেরিকার প্রজনন হার বাড়াতে হলে এই অভিবাসীদের জন্য তাদের বর্ডার উন্মুক্ত করার পথে হাঁটতে হবে। অনেক ইউরোপিয়ান দেশ ইতোমধ্যে মাতৃত্বকালীন, পিতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়েছে। এছাড়া আর্থিক সহযোগিতা, চাকরিতে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে প্রজনন হার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে ইউরোপ, আমেরিকা থেকেও দূর্বল পরিস্থিতি আছে জাপানে। দেশটির জনসংখ্যার বড় অংশের বয়স ৮০+, এছাড়া তরুণদের বেশিরভাগ অস্থায়ী চাকরিতে নিয়োজিত, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্নহত্যা প্রবণতা। এই সমস্যাগুলো সমাধানে জাপান সরকারকে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তাই বলা হচ্ছে, ২১০০ সাল নাগাদ জাপানের জনসংখ্যা ৫০% এ নেমে আসবে।
বিশ্ব জনসংখ্যার এই পরিবর্তনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, জনসংখ্যা ব্যবহার করে একটা দেশ দ্রুত সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। যেমন, চীন তার বিশাল জনসংখ্যাকে ব্যবহার করে সামনের দিনে পৃথিবীর সবথেকে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অপরদিকে, ইউরোপের জন্য কমতে থাকা জনসংখ্যা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বলা যায়, জনসংখ্যা সামনের দিনে বিশ্বে নতুন মোড়ল তৈরি করবে। বাংলাদেশ কি এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে?
বাংলাদেশের ওপর জনসংখ্যার পরিবর্তনের প্রভাব কি?
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০% এর বয়স ২৫-৬০% এর মাঝে। বর্তমানে দেশে প্রজনন হার একটি স্থিতিঅবস্থা ধারণ করেছে। তবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে তরুণদের ১০.৬% বর্তমানে বেকার। এছাড়া দেশের ৬ কোটি লোক মজুরির বিনিময়ে কাজ করে এবং চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে ২১% মানুষ। এই সমস্যার সমাধান না করলে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে শক্তিশালী করা সম্ভব হবে না। ফলে ভবিষ্যত অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার আরেকটি বড় সমস্যা হলো, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের উচ্চহার। বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে শীর্ষ অবস্থানে আছে। প্রায় ২৯% মেয়ের ১৫ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং গর্ভধারণের সক্ষমতা হওয়ার আগেই তাদের বাচ্চা হয়। ফলে, এই নবজাতক শিশুরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগে। তাই শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে আশংকাজনক হারে বেশি। প্রতি ১০০০ এর মধ্যে ২৪ জন নবজাতকের মৃত্যু হয়। আবার, ২০২০ এ করোনাকালীন বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই স্পষ্টতই করোনায় বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনাহীনতার অভাব চোখে পড়ে। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনাহীনতা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টার অভাবে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চাইলে দক্ষ জনশক্তি তৈরীর মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। ।
কোভিড কি বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাবে?
১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি পৃথিবীর জনসংখ্যার বিন্যাসে একটি বড় পরিবর্তন এনেছিল। স্প্যানিশ ফ্লুতে পৃথিবীর ১/৩ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। আক্রান্তদের বেশিরভাগ ছিল তরুণ জনগোষ্ঠী। এছাড়া এই মহামারিতে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। টানা দুই বছর ধরে চলমান সেই মহামারীতে জন্মহার পূর্বের বছরগুলোর তুলনায় কম ছিল। পরবর্তীতে মহামারী শেষে ১৯২০ সালে জন্মহার অনেক বেড়ে যায়। ওই মহামারি পৃথিবীর জনসংখ্যার বিন্যাসের ওপর বড় প্রভাব রেখেছিল এবং পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির ওপরও বড় প্রভাব বিস্তার করে।
এদিকে করোনা ভাইরাসে পৃথিবীর বয়োঃবৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর মৃত্যু বেশি হয়েছে। আবার ইউরোপে গত বছরে তুলনায় জন্মহার কম ছিল। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু জন্মহার গত বছরের তুলনায় কমেছে। স্প্যানিশ ফ্লুর পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, আগামী ২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মহার বাড়তে থাকবে। আশা করা যায়, কোভিড পরবর্তী বিশ্ব জনসংখ্যার নতুন বিন্যাসের সূচনা হবে। তাই কোভিড পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা জনসংখ্যার বিন্যাসে নতুন পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে।
সুত্রঃ
১) Fertility, mortality, migration, and population scenarios for 195 countries and territories from 2017 to 2100: a forecasting analysis for the Global Burden of Disease Study
২) Teenage motherhood and infant mortality in Bangladesh: maternal age-dependent effect of parity one
৩)Time to address youth unemployment
৪) প্রজনন হারে আছে দৃষ্টিকাড়া সাফল্য