( সম্পাদকীয় নোট: আজীবন সংগ্রামী রাজনিতিবিদ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম রাজশাহীতে অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। মাত্র ১৭(?) বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, মাইতি গ্রুপের সদস্য হিসেবে। স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য পরবর্তী সময়েও তিনি আজীবন মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত থেকেছেন, মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি সংবিধান প্রশ্নটিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। ‘বাজেট প্রণয়নে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা’ অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম কর্তৃক ফেসবুকে প্রকাশিত একটি লেখা যা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে )
রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্যাবলিতে জনগণের কার্যকরী অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম দিক হলো রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের ও বাজেট প্রণয়নের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কতটুকু ব্যবস্থা রয়েছে তার ওপর। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানের একটি সাংবিধানিক পদ রয়েছে। তা হলো মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। এই মহা হিসাব-নিরীক্ষকের নিয়োগ, অপসারণ, কার্যাবলি ও ক্ষমতা সংবিধানের ১২৭, ১২৮, ১২৯, ১৩০, ১৩১ ও ১৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা আছে। এতদসংক্রান্ত ১৩২ অনুচ্ছেদে ব্যবস্থা রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের হিসাব সম্পর্কিত মহা হিসাব-নিরীক্ষকের রিপোর্টসমূহ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। এবং ১৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে মহা হিসাব-নিরীক্ষক যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ আকার ও পদ্ধতিতে প্রজাতন্ত্রের হিসাব রক্ষিত হইবে। যেহেতু মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত ও অপসারণযোগ্য সেহেতু রাষ্ট্রপতির তথা রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের স্বেচ্ছাচারী ব্যয়, দুর্নীতি ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি দুর্নীতিযুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয় সম্পর্কে কার্যকরী বিপরীত কোনো রিপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। একইভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীগণের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্বাহী প্রধানের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যবস্থা থাকায় এই পদে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার সুযোগ থাকায় এই সকল পদে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাগণ প্রায়ই জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের ওপর জনগণের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ থাকে না; জন্ম হয় রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের। আর এই আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধী। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকমিশন, এটর্নি জেনারেল ইত্যাদি পদগুলোর নিয়োগ পদ্ধতির কারণে এই সকল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে জনগণের পক্ষে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী প্রতিরোধ করার সাংবিধানিক সুযোগ খুবই সীমিত থাকার কারণে সরকার ও সরকারি কর্মকর্তাগণ গণবিরোধী ভূমিকা পালনের সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৪ অনুচ্ছেদে রয়েছে যে, এই সংবিধানের দ্বারা অনুরূপ বিধান না করা হইয়া থাকিলে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। সংবিধানের এই বিধান বলে সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে জনগণের স্বার্থে কাজ করার স্বাধীনতাকে ও আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করা হয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ ও অপসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনগণের সংসদ সদস্যদের কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নাই। এই সমস্ত বিষয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ না থাকায় স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ইত্যাদি বিস্তারের সীমাহীন সুযোগ রয়ে গেছে।
এবারের বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্যগণ কী ধরনের ক্ষমতা ভোগ করেন এবং কী রূপ ভূমিকা পালন করে থাকেন তা বিশ্লেষণ করা যাক। আমরা সাধারণভাবে জানি, দেশের অর্থমন্ত্রী সরকারের পক্ষে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। কিন্তু আমরা জানি না, এ বাজেট কারা প্রস্তুত করেন এবং কী ভাবে করেন। জাতীয় সংসদে পেশকৃত বাজেট গ্রহণযোগ্য না হলে সংসদ সদস্যগণ সেই বাজেট প্রত্যাখ্যান করতে পারেন কি না। প্রত্যাখ্যান করলে এর ফলাফল কী? এসব বিষয়ে দেশের নাগরিকদের ধ্যান-ধারণা সীমিত বা এ বিষয়ে অধিক জানতে তারা আগ্রহী নয়। ফলে বাজেট পেশ ও গ্রহণের বিষয়টা যে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা অনেকেই উপলব্ধি করেন না। বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী জনগণের স্বার্থে কোনো বাজেট আদৌ প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। বাজেটের সংজ্ঞা নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনার মধ্যে না গিয়ে শুধু এটুকুই বলবো, সাধারণভাবে বাজেট মানে ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বার্ষিক প্রতিবেদন। আর এই প্রতিবেদন সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে পেশ করেন। দেখা যাক, সংবিধানে বাজেট প্রণয়ন সংক্রান্ত কী কী বিধি-বিধান রয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত বাজেট সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধি-বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের আর্থ-প্রশাসন ৫ ভাগে বিভক্ত :
১. সংসদ
জাতীয় সংসদ ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী মূলত ৩টি দায়িত্ব পালন করেন :
১.১ বার্ষিক বাজেট মারফত বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ বা কর্মপরিচালনার জন্য গণঅর্থের সংস্থানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের উদ্যোগের অনুমোদন;
১.২ নতুন কর ধার্য বা বিদ্যমান কর হারের পরিবর্তনের জন্য নির্বাহী বিভাগের সুপারিশসমূহ অনুমোদন;
১.৩ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি পরিদফতরের গণঅর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ।
২. অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে :
২.১ বার্ষিক বাজেট প্রস্তুতকরণ;
২.২ সংসদে বাজেট উপস্থাপনের লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান;
২.৩ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বার্ষিক বাজেট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান;
২.৪ সরকারি রাজস্ব সংগ্রহ;
২.৫ বিভিন্ন প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ও পরিদফতরকে আর্থিক শৃঙ্খলার প্রশ্নে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান। এবং
২.৬ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন মারফত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় বার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তুত করা।
৩. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের মুখ্য হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাবৃন্দ
উল্লেখ্য যে, অর্থ মন্ত্রণালয় হচ্ছে বাংলাদেশের আর্থ-প্রশাসনের মুখ্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে গণব্যয়ের অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে। কিন্তু এ ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সচিবগণ সরকারের আর্থিক নীতিমালা ও অনুশাসনের সাপেক্ষে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগের জন্য গণব্যয়ের অনুমোদনের মুখ্য নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বলে বিবেচিত হন। এসব ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য রাখেন মন্ত্রণালয়/বিভাগের ঘোষিত উদ্যোগের বিপরীতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা কার্যক্ষেত্রে যথাযথ সঙ্গতির সঙ্গে ব্যয়িত হয়েছে কিনা।
৪. মহা হিসাব ও নিরীক্ষণ পরিদফতর
১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী মহা হিসাব ও নিরীক্ষা দফতরের দায়িত্ব হচ্ছে, সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও তা হিসাবের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া সংসদের কাছে গণব্যয়ের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও দুর্নীতির বিষয়াদি তুলে ধরা।
৫. সংসদের বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটি
৫.১ গণহিসাব পর্ষদ : গণহিসাব পর্ষদ মহা হিসাব ও নিরীক্ষণ পরিচালকের হিসাব অনুযায়ী গণহিসাব পর্যবেক্ষণ এবং এক্ষেত্রে অসঙ্গতিসমূহ সংসদের গোচরীভূত করা ও তা প্রতিহত করবার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকে;
৫.২ এস্টিমেট কমিটি : এস্টিমেট কমিটি সরকারের বিভিন্ন দফতর বা মন্ত্রণালয়ের অর্থ ব্যয়ে আর্থিক কৃচ্ছতা সাধনের পরামর্শ দেন;
৫.৩ গণউদ্যোগ পর্ষদ : গণউদ্যোগ পর্ষদ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগসমূহে, যেমন সরকারি খাতের বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক কার্যক্রম পরীক্ষা করে দেখেন এবং তাতে অসঙ্গতি থাকলে সংসদকে অবহিত করেন।
৫.৪ অর্থ পর্ষদ :
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে,
বাজেট প্রণয়ন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে সংসদের তথা সংসদ সদস্যগণের কোনো কার্যকরী ভূমিকা নাই। অন্য কথায়, বার্ষিক জাতীয় বাজেট প্রস্তুতিকরণ প্রক্রিয়ায় সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রই মূলত প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্কটা যে কোনো গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তযুক্ত অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দের জন্য ঋণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। সরকারের ২০০৯-১০ অর্থ বছরের বাজেট অনুসারে বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রায় অর্ধেক অর্থেরই সংস্থান করা হচ্ছে বিদেশী ঋণ ও অন্যান্য সাহায্য গ্রহণের মারফত। এ সমস্ত বিদেশী ঋণ গ্রহণ ও তার শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটা পালন করে থাকে প্রধানত সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র। কাজেই ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রটি মূলত অনুপস্থিত। অন্যদিকে, কোনো সামরিক ও বেসামরিক আমলা এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা কোনো মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে সেজন্য তিনি সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তারা কেবল তাদের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রশ্নে দায়ী থাকেন। সেক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি(?)রা কোনোরূপ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ তো গেল বাজেট প্রণয়নের দিক। এবার আসা যাক, বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে কী কী সাংবিধানিক অনুশাসন রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংসদ হচ্ছে সকল প্রকার আইন প্রণয়ন বা বিল অনুমোদনকারী সংস্থা। আমরা সাধারণ অর্থে যাকে বাজেট বলি তাকে সাংবিধানিকভাবে বলা হয়, বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন (অহহঁধষ ঋরহধহপরধষ ঝঃধঃবসবহঃ)। ১৯৭২ সালের সংবিধানের অধীন নিম্নোক্ত বিষয়াদি বলবৎ রয়েছে :
সংবিধান অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ৮৭(২) বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে পৃথকভাবে :
ক. এই সংবিধানের দ্বারা বা অধীন সংযুক্ত তহবিলের উপর দায়রূপে বর্ণিত ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং
খ. সংযুক্ত তহবিল হইতে ব্যয় করা হইবে, এইরূপ প্রস্তাবিত অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদর্শিত হইবে এবং অন্যান্য ব্যয় হইতে রাজস্ব খাতের ব্যয় পৃথক করিয়া প্রদর্শিত হইবে।
এক্ষেত্রে সংযুক্ত তহবিল বলতে সংবিধানের ৮৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল রাজস্ব, সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল ঋণ এবং কোন ঋণ পরিশোধ হইতে সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল অর্থ একটি মাত্র তহবিলের অংশে পরিণত হইবে এবং তাহা “সংযুক্ত তহবিল” নামে অভিহিত হইবে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সরকারের সকল প্রকার আয়কে বিবেচনা করতে হবে সংযুক্ত তহবিল হিসেবে। অনুচ্ছেদ ৮৮ অনুযায়ী সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয় ৮৮(ঘ) সুদ, পরিশোধ-তহবিলের দায়, মূলধন পরিশোধ বা তাহার ক্রমপরিশোধ এবং ঋণ সংগ্রহ-ব্যপদেশ ও সংযুক্ত তহবিলের জামানতে গৃহীত ঋণের মোচন-সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়সহ সরকারের ঋণ-সংক্রান্ত সকল দেনার দায়। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল প্রকার দেনা (কার্যত বিদেশী দেনাকেই বোঝানো যেতে পারে) পরিশোধের নিমিত্তে যে সমস্ত ব্যয় প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে (যেমন বিদেশী ঋণের সুদ ইত্যাদি) সে সমস্ত কিছুর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান সংযুক্ত তহবিল থেকে করা হবে। এখানে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের যে অংশটি সাংবিধানিকভাবে ঊীঢ়বহফরঃঁৎব পযধৎমবফ ঁঢ়ড়হ ঃযব পড়হংড়ষরফধঃবফ ভঁহফ বলে ব্যাখ্যাত সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী অনুচ্ছেদ ৮৯(১) সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হইবে, কিন্তু তাহা ভোটের আওতাভুক্ত হইবে না। ১৯৭২ সালে প্রণীত বিদ্যমান সংবিধানের এই বিধান অনুযায়ী দেখা যায় যে, কার্যক্ষেত্রে বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো প্রকার নাক গলানোর অধিকার জাতীয় সংসদের নাই। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বিদেশী ঋণ ও মঞ্জুরি সংগ্রহ বা সংগ্রহের উদ্যোগ এবং এ সম্পর্কিত শর্তাবলি নির্ধারণ ও অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ, ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নয়। এর পাশাপাশি আমরা চিহ্নিত করছি যে বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপত্তি তোলার অধিকারও ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের নাই। অতএব, এ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, বিদেশী ঋণ গ্রহণ ও তা পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ‘সার্বভৌম নয়’ এ বক্তব্য বিদ্যমান সংবিধানের অধীন অসাংবিধানিক বলে বিবেচনা করার সুযোগ নাই।
অন্যদিকে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন বা বাজেটের যে অংশটি ঈড়হংড়ষরফধঃবফ ঋঁহফ-এর সাথে সম্পর্কহীন সে সমস্ত ব্যয় সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুশাসন হচ্ছে, অনুচ্ছেদ ৮৯(২) অন্যান্য ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ মঞ্জুরি-দাবির আকারে সংসদে উপস্থাপিত হইবে এবং কোন মঞ্জুরি-দাবিতে সম্মতিদানের বা সম্মতিদানে অস্বীকৃতির কিংবা মঞ্জুরি-দাবিতে নির্ধারিত অর্থ হ্রাস-সাপেক্ষে তাহাতে সম্মতিদানের ক্ষমতা সংসদের থাকিবে। সংবিধানের এই অনুশাসন থেকে মনে হতে পারে যে বাজেটের (সরকারের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন) অনুমোদন কিংবা প্রত্যাখ্যান করবার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের ভুললে চলবে না, তা হলো, কোনো বাজেট সংসদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলে যে সরকার বাজেট উপস্থাপন করে কার্যত তার পতন ঘটে। কারণ প্রজাতন্ত্রের আর্থ-প্রশাসন পরিচালনার আইনগত ভিত্তি তখন সে সরকার হারান। ফলে ক্ষমতা থেকে সেই সরকারের পতন সাংবিধানিকভাবে অবশ্যম্ভাবী। এবং আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৮৯(১) অনুযায়ী সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হইবে, কিন্তু তাহা ভোটের আওতাভুক্ত হইবে না। সোজা কথায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাজেট অনুমোদনে লোক দেখানো কণ্ঠভোটের ব্যবস্থা থাকলেও এর কোনো সাংবিধানিক মূল্য নাই।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযাযী কোনো সংসদ সদস্য তার নিজ রাজনৈতিক দলের নির্দেশ অমান্য করে ভোট প্রদান করতে পারেন না। অর্থাৎ বাজেট যেহেতু সরকারি দল কর্তৃক উপস্থাপিত হয় এবং সরকারি দলের ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য যেহেতু বাজেট অনুমোদন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেহেতু কার্যক্ষেত্রে নিজ দলের এবং আপন সদস্যপদ রক্ষার স্বার্থেই সরকারি দলের সদস্যগণ বাজেট অনুমোদনে বাধ্য। যেটুকু জাতীয় সংসদের সদস্যগণ, বিশেষ করে সরকারি দলের সদস্যগণ করতে পারেন, তা হলো, নিজ দলের সম্মতিসাপেক্ষে বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয় হ্রাসের সংশোধনী পেশ ও অনুমোদন করতে পারেন। কাজেই বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার ওপর জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় অনুশাসন প্রদানে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুরোপুরি অক্ষম। ফলে জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু করার ঘোষণা বা কেন্দ্রবিন্দু করার বাসনা একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম
প্রথম নির্বাহী সমন্বয়কারী, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি
জন্ম: ২৯ নভেম্বর ১৯৪৯-মৃত্যু: ২৬ মে ২০১৭