[ মানস চৌধুরীর এই রচনাটি যে প্রথম আলো প্রকাশ করেনি, সেটা একদম ফেসবুক চ্যাটে খোশগল্প করতে গিয়ে জানা হয়। এমনিতে তিনি লাগাতার নানান বিষয়ে কর্কশ ও স্পষ্টসব মতামত-বিবরণী দিতে থাকেন এবং সেসবের বিষয়ে আমরা আগ্রহী থাকি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ভর্তি পরীক্ষা বিষয়েও তাঁকে ক্ষুরধার সমালোচনা করতে দেখা গেছে। এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, বাস্তবে তিনি ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যহতিও নিয়েছেন। সেই সূত্রেই কয়েক মাস আগের এই রচনাটির বিষয়ে আমরা অবগত হই। বাংলাদেশের সামগ্রিক অগণতন্ত্র, শিক্ষাঙ্গনের বিশেষ দুর্দশা, সাংবাদিকতাতে তল্পিবহন ইত্যাদির একটা স্মারক হিসাবে তাঁর রচনাটি প্রকাশ করছি আমরা। – সম্পাদক ]
২৭ জুন প্রথম আলোর মতামত বর্গে “অনলাইন চূড়ান্ত পরীক্ষার যে মডেল অনুকরণীয় হতে পারে” শিরোনামে অধ্যাপক এম মেসবাহউদ্দিন সরকার-এর একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞাপনধর্মি নিবন্ধখানা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বর্ষপত্র কিংবা ‘উপাচার্যের সাফল্যের অর্ধযুগ’ ধরনের কোনো একটা ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলে তা নিয়ে অবিচলিত থাকা যেতো। বাংলাদেশের পড়ালেখাকারী নাগরিকদের ক্রোড়পত্র ধরনের জিনিসে তালিম ভাল আছে। কিন্তু সংবাদপত্র হিসাবে প্রথম আলো বিরাট পাঠকসংখ্যার প্রভাবশালী একটি পত্রিকা। পরিস্থিতি সম্বন্ধে পাঠকের যাতে ভুলভাল ধারণা না জন্মে সেই লক্ষ্যে এই রচনা লিখতে হচ্ছে।
বস্তুত অধ্যাপক মেসবাহ অসত্য কিছু বলেছেন মর্মে আমার অভিযোগ নয়। যথা, জাহাঙ্গীরনগরে বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা শুরু হয়েছে; কিংবা সেই পরীক্ষাবাবদ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রশংসা পেতে শুরু করেছে প্রশাসকবৃন্দ। এগুলো তথ্য আকারে বানিয়ে-বলা নয়। কিন্তু যে পরিপ্রেক্ষিতের উপর দাঁড় করিয়ে এই ‘সত্যগুলো’ হাজির করেছেন লেখক, তাতে ব্যাপক অতিরঞ্জিত হয়ে গেছে। উপরন্তু, দীর্ঘসূত্রিতা, অনীহা, অদক্ষতার মতো বিষয়গুলোকে তাঁর উপস্থাপনের গুণে সক্ষমতা কিংবা তৎপরতা হিসাবে ভ্রান্তপাঠ হবার অবারিত সুযোগ তৈরি হয়। এখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসা দুটো মাত্র। কোনো ভুল করার সুযোগ নেই সিরিয়াস বিদ্যাচাকুরেদের। এক, জাহাঙ্গীরনগরের কর্তৃপক্ষ একটা দক্ষ ও তৎপর শিক্ষাদান (বা পরীক্ষাগ্রহণ) ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমরা ভাবতে পারি কিনা। দুই, ইতোমধ্যেই নড়বড়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামোটার করোনাকালীন অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক মেসবাহ’র লেখা পড়লে মনে হয় ১৮ মাস ধরে বন্ধ থাকা বাংলাদেশের শিক্ষায়তনগুলোতে পরীক্ষা নেবার একটা উপায় বের করা প্রায় নিউটনের বলবিদ্যার মতো বড়সড় একটা মনুষ্য-আবিষ্কার। যেন বা দিকে দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর (বা যে কোনো স্কুল-কলেজের) গালে-হাত দিয়ে দুর্ভাবনা করেই এই ব্যবস্থা আবিষ্কারের কথা ছিল! যেন বা দেশে রাষ্ট্রীয় কোনো দপ্তর বা প্রশাসন বা মন্ত্রণালয়ের এসব বিষয়ে ভেবে দিকনির্দেশনা দেবার মতো কোনো কারণই ঘটে নাই। শিক্ষাক্ষেত্রে পুরাপুরি দিকভ্রান্ত এবং অনীহামূলক একটা ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষায়তনগুলো যে আছে সেই বিষয়ে কোনোরকম উপলব্ধি হাজির করেননি। এটা না করার মাধ্যমে তিনি বাস্তবে ‘রাস্তা নাই কোনো’ অজুহাতটা বাড়াতেই কেবল সাহায্য করেছেন।
বাস্তবতা হলো যে অনার্স ফাইনাল নেবার জন্য জাহাঙ্গীরনগর কর্তৃপক্ষকে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে সেটা হুড়াহুড়ি করে বিসিএস ধরিয়ে দেবার একটা জনপ্রিয় উদ্যোগ ছিল মাত্র। শিক্ষার্থীবৃন্দ, অভিভাবকগণ, সংবাদকর্মী, তামাম বাংলাদেশের লোকজনই সেটা তখন থেকেই টের পেয়েছিলেন। পরিশেষে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই কারণে যে সেই বিসিএসটাই বরং আন্দাজমতো সময়ে হয় নাই। এই উদাহরণ থেকে যদি আর কিছু পাঠক নাও বুঝতে চান, বাংলাদেশের বিবিধ দপ্তরের মধ্যকার যোগাযোগ-পদ্ধতির বেহাল দশাটা নিশ্চয়ই বুঝবেন।
বাস্তবতা হলো, এখন যে মডেলে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সেই মডেলে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব ছিল কম করেও ১০ মাস আগে, গত বছরের কুরবানি ঈদের ছুটির পরপরই। কোনোরকম গুরুতর উদ্যোগ না-নিয়ে কর্তৃপক্ষ মাসের পর মাস অতিশয় স্থবির শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর ইউজিসি’র হুকুমপত্রের জন্য অপেক্ষা করে গেছে। এখানে প্রসঙ্গ এটা নয় যে এই অনুগত-অনীহ অপেক্ষা কেবল জাহাঙ্গীরনগরের বেলাতেই ঘটেছে কিনা। বরং, সামগ্রিকভাবেই যদি এই পরিস্থিতিটাই বাংলাদেশের হয়, যেখানে অধ্যাপক মেসবাহ’র ভাষ্যানুযায়ী, অন্যান্য ক্যাম্পাস এটুকুও পারছে না, তাহলে সেই দুর্দশাটা সামনে আনা খুবই জরুরি। সত্যি কথা হলো, একটা কনফারেন্স প্ল্যাটফর্ম (জুম) হাজির করে সরকার-রাষ্ট্রের পক্ষে ইউজিসি ‘সব করা হয়েছে’ ধরনের প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্ল্যাটফর্মটি এমনকি পাশ্চাত্যের কোনো শিক্ষাদান প্ল্যাটফর্মও নয়। শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এইসব প্রপাগাণ্ডাকে প্রতিরোধ করা। যদি সাধ্যে না থাকে, অন্তত এগুলোর পক্ষে ওকালতি না-করার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের ডিভাইস ও নেট সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে তামাম বাংলাদেশে যা ঘটছে তার বাইরে জাহাঙ্গীরনগরে বিশেষ কিছুই ঘটেনি। সেই পুরান কাহিনি। দীর্ঘসূত্রী এবং অদূরদর্শী। শিক্ষার্থীরা অনেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পোর্টালের ইমেইল পরিচয়ই পাননি। বাস্তবতা হলো এটা। গত ১৮ মাসে বাণিজ্য সংস্থাগুলোর সাথে শিক্ষার্থীদের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সরকার সুলভ সুরাহা করতে পারতেন। নেট হোক বা ডিভাইস, বহু আগেই পারতেন। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়নি সেখানে জাহাঙ্গীরনগর কর্তৃপক্ষ নাটকীয় কিছু করার কথা নয়। করেনও নাই। সরকার বাণিজ্যসংস্থাগুলোর থেকে দূরে থাকতে চান বলে বিগত বছরগুলোতে মনে হয়নি। হয়তো কী শর্তে ও কোন প্রকল্পে আসবেন তা নিয়ে দেরি হতে থাকতে পারে।
বরং, বছর খানেক পরে হলেও যে ব্যবস্থায় পরীক্ষাটা হচ্ছে তার থেকে অনেক পাকা ব্যবস্থাতে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব ছিল। সেখানে রচনাধর্মি এবং সৃজনমূলক বহুচয়ন/মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন একত্রে গুগল বা সমধর্মী কোনো প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে অত্যধিক মৌখিকনির্ভর পরীক্ষার বাইরে মডেল বানানো যেতো। তবে সেটা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট গণতান্ত্রিক হয়ে নানান শিক্ষকের ভাবনাকে জড়ো করতে পারতে হতো। কেবল দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত অনুগতদের দিয়েই সকল নিরীক্ষা চালালে সেটা সম্ভব হবার কথা নয়। বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে বিশাল একটা কথ্য-রাজ্যের মতো করে। কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস “লেখ্য” পরিপত্র বা বার্তার রাস্তা যারপরনাই এড়িয়ে চলছেন। একটা ‘ফোনাফুনি’ মুডেই কর্তৃপক্ষ স্বস্তিবোধ করছেন সেটা বোঝার জন্য কেবল ওখানকার নিরপেক্ষ একজন কর্মচারি হলেই চলবে। অবশ্যই আমি কাগজের নথির কথা বলছি না, বরং ইমেইল যোগাযোগের কথাই বলছি। তবে “দুর্যোগকালীন পরীক্ষা অর্ডিন্যান্স” বলে একটা লিখিত নথি তৈরি হয়েছে।
আমার রচনাটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাচার বিষয়ে নয়। কিংবা সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষাকাঠামোর হাল নিয়েও নয়। স্বতন্ত্র সুযোগে সেগুলো নিয়ে বিশদ আলাপই লাগবে। বরং, অধ্যাপক মেসবাহ’র রচনাটি ‘সাফল্য’ আর ‘গৌরবময়তা’র বিচ্ছুরণ ঘটাতে গিয়ে তামাম রাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে তাকাতে অনিচ্ছুক ছিল বলে, জাহাঙ্গীরনগরের ঢিলাঢালা কর্তৃপক্ষকে অহেতু বরমাল্য দেবার বন্দোবস্ত করছিল বলে, সাধারণ পাঠকের দরবারে হাজির হতে হয়েছে।
একটা উর্দু লোকগল্প মনে পড়ল যা শৈশবে একটা সিনেমা পত্রিকায় অনুবাদ পড়েছিলাম। একজন ধনী আফিমখোর মনিব তাঁর পাচক পদে নিয়োগ দেবেন কাকে তা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। অনেক বিজ্ঞাপন-ইন্টারভ্যু ইত্যাদি নিয়ে তিনি শেষমেশ নিয়োগ দিয়েছিলেন এমন একজন পাচককে যিনি একটা চাটনি রাঁধতে ১৪ ঘণ্টা লাগিয়েছিলেন!
মানস চৌধুরী, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আদাবর। ২৮ জুলাই ২০২১
#১১/২/উম