(১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে প্রকাশিত ফিরোজ আহমেদের ফেসবুক নোট)
পোষাকশিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার পক্ষে আমার চেনা বেশির ভাগ মানুষই। তবে সিদ্ধান্তটা প্রায় সর্বদাই দেখি সহানুভূতিজাত। ‘পোষাকশিল্প শ্রমিকরা মানবেতর পর্যায়ে আছে, এটা আর চলতে পারে না, কাজেই তাদের মজুরি বাড়ানো দরকার’—অধিকাংশের মত এমনটাই। মোটা দাগে গণমাধ্যমেরওএকটা অংশও পোষাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরি ‘কিছুটা’ বৃদ্ধির পক্ষে, সেটা হতে পারে মানবিক কারণে, হতে পারে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা দাবির বিরোধিতা করার ভয় থেকে। কিন্তু শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি হলে যারা শ্রমিক নন, তাদের লাভ হবে না ক্ষতি হবে, সেইআলোচনাটা প্রায় দেখা যায় না।
অন্যদিকে গণমাধ্যম কিংবা জনমত, দুই জায়গাতেই সংখ্যায় খুব অল্প হলেও খুবই প্রভাবশালী কিছু মানুষ শ্রমিকদের মজুরি যথাসম্ভব কমিয়ে রাখারই পক্ষে। তারা বরং পাল্টা কিছু যুক্তি হাজির করেন, এবং সকলের প্রতি আহবান জানান ‘দেশের স্বার্থে’ সমষ্টির চূড়ান্ত কল্যাণের জন্যই মানবিকতা না, যুক্তিরই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যুক্তির বিচারেই পোষাকশিল্প শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, কিংবা যে কোন শ্রমিকেরই মজুরি বৃদ্ধি উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব তা দেশের স্বার্থের জন্য হানিকর, এই তাদের সুচিন্তিত মতামত।
পোষাকশিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে ‘দেশবাসী’র তাতে লাভ না লোকসান? দেশবাসীর মাঝেই স্বয়ং পোষাক শিল্প শ্রমিকরাও আছেন, প্রশ্নটার মাঝে এই বিপত্তিটুকু আছে। আপাতত আলোচনার স্বার্থে ধরে নিই, লাখ চল্লিশেক পোষাক শিল্পশ্রমিক, মাথাপিছু তাদের জনাদুয়েক ধরে পোষ্য থাকলে আরও লাখ আশি-নব্বই মানুষ বাদ,এমনকি দেড়কোটি-কি দুকোটি মানুষই না হয় বাদ,—বাকি চৌদ্দ কোটিদেশবাসীর স্বার্থে এই মাত্র দু কোটিকে যদি কোরবানী দেয়া দরকার হয়, দিলাম আমরা কোরবানি। সত্যি, দেশের ভালোটাই সবার আগে দেখা দরকার। কিন্তু তাতে বাকি চৌদ্দ কোটির কোন কল্যান আছে তো?
পোষাক শিল্প শ্রমিকদের দেশের স্বার্থে কোরবানি দিলে সম্ভাব্য যা যাভালো ঘটনা ঘটবে:
গার্মেন্টেরমজুরি কম থাকলে কি কি লাভ সমাজের হতে পারে, প্রথমে তার একটা সম্ভাব্য তালিকা বানানো যাক:
১.যত কম মজুরির পেছনে যত কম খরচ করা যায়, মালিকের মুনাফা তত বাড়বে। লাভের টাকা কি মালিক ফেলে রাখবে? তা নিশ্চয়ই না। এই বাড়তি মুনাফা নতুন বিনিয়োগে ব্যবহার করা হবে। ফলে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপিত হবে। নতুন কলকারখানায় আরও নতুন শ্রমশক্তির যোগান দেয়ার জন্য আরও বেশি করে শ্রমিক লাগবে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে শ্রমিকদেরই লাভ হবে এই প্রক্রিয়ায়। বাকি আর সবারও কম বেশি উপকারে আসবে এই নতুন বিনিয়োগ। এভাবেই দেশ এগিয়ে যাবে নতুন নতুন বিনিয়োগের পথ ধরে।
২. শ্রমিকদের বেতন ইচ্ছামতো বাড়ালেই তো হবে না, বাজারটাকে প্রতিযোগিতামূলক রাখতে হবে।আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা সবচে সস্তায় পোষাক বানিয়ে দেই। মজুরি বাড়লে এই সস্তা শ্রমিকের বাজারটা আমরা হারাবো।
৩. পোষাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে তার প্রভাবে আর সব শ্রমিকদের মজুরিও বাড়বে;বাড়বে গার্হস্থ্য সহায়তাকারী থেকে শুরু করে রিকশাচালক পর্যন্ত সকলের শ্রমের দাম; বাড়বে শাকসবজি থেকে শুরু করে আমিষের দাম। ফলে মধ্যবিত্ত আরও চাপের মাঝে পড়ে যাবেন, এমনিতেই তো বাজারে সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া। এই হিসেবে শ্রমিকের মজুরি যতটুকুবৃদ্ধি পাবে, সেই হারে মধ্যবিত্তের জীবন আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
৪. এটা সত্যি যে শ্রমিকরা খুবই কষ্টে থাকে। ভাতের কষ্টে কিংবা থাকার কষ্টে তাদের ফেলা ঠিক না। কিন্তু খুব বেশি মজুরি পেলে তারা হয়তো সেই টাকা আজেবাজে পণ্য কিনে কিংবা ভোগবিলাসে অপব্যায় করবে। শিক্ষার অভাবে, বিবেচনাবোধ না থাকায় তারা বেতনের বাড়তি অর্থ কোন যথাযথ বিনিয়োগে ব্যবহার করতে পারে না। অন্যদিকে মালিকরা কিছু ভোগ বিলাস করলেও বিপুল টাকা তাদের হাতে থেকে যায়। সেই টাকা তারা শিক্ষা-মেধা-বিচক্ষণতা খাটিয়ে ব্যবহার করতে পারে বলে প্রথমে উল্লেখ করা কারণটার জন্যই মালিকদের হাতে মুনাফার যত সম্ভব বেশি ভাগ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।
৫. লাভের টাকা দিয়ে পোষাক শিল্প মালিকরা অনেকেই শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। এটা দেশের সাংস্কৃতিক অর্জনকে শক্তিশালি করছে। পোষাক শিল্প মালিকদের বদান্যতা না পেলে চিত্রকলা, সঙ্গীতের মত অনেক ব্যয়বহুল মাধ্যম হয়তো উচ্ছন্নে যেতো। গল্প-কবিতার বই পোষাক শিল্প মালিকরা ততটা না কিনলেও । যদি কবি কিংবা সাহিত্যিকরা দলবেধে তাদের সাথে দেখা করেন, তাদেরকে এই পৃষ্ঠপোষকতার তাৎপর্য বোঝাতে সক্ষম হন, তাহলে কি তাদের পেছনেও কারখানা মালিকরা দুপয়সা খরচা করবেন না? এভাবেই কিন্তু সমাজে ধনীদের পৃষ্টপোষকতাতেই সুকুমার বৃত্তির চর্চাটা টিকে থাকে।
পোষাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেলে যা যা ভালো কিছু ঘটবে:
অন্যদিকে পোষাকশিল্প মালিকরা যে বিপুল মুনাফা করেন, সেটা কারখানা মালিক কিংবা বিদেশী ক্রেতা কেউই অস্বীকার করেন না। পোষাক শিল্প মালিকরাই এই দেশের সবচে ধনী সম্প্রদায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক দিয়ে হোক, ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দেয়ার দিক দিয়ে হোক, পত্রপত্রিকা দিয়ে হোক, দেশের বাকি সব শিল্প-ব্যবসা-উদ্যোগকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন পোষাকশিল্প মালিকদের প্রতিনিধিরা। দশ বছর আগে ছোট একটা কারখানা ছিলো, তেমন অনেকেই আজ পাঁচ দশটি বড় কারখানার মালিক, খুব কম কারখানাই লাটে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে, কারখানার লোকসান না, ব্যক্তিগত নির্বুদ্ধিতা কিংবা কোন দৈব দুর্যোগেরই ফলে তা ঘটেছে। বিলাস-ব্যসনেও পোষাকশিল্প মালিকরা সবাইকে পিছিয়ে ফেলেছেন। বোঝাই যায় পোষাক শিল্প খাতে মুনাফার রমরমা খুব কম না। কিন্তু তাদের এই রমরমা নিয়ে ঈর্ষান্বিত হবার কি আছে! এমন কি মুনাফা কত হলে তা সঙ্গত হয়, সেটা নির্ধারণ করতে যাওয়াও এই লেখার উদ্দেশ্য না। মুনাফার পরিমান তাবৎ দুনিয়াতে আসলে নির্ধারিত হয় মালিকের সাথে শ্রমিকের একটা রশি টানাটানির লদ্ধিবলে, এই জোরাজুরির খেলা কখনো গোপন কখনো প্রকাশ্য থাকলেও সদা চলমান। এইখানে আমরা শুধু দেখতে চাচ্ছি এই দড়ি টানাটানির কোন পক্ষে থাকাটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য লাভজনক। মালিকের পক্ষে থাকলে মধ্যবিত্তের কি কি লাভ হতে পারে, তা একদফা আমরা দেখলাম। আবারও আমরা সেটা পুনর্বিবেচনা করবো, তার আগে আমরা শ্রমিকের পক্ষে থাকলে কি কি ভালোমন্দ ঘটতে পারে, সেটা দেখার চেষ্টা করি।
ধরে নেয়া হলো দেশব্যাপী প্রায় ৪০ লাখ পোষাক শ্রমিকের মাসিক মজুরি দুই হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেলো। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকের থাকা-খাওয়ার ব্যয়কে যদি খানিকটা স্থিতাবস্থায় রাখতে সক্ষম হন, তবে:
১. মালিকদের লাভের ভাগ থেকে ৪০ লাখ × ২ হাজার = ৮,০০০,০০০,০০০ (৮ শত কোটি টাকা) বাড়তি মজুরি হিসেবে শ্রমিকদের কাছে যাবে। বছরে ১২ × ৮ = ৯৬,০০০,০০০,০০০ (৯ হাজার ৬শত কোটিটাকা) বাড়তি মজুরি হিসেবে শ্রমিকদের কাছে যাবে। মজুরি তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি পেলে বছরে এভাবে ১৪ হাজার ৪০০কোটি টাকা শ্রমিকের কাছে যাবে। মাসে চার হাজার টাকা মজুরি বৃদ্ধি পেলে বছরে ১৯ হাজার দুইশ’ কোটি টাকা বাড়তি মজুরি হিসেবে বাজারে যাবে। মজুরি মাসে পাঁচ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেলে ২৪ হাজার কোটিটাকা প্রতি বছরে মজুরি হিসেবে বাজারে আসবে।
২. যে কোন বিবেচক মানুষই স্বীকার করবেন পোষাক- শ্রমিকরা এখন যে দশায় আছেন, সেটা কোনমতে টিকে থাকার স্তর। ন্যূনতম চাহিদা পূরণের মত অবস্থা এটা না। তাদের জীবন মরুভূমির মত শুষ্কপ্রায়, এটাকে সজল করতে বাড়তি দুই-পাঁচ হাজার টাকা মোটেই যথেষ্টকিছু না। ফলে এই টাকা পাওয়া মাত্র আর কোন কিছু বাদ দিয়ে তারা পণ্য কিনতে ছুটবেন সোজা বাজারে। বাড়তি বাড়িভাড়া আর খাদ্যশস্যের মূল্য যতটা সীমিত রাখা যাবে, ততটাই তারা নিত্যনতুন কিন্তু অত্যাবশ্যক পণ্য, সেবা ইত্যাদি কিনবেন। তার মানে এই বিপুলপণ্যের চাহিদা রাতারাতি বাজারে তৈরি হবে, যেটার প্রয়োজন এখনি তাদের জীবনে থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার অভাবে তারা সেটা কিনছেন না, ফলে বাজারে সেটার কোন চাহিদাও তৈরি হচ্ছে না, ফলে সেটা আদৌ উৎপাদিতও হচ্ছে না।
বাড়তি এই অর্থ দিয়ে পোষাক শ্রমিক কিনবেন কাপড়, জুতো, ইলেকট্রনিক পণ্য, তাজা ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, উন্নত যাতায়াত, বিনোদন, ওষুধ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা। বাড়বে পাঠাভ্যাস, বইপুস্তক আর পত্রিকা ক্রয়।
৩. নিজ দেশের শিল্পকলকারাখানার জন্য কৌশলী সুরক্ষানীতি প্রণয়ন করেই পৃথিবীর সকলশিল্পোন্নত দেশ নিজ দেশের শিল্পের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো,এর ব্যতিক্রম একটাও নেই। সেই রকম নীতি অবলম্বন করলে বর্ধিত মজুরির ফলে সৃষ্ট এইবাড়তি পণ্যের চাহিদার একটা বড় অংশ দেশেইউৎপাদিত হতে পারবে, ধীরে গোটটাই দেশে তৈরি হওয়া সম্ভব।
বিশ্বব্যবস্থার শ্রমবিভাজনে চাপিয়ে দেয়া পোষাক শিল্পের মজুরি যদি প্রায় পুরোটা মালিকের পকেটে যায়,তাহলে কোনদিনই রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বাড়বে না, কারণ তা জনগণের অধিকাংশ যে শ্রমিক,তাদের প্রাত্যহিক চাহিদাগুলোকে পূরণের বদলে তাকে দমন করছে। এভাবে সস্তা শ্রমিকেরযোগান তারা অব্যাহত রাখছে। অন্যদিকে মজুরির বৃহত্তর অংশকে শ্রমিকের পকেটে আনা যায়, তাহলে এই আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের মাঝেই শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাকেবাজারে সক্ষম করে তুলবে। ফলে বাজারে বিপুল পণ্যের চাহিদা দেখা দেবে, উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবেই আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের আপাত অধীনতামূলক শ্রমবিভাজনেও দ্বান্দ্বিকভাবে বাংলাদেশের সার্বিক উৎপাদনশীলতার বিকাশ ঘটাবে, পরিনামে তা শ্রমিকশ্রেণীর বিকাশ ঘটাবে, তার সংগ্রামেরও উচ্চতর রূপে প্রকাশিত হবে। এই উৎপাদনশীলতারবিকাশ ঘটবে কিনা, তা আসলে নির্ভর করবে বাড়তি মজুরি আদায় শ্রমিক আন্দোলনের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ওপর, কিংবা (যেটার সম্ভাবনা আপাতদৃশ্যে খুব কম) মুৎসুদ্দী বুর্জোয়ার বদলে উৎদানশীল বুর্জোয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতাগ্রহণ।
পুঁজি কোথায়?
কিন্তু প্রশ্ন হলো: বাড়তি মজুরির ফলে মালিকদের মুনাফা তো কমে যাবে। তাহলে নতুন পণ্য উৎপাদনের জন্য এই নতুন বিনিয়োগ করতে কারা পারবেন?
উত্তর খুব সহজ: যে কোন পণ্যের যদি নিশ্চিত বাজার থাকে, লাভের সম্ভাবনা থাকে, উদ্যোক্তারা ব্যাঙ্ক থেকে হোক, অর্থবাজার থেকে হোক, দশজনে জমিয়ে হোক, পুঁজি কোন না কোনভাবে সংগ্রহ করেন। চল্লিশ লাখ পোষাক শ্রমিক, তাদের সাথে যুক্ত পরিবারসমূহ মিলে যে বিপুল জনগোষ্ঠী, তাদের সংখ্যা বহু দেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক পণ্য ও সেবাচাহিদা যা হবার কথা, তা বাংলাদেশের আস্ত শিক্ষা বা সামরিক খাতে বরাদ্দ হওয়া গোটাবাজেটের চেয়ে বহুগুন বড় একটা পণ্য-বাজার দেশের মাঝেই তৈরি করে ফেলবে কলমের এক খোঁচাতেই।
প্রাচীনআমল থেকে হাল আমল পর্যন্ত অজস্র উদাহরণ দেখানো যাবে, যেখানে জনগণের জীবনে চাহিদা তৈরি হলে আপাতদৃশ্যে প্রায় কোন পুঁজিহীন সমাজেও বিশাল সামষ্টিক পুঁজির যোগান হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন গড়ে ওঠে, এত বড় বিনিয়োগের কোন সামর্থ্য ইংরেজ কোন শিল্পপতির ছিল না, বরং স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে বনিক পর্যন্ত সাধারণ জনগণের অর্থায়নেই এটি সম্ভব হয়েছিল। মসলাসহ প্রাচ্যের পণ্যের বাজার সুনিশ্চিত ছিল বলেই এতে অর্থ যোগানে কারও কোন সমস্যা হয়নি। অন্যদিকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা নেই বলেইআমাদের দেশে যৌথঅংশীদারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না, বরং জনগণের পকেটের যা কিছু বাড়তি বিনিয়োগযোগ্য অর্থ চলে যাচ্ছে শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এর মত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ফাটকাবাজদের পকেটে।
আরও সব পরজীবীরা
একদিকেমালিকরা যেমন কেবলমাত্র গায়গতরে কোনভাবে বেঁচে থাকার মত মজুরি শ্রমিকদের দেন, সেই বেতনটুকুরওপরও ঝাঁপিয়ে পড়েন বাড়িওয়ালারা, তারও চেয়ে বেশি শুষে নেয় মজুদদারদের চক্রগুলো। মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাই প্রয়োজন ঘরের-ভাড়াবা ভোগ্যপণ্যের দামের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা। এটা করা হবে যাতে শ্রমিকের বাড়তি মজুরির ভাগ বাড়িওয়ালা বা মজুদদার খেয়ে না ফেলে; বরং বেতনাটা দিয়ে সে যেন সর্বোচ্চবেশি পরিমান পণ্য কিনতে পারে, কিংবা সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করতে পারে, সেটা নিশ্চিতকরাই হতে হবে রাষ্ট্রের লক্ষ্য। বর্তমান ব্যবস্থায় বাংলাদেশের গোটা উৎপাদনী খাতেরই একটা বড় সঙ্কট হলো খোদ উৎপাদক যারা, সংখ্যায় যারা অনেক, যাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে বাজারে বিপুল পণ্যের চাহিদা তৈরি হতো, তারা নন—মুনাফার বড় অংশখেয়ে ফেলেন সংখ্যাল্প কারখানা মালিক, বাড়িওয়ালা, বৃহৎ-পণ্যব্যবসায়ীরা।
হিসেবটা আবারও কষা যাক, আরেক দিক দিয়ে
কমবেশি হাজার তিনেক পোষাক মালিক মাথা পিছু তিরিশ জোড়া করে জুতো কিনলেও নব্বই হাজার জোড়া জুতোর বাজার তৈরি হয়, পণ্যটির চাহিদা এক লাখেও পৌঁছায় না।
কিন্তু চল্লিশ লাখ শ্রমিক বছরে তিন জোড়া জুতো কেনার সামর্থ্য অর্জন করলে সোয়া এক কোটি জুতোর চাহিদা তৈরি হয়। শ্রমিকরা যদি তাদেরওপর নির্ভরশীল পোষ্যদের জন্য জুতো কেনেন, তাহলে এই চাহিদা বেড়ে দুই তিন কোটিরবেশিতে পৌঁছাবে। নিশ্চয়ই এই পণ্যগুলো তারা এখনও ব্যবহার করেন, তবে সেটা পরিমানেখুব কম, কিংবা খুব কম টেকসই, বারেবারে তালি কি রিফু করে ব্যবহার করতে হয়।
জুতোরএই উগাহরণটিকে ব্যবহার করা সম্ভব শাড়ি-লুঙ্গিসহ যাবতীয় পোষাক, বই, খাতা, কলম,চশমা, তাজা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য, ইলেকট্রনিক পণ্য— এই সব বিষয়েই। মোট কথাআমাদের আশেপাশে বিক্রি হয় এমন সকল পণ্যের চাহিদাই বহুগুন বৃদ্ধি পাবে যদি মুনাফারক্রমশ বেশি বেশি অংশ মালিকদের পকেট থেকে শ্রমিকদের হাতে চলে আসতে থাকে।
মালিকের বাইরে বিরাট একটা মুনাফা সমাজ থেকে তুলেনেয় একচেটিয়া খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ীরা, এরপর নেয়বাড়িওয়ালারা নামের পরজীবীরা। এদের মুনাফার ভাগ যত কমানো যাবে, তত বেশি পণ্যেরচাহিদা তৈরি হবে, তত বেশি শিল্পোৎপাদন বাড়বে, তত বেশি শ্রমজীবী হোক আর মধ্যবিত্ত পেশাজীবীহোক, মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। কারখানা পরিচালনা, প্রকৌশল, উন্নয়ন, বিপননেরবুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলোতে মধ্যবিত্তরা জড়িত বলে মধ্যবিত্তের জন্যও বিপুলকর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে প্রত্যক্ষভাবেই। পরোক্ষভাবে এর ফল কিন্তু মধ্যবিত্ত আরওবেশি ভোগ করবেন, কেননা শ্রমজীবী সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনের জন্য সৃষ্টিহওয়া নতুন বাজারের চাহিদা মেটাতে মধ্যবিত্তের বুদ্ধিজীবীসুলভ বৃত্তিগুলোরও চাহিদাবহুগুন বৃদ্ধি পাবে।
এভাবেইএকটা পুঁজিবাদী সমাজে দু’চার জনের পকেটে আটকা না পড়ে মুনাফা ছড়িয়ে গেলে তা আরও বহুভাবে নতুন নতুন উৎপাদনী চাহিদার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে লাভটা কেবল মালিকের মুনাফা,বাড়িওয়ালার ভাড়া এবং ব্যবসায়ীর মুনাফায় হজম হয়ে গেলে সমাজের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ার মতো কিছু বাকি থাকে না।
কার ভাগে কত? দেশি-বিদেশী ভাগবাটোয়ারার চেহারা
এটা খুব জানা-বোঝা হিসেব আজকাল, পশ্চিমা ক্রেতারা একটা পোষাকের জন্য যে দাম দেন, তার ভগ্নাংশও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ব্যয় করা হয় না। এই বিষয়ে যতগুলো হিসেব আছে, সবগুলোতেই দেখা যায় এই বৈষম্যটা কত বিপুল। রানাপ্লাজার ভয়াবহ বিপর্যের পর ১৪ মে বার্তাসংস্থা রয়টার্স হিসেব কষে দেখায় ম্যাঙ্গো নামের স্প্যানিশ পোষাকের ব্রান্ডটি ৪.৪৫ ডলার দিয়ে যে পোলো শার্টটি বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করছে, সেটি তারা ইংল্যান্ডে বিক্রি করছে ৪০ থেকে ৪৬ ডলারে, স্পেনে সেটি তারা বিক্রি করছে ৩৪ থেকে ৩৯ ডলারে। ম্যাংগোর ফরমায়েসী কাজ করা হতো রানা প্লাজায়। তো, ম্যাংগো প্রকাশ না করায় প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক মুনাফার হার রয়টার্স জানাতে পারেনি, তবে তুলনা করতে পেরেছে এর প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টিডেক্স এসটির সাথে। খরচ বাদ দিয়ে এটির মুনাফার হার শতকরা ৫৮ ভাগ, সুইডেনেরএইচয়্যান্ডএম হ্যানস অ্যান্ড মরিস এবির বেলায় এটি ৫৫ ভাগ।
কর ও অন্যান্য ব্যয় বাদ দিয়ে প্রথমকোম্পানিটির নিরেট মুনাফা থেকেছে ১৬ ভাগ, আর দ্বিতীয়টির ৯ ভাগ। এই পার্থক্য হবারকারণ স্পেনের তুলনায় সুইডেনের করের হার অনেক বেশি, কিন্তু রাষ্ট্রের পাওয়া এইবিপুল করও তো তাদের সামাজিক, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও অন্যান্য নানান খাতে ব্যয় হয়।অন্যদিকে পোষাক খাতকে বাংলাদেশ নানান ভাবে কর রেয়াত দেয়, পোষাক শিল্প মালিকরা এখানেনগদ মুনাফার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নানান রকম ভর্তুকি ও সুরক্ষা পান। এই চিত্রের মধ্যদিয়ে বোঝা যায় বৈশ্বিক এই শ্রমবিভাজনের মাঝেই লুকিয়ে আছে একদিকে ‘উন্নত’ নামেপরিচিত রাষ্ট্রগুলো কিভাবে সম্পূর্ণত গরিবদেশের শ্রমের দ্বারা অর্জিত সম্পদের বড়অংশটা নিয়ে নিচ্ছে মূলত কর বাবদ। পূবের মানুষের শ্রমে কর বসিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রের পাওয়া এই অনোপার্জিত এই অর্থের সুবিধাভোগী সেখানার গরিব ও ধনী সকলেই, কিন্তু বিশেষভাবেই পুঁজিপতি শ্রেণীই।
কোম্পানিগুলোর মুনাফার পরিমান সম্পর্কেধারণা পাওয়া যাবে তাদের বিক্রির পরিমাণ থেকে। স্পেনে ১৬ ভাগ কিংবা সুইডেনে ৯ ভাগকরপরবর্তী মুনাফার পরিমানটা কিন্তু খুব ক্ষুদ্র নয়। এক ম্যাঙ্গোর ১০৭ টি দেশ জুড়েরয়েছে ২৬০০ টি খুচরা বিক্রির দোকান, তার গত বছরের মোটা বিক্রি ১.৬৯ বিলিয়ন ইউরো,মানে সতেরো হাজার দুইশো কোটি টাকারও বেশি!
অন্যদিকে দেশে ‘কারখানা মালিক’ নামের বহুজাতিকপুঁজির কার্যত ফড়িয়া কিংবা মুৎসুদ্দী গোছের কারখানা মালিকরা কত ভাগ পান? ২০১১ সালেকানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের করা একটি জরিপ অনুযায়ী যে কাজের জন্য শ্রমিক .১২ সেন্টপান, সেই কাজে মালিকের মুনাফা .৫৮ সেন্ট। ওই হিসেবে দেখা যায় ৩.৬৯ ডলার দামের একটিপোলো শার্টের মোট উৎপাদন খরচের শতকরা .৮৫ ভাগ ব্যয় হয় শ্রমিকের জন্য, আর কারখানা মালিকেরপকেটে থাকে ৪.১৪ ভাগ। এই ভাগাভাগিটি ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক। খুব কম ক্ষেত্রেমালিক-শ্রমিকের আয়ের বৈষম্য এত বেশি থাকে। বাংলাদেশে পোষাক শিল্প মালিকরা যে সবচে বেশি ধনী অংশ, সেটা এমনি এমনি নয়।
ওই ৩.৬৯ ডলার দামের পোলো শার্টটি বানাতেশ্রমিকের বেতন চারগুন বেড়ে .৪৮ সেন্ট হলেও পোলো শার্ট প্রতি মালিকের মুনাফা .২২সেন্ট অবশিষ্ট থাকে। তাতেও মালিকের মুনাফাটা বিপুল লোভনীয়ই থাকবে, সেটা বোঝা যাবেহাজার হাজার শ্রমিকের তৈরি করা লাখ লাখ পিস শার্ট দিয়ে এই বাইশ সেন্টকে গুন করাহয়। এমনকি মুনাফা আরও কমিয়ে যদি পোষাক প্রতি দশ সেন্ট করা হয়, তারপরও পোষাককারখানায় উদ্যোক্তার অভাব হবে না। যে মাঝারি কারখানা বছরে আট কোটি টাকা মুনাফাকরে, সেটির মুনাফা যদি রাতারাতি এক কোটি টাকায় এসে দাঁড়ায়, মালিকরা কি কারখানাবন্ধ করে দেবে? মোটেই তারা তা করবে না, যদিও নিজেদের লাভের ভাগ বাড়াবার জন্য তারাশ্রমিকদের ওপর চাপ এবং ভয়ভীতি যথাসম্ভব অব্যাহতই রাখবে। মনে রাখবেন, এই গার্মেন্ট মালিকরা আশির দশকেআপনার মতই আশি এবং নব্বই এর দশকে রাস্তার পাশে চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে অভ্যস্ত, এবংকমে আসা মুনাফার পরও তারা কারখানা অব্যাহত রাখবে, কারণ তাদের অত কম বিনিয়োগে এরচে বেশি মুনাফা আর কোন শিল্পেতারা পাবে না।
ফলে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে দু দুটোস্তরে আধিপত্যের চিত্রকে। একদিকে বৈশ্বিক শ্রমবিভাজনে আমরা পাচ্ছি ভারি শ্রমঘনশিল্পগুলো, যেখানে আমাদের সস্তা মজুরি পশ্চিমের মালিকের জন্য খুবই আকর্ষণীয় একটাবস্তু। অন্যদিকে দেশীয় ফরমায়েসী কারখানা-মালিকও এই সস্তাশ্রমের বাজারের ফলে লাভবানহচ্ছে। ফলে সে যেচেই এই চরম অমানবিক ব্যবস্থার উপযোগী রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক ও আইনীসকল রকম বন্দোবস্ত খাড়া করছে। অন্যদিকে বাড়তি কাজের চাপ পোষাক শিল্প শ্রমিকের আয়ুও কর্মজীবনকে সংকুচিতই করছে না শুধু, গোটা জাতির মাঝ থেকেই সেই প্রাণশক্তিকে শুষেনিচ্ছে, এখানে শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিনোদনকে বাধাগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস করছে। চাইলেই এইচাপিয়ে দেয়া শ্রমবিভাজন থেকে আমরা রাতারাতি মুক্তও হতে পারছি না। এই রাষ্ট্রেরশাসন ক্ষমতায় সকল দিক দিয়েই পোষাক শিল্প মালিকেরা সুবিধাজনক অবস্থানেই আছেন। এটাতাদেরই রাষ্ট্র, কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির প্রধানতম বাহকও হয়ে উঠতে পারেনপোষাকশ্রমিকরাই, ক্রমশ উচ্চহারে মালিকের কাছ থেকে মুনাফার ভাগ আদায় করে এবং এইশ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আর সব শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করে।
পোষাক শ্রমিকের মজুরি বাড়লে কবিরও লাভ আছে
মধ্যবিত্ত আমরা কাদের বুঝি? যারা প্রধানত গায়ে গতরে শ্রম বিক্রি করেন না, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা বা জ্ঞানই তাদের জীবিকার উৎস। শিক্ষক থেকে শুরু করে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রসায়নবিদ, ব্যবস্থাপক, সংস্কৃতিজীবী—এরা সকলেই মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশের আজকের মধ্যবিত্তের প্রধান সঙ্কটের একটা দিক বোঝা যায় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধানতম দিক হিসেবে ‘বিবিএ’ সনদধারীদের আবির্ভাব থেকে, আরেকটা বোঝা যায় ক্রমহ্রাসমান সাহিত্য পাঠের হার দেখে। ষোলো কোটি নাগরিকের দেশে আমাদের কবিরা ঝগড়া করেন কার বই আড়াইশ আর কার বই সত্তুরটি বিক্রি হলো! কোন একটি প্রবন্ধ কি ইতিহাসের বই বছরে এক হাজার বিক্রি হয় না এই দেশে।
পোষাক শ্রমিক যদি আরেকটু বেশি কেনাকাটা শুরু করে, তার জন্য প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরি করা কারখানায় আরও বহু রসায়নবিদ লাগবে; পোষাককর্মী স্বাস্থ্যের জন্য যত্নবান হতে পারলে আরও অজস্র চিকিৎসকের চাহিদা তৈরি হবে। পোষাক কর্মীর সন্তানের আরও ভালো পড়াশোনার জন্য দরকারপড়বে সংখ্যাতীত ভাষা শিক্ষক। তার সন্তানদের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠলে দুই থেকে পাঁচশ বইবিক্রি নিয়ে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা-মত্ত সাহিত্যের বাজারের চেহারাও রাতারাতি না হলেও আরও দ্রুতলয়ে ইতিবাচক হবে। তাদের জন্য গড়ে উঠবে বিনোদন বাণিজ্যের ভর ভরন্তবাজার, তাদের জন্য ছাপা হবে অজস্র শিশুসাহিত্য।
কিন্তু এই অগণন শ্রমিকদের যদি আমরা ধরেবেধে ক্রয়ক্ষমতাহীন করে রাখি, কেননা কারখানা-মালিকরা আমাদের আত্মীয়স্বজন, কি কাছাকাছি রুচির, মাঝেমধ্যে একত্রে ভোজ হয়, উৎসবে আয়োজনে দেখা হয়, শুধু এই শ্রেণিগত সঙ্গতির সুবাদেই শ্রমিকের ঔদ্ধত্য আর নৈরাজ্যের ডর দেখিয়ে মালিকরা আমাদের সমর্থন আদায় করছে। “এইবার পোষাক শিল্প শিল্পটারে শ্যাষ না কইরা ছাড়বে না” এমন অবিবেচক আশঙ্কা আমাদের আশেপাশের মধ্যবিত্ত মানুষজনকেই করতেদেখেছি অজস্রবার।
অথচ মুনাফার বন্টনে মালিকরা প্রায় পুরোটা মেরে দেয়ার ফলে একদিকে যেমন এই মধ্যবিত্তের জীবিকার-জীবনের বিকাশের পথগুলো শেষ পর্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে আমাদের সমাজের ভেতরই তৈরি হচ্ছে সাংস্কৃতিকভাবেই ভিন্ন তিনটি আলাদা উপসমাজ। একদিকে বিপুল মুনাফা হজম করা কিংবা দুর্নীতির মাধ্যমে পকেট ভারি করা ক্ষুদ্রাংশ তাদেরবিত্তের বড় অংশটা পাচার করে দিচ্ছেন বাইরে, কিংবা কিনছেন আরও বেশি পরিমানে জমি,ফ্লাট—কারণ দেশে বিনিয়োগের উপায় নাই, কারণ চাহিদা সীমিত, কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নাই, কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা মেরে দেয়াহয়েছে—অন্যদিকে থেকে যাচ্ছেন সংস্কৃতি বঞ্চিত,অবসররহিত বিপুল শ্রমজীবী মানুষ। নিজেদের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিকে তারা ধরে রাখতে এবংতা থেকে নবনব সৃষ্টিতে আর যথেষ্ট মাত্রায় সফল হচ্ছেন না। সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, বটেই। কিন্তু জাতীয় সংস্কৃতির প্রধান ধারক যে শ্রমজীবী মানুষ, তাদের জীবন এই রকম হামলার মুখে পড়লে যে নৈরাজ্য দেখা যায়, তার দৃষ্টান্ত তো আমরা চর্তুদিকেই দেখতেপাচ্ছি। মুনাফার ভাগ যতটা বেশি শ্রমজীবী মানুষের মাঝে যাবে, সমাজে অবসর যত বাড়বে,বিনোদন আর সংস্কৃতির মানও তত উচ্চতর ও সুক্ষ্মতর পর্যায়ে যাবে। একই সাথে যেমাস্তানি, সন্ত্রাসী রাজত্বে বেকার শ্রমজীবী মানুষ সস্তা হাতিয়ার হিসেবে খাটছেন,সেটাও সামান্য কিছুটা হলেও অবসানও ঘটবে।
বাংলাদেশেরবাৎসরিক বিশাল বাজেটের তুলনায় মুনাফার বাড়তি ভাগ পাওয়া শ্রমিকদের এই বাজারকে বেশ খাটোই মনে হচ্ছে? তা কিন্তু আর মনেহবে না বাংলাদেশের আর সব বিনিয়োগের চিত্রের দিকে তাকালে। যে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়েএত কথাবার্তা বলা হয়, যাদের সুবিধা করে দেয়ার জন্য দেশি শিল্পের ভিত ধ্বংস করেদিয়ে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সেবা খাতে বহুজাতিক পুঁজির জন্য পরিসর তৈরি করতে, তারপরিমান কতো? শুধু গার্মেন্ট খাতেই মজুরির ভাগ বাড়িয়ে যে নতুন বাজার সৃষ্টি হবে,সেটার পরিমান প্রতি বছর যে বিদেশী বিনিয়োগ হয়, তারচে বহু বহু গুন বেশি।
গার্মেন্টখাত কিন্তু বাংলাদেশের সম্পূর্ণ শ্রমশক্তির সামান্য একটা অংশের চিত্র। গার্মেন্টের মতই যদি কৃষি, পরিবহন, আর সব শিল্প খাত থেকে একইভাবে মালিকের মুনাফার হার কমিয়েআনা সম্ভব হয়- শিল্পোন্নত প্রায় সকল দেশেই এই কাজটি ইতিহাসের নানান পর্যায়ে করা হয়েছে, এবং এভাবে সাধারণ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে—শ্রমিক ও কৃষকদের যে বর্ধিত ক্রয়ক্ষমতার সৃষ্টি হবে, সেগুলোর চাহিদা মেটাতেই আরও অজস্র শিল্পকারখানার চাহিদা গড়ে উঠবে। শুধু তাই না, এরা সামগ্রিকভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে আসলে পরস্পরের বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে।
কিন্তু সম্পূর্ণ জনশক্তির তুলনায় ছোট হলেও পোষাক শিল্প এবং এই ধরনের খাতের শ্রমিকরাই বাংলাদেশে সবচে ঘনীভূত শ্রেণি। ফলে বাকিদের সংগ্রামের ফলাফলের তুলনায় পোষাক শিল্পশ্রমিকদের সংগ্রামের ফল অর্থনীতির ওপর অনেক বেশি প্রত্যক্ষ হবে। ইতিহাসে একেকটি পর্বে এভাবেই এক একটি শ্রেণী, কিংবা শ্রেণীরও একটা নির্দিষ্ট অংশ সমাজের বাকি সবার প্রগতিশীল রূপান্তরে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী তাদের সাম্প্রতিক মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আসলে বাংলাদেশের ইতিহাসের এইপর্যায়ে বাকি প্রত্যেকর হয়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে দরিদ্র মানুষের মজুরির বৃদ্ধি ঘটিয়ে তার ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি এবং এভাবে গোটা সমাজেরই গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটবার সংগ্রামে।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, দেশে সব খাতেই মজুরি গত এক দশকে বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এতে গার্মেন্টের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কিন্তু উপর্যুপুরি ক্রমবর্ধমান পোষাক শিল্প শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধিযেন শ্রমিকের মজুরিকে সেই হারে না বাড়িয়ে তোলে, সেটা রোধ করার জন্য মালিকরা একটি কৌশল অবলম্বন করে। মালিকরা বলা ভুল হবে, বরং বলা যায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র শিল্পশ্রমিকের মজুরি কমিয়ে রাখার জন্য এই কায়দাটা ঐতিহাসিকভাবেই অবলম্বন করেছে নানান পর্যায়ে। সেটা হলো এমনভাবে কৃষিনীতি নির্ধারণ করা যাতে কৃষিকাজ মোটাদাগে অলাভজনক হয়ে পড়ে। ফলে কৃষি থেকে যে বিপুল উদ্ধৃত্ত মানুষ বাধ্য হয়ে কারখানায়সস্তা শ্রমিক হিসেবে আসেন এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শ্রমবাজারকে মালিকের জন্য লাভজনক করে ফেলেন। ফলে পরিস্থিতি অসম্ভব ঠেকলে কয়েক বছর পর পরশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করতে মালিকরা বাধ্য হলেও মুদ্রাস্ফীতির হিসেবে এবংক্রমক্ষমতার হিসেবেও দেখা যাবে এখনও পর্যন্ত এত আন্দোলন সংগ্রাম করার পরও শ্রমিকরা প্রকৃত ক্রয় ক্ষমতার অর্থে তাদের মজুরি বৃদ্ধিতে সক্ষম হননি। ফলে এ যাবত কালের মজুরি বৃদ্ধিগুলো খুব সামান্যই দেশজ ক্রয়ক্ষমতার এবং ফলত দেশজ শিল্পের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। শ্রমিকা এখন পর্যন্ত আত্মরক্ষামূলক ভূমিকাতেই খেলেছেন, ক্রমক্ষশতার সীমা বিস্তার করে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার বিকাশের যে বিপুল সম্ভাবনা তারা ধারণ করেন, যেটা এই দেশের শ্রমিক-কৃষক তো বটেই, এমনকি মধ্যবিত্তের জন্যও জীবনের যে বিচিত্র বিকাশের দুয়ার খুলে দিতে পারে, তা এখনো অধরাই আছে।
ফিরোজ আহমেদ
সদস্য, রাজনৈতিক পরিষদ
গণসংহতি আন্দোলন