আমরা তো সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। আমরা এখন উন্নত দেশের শিক্ষানীতি, পরিবেশ, খাদ্য ইত্যাদির পর্যালোচনা করতেই পারি। এমনিতেই তো আমাদের “প্রাচ্যের অকসফোর্ড”, “প্রাচ্যের কেমব্রিজ” আছেই। আমার আজকের আলোচনা বাস ভাড়া নিয়েই থাকবে। জার্মানির শিক্ষানীতি “Befog act” অনুসরণ করে প্রতি শিক্ষাবর্ষ বা সেমিস্টারে শিক্ষার্থী পাস দেয়। শিক্ষার্থী পাস দিয়ে বিনামূল্যে সকল পরিবহনে যাতায়াত করা যায়। এমনকি বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই পাসের সুযোগ পায়। লক্ষণীয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিও তারা অত্যন্ত যত্নশীল। আমাদের দেশে মৃত্যুর মতো ঘটনা না ঘটলে এইসব আলোচনায় স্থান পায় না!
১৯৬৯ সালের সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খেদানো আন্দোলনের ঐতিহাসিক ১১ দফার ১(ঢ) ধারায় বলা হয়, “ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের “আইডেন্টিটি কার্ড” দেখাইয়া শতকরা ৫০ ভাগ “কন্সেসন” টিকিট দেয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোন যায়গায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলেও বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ “কন্সেসন” দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। … ” ১৯৬৯ সালের সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খেদানো আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ১১ দফার ১(ঢ) বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না কেন? অন্তরায় কী? আবার স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত সরকার এতোগুলো লাশ ও দুই দফা আন্দোলনের পর অনেক শর্তযুক্ত হাফপাস দিতে বাধ্য হলো। কোথায় আমাদের স্বাধীনতার চেতনা? কোথায় আন্তর্জাতিক মান রক্ষার ন্যূনতম চেষ্টা?
গতকাল রাজধানীতে আরো এক শিক্ষার্থীকে হত্যা করার পর হাফপাস দিলো। এটাকে আংশিক বিজয়, প্রাথমিক বিজয় ইত্যাদি বলতেই পারেন! ঢাকার শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস কার্যকরের ঘোষণা কী সারাদেশের বিজয়? হাফ পাসের দাবিতে শুধু ঢাকায় আন্দোলন হয় নি। ছাত্ররা শুধু ঢাকায় থাকেন না, ছাত্ররা সারাদেশেই থাকেন! তাহলে আংশিক সিদ্ধান্ত কেন? তাও সেই সিদ্ধান্ত এসেছে মালিক সমিতি থেকে। সরকার কোন প্রজ্ঞাপন জারি করেনি।
নিরাপদ সড়ক ও হাফপাসের দাবিতে বিক্ষোভ করলে চট্টগ্রামে ছাত্র ফেডারেশনের ১ জন সহ মোট ৪ জন শিক্ষার্থী আটক হন। পুলিশ তাদেরকে মারধোর করে গায়ের শার্ট পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলে! তাহলে বরিশাল, দিনাজপুর, নারায়ণগঞ্জ বা অন্যান্য জেলার আন্দোলনকারীদের বিজয় কোথায়? ঢাকায় সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ছাত্ররা হাফপাস অধিকার পাবেন। সারাদেশের ছাত্রদের অধিকার কোথায়? হাফপাসের দাবির আংশিক বিজয় হয়েছে! আংশিক অভিনন্দন! রাত আটটার পর শিক্ষার্থীরা কী পেশাজীবী হয়ে যান? ঢাকাও কী বিজয়ী হলো? আমাদের সংশয় থেকে গেলো!
সুতরাং কথা একদম স্পষ্ট, হাফপাসের ঘোষণা বা এর বাস্তবায়ন নিয়ে অপরাজনীতি করবেন না। সারাদেশের ছাত্রদের জন্য হাফপাস অধিকার কার্যকর করতে হবে। এই ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করছি।
সারাদেশের ছাত্রদের জন্য হাফপাস অধিকার কার্যকর করতে হবে। এই ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। নিরাপদ সড়ক চাই, এটা কোনো মামুলি দাবি নয়। এই দাবির প্রেক্ষিতে যদি সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কি? পথচারী ছাত্র-শ্রমিক-জনমানুষের জীবন যদি গাড়িচাপায় পিষ্ট হবার ঝুঁকি পুরোপুরি বহাল থাকে তাহলে আসলে কী বিজয়ের কোনো আনন্দ নিয়ে আমরা ঘরে ফিরতে পারি?
সড়ক দুর্ঘটনার নামে যেসব মৃত্যু হয় সেসব আসলে অব্যবস্থাপনাজনিত হত্যা। এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে কাঠামোগত হত্যা বলা হয়। হত্যার জন্য দায়ী কাঠামো/ব্যবস্থার পরিবর্তন না করলে নাঈম হাসান, মাঈনউদ্দিনদের মতো স্বপ্ন হত্যা বন্ধ হবে না। এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে পারেন দেশের শিক্ষার্থীবৃন্দ। আপনারা হতে পারেন নিরাপদ, শিক্ষার্থীবান্ধব বাংলাদেশের রূপকার।
গোলাম মোস্তফা, সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
#১১/৮/উৎসব মোসাদ্দেক