১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। লাখো মানুষের প্রাণ, আত্মত্যাগ এবং মরণপণ লড়াইয়ের ফল আমাদের এই স্বাধীনতা। যে প্রত্যাশার কথা বলে যেমন- দু’ মুঠো পেট ভরে খেতে পাওয়া, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ,কর্মসংস্থান, সাম্য ও মানবিক ন্যায়বিচার ইত্যাদির জন্য সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীতে মানুষ ধীরে ধীরে চরম হতাশায় আচ্ছন্ন হতে থাকলো। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দেশীয় শাসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের হল বীতশ্রদ্ধ। দেশটা অচিরেই চলে যেতে থাকে লুটেরা পোর্ট-ফোলিওদের দখলে। প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা ক্রমান্বয়ে শাসনযন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন ও কোনঠাসা হয়ে পড়তে পড়তে চলে যেতে থাকলো শূন্যের কোঠায়। ফলশ্রুতিতে দেশে দুর্ভিক্ষের কালোছায়া গ্রাস করতে থাকলো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে দেশীয় লুটেরাদের জোট শক্তিশালী হতে থাকে। কিন্তু দেশের শাসকগোষ্ঠীর কোন ইতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণ না করে শুধু আপ্তবাক্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। পরবর্তী পরিস্থিতি সকলের জানা।
ক্ষমতার মসনদে সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসররা অধিষ্ঠিত হয়। অন্তর্হিত হয় স্বাধীনতার স্বপ্ন। এরই ধারাবাহিকতায়-দেশ স্বাধীনতাপূর্ব অবস্থায় চলে গেল। অর্থহীন হয়ে পড়লো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সময় দেশের মানুষের মধ্যে যে আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকলো। দেশের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে পূর্বাবস্থায় চলে গেল। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি- দেশের কোটি কোটি মানুষ নিরন্ন ও ছিন্নমূল, কোটি কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নেই। শ্রমিকের জীবিকার কোন নিরাপত্তা নেই।
পোশাক শ্রমিকসহ অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের জন্য রাজপথে নামতে হচ্ছে। রাজপথে ঘটছে রক্তপাত। এমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখি। শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে এক শ্রেণীর কালো ব্যবসায়ীদের মদদে ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হলো। লুটেরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট চিনিকলগুলো বন্ধের প্রক্রিয়াধীন। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখলাম- চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া বেতন চাওয়ায় শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ড। কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীর জীবন ও কর্মের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। ভারতীয় আধিপত্য নীতির কারণে সীমান্ত হত্যা হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঠুঁটো জগন্নাথের মতো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণমুক্তির লড়াইয়ে আমরা ’৭১ সালে দেশ স্বাধীন করেছি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য, কিন্তু এদেশের জনগণ স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে মুক্তির স্বাদ পায়নি। দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। শাসকগোষ্ঠী এমনভাবে বাংলাদেশকে পরিচালনা করেছে যা’ মুক্তিযুদ্ধের আকাঙক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমানে আমরা তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। আজ জনগণের জান-জবানও নিরাপত্তাহীন। তাদের পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছে। হরণ করা হয়েছে জনগণের ভোটাধিকার। দেশের গণতন্ত্র এখন তিরোহিত। রাষ্ট্র ক্ষমতা এখন কুক্ষিগত।
ভোট নাগরিকদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জনগণের ভোট বা ভোটাধিকার। ভোটাধিকার ব্যতীত নির্বাচন ব্যবস্থার কোন মূল্য বা অস্তিত্ব নেই। আর নির্বাচন না হলে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে না। ফলে গণমানুষের রায় নিয়েই বৈধ একটি সরকার ক্ষমতায় যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে মানুষের ভোটের সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা চলছে। একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় আকড়ে থাকা। উন্নয়নের মহাসড়কের নাম করে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট। চলছে ধোঁকাবাজির মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানাবার প্রচেষ্টা। জনগণের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করে বিত্তবৈভবে জীবন কাটাচ্ছে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগীরা। দেশের হাজার- হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্যই তারা জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে রেখেছে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নয়, ১৯৮৬, ১৯৮৮ সাল বা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একই প্রক্রিয়ায় হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয়।
বিগত মার্চ মাসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সাড়ম্বরে উদযাপন করলো সরকার। ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটিয়ে পালন করেছে এ উৎসব। অথচ জনগণ যে স্বাধীন নয় তা এই সরকারের আচরণে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের অনিয়ম,দুর্নীতির সমালোচনা করা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব করার এখতিয়ার সরকারের নেই। জনগণের এই অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। অথচ দুঃশাসক এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত নেমে আসে। রাষ্ট্রীয় জুলুম অব্যাহত থাকে। এরই বৈধতা দিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নামক একটি নিপীড়নমূলক আইনের প্রবর্তন করা হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিক অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মোক্ষম অস্ত্র। যাতে করে সরকারের সুবিধাভোগকারী প্রভাবশালী ব্যক্তি, মন্ত্রী-আমলা-জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও লুটপাটের সমালোচনা করতে না পারে। অথচ সরকার সমর্থকরা নদী-বন-খাল-খাসজমি দখলের পাশাপাশি হুমকি, হামলা, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস অব্যাহত রেখেছে।
দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের উদ্দেশ্যে ভয়ভীতি, ধরপাকড়, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চলছে। খুনিদের কেউ কিছু করতে পারছেন না। সঙ্গতকারণে প্রতীয়মান হয় এ সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ড সরকারের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় ঘটছে। এসব অপরাধীদের রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে আটক ও বিচার করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের অনুগত বলেই তারা মুক্তবিহঙ্গের মতই প্রশাসনের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস- যারা দেশের জন্য কথা বলছেন, জনগণের পক্ষে কথা বলছেন তারাই রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এই আক্রমণ থেকে সাংবাদিক-ব্লগার-লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-কার্টুনিস্ট-রাজনৈতিক কর্মী কেউই পরিত্রাণ পাচ্ছেন না। তারা তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারছেন না। ইতোমধ্যে খুলনার পাটকল আন্দোলনের অন্যতম নেতা মোঃ রুহুল আমীন এই আইনে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেফতার হন। তিনি প্রায় ২ মাস পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলা যায়। ঢাকায় উদ্যোক্তা লেখক মুশতাক আহমেদ তো নির্যাতনে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কার্টুনিস্ট আহমেদুল কবীর কিশোরসহ আরো অনেক ভিন্নমতের মানুষ কিংবা রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে। সম্প্রতি ২১ এপ্রিল রাতে খুলনার সাংবাদিক আবু তৈয়বকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তিনি বেসরকারী টিভি চ্যানেল এনটিভি’র খুলনার ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয়া হয়েছে। বলা যায় না পরবর্তী সকালে অন্য কে আটক বা গ্রেফতার হবেন, কে কারাগারে যাবেন!
রাষ্ট্রে যদি রাজনীতি দৃশ্যমান না থাকে তাহলে দুর্বৃৃত্তায়ন বৃদ্ধি পায়। দুর্নীতির ব্যাপ্তি সমাজের রন্ধ্রে- রন্ধ্রে প্রবেশ করে। দুর্নীতি তখন সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। এজন্য সরকার এককভাবে দায়ী থাকে। সরকার আমলা-পুলিশ প্রশাসন-গুন্ডাবাহিনী দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে অকেজো করে ফেলে। তাই দেশে ব্যবস্থাগত পরিবর্তন করতে চাইলে, গণতান্ত্রিক ধারা বিকশিত করতে হলে, বিদ্যমান গণবিরোধী শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপ দিতে হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিনির্মাণ প্রয়োজন। প্রয়োজন রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলে প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা। দেশের গভীরতর সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে জাতীয় সমঝোতার পথে এগুতে হবে। সংকট সমাধানে এটাই এই মুহূর্তে জরুরী কাজ। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে করণীয় হলো- আগামী ৩টি জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে হতে হবে। এই ৩টি নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করবেন। এক্ষেত্রেও জরুরী প্রয়োজন -বিদ্যমান সংবিধানকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানে রূপ দেয়া। সংবিধানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আবশ্যিকতা ঘটাতে হবে। সংসদ সদস্যদের শুধুমাত্র হাত তোলা ক্ষমতা নয়, ন্যায় বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতস্ফুর্ত স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
জান-জবানের নিরাপত্তা, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিনির্মাণের জন্য জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। বুকটা টান টান করে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার, প্রতিবাদ করার সাহস সঞ্চয় করতে হবে। বুক চিতিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। যাঁরা আমাদের বাঁচার মতো বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার ভরসা দেয় তাদের পাশে এসে আপনাদের দাঁড়াতে হবে। তাদের শক্তি জোগাতে হবে।
মুনীর চৌধুরী সোহেল
তারিখঃ ২৪-০৪-২০২১
ভালো লাগলো