প্রথম অধিবেশন
বিষয় : স্বাস্থ্যের অধিকার, মৌলিক অধিকার, বিদ্যমান অবস্থা এবং গণমুখী সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রূপরেখা
“যখনই আমরা জনস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করব, তখন নারীস্বাস্থ্যকে পৃথক করে দেখার সূযোগ নেই। যখন জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা ভীষণ রকম জটিলতায় থাকি তখন যৌক্তিকভাবে নারীস্বাস্থ্য নিয়েও আমরা একই ধরণের জটিলতা ও সংশয়ে থাকি- আলোচনার শুরুতে আমাদের এই কথাটি বুঝতে হবে।
দরিদ্র দেশে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ৫০ বছরের একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা কাঠামো রয়েছে, যার ইতিবাচক ব্যবহার সম্ভব ছিল। এতদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, তার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভালো উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই উন্নতির মধ্য দিয়েও আমাদের তদারকি ব্যবস্থার ভীষণ দূর্বলতা ও রিসোর্সের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যতোটা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, সেটা না হয়ে আশির দশক থেকে বেসরকারি খাতকে অনুপ্রেরণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এর জন্য হয়তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও পরামর্শ ছিল কিন্তু পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও বেসরকারিকরণ করতে গিয়ে আমরা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জনসাধারণের কাছাকাছি পৌছে দিতে পারিনি, বরং আরো দূরে সরিয়ে নিয়েছি।
সরকারি ও বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রেই নারীস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নারীকে শুধুমাত্র ‘প্রজনন শরীর’ হিসেবে দেখি। নারীর জন্মনিয়ন্ত্রন অথবা নারীর জন্মদান ছাড়াও নারীস্বাস্থ্যের অনেকগুলো ক্ষেত্র রয়েছে। নারীকে যদি শুধু আমরা ‘প্রজনন শরীর’ হিসেবে দেখি তখন আসলে নারীর সার্বিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ধারণার মধ্যেই আনা হয় না। প্রাথমিক পর্যায় থেকে টারশিয়ারি পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবার এ তিন পর্যায়ে কতজন নারী কি কি রোগ নিয়ে হাজির হন, কি কি স্বাস্থ্যসেবা পান- এর তুলনামূলক চিত্র ও তথ্য দেখলে বোঝা যাবে যে, নারীর জন্মনিয়ন্ত্রন ও নারীর জন্মদান- এ দুটো ক্ষেত্রের বাইরের ক্ষেত্রগুলো খুব কম গুরুত্ব পাচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাকে কার্যকরি ভূমিকায় নিয়ে যাওয়ার ফলে জন্মহার কমেছে এবং তা উদযাপনও করা হয়েছে। কিন্তু জন্মহার কমানোর জন্য যখন কোন নারী জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতির আওতায় আসেন তার ক্ষেত্রে নারীস্বাস্থ্য কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ তা কতটুকু বিবেচনা করা হয়েছে, জনস্বাস্থ্য ও নারীস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা এই বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন- সে ধরণের কোন তথ্য আমাদের কাছে আছে কিনা? জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি নিয়ে যতগুলো কাজ হয় সেই কাজের ক্ষেত্রে জন্মহারের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নারীস্বাস্থ্য তার জন্য কি পরিমাণে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে ও কি ভোগান্তি পোহাচ্ছে সেই সম্পর্কে কতটুকু তথ্য আমরা সাধারণ জনগণ জানি, সে বিষয়টি নজরে আনতে হবে। আমি স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানী হিসেবে, ছাত্রীবস্থা থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতায় যতগুলো গবেষণা করেছি, সেই সমস্ত গবেষণায় এসব ঘটনা একেবারে খুব সাধারণ চিত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছি এবং জন্মনিয়ন্ত্রনের কারণে একজন নারী যতদিন পর্যন্ত তার ‘জব-চৎড়ফঁপঃরাব ঞরসব’ থাকে, ততদিন পর্যন্ত সে নানা সমস্যায় ভ‚গে। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়না বিধায় নারীরাও এ সমস্যাগুলো হওয়াকেই স্বাভাবীক বলে মনে করেন। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে যদি আমরা সার্বিকভাবে চিন্তা করি তাহলে আমাদের অবশ্যই নারীস্বাস্থ্যের এ দিকটি তুলে ধরতে হবে।
দ্বিতীয়ত, সন্তান জন্মদান ছাড়াও অসুখ-বিসুখ নানা স্বাস্থ্য প্রক্রিয়া নারীর ক্ষেত্রে চলতে থাকে। বিগত প্রায় দুই-তিন দশক ধরে সন্তান জন্মদানের বিষয়টি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে ঘরে জন্মদানের যে সংস্কৃতি এদেশে ছিল সেটি এখন নেই। ভ‚ল পদক্ষেপ বা বিকল্প পদ্ধতিকে আড়ালে রাখার মাধ্যমে নজরে না আনাও একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দূর্বলতা। ঘরে জন্মদান আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ, এই ঘরে জন্মদান পদ্ধতি কিভাবে ত্রুটিমুক্ত ও নারীবান্ধব করা যায় সে চেষ্টা করলে তা আরো অনেক বেশি কার্যকরি হতো। ধাত্রী বা দাইকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জন্মদানের প্রশিক্ষণ না দিয়ে যেভাবে জন্মদানের ক্ষেত্রে হাসপাতালকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তাতে খুবই বড় ধরণের একটি বাণিজ্যিকিকরণ ঘটেছে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ততো বটেই, নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রেও নারীর জন্মদানের সময় সিজারিয়ান জন্মের হার খুব বেড়েছে। এ সকল বিষয় সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাইরে ভাববার কোনো অবকাশ নেই।
বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো চিকিৎসা ব্যয়ের দুই তৃতীয়াংশ রোগীর পকেট থেকে যায়। এটি এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং বাকি যা সমস্যা রয়েছে সেগুলোর উৎপত্তি এই সমস্যার কারণেই। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো এই বাণিজ্যিকিকরণ কমাতে পারব না কিন্তু তার বিপরীতে যদি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হিসেবে গড়ে না ওঠে তাহলে, রোগীর পকেট থেকে দুই তৃতীয়াংশ চিকিৎসা ব্যয় যাদের কাছে যাচ্ছে তারা শক্তিশালী হতে থাকবেন এবং তারাই স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেন এরকমই থাকে তা নিশ্চিতের চেষ্টা করবেন। প্রাথমিকভাবে সিজারিয়ানকে কেন্দ্র করেই অনেক বেসরকারি ছোট ছোট হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যতগুলো হাসপাতালই দেখবেন তার মধ্যে ‘এখানে কম খরচে সিজার করা হয়’ লেখা একটি সাইনবোর্ড থাকবেই। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘আইসিইউ/সিসিইউ’ লেখা সাইনবোর্ড। এটি এখন খুবই সাধারণ চিত্র। এও সত্য যে অনেক সময় ‘সিজার-তো নারীর সমস্যা, পুরুষের সমস্যা না’ এই মতাদর্শও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। আমাদের জন্য কোনটা বেশি জরুরী- টিকা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ নাকি সিজারের সংখ্যা কমানো জরুরী- এইসব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দেখছি- সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোরও যথাযথ প্রয়োগ নেই। স্বাস্থ্য আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ যদি থাকতো তাহলে শুধু নারীস্বাস্থ্যই নয়, জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য এই কাঠামোটি ব্যবহার করা যেত। এ ৫০ বছরে যেটি বাংলাদেশে গড়ে ওঠা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হলো নাগরিকদের বা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা অধিকার আন্দোলন, যা গড়ে ওঠেনি। যদি গড়ে উঠেও থাকে তা খুবই সামান্য পরিসরে। যেমন- বর্তমান করোনাকালে চিকিৎসা পেতে একজন নাগরিক বা রোগী কোথায় যাবেন, এ সম্পর্কে কোথায় জিজ্ঞেস করবেন, কোথায় এ সম্পর্কে জানবেন এবং কোথায় স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে তার বক্তব্য তুলে ধরবেন- এ ধরণের কোনো প্লাটফর্ম গড়ে উঠেনি। গত দশ বছরে একটি স্বাস্থ্যসেবা অধিকার আইন গড়ে ওঠার কথা ছিল। দুর্নীতিগ্রস্ততার মধ্যেও এ আইন গড়তে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আইনটি গড়ে উঠতে পারেনি। সেই আইনটি কার্যকরিভাবে গড়ে উঠার জন্য নাগরিকদের বা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নিয়ে একটি প্লাটফর্ম প্রয়োজন।”
সাদাফ নূর
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী।