জনপ্রশাসনের মাঠপর্যায়ের তিনটি ঘটনা গত এক বছরে আলোচিত হয়েছে, প্রথমটি নৃশংস, পরেরটি মর্মান্তিক এবং সর্বশেষটি হাস্যরসাত্মক। পরিহাসময় হলেও এই তৃতীয়টি অত্যন্ত হৃদয়হীন ঘটনাও, এর থেকেও বাংলদাশের প্রশাসন নিয়ে যারা ভাবেন তাদের জন্য শিক্ষার বিষয় আছে। এর বাইরেও এমনি অজস্র সব ঘটনার সাথে জড়িত জনপ্রশাসনের কর্মচারিদের বহু সংবাদ গণমাধ্যমে মেলে। মানুষকে কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা থেকে শুরু করে বৈচিত্রের দিক দিয়ে এগুলোর কোন শুরু শেষ নেই। কিন্তু আপাতত এই তিনটি সংবাদের বিশ্লেষণেরই চেষ্টা চলুক, এই তিনটিই যেহেতু দৃষ্টান্তমূলক।
প্রথমটি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ভয়াবহতার মাত্রাগত দিকের জন্য। হয়তো মাঠ পর্যায়ের সংবাদকর্মী বলে আরিফুল ইসলাম রিগ্যান অতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। কিন্তু সত্যি এই ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুতর ছিল, যদিও এক বছর হলেও ঘটনার কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আর দেখা যাচ্ছে না। বাংলা ট্রিবিউন তাদের এই কর্মীটির পাশে পুরোটা সময়ই যথাযথভাবেই দাঁড়িয়েছিল, প্রথম আলোতেও আরিফুল ইসলামকে নিয়ে খুবই ভালো একটা প্রতিবেদন করেছিল। কিন্তু আরিফুল কি কোন আইনগত প্রতিকার পাবেন? সেই মামলার প্রতিবেদন এক বছর পরও জমা পড়েনি, এমন একটা খবর শুধু পেলাম।
বিষয় ছিল কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নিয়ম বহির্ভূত অনেকগুলো তৎপরতা নিয়ে আরিফুলের প্রতিবেদন। সরকারী পুকুরকে জেলাপ্রশাসক সরকারি পয়সায় সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করেছিলেন। হাস্যকর রকমের আত্মপ্রচার, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই নিয়ে আরিফ প্রতিবেদন করায় জেলা প্রশাসকের ধৈয্যের বাঁধ ভেঙে যায়। মাঝ রাতে তার ঘর ভেঙে তাকে ‘তুই বড় জালাচ্ছিস’ বলে ধরে এনে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এনে চোখ বেধে নির্যাতন করা হয়, বিবস্ত্র করা হয়, সেই রাতেই ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে তাকে মাদক মামলায় এক বছরের কারাদণ্ডও প্রদান করা হয়।
প্রশ্ন এখানে বেশ কয়েকটাই জেগেছিল। গোটা একটা জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার নাম পাচ্ছি এই অপরাধমূলকভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করার কাজটিতে, এটা কী প্রশাসনের একটা সার্বিক নৈতিক মানের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কি না! দ্বিতীয়ত, জেলা প্রশাসকের নিজের নামে কোন কিছুর নাম করণ করার এখতিয়ার আছে কি না, এমনকি কোন কিছুর উদ্বোধন ইত্যাদির সাথে তার নামফলকে থাকাটা শোভন কি না। এগুলো তো জনগণের পয়সায় করা হয়, এগুলোর পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন ও নির্মাণের সাথে অনেকগুলো দফতর জড়িত থাকে। তৃতীয়ত, আরিফুল এই নির্যাতনের ঘটনার কোন বিচার পাবেন কি না।
কিন্তু সব চাই্তে জরুরি প্রশ্ন এইটাই: এই বিচারের অধিকার জেলা প্রশাসক, তার অধস্তন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা ইউএনওদের আছে কি না, তা বৈধ কি না।
তুলনীয়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সাথে রাস্তায় ব্যক্তিগত বিরোধকে কেন্দ্র করে লক্ষীপুরে সাবেক চিকিৎসককে হাত কড়া পরিয়ে ভ্রাম্যমান আদালতে কারাদণ্ড প্রদানের ঘটনাটি। সাবেক এই চিকিৎসকের মত সুপরিচিত মুখ যখন ভ্রাম্যমান আদালতের হাত থেকে রেহাই পাননি, আরিফুল ইসলাম সেই তুলনায় নিতান্তই ক্ষমতাহীন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি অতি সম্প্রতি ঘটলো। নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদ, অভাবের তাড়নায় জরুরি নাম্বারে ফোন করে খাদ্য সাহায্য চেয়েছেন। ইউএনওর এসে মনে হয়েছে ফরিদ আহমেদ ‘দুষ্টুমি’ করেছেন। ফলে শাস্তি স্বরূপ এই দরিদ্র ব্যক্তিটিকে ইউএনও বাধ্য করেছেন একশত দরিদ্রকে খাদ্য কিনে দিতে। সুদে টাকা ধার নিয়ে এই অভাবী নিরন্ন মানুষটি সেই কাজটি করেছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়,, শুরুতে তারা ইউএনওর সুরে কথা বললেও পরবর্তীতে তারা বিস্তারিত তদন্ত করে আসল চিত্রটি বের করে আনে। কোন পত্রিকাটি প্রথমে এই সংবাদটি করে, সেটা জানার আগ্রহ হচ্ছে খুব, তাদের অনুসন্ধানী চোখের প্রশংসা করতেই হয়।
কিন্তু এই ঘটনাতেও ইউএনওর ভুল বোঝার বাইররেও একাধিক প্রশ্ন আসে। প্রথমত, বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্যের কাজটি আরও বিস্তৃতভাবেই করা দরকার, এটা সকলেই স্বীকার করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলে ইউএনও খাদ্য সাহায্য দেয়া বা এ বিষয়ক খোঁজ খবর নেয়ার কাজটি করবেন কেন? এই কাজটি প্রায়ই পুলিশকেও করতে দেখি। হঠাৎ প্রয়োজনে এমন সেবা আকাঙ্খিত, কিন্তু নিয়মিতভিত্তিতে এই কাজটা করা হলে সেটা সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে ঘটার কথা না? কেন একটা পরিবারকে কয়েক কেজি করে চাল, আটা, তেল, আলু ইত্যাদি দেয়া হবে, সেটার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে ছুটবেন, এবং এই বরাদ্দটা সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে করা হবে না, আরেকজনের কাজ কেড়ে নেবেন ইউএনও? কারণটা অনুমেয়, আপনারা যারা বোঝেন, বুঝবেন। বাকিরা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে দেখতে পারেন, এইসব আলোচনায়-তর্ক বিতর্কে আমরা সকলেই অনেক রকম অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হতে পারবো বাংলাদেশের জনপ্রশাসন নিয়ে। ((আসলে করার কথা স্থানীয় সরকারের, তাকে আরও পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, কিন্তু সে আলোচনায় আমরা আপাতত একদম না যাই। )
এখানে আরও একটা নতুন প্রশ্ন তোলা যায়, যিনি দুষ্টুমির শিকার, তিনিই তদন্ত করছেন, তিনিই বিচারক, একই অঙ্গে এই তিন রূপ, এটা কি আইনের নীতিতে যায়? ফরিয়াদী, পুলিশ, হাকিম একই ব্যক্তি হতে পারেন? দুনিয়ার কোথাও হয়? কেন হয় না?
কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনার মাঝে মৌলিক প্রশ্নের মিলটি থেকেই গেলো, সেটি হলো, কিসের বলে, কোন এখতিয়ারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এই ফরিদ আহমেদকে শাস্তি দিলেন? খেয়াল করুন, ইউএনওর উদঘাটন যদি সঠিকও হতেন, ফরিদ আহমেদ যদি সত্যিই দুষ্টুমি করে ফোন করতেন, এই শাস্তিটা দেয়াটা তার ক্ষমতার আওতায় পড়ে কি না, নাকি এই শাস্তির সিদ্ধান্তটা আর কারও নেয়ার কথা, সেটাই হলো প্রশ্ন। এই ঘটনাটা নিয়ে প্রথম আলোতে শওকত হোসেন মাসুম ভাইয়ের একটা খুব ভালো লেখা পেলাম, যেখানে মধ্যবিত্তের বর্তমান দশা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সত্যি বলতে কী, কোন গণমাধ্যমই এই মৌলিক প্রশ্নকে নিয়ে আর অগ্রসর হয়নি: ইউএনও কেন, কোন ক্ষমতা বলে ফরিদ আহমেদকে শাস্তি দিলেন? প্রশ্নটা তাই শুধু মধ্যবিত্তের করুণ দশার না, যদিও এই করুণ দিকটির সংবাদমূল্য আছে। কিন্তু ঘটনা অন্য রকম হলেও, ফরিদ আহমেদ দুষ্টুমিটা করে থাকলেও শাস্তিটা ইউএনও কিংবা যে কেউ দিতে পারেন কি না, সেই মৌলিক আইনী প্রশ্নেরও।
ঘটনা হিসেবে কিন্তু এর চাইতেও ভয়াবহ একটি ঘটেছিল, র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রের সারওয়ার আলম ৩২ মিনিটে ২৩ শিশুর দোষ স্বীকারোক্তি নিয়ে তাদেরকে দণ্ডাদেশ দিয়েছেন।
তৃতীয় ঘটনাটি তো সেই গ্রামীণ জমিদারদের আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ছাগলে ফুল গাছ খেয়েছে, ছাগল পাকড়াও করে নিয়ম মোতাবেক খোয়ারে না দিয়ে ইউএনও তা বিক্রি করে দিয়েছেন বলে ছাগলের মালিক দরিদ্র সাহারা বেগম দশজনের কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছেন।
এটা হজরত ওমর কিংবা সম্রাট অশোকের আমল হলে সেই মহানুভব শাসকেরা হয়তো ইউএনওকে ভৎর্সনা করেই তাম্রশাসন পাঠাতেন, বলতেন, এলাকায় যদি গরিব মানুষের ছাগলের খাবারের অভাব দেখা দেয়, জনগণের মালিকানার জায়গাগুলোতে যথাসম্ভব ফুল গাছ চাষ না করে গোখাদ্যই চাষ করতে। অন্তত ন্যূনতম বুঝদার একজন মাঝারি শাসকও বলতেন ছাগল আর শিশুদের থেকে ফুলগাছকে বেড়া দিয়ে রাখতে, এইরকম কারণে জরিমানাটা দৃষ্টিকুট রকমের অন্যায় ও হাস্যকর। সেই সব রাষ্ট্রনৈতিক ও দার্শনিক, কিংবা নিছক নৈতিকতার আলাপে আমরা না যাই।
এখানে বরং যে প্রশ্নগুলো সকলের বোধগম্যভাবেই উঠছে, সেগুলো নিয়েই ভাবা যাক: কেন গরিব একটা নারীকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এত তুচ্ছ একটা কারণে? এত অমানবিকতা! দ্বিতীয় প্রশ্নটা যেটা আসে সেটা হলো, সংশ্লিষ্ট সকলেই জানিয়েছেন, ভ্রাম্যমান আদালতে শাস্তি দিতে হলে অভিযুক্তকে উপস্থিত পেতে হয় (অনবগতদের জন্য বলে রাখছি, এখানে অভিযুক্ত কিন্তু ফুলখেকো ছাগলটি নয়, ছাগলের অভাগা মালিক)। ফলে খোঁয়ারে না দিয়ে ইউএনও অন্যায় করেছেন, মালিকের অনুপস্থিতিতে ছাগলকে জরিমানা করাটা এখানে ভ্রাম্যমান আদালত আইনসঙ্গত হয়নি। ছাগলের মালিক নারীটি হয়তো ইউএনওর এই আইন লঙ্ঘনের অতশত জটিলতা বোঝেন না, কিন্তু তিনি অন্তত এইটুকু বোঝেন যে, তার উন্নত প্রজাতির ছাগলটির দাম কমপক্ষে বারো হাজার টাকা; ওদিকে ইউএনও কার্যালয়ের লোকেরা ফুল খাবার জরিমানার দুই হাজার টাকা কেটে তাকে মাত্র তিন হাজার টাকা সাধছেন।
কিন্তু এইসব ছাপিয়ে, ছাগলের ফুল খাওয়ার রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার কিংবা ছাগলের বাজারমূল্য বিষয়ক অর্থনৈতিক আলাপ বাদ দিয়ে বরং প্রথম দুই ঘটনায় যে প্রশ্নটি ঘুরেফিরে আসলো, সেই কথাটাই আবারও তুলতে চাই: ইউএনও কিসের বলে নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট? কিভাবে তিনি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেন? এই সব কটি ঘটনায় আদালত গঠনের এখতিয়ার ইউএনওদেরকে বাংলাদেশের আইন কিভাবে দিলো?
এবং এই ভ্রাম্যমান আদালতের ক্ষমতার ভীতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় কয়েক বছর আগে গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি সংবাদে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ইউএনওর ভয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পা ধরে ক্ষমা চাইছেন একজন শিক্ষক।
ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক করে, চরম ক্ষমতা আত্মঘাতী দম্ভের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের জনপ্রশাসের মাঝে হয়তো আমরা সেটা দেখছি। এই সব রাষ্ট্রনৈতিক ও দার্শনিকতা বিষয়ক আলাপ জরুরি হলেও আপাতত আমাদের প্রসঙ্গটা আইনেই সীমিত থাকুক: ইউএনওরা আইনসঙ্গতভাবে এই বিচার ও শাস্তির ঘটনাগুলোতে যথাযথ এখতিয়ার রাখেন কি?
আপনাদের ভাবনাও জানাবেন দয়া করে, কারণ ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কল্পনা করতে চাইলে এই মৌলিক প্রশ্নগুলোকে ভুলে যেতে দেয়া যাবে না।
বরাত
১. কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককের হাতে আরিফুল ইসলামের নির্যাতনের শিকার হওয়া বিষয়ক একটা প্রতিবেদন “মধ্যরাতে বাড়ি থেকে সাংবাদিককে ধরে নিয়ে মোবাইল কোর্টে এক বছরের জেল” t.ly/Qycy
তুলনীয় সিভিল সার্জনকে কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনাটি দেখুন t.ly/Wsra
২. নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদের নিগ্রহ বিষয়ক একটি লেখা, “ত্রাণ চেয়ে ৩৩৩ নম্বরে ফোন বাড়ির মালিকের, জরিমানা করল প্রশাসন” t.ly/VYql
পথশিশুদের কয়েক মিনিটে দুই ডজন শিশুকে ভ্রাম্যমান আদালতে কারাদণ্ড প্রদান কেন বেআইনী ও অবৈধ, তা নিয়ে আদালতের আদেশ দেখুন, অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ছিল ঘটনাটি t.ly/JJLr
৩. বগুড়ায় ছাগলের ফুলগাছ খাওয়া বিষয়ক প্রতিবেদন, ‘ছাগলে খেল ফুলগাছ, ইউএনও করলেন জরিমানা, অতঃপর…’ t.ly/9Ghc
শিক্ষককে পা ধরিয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার ঘটনাটা দেখুন এখানে t.ly/DdY9
এই ছয়টি ঘটনা নমুনা মাত্র। যে কেউ সন্ধান করলে এমন অজস্র কাহিনীর সন্ধান পাবেন। আমরা প্রায়ই শুধু আইনের অপপ্রয়োগের প্রবণতাটা নিয়ে আলাপ করতে চাই। সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এইখানে আলাপের মূল বিষয় ভ্রাম্যমান আদালতের আইনটাই।
#জ/উম-৬/৮