(২৬ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত ফিরোজ আহমেদের নোট)
গোলাম আজমের পুনর্বাসনের কাহিনীটা সবারই কমবেশি জানা, তারপরও কিছুটা শুরু করা যাক ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়’ গ্রন্থটি থেকেই:
“কিন্তু এর ভেতর চলছিল আর এক খেলা। স্বাধীনতা বিরোধী কুখ্যাত দালালদের জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ ডিসেম্বর থেকেই প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল থেকে কুখ্যাত খুনী এবং দালালদের জন্য একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়ায় জেলখানা। কুখ্যাত দালালদের কাছ থেকে সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ১১ হাজার লিখিত আবেদনপত্র পড়েছিল, তাদেরকে জেলখানায় সরিয়ে নেয়ার জন্য। এদের বিচারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার কালক্ষেপণ নীতি গ্রহণ করে।”
একদিক থেকে স্বাধীনতার পর জনরোষে খুন হওয়া থেকে ঘাতকদের রক্ষা করাটা প্রয়োজনীয় ছিল, কেননা রাষ্ট্র খুনীকেও খুন করে না, বিচার করে। এটা রাষ্ট্র হিসেবে তার কার্যকারিতার জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, তাদের জেলখানায় নেয়া হয়েছিল বাঁচিয়ে দেয়ার জন্যই, বিচার করার জন্য না… বরং সরকার তাদের রক্ষায় কালক্ষেপনের নীতি গ্রহণ করেছিল। এর পরে ‘বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ ১৯৭২: ঘাতকদের রক্ষাকবচ’ উপশিরোনামে আমরা দেখি–
“বিভিন্ন মহল থেকে দালালদের বিচারের জন্য সংক্ষিপ্ত আদালতের দাবিকে উপেক্ষা করে ২৪ জানুয়ারি জারি করা হয় ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। দালালদের বিচারের জন্য এই আইনে দুবছরের জেল থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তির বিধান রাখা হয়।” কিন্তু এই আইনটির আসল মতলব ছিল:
“এই আদেশ অনুযায়ী আসামীর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করবার অধিকার থাকলেও ফরিয়াদিকে ট্রাইব্যুনালের বিচার্য অপরাধের জন্য অন্য কোন আদালাতের বিচার প্রার্থনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।’ অর্থাৎ, আদালতের দেয়া শাস্তি পছন্দ না হলে ঘাতক যেতে পারতো ট্রাইব্যুনালে, কিন্তু ফরিয়াদী যদি মনে করতো যথাযথ শাস্তি হয়নি, তার কিছুই করার থাকতো না।
এমনকি, নিহত-ধর্ষিত-আহত-ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ নয়, “আইনের ৭ম ধারায় বলা হয়েছিল, থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি যদি কোন অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারও কথা বিশ্বাস করা হবে না, অন্য কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার হবে না ট্রাইব্যুনালে। অন্য কোন আদালতেও মামলা করা যাবে না। দালালদের আত্মীয়-স্বজনের ওসিকে সন্তুষ্ট করার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, স্বজন হারানো নির্যাতিত দরিদ্র জনসাধারণের তা ছিলো না।” শুধু কিন্তু ওসিকে ঘুষ দিতে পারার সামর্থ্য কিংবা ওসির বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেয়াই লক্ষ্য ছিল না, যদিও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। উপরন্তু আক্রান্তদের বিশালতম অংশটাই ছিলেন দরিদ্র,অন্যদিকে দালালদের শীর্ষস্থানীয়দের বড় অংশটিই ছিল আগে থেকেই ক্ষমতাবান, অভিজাত ও সম্পত্তিবান। ফলে অর্থ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা রাজাকাদের রক্ষায় একটা ভূমিকা পালন করে। সর্বোপরি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বদলে ওসির হাতে এই ক্ষমতার অর্পণ আসলে কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধীকে বিচার করা বা না করার এক তরফা অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে তুলে দেয়, এবং এটাই ছিল মূল লক্ষ্য।
“দালাল আইন কুখ্যাত খুনী দালালদের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা দেয়। যে শান্তি কমিটির মূল কাজ ছিল নিরপরাধ বাঙালীদের হত্যা তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের হত্যার জন্য পাকসেনাকে সহায়তা করা, তার সদস্যরা সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড পেয়ে নিস্তার পেয়ে যায়। শান্তি কমিটির নিজস্ব ঘোষণা অনুযায়ীই এর মূল কাজ ছিল তাদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় চরদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে সেনাবাহিনীর সহায়তা তাদেরকে নির্মূল করা’, সুতরাং যে কোন দালালের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার জন্য তার শান্তি কমিটির সদস্য প্রমাণিত হওয়াই ছিল যথেষ্ট… ( কিন্তু সেখানে) মোট ৩৭ হাজার ৪শ ৭১ জনের মাঝে ২হাজার ৮শ ৪৮ জনের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে দণ্ডপ্রাস্ত হয়েছিল মাত্র ৭শ ৫২জন, বাকি ২হাজার ৯৬জন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়…”
” দালাল আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনালের বিচারও ছিল প্রহসন মাত্র। একটি দৃষ্টান্ত এ প্রসঙ্গে দেয়া যেতে পারে। সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী আলবদরটির বিরুদ্ধে হত্যাতর উদ্দেশ্যে শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণের অভিযোগ সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হ্য়েছিল, কিন্তু তবু তাকে মাত্র ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। গণহত্যার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, ইত্যাদি দলে যোগদানকারী ব্যক্তিদের এইভাবে লঘু শাস্তি দিয়ে কিছু দিনের জন্য কারাগারে রেখে বিক্ষুদ্ধ জনতা এবং তাদের হাতে নির্যাতিতদের রোষাণল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।দালালদের রক্ষার এই ষড়যন্ত্র কুখ্যাত দালালদের তথাকথিত বিচার হওয়ার পূর্বে জনসধারাণের কাছে ধরা পড়েনি। তবে সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রথম থেকেই এই চক্রান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এরপর যখন দেখা গেলো সরাসরি গণহত্যায় নেতৃত্বদান কারী দালালরা নামমাত্র শাস্তি পেয়ে নিষ্কৃতি পাচ্ছে তখন এ ব্যাপারে সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়।”
বোঝাই যাচ্ছে দালাল আ্ইন করা হয়েছিল প্রধাননত দালালদের রক্ষার জন্য, কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সহায় সম্পত্তি নিয়ে আপোষরফা ও তাদের পুনর্বাসনও প্রক্রিয়া হিসেবে চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আ্সে ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমা। “সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যেই মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ, কেন্দ্রীয় শাস্তি কমিটি এবং শান্ততি ও কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলামের নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার চন্ত্রান্তকারী দালালসহ মূল স্বাধীনতা বিরোধিরা জেল থেকে বেরিয়ে আসে।”
এবার গোলাম আজম ও জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গ। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক হিসেবে জামায়াতের ইসলামীর ভূমিকা অন্য যে কারও বেশি ভয়াবহ ছিল। এই জিঘাংষার কারণটি আদর্শিক। জনগণের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তারে এই বুদ্ধিজীবীদের ভুমিকার প্রতি তাদের ক্ষোভই শুধু নয়, নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাতেও প্রগতিশীল ও বামপন্থী চেতনার এই বুদ্ধিজীবীদের বাধার মুখেই তাদের সবচে বেশি পড়তে হয়েছিল। গোলাম আজমই রাও ফরমা আলীর সাথে ৭১ এর সেপ্টেম্বরের দিকে এক বৈঠকে বুদ্ধিজীবী নিধনের নীল নকশা প্রণয়ন করায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী, এই পরিচিতি তাকে জনগণের মাঝে বিশেষ ঘৃনার লক্ষ্যববস্তুতে পরিনত করেছিল সঙ্গতকারণেই।
মুক্তিবাহিনী যখন ঢাকার উপকণ্ঠে, গোলাম আজম এবং মাওলানা আবদুর রহীম পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে যোগ দেয়ার নাম করে। সেখানে থেকেও তাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী তৎপরতা অব্যহত থাকে। ৭৩ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর মালেক মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গ মুক্তি পায়, মুক্তি পায় আব্বাস আলী খান এর মত জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম আরেকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা, শাহ আজিজুর রহমানসহ প্রধান প্রধান ঘাতক ও সহযোগীরা।
গোলাম আজম যতখনও দেশে ফিরে আসার সাহস না করলেও জামায়াতের অপর শীর্ষ নেতা মাওলানা আবদুর রহীম সৌদী আরব থেকে বাংলাদেশে আসেন সাধরণ ক্ষমা ঘোষণার পরপরই। সরকার রাজাকারদের তোষণ করে চললেও সাধারণ জনগণের মাঝে তাদের প্রতি যে তীব্র ঘৃণা ছিল, তার কারণে তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করতে না পারলেও গোপনে সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। শাস্তি তো দূরের কথা, সরকারী ছত্রছায়ায় রক্তস্নাত বাংললায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত পথে যাত্রা।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে রাজকারদের প্রতিষ্ঠায় আরও বেশ খানিকটা অগ্রসর হলেন। তিনি শাহ আজিজুরর রহমানের মত রাজাকারকে শুধু নয়, আবদুল আলীমের মত কুখ্যাত খুনী যুদ্ধাপরাধীকেও মন্ত্রীত্বে আসীন করেন। ইতিমধ্যেই অকার্যকর হয়ে যাওয়া দালাল আইনটি জিয়াউর রহমানের উর্দি শাসনের জোরে রদ হয়, বিচারের জন্য অপেক্ষমান যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তি পায়।
বলা যায় যে, তাদের বড় অংশের জন্য নিরাপদ পরিবেশ রাষ্ট্র ও সমাজে ইতিমধ্যেই অনেকখানি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। গোলাম আজম ইতিবাচক সময় বুঝে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলেও এটা যে জিয়ার মত রাজাকারতোষকের জন্যও বিপদজনক হবে, বোধকরি সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে ১৯৭৮ সালে তার সেই আবেদন বাতিল হয়। কিন্তু অসুস্থ মাকে দেখার নামে ৭৮ সালে গোলাম আজমের ঢাকায় আগমন ঘটলো। মানবিক কারণে তিন মাসের ভিসা নিয়ে ফেরত আসার পর তাকে কেন্দ্র করেই জাময়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃতিক মিত্র বিএনপি। যুদ্ধাপরাধীদের একটা বড় অংশ ছিল পাকিস্তান আমলে যাদের খাজা-গজা বলা হতো, সেই অভিজাত মুসলিম লীগাররা। এদের বড় অংশ পরবর্তীতে রেহাই পাবার পর বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের আরেকটা বড় অংশ ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। এই দুই অংশের মাঝে কিছু প্রভেদ থাকলেও ৭১ এর চরম মূহুর্তগুলোতে তারা অভেদাত্মা হিসেবে পাকিস্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আবার অন্যদিকে, ৭১ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী নেতৃত্ব যেভাবে তাদের উভয়কেই রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, সেটাও শ্রেনীগত নৈকট্যের কারণেই।
এর পরও জামায়াতে ইসলামী ও গোলাম আজম উভয়ের জন্যই খুব সহজ হয়নি প্রতিষ্ঠিত হওয়াটি। ৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটা জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে মুসুল্লিদের জুতোর বাড়ি খান তিনি, তার পর থেকে বলা যায় প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বর্জনের কৌশল নিতে হয় তাকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একটা বড় ইস্যু ছিল গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে স্বীকৃতি না দেয়ার প্রশ্নটি। কিন্তু ৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে সামরিক শাসকটি শুধু বৈধতা পায়নি, জামায়াতও রাজনৈতিক বৈধতা পায়। তখন জামায়াতের কাছে এটা ছিল বিশাল অর্জন। একে একে বেশ কয়েকটি ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলে তারা, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখলে নেয়। ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে সামাজিক বুনিয়াদ শক্তিশালী করে। ৯১ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সমর্থন চায়, জামায়াত অবশ্য তার প্রাকৃতিক মিত্র বিএনপিকে সমর্থন দেয় সরকার গঠনে। আদালতের রায়ে গোলাম আজম নাগরিকত্ব ফিরে পেলেও জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে তারা প্রায় কোনঠাসা অবস্থায় পতিত হয়। কিন্তু দ্রুতই এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে যৌথ আন্দোলনে তারা নিজেদের সামলে নেয়। কৃতজ্ঞ আওয়ামী লীগ তাদের সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তাব দিলেও তারা দূরত্ব বজায় রাখে।
কিন্তু শাসক দলগুলোর ওপর মহলে এই ধরনের আঁতাতের পরও জগণের মাঝে, আওয়ামী লিগের কর্মীদের মাঝে বটেই, এমনকি বিএনপির সাধারণ কর্মীদের একাংশে মাঝেও তাদের প্রতি যে একটা প্রতিরোধ ছিল, সেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দখল কায়েম করার চেষ্টার প্রতিহত করার আন্দোলনেও দেখা গিয়েছিল। সর্বশেষ শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানেও বিশেষ করে তরুণদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল সুষ্পষ্ট।
বাংলাদেশে সাধারণত সরকারের তৎপরতা বিষয়ে জনগণের সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাস্তবায়িত হয়। গুজব ও ফিসফাসই সত্যি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সরকারের আশ্বাস কোন কালেই বাস্তবায়িত হয়নি, যতক্ষণ না তার জন্য মানুষ রাস্তায় নামে। বাংলাদেশের লুটেরা দলগুলোর মাঝে আওয়ামী লিগ সন্দেহাতীতভাবেই সবচে শক্তিশালী, দৃঢ়ভিত্তি সম্পন্ন। একদিকে তার আছে ঝোলায় আছে সাচ্চা হেফাজতী অন্যদিকে কতিপয় পাকা বাম। মদীনা সনদ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ঝাণ্ডা, যে কোন অস্ত্র ব্যবহারের সামর্থ্য তার আছে। তার শক্তি এমনই বেশি যে, শিক্ষিত মানুষ জনেরও অনেকে তাকে বামপন্থী ভেবেই মোহগ্রস্ত থাকেন। কেউ যদি গাণিতিকি নিয়মে আঁক কষেণ যে, সাবেক কয়েকজন বাম আর বর্তমান ডান মিলে ভাগ কষে মধ্যপন্থা আসে, সেটাও নিছকই ভুল হিসেবে। বরং বলা উচিত যে, ওই সাবেক বাম পরিচয়কে ব্যবহার করেই ডানপন্থীরা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।
গোলাম আজম বাড়িতে মারা যাননি, কিন্তু যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার ফাঁসি হওয়া খুবই ন্যায়সঙ্গত, যে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের রাজনীতির মূলোৎপাটন ৭২ সালেই হয়ে যাওয়া কর্তব্য ছিল, তাই বাংলাদেশের রাজনীতিকে এত বিপুলভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, এটা জনণের জন্য বিরাট পরাজয় বটেই। একদিকে শাসকদের বেইমানী ও প্রতারণার কারণেই এটা ঘটা সম্ভব হয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী সাংস্কৃতিক আয়োজন এ্টই সত্যটাও মানুষকে ভুলিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করে চলেছে।যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান নায়ক গোলাম আজমের জানাজাতে লোকসংখ্যা গুনে তাই হতোদ্যম হবার কিছু নেই। এই তাদের সর্বোচ্চ। কিন্তু আজকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার পক্ষের শক্তিগুলো অনেকখানি ছত্রভঙ্গ থাকলেও, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে চাইলে এই ইতিহাস ভুলে যাওয়া তাদের চলবে না। রাষ্ট্রীয় পাহারায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সখানে জুতো নিক্ষেপ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত একজন কর্মী। এই ঘৃনার প্রতীকী মূল্য অপরিসীম, কিন্তু রাষ্ট্রের যে পাহারা ঘাতকদের রক্ষা করে চলেছে, তাকে প্রতিহত করার শক্তি অর্জন না করা গেলে এই প্রতীকী মূল্য বাস্তবে রূপায়িত হবে না।
এ প্রসঙ্গে আর একটি পুরনো লেখা
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন যথাসময়ে হয়নি, এই প্রশ্নটা যে কারণে জরুরি
(২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে ফেসবুকে প্রকাশিত ফিরোজ আহমেদের নোট)
“পান্না কায়সার বলেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোন নেতা যুদ্ধে আপনজন হারাননি। ফলে স্বজন হারানোর ব্যাথা তাদের জানা ছিল না। ঘাতকদের তারা সহজেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন। তাই আজ খালেকের মত ঘাতকরা বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে এববং নতুন হত্যার ইন্ধন যোগাচ্ছে। আমার মেয়ে যখন ঘাতক খালেকের বই পড়ে নানা প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দিতে পারি না…
শহীদ ডাক্তার মর্তুজার স্ত্রী মিসেস মর্তুজা বলেন, যাদের প্রাণ গেছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনই বুঝতে পেরেছেন, শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমার মর্ম।…
শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেনের জৈষ্ঠ্যপুত্র শাহীন রেজা বলেন, শুধু ষাধারণ ক্ষমা নয়, এর আগে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সুকৌশলে রেহাই দেয়া হয়। অথচ যাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের কোন প্রমাণ ছিল না, তাদেরকে জেলে ঢোকানো হয়। এছাড়াও যারা হত্যার মূল পরিকল্পনা করেছিল তারাও অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় সকল দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এ রকম প্রহসনমূলক বিচারের পর আবার আসলো সাধারণ ক্ষমা।”
উপরের উদ্ধৃতি তিনটি সাম্প্রতিককালের না, আশির দশকের শেষের। আজ আর এদের অনেকেই এই সুরে কথা বলবেন না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ভিন্ন বয়ানগুলোর অধিকারীদের অনেকেই এভাবে আওয়ামী রাজনীতির বলয়ে একাকার হয়ে মুখ বন্ধ করছেন, কেউ কেউ মৃদুস্বরে ঘরোয়া চায়ের টেবিলেই ঘাতকদের ছাড়া পাবার ইতিহাসটা ফিসফিসিয়ে বলছেন। এদের কাউ্কে কাউকে কিনে নিয়েছে স্বার্থ, কেউ কেউ মতাদর্শিকভাবেই আশ্রয় নিয়েছেন আও্য়ামী শিবিরে। এই তিনটি অনুভূতির মত আরও অজস্র প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা আছে ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ নামের গ্রন্থটিতে। এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সেকটর কমান্ডার কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবীর আর আহমদ শরীফ। গ্রন্থটিতে নির্মোহ ভাবে দেখানো হয়েছে কিভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার এদেরকে রক্ষা করেছে, সমাজে নতুন করে প্রতিপত্তি বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে; জিয়াউর রহমানের সরকার রক্ষাপাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছে মন্ত্রী করে; এবং এরশাদ সরকার রাজাকারদের সুস্পষ্ট কর্তৃত্ব কায়েম করেছে সমাজে রাষ্ট্রে। বলা উচিত যে, কেউ যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণশত্রুদের আঁতাতের ইতিহাস লিখতে চান ভবিষ্যতের কোন কালে, তাদের জন্য আকরগ্রন্থ হবে এই বইটি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আওয়ামী মনোভাবসম্পন্ন বহু মানুষের সত্যিকারের আবেগ থাকার পরও এটা পরিস্কার থাকা প্রয়োজন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগই প্রথম তাদের সুরক্ষা দিয়েছিল, যদিও এর আগে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তাদের বিচারের ওয়াদা করেছিলেন। পরবর্তীতে সামরিক শাসকেরা এই কাজেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। কিন্তু কেন আওয়ামী লিগ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করেছিলো? এর কি ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে?
খেয়াল করলে দেখা যাবে আওয়ামী লিগ যখন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছিল ও্ই একই সময়ে ওই দলের কর্মীদের হাতে, পুলিশের হাতে এবং রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এদের একটা বড় অংশ সদ্য আওয়ামী লিগ ছেড়ে জাসদ করেছিলেন সরকারের বেপরোয়া লুণ্ঠন, সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে। খুব দ্রুতই সরকার যে অজনপ্রিয়ও হয়ে পরে, তার নমুনা পাওয়া যাবে দলে দলে তরুণদের বামপন্থী নানান সংগঠনে অংশ নেয়া থেকে, সদ্যস্বাধীন দেশে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র লীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলের ভরাডুবি থেকে। সেই ভরাডুবি এড়াতে ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যলট ছিনতাই, প্রথম নির্বাচনী কারচুপি। তরুণদের এই অংশগ্রহণ ঘটছিল কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখনও ছিল তরতাজা, আর ফলে প্রতারিতের বঞ্চনাবোধটিও ছিল শক্তিশালী। গৃহপালিত যে বামপন্থী দুটি দল সরকারের সাথে তখন ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করাসহ সরকারের এই কাজগুলোর কোন কার্যকর সমালোচনা তারা কখনোই করেনি। কিন্তু তারাও খুব সুবিধা পায়নি, আওয়ামী লীগারদের হিন্দুসম্পত্তি লুণ্ঠনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেবু ভাই, তার খুনি হেমায়েত পান রাষ্ট্রীয় পদক। দলের কার্যালয়ে আগুন দিয়ে, চরম নির্যাতন করে তাদেরকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা হয় মতিউল কাদেরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায়।
একদিকে যারা ছিল ঘাতক-দালাল, তাদের সুরক্ষা প্রদান, অন্যদিকে নিজ দল এবং দলের বাইরের দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষদের ওপর অকল্পনীয় নিপীড়ন, এর ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে আওয়ামী লীগের শ্রেণীচরিত্রের মাঝেই। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ছিল উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় বিকাশের উপযুক্ত একটি রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি গড়ে তোলা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা যখন লুণ্ঠনের, হিন্দুসম্পত্তি দখলের এবং দুর্নীতি-মজুদদারীর মাধ্যমে দেশটাকে দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত করলো, লুটপাটের সুবিধার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতাকেও তারা ক্রমাগত একচেটিয়াকরণ করতে থাকলো; মুক্তিযোদ্ধা তরুণদের বিপুলাংশ সঙ্গতকারণেই তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা অজনপ্রিয় হলেও তাদের পারিবারিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য প্রভাব ছিল যথেষ্ট।ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল শক্তিগুলোর উত্থানকে মোকাবেলা করতে চাইছিল পরাজিত শক্তিগুলোকে ব্যবহার করে। তাজউদ্দীনরা তাই বাতিল হন, মোশতাকরা সামনে আসতে থাকেন।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধীরাও বসে থাকেনি, গোপনে সব কিছু গুছিয়ে আনা চলে। শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে যতই সদয় হোন না কেন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি, তাদের কাছে তিনি ছিলেন তাদের পরাজয় ও বাংলাদেশের জন্মের জন্য দায়ী ব্যক্তি। হুঁশহারা লুটপাটে মত্ত আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের দমন করতে করতে আসলে রাজনৈতিকভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জনগণ থেকে, এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের মর্মান্তিকতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ হয় ক্ষমতা থেকে।
শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সাথে জিয়াউর রহমানের সরকারের পার্থক্য একটা জায়গায়তেই, সেটা হলো ৭৫ সাল নাগাদ যুদ্ধাপরাধীরা অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে তাদের প্রভাব বলয়। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার সাথে আওয়ামী লীগের বৈঈমানীর কারণে, দুর্ভিক্ষের ধাক্কায় জনগণ কিছুটা নিস্পৃহভরেই দেখে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় রাজাকারদের ঠাঁই হওয়া। বহু মুক্তিযোদ্ধা নামধারী যখন সামরিক সরকারগুলোর সাথে আঁতাত করে ব্যক্তিগত সম্পদ বানিয়ে নিচ্ছেন, বহুজন যখন হতাশ আর ছত্রভঙ্গ কাজী নুরুজ্জামানসহ আরও বহু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আগলে রেখেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দেশজুড়ে সফর করেছেন, সংগঠন গড়ে তুলেছেন। জাহানারা ইমামের আন্দোলন আসলেই শূণ্য থেকে আবির্ভূত হয়নি, তার পেছেন আছে এই সব সংগ্রামী মানুষের অক্লান্ত অধ্যাবসায়।
বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ নামের বাংলাদেশের লুটেরাদের তিনটি প্রধান দলের শেষ দুটির সম্পর্ককে আঁতাত ছাড়া আর কি বলার আছে? আঁতাত তো তখনই করতে হয়, বাইরে যখন শত্রুতার মুখোশ থাকে? বোঝাপড়াপূর্ণ শত্রুতা থেকে সকলেই লাভবান হতে পারে, একপক্ষ গণরোষ থেকে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সুযোগ পায়, অন্যপক্ষ পায় বাড়তি কিছু হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ। বিএনপি-জামাতের সম্পর্ক বরং কিছুটা সমঝোতামূলক, যেমনটা আওয়ামী লীগের সাথে প্রায়শঃই সিপিবির। কিন্তু এই সমঝোতা সাদৃশ্য সত্ত্বেও ৮৬ সালে জামায়াতের সাথে মিলে এরশাদের নির্বাচনে যাওয়া কিংবা ৯০ পরবর্তীতে জামায়াতের সাথে যৌথভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করায় তাদের কোন অসুবিধা হয়নি।
কামাল পাশাদের অভিযোগ ইমরান সরকার সরকার বিরোধী। ইমরান সরকাররা বলছেন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর আজকের আওয়ামী লীগ আলাদা। কামাল পাশা সম্ভবত এই একটি মাত্র আপাত-সত্য কথা বলেছেন, অন্যপক্ষের দাবিটা সর্বাংশে ভুল। সকল বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়েই আজকের আওয়ামী লীগ অতীতের ধারাবাহিকতা। শুধু তাই নয়, অতীতের তুলনায় বরং মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় ভিন্নস্বরকে গায়েব করে দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাশূন্য, যদিও ততটা শক্তিশালি না। যে কোন সময়ের তুলনায় লাগামহীন লুণ্ঠন আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচ্ছেদ তাকে ভেতর থেকে ক্ষয়ে এনেছে। এখন এদের প্রবীণরাও দলের প্রধানতম ব্যক্তির কাছ থেকে ‘ক্রয়যোগ্য’ এই সম্বোধনেও অভ্যস্ত। কামাল পাশার বক্তব্যটিও আপাত-সত্য, পুরো সত্যি না। কারণ সুন্দরবন-ফুলবাড়ি-কুইক রেন্টাল-হলমার্ক-গার্মেন্ট শ্রমিক-তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎসহ যাবতীয় প্রসঙ্গকে উধাও করে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ায় রাজনীতি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বলয়কেই শক্তিশালী করেছে, করবে। ওই বিচারে আজকে যারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আও্য়অমী লীগকে আলাদা বলছেন, অতীতের প্রতি তাদের ভুল মোহ অচিরেই আওয়ামী বলয়েই তাদের আবারো নিক্ষেপ করবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদিপাপ। ১৯৭১ সালে যতটা, আজকেও যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের মানুষের ততটাই শত্রু। এই বিচারহীনতার ফলে সমাজে, রাজনীতিতে, নারীর অগ্রসরতায়, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে যতভাবে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, সেটা করা সম্ভবই হতো না যদি ৭২ সালেই যথাসম্ভব দ্রুত তাদের শীর্ষস্থানীয়দের যথাযথ বিচার করা হতো। জামায়াতী সাহিত্য দেখলে বোঝা যাবে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে তারা গণ্য করে প্রগতিশীল শক্তিকে, আর আওয়ামী লিগকেও তারা এই প্রগতিশীল কাতারেই চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ অন্যদিকে তার লুণ্ঠনকে আড়াল করার চেষ্টা করে তার বিরোধী সকলকে স্বাধীনতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু ওই লুণ্ঠনের জায়গাতেই এই তিন দলের কোন ভেদাভেদ নেই। তাদের এই পারস্পরিক বোঝাপড়ার মিথোজীবীতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ আবর্তিত হচ্ছে লুণ্ঠনের রাজনীতি-অর্থনীতি।
বাংলাদেশের গণমানুষের, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি বিকশিত হতে পারবে না যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে প্রতারণা যতবার করলো যুদ্ধারপরাধের বিচারের প্রশ্নে, তাতে বোঝা যায় তাদের শ্রেণীগত আঁতাত এত শক্তিশালী যে, জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ছাড়া ঘাতকদের যথাযথ বিচার আদায় করা সম্ভব না। যে জনসমর্থন আওয়ামী লীগ হারালো, তাকে আবারো কিছুটা ফেরত আনার জন্য তারা নিশ্চয়ই জামাতের সাথে সামনের দরকষাকষিতে কিছুটা শক্ত হবে, কিংবা হয়তো জামায়াতই আরও খানিকটা বেশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মিত্রতার নিশ্চয়তা দিয়ে ক্ষতিটা আরেকভাবে পুষিয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু যাই ঘটুক, আওয়ামী প্রচারবিদরা যখন মুখে কুলুপ এঁটেছেন, মোহাভঙ্গ হওয়া আমাদের তরুণরা নিশ্চিতভাবেই জীবনের শিক্ষাটা গ্রহণ করবেন: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটা কেবল আইনী প্রশ্ন না, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতির যাবতীয় আশাভঙ্গের সাথে তার গভীর সম্পর্ক আছে। ইতিহাসের মীমাংসা না করে আমরা আগাতে পারবো না বলেই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই বলেই, বিচার কেন যথাযথ সময়ে হয়নি, সেই প্রশ্নটি না তুলেও তাই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার আলোতে আমরা হাঁটতে পারবো না, পারবো না বিচারের কাজটি সমাধা করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে।
ফিরোজ আহমেদ
সদস্য,রাজনৈতিক পরিষদ
গনসংহতি আন্দোলন