২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় গণসংহতি আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে বক্তরা
জোনায়েদ সাকি
জবাবদিহীতাহীন কতিপয় লুটেরা ও দুর্নিতীবাজদের স্বার্থে এ বাজেট
আজ ৫ জুন ২০২১, শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় গণসংহতি আন্দোলনের উদ্যোগে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এক সংবাদ সম্মেলন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন দলের প্রধান সমন্বয়কারী জননেতা জোনায়েদ সাকি। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য তাসলিমা আখতার, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য মনির উদ্দীন পাপ্পুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে জোনায়েদ সাকি বলেন, বাজেট নিছক আয়-ব্যায়ের হিসাব নয়, বাজেটের মধ্যে যে নীতির প্রতিফলন ঘটে সে নীতিটা আমাদের বিবেচনায় নেয়া দরকার। আমাদের দেখা দরকার নীতির পেছনে কি আছে? বিদ্যমান নীতিতে দেখা যাবে সরকার বাজেটে কোথাও কম বেশি বরাদ্দ বাড়িয়েছে, কিম্বা কমিয়েছে। এই বরাদ্দ বাড়ানো কিম্বা কমানোর মধ্যে বাস্তবে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। মুদ্রাস্ফিতির সাথে এর সম্পর্ক থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকার অংকের ক্ষেত্রে হয়তো বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় বটে, কিন্তু এই বরাদ্দকৃত টাকা ব্যায়ের যে একটা জবাবদিহীতার জায়গা আছে সেটা উল্লেখ বাজেটে থাকে না। যেমন স্বাস্থ্য খাতে এবারও থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই, স্বাস্থ্যখাতের কোন কোন বিষয়ে তারা অগ্রাধিকার দিবে। এই অগ্রাধীকার সুনির্দিষ্ট না থাকার ফলে ব্যায় কিভাবে হবে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে না। ফলে বিভিন্ন ক্রয় খাত থাকে, সেখানে বিভিন্ন লবিষ্ট গ্রুপের প্রকল্প নিয়ে হাজির হয় এবং সেখানে দুর্নিতির নহর বয়ে যায়।
এরকম দুর্যোগের মধ্যে সরকারের যে নীতি থাকা দরকার, অপ্রয়োজনীয় এবং অনুৎপাদনশীল ব্যায় কমানো অন্যদিকে বিনিয়োগ অর্থাৎ যে বিনিয়োগে জনগণের হাতে টাকা পৌছাবে সেটার পরিকল্পনা থাকা দরকার। সরকারের ব্যায়ের খাতকে জবাবদিহীর আওতায় আনতে হবে যেমন জনপ্রশাসনের ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট জবাবদিহীতার আওতায় আনা দরকার। মানুষের দুর্দশাকে পুজি করে দুর্নিতি লুটপাট করার সকল পথ যেনো বন্ধ থাকে সেরকম বাজেটই জনগণের দরকার। আর সেজন্য দরকার বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর। আমরা রাষ্ট্রের এই গণতান্ত্রিকর রূপান্তরে লড়াই চালিয়ে যাবো।
নিচে বাজেটে লিখিত বক্তব্যটি সংযুক্ত করা হলো
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
গণসংহতি আন্দোলনের ডাকে এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হবার জন্য আপনাদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। আপনারা জানেন গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশে যেকোন বিষয়ে পর্যালোচনামূলক মতপ্রকাশ করাটা প্রায় অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ সরকার কারও কথায় কান দেয় না, এবং সমালোচনাকে একটা অপরাধ হিসাবে গণ্য করে। ফলে তাদের পরামর্শ দান একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশ ও জনগণের স্বার্থে আমরা বর্তমান বাজেটের কিছু পর্যালোচনা হাজির করছি যা এই লুন্ঠনভিত্তিক অর্থনীতির গণবিরোধী চরিত্রকে উন্মোচন করে জনগণের সংগ্রামকে শানিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বাজেট ২০২১-২২: সর্বজনের চাহিদার প্রতি অসংবেদনশীলতার দলিল
গত এক দশক ধরে অবিমৃষ্যকারি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আর্থিক নীতি প্রণয়নের যে ধারা বাংলাদেশে চালু হয়েছে এবারের বাজেট প্রস্তাব তার ব্যতিক্রম হবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। তবুও চলমান করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি যে নাজুক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এবং বৃহত্তর জনগণকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে বাজেট প্রণয়নের গতানুগতিকতা থেকে বের হয়ে আসার একটা ন্যূনতম চেষ্টা আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে থাকবে বলে অনেকে আশা করেছিলেন। বলা বাহুল্য তারা হতাশ হয়েছেন। স্বাস্থ্যখাত পুনর্গঠনের উদ্যোগের নূন্যতম কোন ছাপ বর্তমান বাজেটে নাই। তেমনি নাই করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, কিংবা নতুন করে দারিদ্রে প্রবেশ করা জনগোষ্ঠীর সংকট উত্তরণের কোন পরিকল্পনা। বর্তমান সরকার শুরু থেকেই বৃহত্তর জনস্বার্থকে অবজ্ঞা করে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠির স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছেন। মহামারি কালের এই দ্বিতীয় বাজেটে তা আরও প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। কাজেই প্রস্তাবিত বাজেটকে সর্বজনের চাহিদার প্রতি সরকারের অসংবেদনশীলতার দলিল বলা যায়।
স্বাস্থ্যে বরাদ্দ: উপেক্ষা করা হয়েছে সকল দাবি ও পরামর্শ
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিটি অর্থবছরে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ অল্প করে বাড়লেও মোট বাজেটের বরাদ্দ হিসেবে স্বাস্থ্যের বরাদ্দ থেকে গেছে ৫ শতাংশের আশে পাশে। ফলে মোট জাতীয় আয়ের যে অংশ স্বাস্থ্যে পেছনে ব্যয় হয় সে বিচারে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় (আফগানিস্তানসহ) বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। করোনা পরিস্থিতি নতুন করে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলো সামনে এনেছে। সকল মহল থেকে এ খাতকে ঢেলে সাজাবার দাবি ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য বরাদ্দ হয়েছে ৫.৪ শতাংশ, যা জিডিপির ১ শতাংশের কাছাকাছি। অথচ স্বাভাবিক সময়েও জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকা হলো আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত মান। বরাবরের মতই জনগণের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যয় ব্যক্তির ঘাড়েই রাখা হয়েছে, উল্লেখ্য বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যক্তি ব্যয় হলো ৬৭ ভাগ আর সরকারি ব্যয় হলো ৩৩ ভাগ। অথচ হবার কথা ছিলো ঠিক উল্টোটা। স্বাস্থ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই গতানুগতিকতা তাই হতাশ করেছে বললে কম বলা হয়, এটা সংক্ষুদ্ধ হওয়ার মতো। সর্বজনের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে এ সরকার প্রচন্ড রকম বেপরোয়া তা এখানে খুবই স্পষ্ট।
মহামারি মোকাবেলার জন্য আসন্ন অর্থবছরেও চলতি বছরের মতো দশ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনার মধ্যে প্রথম বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখাকে প্রাথমিক ধাক্কার অপ্রস্তুত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা গিয়েছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় বাজেটে এসেও যখন সুনির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ দেয়ার বদলে থোক বরাদ্দ দেয়া হয় তখন স্পষ্টই বোঝা যায় যে, ব্যয়ের যথাযথ পরিকল্পনার বদলে যখন যেমন সুবিধা সেভাবে ব্যয় করার বিষয়েই সরকারের আগ্রহ বেশি, যা দুর্নীতিকেই সাদরে স্বাগত জানায়। স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে সার্বিক পরিকল্পনা দরকার সেটা না করে ও তাকে জবাবদিহিতার আওতায় না এনে এ ধরনের বরাদ্দ হয় দুর্নীতি বাড়াবে, না হয় বরাদ্দ অব্যবহৃত থেকে যাবে। করোনার টিকা কেনার ক্ষেত্রে আমরা এর মধ্যেই সরকারের এহেন অবিমৃষ্যকারিতার ফল ভোগ করছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যদি আরও প্রবল হয়, কিংবা তৃতীয় ঢেউ যদি আমাদের মোকাবেলা করতে হয় সেক্ষেত্রে এই পরিকল্পনাহীনতার চরম মাসুল দিতে হবে।
শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দের মিথ্যা গৌরব আছে, ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা নেই
ইদানিং জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া নিয়ে সরকারের তরফ থেকে গৌরব করা হলেও তার মধ্যে বড় ফাঁকি আছে। এবারের বাজেটেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। ৯৫ হাজার কোটি টাকার যে বরাদ্দের কথা বলা হচ্ছে তা মোট বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে এই বরাদ্দ এককভাবে শিক্ষায় নয়, এর সঙ্গে প্রযুক্তিতে বরাদ্দও রয়েছে। শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়- অর্থাৎ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫৯ হাজার কোটি টাকার কম। গুণগত পরিবর্তন বিশেষত দেড় বছরের মতো শিক্ষা কার্যক্রম এক রকম বন্ধ থাকার যে নেতিবাচক প্রভাব তা কাটিয়ে ওঠার কোন নির্দেশনা বা পথনকশা প্রস্তাবিত বাজেটে অনুপস্থিত। উপরন্তু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫% ভ্যাট আরোপ করে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণের ধারাবাহিকতাই অব্যাহত আছে। যাকিনা এই মহামারী কালে শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের গণবিরোধী চরিত্রকে আরো স্পষ্ট করে। করোনার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম সামনে আর কতোটা বাধাগ্রস্ত হবে তা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। কাজেই সরাসরি শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নেয়া বা পরীক্ষা নেয়ার জন্য সামনের দিনেও ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণে যে ধরনের মনোযোগ দরকার তা বাজেটে দেখা যাচ্ছে না। এমন কি সরকারের অষ্টম প বার্ষিকী পরিকল্পনাও বিষয়টিকে এক রকম উপেক্ষাই করেছে। বিশেষত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য নয় এমন এলাকার শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিক্ষা কার্যক্রমে সহজে অংশ নিতে পারে সে বিষয়ে কোন ভাবনা সরকারের রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
গতানুগতিকতার কবলে কৃষি বাজেটও
বাজেট প্রস্তাবে বাস্তব বিমুখতার আরেকটি উদাহরণ হতে পারে কৃষি খাতের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় যে বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছিলো তার প্রতিক্রিয়ায় শস্য বীমা চালু করার ঘোষণা ছিল চলতি বছরের বাজেটে। এবারের বাজেটে তা নিয়ে নতুন কিছু জানা যায়নি। শস্য বীমা নিয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে সেগুলো থেকে নেতিবাচক ফলাফলই পাওয়া গেছে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা, ধান সংরক্ষণ করার জন্য নতুন গুদাম তৈরির বরাদ্দ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রত্যাশিত ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কোনটিই দেখা যায়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। কৃষির বরাদ্দ বেড়েছে ৬ শতাংশের মতো। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আসন্ন বছরের প্রস্তাবিত বাজেটও সেই ৬ শতাংশই বেড়েছে। এই গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই দরকারি। কারণ নগরা লের নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষত অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত মানুষদের একটি বড় অংশ এখন টিকে থাকার জন্য গ্রামের কৃষির ওপর নির্ভর করছেন। অনেকে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থায় কৃষি নিয়ে আলাদা করে ভাবা দরকার। গ্রামে ফেরা এই মানুষদের অন্তত একটি অংশ যেন গ্রামেই থেকে যেতে পারেন তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে নতুন কর্মসূচি প্রয়োজন। বাজেটে এমন কোন কর্মসূচি থাকা তো দূরের কথা, এই বাস্তবতাটুকু স্বীকারও করা হয়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা খাত উপেক্ষিত থাকছে মহামারির মধ্যেও!
করোনাজনিত অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় বিপন্ন প্রান্তিক মানুষকে রক্ষা করতে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদার করা প্রত্যাশিত। সরকারের তরফ থেকেও এ নিয়ে বড় বড় কথা শোনা গেছে। সবচেয়ে উদার হিসাব অনুসারেও দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস কারি মানুষের অনুপাত মহামারির আগের ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হয়েছে অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে (কোন কোন সংস্থার অনুসন্ধান বলছে তা পৌঁছেছে ৪০ শতাংশে)। অথচ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ চলতি বছরের প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা থেকে সামান্য বেড়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৮ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দ বৃদ্ধির এই অপ্রতুলতা ছাড়াও আমাদের মনে রাখতে হবে এই বরাদ্দেরও একটি বড় অংশ আসলে বিপন্ন মানুষদের কাছে যাচ্ছে না। এই অপ্রতুল বরাদ্দেরও এক-চতুর্থাংশের বেশি (প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা) যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পেনশনে।
দুর্যোগের মধ্যেও মেগাপ্রকল্পের বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং জনপ্রশাসনের পেছনে ব্যয়ের চাপ গণবিরোধিতারই প্রকাশ
পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ১২ শতাংশ। জ্বালানি ও বিদ্যুতে ৪.৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে এ দুই খাতের বড় প্রকল্পগুলোতে কিছুটা কাটছাট করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানোটিই প্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু সরকার আর সব জায়গার মতো এখানেও হাঁটছে জনপ্রত্যাশার বিপরীতে। এর পেছনে সম্ভবত কাজ করেছে বড় প্রকল্পে বড় দূর্নীতির সুযোগ থাকা। এই বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় প্রতি বছরই বাড়ে। আর প্রকল্পের কেনাকাটায় পুকুর চুরি তো এখন সর্বজনবিদিত। সম্ভবত এ সরকারের সব চেয়ে পছন্দের এবং সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্প হলো পদ্মা সেতু প্রকল্প। ২০১৯-এ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন শোনা যাচ্ছে ২০২২ সালের আগে এই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলা শুরু করছে না। এদিকে ইতোমধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৩ গুন বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এ ব্যয়ের পরিমাণ আরও কয়েক দফায় বাড়লে অবাক হবার কিছু নেই। সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া এই প্রকল্পের অবস্থা দেখেই অপরাপর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
রাজস্ব আয়ের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা এবং বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তোষণের কর নীতি
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আগামী অর্থবছরে প্রায় ৩ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার এ পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করতে পারবে না এটা সরকারের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা দেখলেই বোঝা যায়। চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও ৩ লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটিতে নেমে এসেছে। প্রকৃত অর্থে রাজস্ব আহরিত হবে এরচেয়েও অনেক কম। সরকারের রাজস্ব আয় নির্ভর করে প্রধানত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর আহরিত করের ওপর। আগামী অর্থবছরের যে পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে এনবিআর এর সক্ষমতা বৃদ্ধির এমন কোন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। ফলে এনবিআর আগামী অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম কর আহরণ করবে এমন সন্দেহ করা অমূলক নয়।
প্রস্তাব অনুসারে আসন্ন অর্থবছরে এনবিআর কর আদায় করবে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ২৮ হাজার কোটি টাকা (অর্থাৎ ৩৯ শতাংশ) আসবে মূল্য সংযোজন কর থেকে। আমরা আগেও বলেছি বাজেটে সরকারি আয়ের জন্য ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে তুলনামূলক নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ে বেশি। এই ধারাবাহিকতা এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাজেটের কর প্রস্তাব থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকার তার করনীতি দিয়ে মূলত কতিপয় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মহলকেই সন্তুষ্ট করতে চাইছে। সাধারণ মানুষের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। নন-লিস্টেড বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর কর এক দশক আগেও ৩৭.৫ শতাংশ ছিল। ধারবাহিকভাবে এ হার কমিয়ে আসন্ন অর্থবছরের জন্য ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। একই ধারায় অন্যান্য বড় ব্যবসার জন্যও নানা রকম কর ছাড়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অসংখ্য ছোট বিনিয়োগকারী যে পথে বসেছে তাদের জন্য কোন উত্তরণ পরিকল্পনা নাই। বলা হচ্ছে এদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর এতে করে কমবে ঠিকই, কিন্তু এরা আরও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। এই দাবিটির অসারতা সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেই মেলে। চলতি বছরের বাজেটেও এমন কর ছাড় দেয়া হয়েছিল। তাতে বিনিয়োগ ওই অর্থে বাড়েনি। কর্মসংস্থানও হয়নি।
কর প্রস্তাবে সাধারণ মানুষের কথা সেভাবে ভাবা হয়নি। মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সেবাদানকারীদের ওপর যে ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ করপোরেট কর আরোপ করা হয়েছে তার চাপ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়বে গ্রাহকদের ওপর। অথচ দুর্যোগ কালে এই সেবাগুলোর ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। একই রকম অবিমৃষ্যকারিতা দেখানো হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আরোপিত করের ক্ষেত্রে। দুর্যোগকালে চাপে থাকা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় কর কমালে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারগুলোর ওপর চাপ কিছুটা কমতো।
সাধারণভাবে বাজেট প্রস্তাবে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বৃদ্ধি না করেই বিপুল পরিমাণ কর আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চাহিদা মতো কর আহরণ সম্ভব না হলেও সরকারের কর নীতির কারণে বিত্তবানরা সুবিধা পাবেন এবং বিপদে পড়বেন তুলনামূলক কম আয়ের মানুষেরা। অন্যদিকে সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা/কর্মচারিদের সুবিধা লাগাতার বাড়িয়ে যাওয়ার কারণে ব্যয়ের বড় অংশটিই করতে হচ্ছে এসব কর্মকর্তা/কর্মচারিদের পেছনে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় বাড়লেও কাক্সিক্ষত সুফল পেতে দেরি হচ্ছে বা আদৌ পাওয়া যাচ্ছে না। অপ্রয়োজনীয় এসব ব্যয় সামাল দেয়ার জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে, আর তার ফল জনগণের ওপর ঋণের বোঝা চাপছে। এ বিষয়ে আরেকটা উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো ঋণের ক্ষেত্রে দেশের বাইরের উৎসের ওপর ক্রমাগত নির্ভরতা বাড়া। এটা দেশকে আরও বেশি পরনির্ভরশীল ও নাজুক করে দেবে।
এদিকে দেশের আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা দূর করতে না পারায় পুরো সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এসব সঙ্কট দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান এবং এগুলো ক্রমেই পুঞ্জিভ‚ত হচ্ছে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব সঙ্কট থেকে উত্তরণের কোন দিশা পাওয়া যায়নি। বরং বাজেট পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় সঙ্কটগুলো আরও ঘনিভ‚ত হতে যাচ্ছে।
জনগণের হাতে টাকা না আসলে, তার সক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে মুখ থুবড়ে পড়ার দশায় যাবে। অথচ বর্তমান বাজেটে সবচেয়ে উপেক্ষিত এই দিকটি। টেকসই উন্নয়ন যা অধিকাংশ মানুষের সুযোগ সৃষ্টি করে, সেটা নিশ্চিত না করলে জিডিপির ফুলানো বেলুন যেকোন মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি সেই পথেই হাঁটছে। আমরা জানি অর্থনীতি কোন পথে হাঁটবে সেটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বর্তমান জনসম্মতিহীন সরকার তাদেরই সুবিধা দিতে ব্যস্ত যাদের সমর্থন ও সহযোগিতায় তারা টিকে আছে। এই ধারার ছেদ ঘটিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম বেগবান করা ছাড়া আমাদের সামনে কোন রাস্তা নাই। আমরা জনগণের বাজেট প্রতিষ্ঠায় জনগণের ভোটাধিকার, জনগণের প্রতিনিধিদের বাজেট প্রণয়নের সত্যিকার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে জনগণের বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
বার্তা প্রেরক-
বাচ্চু ভূঁইয়া
সদস্য, কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী
গণসংহতি আন্দোলন
#জ/উম-৬/২