আব্বু যে একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ, সেটা তথ্য হিসেবে জেনেছি খুব ছোটবেলাতেই। সেই তথ্যের তেমন কোনো তাৎপর্য অবশ্য ছিলো না আমার কাছে। বরং এটা আব্বু সম্পর্কে একটা নেতিবাচক মনোভাবই তৈরি করেছে আমার শিশুমনে, আর তার কারণটা অবশ্যই সামাজিক। শুনতাম, আব্বু এমন এক পার্টি করে যাতে কোনো ‘লাভ’ নাই। বরং ক্ষতি। পার্টির কারণে ওকালতি প্র্যাকটিস করার সময় পায় না, তাই আমরা অভাবী। মনে আছে একবার এক আত্মীয় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আ্যই তোমার আব্বা যেন কী করেন? আমি খুব উৎসাহ নিয়ে সদ্য শেখা শব্দটা ব্যবহার করে বললাম, আমার আব্বু অ্যাডভোকেট। উনি হা হা করে হেসে বললেন, অ্যাডভোকেট, না এক পকেট? টাকাপয়সা নাই এটা আবার কেমন উকিল? খুব ভালোমতো না বুঝলেও রাগ হয়েছিলো খুব, এখনো মনে আছে সে জন্যেই।
সেই ৭/৮ বছর বয়সেই নিয়মিত শুনতে হতো, তোমার আব্বুর পার্টি তো কোনো দিন ক্ষমতায় যাবে না, এমন পার্টি করে কী লাভ? প্রশ্নের মাথামুন্ড না বুঝলেও ধারণা হয়েছিলো আব্বু পার্টি করে বলেই আমরা এত গরিব। আব্বুকে আমিও তাই প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতাম, পার্টি করে কী লাভ? শিশুকন্যাকে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ বোঝানোর চেষ্টা বলাই বাহুল্য, আব্বু করেননি কখনো। হাসিমুখে শুধু বলতেন- লাভের জন্য তো পার্টি করি না, মানুষের জন্য করি।
এমন উত্তরে সন্তুষ্ট না হলেও আর বেশি মাথা ঘামাতাম না। তবে আব্বুর এই ‘পার্টি করার’ কারণে শৈশবে আমার কিছু আবছা স্মৃতি তৈরি হয়েছে, যা অজান্তেই আমার মনে বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা বুনে দিয়েছে। যেমন; একবার চীন থেকে কিছু কমিউনিস্ট বন্ধু এসেছিল রাজশাহীতে, আব্বুর পার্টি থেকে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আব্বু আমাকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। বিদেশি লোকগুলোকে দেখে ভারী অদ্ভুত লেগেছিল আমার, আমাকে বেশ আদর করেছিল তারা। আরেকবার কী যেন একটা নির্বাচনে ফজলে হোসেন বাদশার প্রতি সমর্থন দিলো আব্বুর পার্টি। শোলার তৈরি বড় বড় চাবি হাতে নিয়ে চাবি মার্কার পক্ষে মিছিল হতো। সেই আমার প্রথম মিছিলের স্মৃতি। এই যে আব্বুর পার্টি পার্টি বলছি, এই পার্টির নাম নিয়েও ভারী কৌতূহল উদ্দীপক স্মৃতি আছে আমার। আমি স্কুল পেরোনোর আগেই অন্তত এক হালি পার্টির নাম শুনে ফেলেছি আমি, যেগুলো আব্বুর পার্টি। কিছুদিন পরপরই পার্টি ভেঙে যাওয়া নিয়ে আম্মু হাসাহাসি করতো, আর পুরোনো পার্টির প্যাডকার্ড সিল এগুলো আমার দখলে চলে আসতো। ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’ লেখা প্যাড নিয়ে দীর্ঘদিন আমি ‘অফিস অফিস’ খেলেছি।আরেকটা কারণে আমার আব্বুর পার্টি করা নিয়ে আত্মীয়-পরিজনের তিরস্কার শুনতে হয়েছে। তা হলো, এই পার্টি করার কারণে নাকি আল্লাহ-খোদার নাম নেয় না আব্বু। আমার শৈশবে আশপাশে খুব নিষ্ঠাবান ধার্মিক পরিবার খুব চোখে পড়েনি আমার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখতাম সাধারণত পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের। আব্বুর বয়সী পুরুষদের ধর্মচর্চা সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তো, সেটুকুও আব্বু করতেন না বলে আম্মু দুঃখ করতেন প্রায়ই। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে আব্বু যথারীতি হাসিমুখে উত্তর, তোমার আম্মুই পড়ুক না নামাজ, আমি কি তাকে নিষেধ করছি? স্কুলপড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতো না আব্বু। কিন্তু স্কুল পেরোতে পেরোতেই আব্বুর কিনে দেওয়া বিজ্ঞান কী ও কেন, মানুষ কী করে বড় হলো, যে গল্পের শেষ নেই, ইস্পাত, মা, দুনিয়া কাঁপানো দশদিন আমার পড়া হয়ে গেছে।
আব্বু আমাকে খুব বেশি সময় দিতেন, এমন না। আমি বড় হয়েছি অতিমাত্রায় মা-ঘেঁষা শিশু হিসেবেই। তবু শৈশবের স্মৃতি হাতড়ালে দেখতে পাই, ভালো লাগার, মনে রাখার মতো বেশির ভাগ স্মৃতিতেই জড়িয়ে আছে আব্বু। এর মধ্যে সেরা হলো আব্বুর সঙ্গে আমার প্রাতঃভ্রমণের স্মৃতি। রাজশাহী শহরে থাকতাম আমরা। রোজ ভোরবেলা আব্বুর হাত ধরে হাঁটতে বের হতাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পদ্মা নদীর পাড়ে। সেখানেই রাস্তার ধারের হোটেলে মাঝে মাঝে নাশতা খাওয়াতো আব্বু। পরোটা আর মিষ্টি। আব্বুর কাছে যথেষ্ট টাকা থাকলে কখনো কখনো তন্দুর রুটি আর মুরগির স্যুপ। কী যে খুশি লাগতো! কখনো কখনো ফেরার পথে কাঁচা বাজারেও নিয়ে যেত আব্বু। আম্মু বলতো, আমি সঙ্গে থাকলে আব্বু নাকি ভালো বাজার করে, বড় মাছটা, মুরগিটা কেনে। আবার কখনো হাঁটতে হাঁটতে একটু গ্রামের দিকে আমার দাদাবাড়ি পর্যন্ত চলে যেতাম। সক্কাল সক্কাল আমাদের দেখে ভারী খুশি হতেন দাদি। ঠিক বইয়ের পাতার ছবির মতো স্মৃতি আছে আমার, আমার দাদির। লম্বা, ফরসা সাদা চুল সাদা শাড়ির এক শক্ত সমর্থ বৃদ্ধা, উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁস-মুরগিকে খাবার দিচ্ছেন। রাতের ঁেবচে যাওয়া ভাত, ডিম দিয়ে ভাজতেন দাদি। সেটাই সকালের নাশতা। বেশি করে শুকনা মরিচ দেওয়া সেই ভাতভাজা আব্বুর এত পছন্দ ছিল যে, আম্মুও অবিকল সেরকম ভাতভাজা তৈরি করতে শিখে ফেলেছিলেন পরে।
ছোট থেকেই দেখেছি, আব্বু বেশ স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। বিড়ি-সিগারেট ছুঁতেন না, পছন্দের খাদ্যতালিকায় পোলাও-কোর্মার বদলে সেই ভাতভাজা, বেগুন বড়ির ঘন্ট, কালাই ডালের রুটি এসবই ছিল। প্রাতঃভ্রমণের পাশাপাশি যোগ ব্যায়ামের অভ্যাসও ছিল। সেই আব্বুই কেন যে সত্তর পেরোনোর আগেই কিডনির অসুখে ভুগে এত কষ্ট পেয়ে কেন মারা গেলেন, আমার বোধগম্য না তা। আব্বু অবশ্য বলতেন, সারাজীবনে টানা খেসারির ডাল খেয়েই এ অবস্থা। আশির দশকে প্রায় দুই বছর রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছেন। জেলখানার নোংরা কম্বলের কারণেই কী না, সেসময়ই পায়ে একধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়, যা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আব্বুকে ভুগিয়েছে। কোনো কোনো ডাক্তারের কাছে শুনেছি, দীর্ঘদিন চর্মরোগে ভুগলে তা কিডনির ওপর বাড়তি চাপ ফেলে। জানি না। কিন্তু এই কষ্টকর মৃত্যুকেও আব্বু গ্রহণ করেছে এক বিষর্ণ সাহসের সঙ্গে। মৃত্যুর মাস দু-এক আগে, রীতিমতো কাগজ কলমে মরণোত্তর দেহদানের ব্যবস্থা করে গেছেন। আব্বুর নিয়মিত পার্টি ভাঙার পালা যাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর থেমেছিল, সেটা হলো গণসংহতি আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই দলটির ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আমিও কিছুদিন যুক্ত ছিলাম। সংক্ষিপ্ত সেই সময়টাতেই মূলত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আব্বুর উচ্চতার কিছুটা আন্দাজ পেয়েছি আমি। আব্বুর শেষদিনগুলোতে এই দলের ছেলেমেয়েরাই আব্বুর প্রকৃত সন্তানের মতো পাশে থেকেছে। অর্থনৈতিক দায়িত্ব থেকে শুরু করে সেবা, সব করেছে তারা। আব্বুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ২৬শ মে। এই দিনটাতেও আমার বামপন্থী বাবার জন্য গর্ব করার উপলক্ষ এনে দিয়েছিল আব্বুর পার্টি। আব্বু বেঁচে থাকতে বাবা দিবসে কখনো তাকে শুভেচ্ছা জানানোর কথা মনে হয়নি। আজকে এত দিন পর, ইচ্ছা হলো আব্বুকে নিয়ে লিখি।
(আবদুস সালাম: পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আগ্রহের বিষয় ছিল মার্ক্সীয় দর্শন অধ্যয়ন এবং ভারতের ও পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি পর্যালোচনা। ‘মাইতি গ্রুপ’ নামে পরিচিত প্রগতিশীল ছাত্র মৈত্রী, মার্কসবাদী লেখক সংঘ ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী সম্মেলন নামে তিনটি সংগঠন গড়ে তোলেন। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন বামপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও মতপার্থক্যের কারণে নিজেকে প্রত্যাহার করেন এবং ১৯৯৬ সালে গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি গড়ে তোলেন। ২০১১ সালে গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে মজদুর পার্টিকে একীভূত করেন।)
নাদিয়া সারওয়াত
গণমাধ্যম কর্মী ও প্রয়াত জননেতা অ্যাড. আবদুস সালামের কন্যা
দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত।