সাধারণভাবে একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে বৃহত্তর অর্থে মানুষের শারিরীক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থাকে বোঝায়। একটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা নির্ধারিত হয় তার জৈব-স্বাস্থ্য, জীবনযাপন ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দ্বারা। তবে স্বাস্থ্য সেবার মানের উন্নয়নও মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থার উন্নতিতে ইাতবাচক প্রভাব রেখে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে। চিকিৎসা এই স্বাস্থ্য সেবারই একটা অংশ।
অথচ, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোন আলোচনার শুরু হয়ে থাকে চিকিৎসা দিয়ে আর শেষও হয় তাই দিয়ে। সকল রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ভালো রাখার ব্যবস্থা সত্ত্বেও কেউ রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে তা থেকে উত্তরণের প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা আসার কথা প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে যাবার পরবর্তী করণীয় হিসাবে। অথচ আমরা করছি তার বিপরীতটা। এই বিপরীত করাটা কোন অসচেতন প্রক্রিয়া কিংবা অজ্ঞতার ফল নয়। স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের যে খন্ডিত ধারণা তৈরি করা হয় তার সাথে যুক্ত একটা বিশাল বাণিজ্য। ওষুধ কোম্পানি, বিভিন্ন ডাক্তারী যন্ত্রপাতি কোম্পানি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের ব্যবসা আছে এই ধারণার পেছনে। এক কথায় গোটা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথেই মোটা মুনাফার প্রশ্নটা যুক্ত। বিপরীতে নিরোগ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের নিশ্চয়তা তৈরি করা, কিংবা ভেজাল- বিষমুক্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা তৈরির সাথে যুক্ত মুনাফার হ্রাস। ফলে আমাদের স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা এক করে ফেলার ভেতরে একটা মুনাফার স্বার্থ যুক্ত আছে। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় দুনিয়ার বেশির ভাগ জায়গার জন্যই সত্য। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই এই মুনাফার লাগাম টেনে ধরার একটা ব্যবস্থা আছে। মুনাফা যাতে জনগণের জীবনকে জিম্মি করে ফেলতে না পারে সেটার জন্য ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্র এ বিষয়ে টাকা খরচ করে, একে একটা সেবা হিসাবে, জনগণের অধিকার হিসাবে বিবেচনা করে। সেখানেও চিকিৎসা মুনাফার যোগান দেয়, কিনতু তার একটা সীমা আছে । মুনাফাটা সেখানে একটা ব্যবস্থার অর্ন্তগত, আমাদের দেশের মত যার যেভাবে ইচ্ছা লুটেপুটে খাবার স্বাধীনতা সেখানে নাই। অর্থাৎ আমরা মরছি দুই দিক থেকেই- ব্যবস্থার দ্বারা এবং অব্যবস্থার দ্বারা।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে এক করে ফেলার শেকড় যে কতটা গভীরে প্রোথিত সেটা বোঝা যায় বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) ধারায় স্বাস্থ্য নয় বরং চিকিৎসাকে মৌলিক প্রয়োজন হিসাবে স্বীকৃতি দানের ভেতর দিয়ে। এমনকি ১৮ ধারায় জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনায়ও পুষ্টি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্য বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
এই মুনাফাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একটা জনগণের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নির্মাণ একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ। আমরা এখানে সংক্ষেপে আমাদের মূল প্রস্তাবগুলো খসড়া আকারে পেশ করছি। আশাকরি আলোচকদের অংশগ্রহণে সেগুলো আরও পূর্ণতা পাবে।
এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম প্রস্তাব হবে মানুষকে সমগ্র প্রকৃতির একটা অংশ হিসাবে বিবেচনা করে তার আশপাশের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। সেজন্য পরিবেশ দূষণ রোধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ। বায়ু, পানি, মাটি, শব্দ, মেডিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স ও ডিজিটাল দূষণ রোখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষকে এইসব দূষণজনিত রোগের হাত থেকে যতদূর সম্ভব রক্ষা করা। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে বাংলাদেশে মৃত্যুর ২৮ ভাগ হয় দূষণজনিত কারণে, যেখানে পৃথিবীতে এ ধরনের মৃত্যুর গড় হার ১৬ শতাংশ। কাজেই স্বাস্থ্যগত বিবেচনায়ও পরিবেশের সুরক্ষা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথম দিকে থাকা জরুরি।
আমাদের নজর দেয়া দরকার মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলায়। জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হওয়া। যেসব রোগের টিকা পরীক্ষিত ও নিরাপদ সেসব টিকাকে সার্বজনীন অধিকারে পরিণত করার মাধ্যমেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।
খাদ্যে ভেজাল, অতিরিক্ত কীটনাশক, ক্ষতিকর মাত্রায় প্রিজারভেটিভ, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার আইন করে বন্ধ করা। খাদ্যকে মানুষের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে নিরাপদ, সহজলভ্য ও ভেজালমুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া । নীতি হিসাবে খাদ্য উৎপাদনে কোম্পানির বদলে কৃষকের ও দেশীয় উৎপাদকদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা । দেশীয় খাদ্যের বৈচিত্র রক্ষা ও বিষ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া ।
খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার,যোগ ব্যায়াম, হাঁটা ও মুক্ত ব্যায়াম চর্চার মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে। নগরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন সেখানে গাছপালা, পর্যাপ্ত পার্ক, খোলা জায়গা , খেলার মাঠ থাকে। এভাবে মানুষের সুস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পরও সম্পূর্ণভাবে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা, বিশেষ পথ্য ও পুনর্বাসনের প্রশ্ন আসে, যেগুলোকে মোটাদাগে স্বাস্থ্যসেবা হিসাবে চিহ্ণিত করা যায়। বর্তমানে এই স্বাস্থ্যসেবা নানাভাবে মুনাফার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যা এই স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনের অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। কাজেই এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিয়ে সকল জনগণের জন্য সুলভে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমান মুনাফা ভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বদলে জনগণের স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে জনগণের জন্য সুলভে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে:
১. বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের যে দুরাবস্থা সেটা এই খাতে ধারাবাহিক অবহেলা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার ফলাফল। প্রথমেই আসা যাক এই খাতের বরাদ্দ প্রসঙ্গে। বহুদিন থেকেই এই খাতে বরাদ্দ দেশজ জিডিপির ১ ভাগের এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান ন্যূনতম ৫ ভাগ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তির ব্যয় ৬৬ থেকে ৭০ ভাগ, অর্থাৎ সরকারের ব্যয় ব্যক্তির এক তৃতীয়াংশের চাইতেও কম। হবার কথা উল্টোটা। অতএব স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় বদ্ধি করে সাধারণ মানুষ, নারী , শিশু, গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য চাহিদা মাথায় রেখে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে ও তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে অন্তত জিডিপির ৫ ভাগে উন্নীত করতে হবে।
২. জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সার্বজনীন স্বাস্থ্যকার্ড চালু করতে হবে। স্বাস্থ্যকার্ডের অধীনে আয় অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করতে হবে। নাগরিকের স্বাস্থ্যের অবস্থা, রোগের ধরন, সময়কাল, চিকিৎসার ইতিহাস, বীমা সংক্রান্ত তথ্য এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা ও ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড, উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে তার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। সেবা গ্রহণকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা উচ্চতর চিকিৎসা সেবার জন্য সুপারিশ করবেন স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা। একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা মডেল গড়ে তুলতে হবে।
৩. বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে স্বাস্থ্যকর্মী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চাইতে অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান যেখানে প্রতি ১০০০০ এ ২৩ জন। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজারে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৬ জন। এর ভেতরে আবার নার্স, আয়া , ফিজিওথেরাপিস্ট, টেকনোলজিস্ট, ধাত্রীসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা আরো কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী প্রতি জন ডাক্তারে যেখানে নার্স সংখ্যা থাকার কথা ৩ জন,সেখানে বাংলাদেশে এই চিত্র পুরো উল্টা। একজন নার্সের বিপরীতে গড়ে দুইয়ের অধিক ডাক্তার রয়েছে বাংলাদেশে। সর্বমোট স্বাস্থ্যকর্মীর ৭০ ভাগ ডাক্তার। কিন্তু ডাক্তারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অনেক কম। এটা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী যেমন নার্স, টেকনোলজিস্ট,ফিজিওথেরাপিস্ট, আয়া, ধাত্রী, সহকারী টেকনিশিয়ান ইত্যাদির ক্ষেত্রে ঘাটতি আসলে কত বিশাল। এর সাথে আবার আছে শহর গ্রামের বিপুল বৈষম্য। শহরের চাইতে গ্রামে জনসংখ্যা অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা ১০ ভাগের একভাগ। এই অবস্থার পরিবর্তনে দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. সরকারি হাসপাতালের সেবার মান বাড়ানো, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বসার স্থান, রোগীদের জন্য অপেক্ষার স্থানের আধুনিকায়ন, পরিচ্ছন্নতার মান বৃদ্ধিতে নজর দেয়া, যথাযথ প্রক্রিয়ায় বর্জ্য অপসারণ এর ব্যবস্থা, বেড সংখ্যা বাড়ানো, সুযোগ-সুবিধার আধুনিকায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনীয় এম্বুলেন্স, রোগ নির্ণয়ের জন্য যন্ত্রপাতি, টেকনোলজিস্ট, নার্স, ডাক্তার সংখ্যা বাড়ানো । প্রতি জেলায় অন্তত ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ সমেত হাসপাতালের ব্যবস্থা।
৫. নার্স, টেকনোলজিস্ট, ফিজিও থেরাপিস্ট তৈরির জন্য টেকনিক্যাল কলেজ সংখ্যা বৃদ্ধি। মেডিক্যাল কলেজ সংখ্যা বাড়ানো। উচ্চতর শিক্ষার জন্য মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করার ব্যবস্থা গ্রহণ। হাসপাতালগুলোতে পুষ্টিবিদ নিয়োগ । পুষ্টিকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তোলা। গবেষণার জন্য ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হিসাবে ধরা।
৬. বেসরকারি হাসপাতালের মুনাফার লাগাম টেনে ধরতে হবে। প্রত্যেক বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি বিভাগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রত্যেকটি সেবার মূল্য তালিকা হাসপাতালে টাঙ্গানো থাকতে হবে। কোন গোপন বা অপ্রদর্শিত ব্যয় সেবাগ্রহীতার বিলের সাথে যুক্ত করার বিরুদ্ধে আইন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক হাসপাতালের নিজস্ব স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে। প্রতিটি সেবার মূল্য সরকার নির্ধারিত যৌক্তিক সীমার মধ্যে হতে হবে।
৭. ওষুধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ওষুধ কোম্পানি, ডাক্তার, হাসপাতালের যোগসাজস বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে দেশে বায়ো ইকুউভ্যালেন্সি টেস্ট এর সুবিধাসহ ল্যাবরেটরি স্থাপন।
৮. মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য একটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কাজেই এ বিষয়ে যথাযথ মনোযোগ দিয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব, প্রসূতি সেবা ও শিশুর বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত সংখ্যায় প্রশিক্ষিত ধাত্রী, সর্বত্র গর্ভবতী ও প্রসূতি দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য যথাযথ পুষ্টির পরামর্শ দেবার জন্য পুষ্টিবিদ নিয়োগ দিতে হবে। বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রজননকালীন স্বাস্থ্য ছাড়াও সাধারণভাবে নারী স্বাস্থ্য রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে মানসিকতার বদল ঘটাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ও মানসিক অসুস্থতা বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯. গ্রামাঞ্চলে বিশেষত দুর্গম অঞ্চলে ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এ ধরনের সেবা প্রদানকারীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। পদোন্নতি, উচ্চতর শিক্ষায় এসব অঞ্চলে সেবা প্রদানকারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
১০. গবেষণা খাতে অর্খ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণার জন্য একটা ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক করে নতুন ওষুধ, চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রচলিত পদ্ধতির আধুনিকায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষণায় মনোযোগী হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে দেশি, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা, নগরায়ন ও জীবনযাপনের পরিবর্তন, মহামারী জনস্বাস্থ্যগত যেসব পরিবর্তনের প্রয়োজনকে আবারো সামনে এনেছে
গত বেশ কয়েকটা মহামারী দেখলে দেখা যাবে এগুলো ঘটেছে মূলত বন্য প্রাণীর সাথে মানুষের অতি সংস্পর্শতা থেকে বা কোন প্রাণীকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে গিয়ে। ২০০২-৪ এ সার্স এসেছিল বাদুড়ের মাধ্যমে মানবদেহে, বার্ড ফ্লু এসেছিল মুরগীর মাধ্যমে, মার্স এসেছিল উট থেকে, ইবোলা এসছিল গোরিলা বা শিম্পাঞ্জী থেকে, বর্তমান কোভিড ১৯ এসেছে বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন থেকে। জীবানুর এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান কোভিড ১৯ হয়তো অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত মাসে রয়েল সোসাইটি অফ লন্ডন ফর ইম্প্রুভিং ন্যাচারাল নলেজ এর সভার নথিতে দাবি করা হয় “ মানুষ যেভাবে সারা দুনিয়াটাকে চষে বেড়াচ্ছে তাতে সামনের দিনে এ ধরনের সংক্রমণ আরও বাড়বে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস এবং শিকার ও বাণিজ্য এই সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে বড় ভূমিকা রাখবে।” তারা প্রস্তাব করেন বন্য প্রাণীকে খাবার ও ওষুধ হিসাবে ব্যবহার কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
কিন্তু এতো গেল কেবল মহামারীর কথা। এর বাইরে আমাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে আমরা কিভাব অসুস্থ হয়ে পড়ছি তার হিসাব নিকাশ দেখলে আমাদের হতবাক হয়ে যেতে হবে। প্রথমে আসা যাক চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্বারা অসুস্থ হওয়া প্রসঙ্গে। এন্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারের ফলে এন্টিবায়োটিক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এরকম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে। এটা হচ্ছে ফ্লু বা ভাইরাস ঘটিত রোগে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে, ব্রড স্পেক্ট্রাম এন্টিবায়োটিকের অধিক ব্যবহারের ফলে, এন্টিবায়োটিক এর কোর্স সমাপ্ত না করার ফলে, এবং বড় আকারের বাণিজ্যিক কৃষি খামারের মাধ্যমে। এর ফলে এন্টিবায়োটিক তার কার্যক্ষমতা হারা্চ্ছে। আগামী দিনে ছোটখাটো কাটাছেঁড়া, সাধারণ অপারেশন এগুলোই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। বেশি বেশি এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়া নিজেকে বদলে নিতে ও সেই এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষমতা লাভ করে। গবেষকরা অনুমান করছেন আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ১ কোটি মানুষ এন্টিবায়োটিক রেজিটেন্সের ফলে মারা যাবে পৃথিবীতে।
শুধু চিকিৎসাই নয় এন্টিবায়োটিকের বহুল ব্যবহার করা হচ্ছে গবাদি পশু ও পোল্ট্রি খামারগুলোতে। ২০১৪ সালে যত এন্টিবায়োটিক বিক্রি হয়েছে তার ৮০ ভাগ ব্যবহৃত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষি উৎপাদনে। দুনিয়াজুড়ে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এন্টিবায়োটিকের চাহিদা বাড়বে ৬৭ ভাগ। গাদাগাদি করে রাখা মুরগীর খাঁচাগুলোতে মুরগীগুলো তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে সালমোনেলা ও ইকোলাই দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তাদের বার বার এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। মাংস উৎপাদনের জন্য যেসব পশু-পাখি পালন করা হয় তাদের রোগ বালাই ছাড়াও খাবারে এন্টিবায়োটিক উপাদান যোগ করা হয়। এর ফলে যারা খাবার দেন বা এদের লালন-পালন করেন তারা সরাসরি এসব এন্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে আসেন এবং না জেনেই নিজেদের কম্যুনিটিতে তা ছড়িয়ে দেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এমআরএসএ নামের অধুনা পরিচিত হয়ে ওঠা এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধে সক্ষম ব্যাকটেরিয়ার কথা, যা এই খাতের কর্মীদের মধ্যে কাজ ছেড়ে যাবার বহুদিন পরেও থেকে যায়। এছাড়া খামারের বর্জ্যের মাধ্যমেও ব্যাকটেরিয়া ও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো রয়ে যায় উৎপাদিত প্রোডাক্টের ভেতরেও। ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা সেইলি ডেভিস এন্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারের ফলে এর অকার্যকারিতা জনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন এটা বিপদজনক ও অপরিবর্তনীয়
পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই আলোচনাটা একটু বড় করতে হলো। এন্টিবায়োটিকের এই অতি ব্যবহার আসলে কোন ডাক্তার বা রোগীর, বা উৎপাদক বা ভোক্তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। এটা যুক্ত আমাদের উৎপাদন ও ভোগের পুরো আয়োজন, জীবনযাপন এর ধরন, মানুষ , তার শরীর, তার সভ্যতা, নগরায়নের ধরন, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক এবং পূঁজি ও তার মুনাফা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে। প্রকৃতির ওপর মানুষের দখলদারির মূলে আছে মুনাফা তাড়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গোটা প্রকৃতির ওপর প্রভূত্ব কায়েম। প্রকৃতিকে আধিপত্য ও সাম্রাজ্য বিস্তারের একটা ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা। মানুষ-প্রকৃতির সহাবস্থানমূলক চিন্তার বিপরীতে এধরনের আধিপত্যমূলক চিন্তা শেষ বিচারে মানুষ সহ গোটা প্রাণ জগতকেই একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
মানুষ প্রকৃতির একটা অংশ এবং প্রকৃতি বিনষ্ট হলে মানুষ তার বিপদকে এড়িয়ে যেতে পারে না। মানুষের সুস্থ থাকার শর্ত তাই তার প্রতিবেশকে রক্ষা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষ মারা যায় বায়ু দুষণজনিত রোগের কারণে। এদের ভেতরে একটা বিরাট অংশই শিশু। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি গোটা দুনিয়ার চাইতে ভয়াবহ। বহু বছর ধরেই ঢাকা দূষিত নগরীর তালিকায় শীর্ষ অবস্থানগুলোর প্রথম পাঁচের ভেতর জায়গা করে নিয়েছে নিয়মিত। স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ারের গবেষণার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর মারা যায় ১ লক্ষ ২৩ হাজার জন। এই বায়ু দূষণের কারণ যানবাহন, কলকারখানার বর্জ্য উদগীরণ, ইট ভাটা, নির্মাণ কাজ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি।
একই অবস্থা পানি দূষণজনিত রোগগুলোর ক্ষেত্রেও। প্রতি বছর পৃথিবীতে ডায়রিয়ায় মারা যায় ৫ লক্ষ ৫ বছর নীচে বয়স এমন শিশু। বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখনও ৪৫০০০। জন্ডিস, টাইফয়েড এর মত পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হন বহু সংখ্যক মানুষ, জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয়া মশকবাহিত রোগ ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়ার প্রকোপ সাম্প্রতিক সময়ে মহামারীর আকার নিয়েছে।
বিপরীতে আমরা দেখব আমাদের নগরায়নের ধরন দিনের পর দিন সবুজ ধ্বংস করছে নির্বিচারে, নদী-খাল বিল দখল, দূষণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, খোলা জায়গা, খেলার মাঠ ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত। শিশুদের শৈশব চুরি করে তাদের করে তুলছে ডিভাইস আসক্ত। যা তাদের মানসিক ও শারিরীক উভয় ধরনের অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিক ও প্যাকেটজাত খাদ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কহীন একটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলছে আমাদের। আর এগুলোতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হরমোন, প্রিজারভেটিভ, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
এগুলোর বদল ঘটিয়ে আমরা যদি প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষা করতে না পারি, নগরায়নের ও জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনতে না পারি, মানুষের শরীর ও মনের সুস্থতার লক্ষ্যে নগর পরিকল্পনা না করতে পারি, আমাদের উৎপাদন ও ভোগের ধরনে পরিবর্তন আনতে না পারি তাহলে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
আর্থ-সামাজিক বিকাশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনর্গঠন কেন অপরিহার্য
অর্থনৈতিক উন্নয়নের আসল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি ও সমষ্টির কল্যাণ। সুস্বাস্থ্য এই কল্যানের একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক। একইভাবে সুস্বাস্থ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিপুল ভূমিকা রাখতে পারে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একটা জনগোষ্ঠী দেশের সামগ্রিক কর্মক্ষম জনশক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বৃদ্ধি করে তাদের উৎপাদনক্ষমতা। সুস্বাস্থ্য একজন মানুষকে নানামুখী কর্মতৎপরতায় যুক্ত করে, তার সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সংযুক্তি বাড়ায়, তাকে জ্ঞান আহরণ ও তাকে ধরে রাখার অধিকতর সুযোগ দেয়। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ অধিকতর নিশ্চয়তার সাথে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাজাতে পারে। এসব কিছুই আর্থ-সামাজিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। ফলে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ আসলে খুবই উৎপাদনশীল ব্যয় যা বহুগুণ বর্ধিত হয়ে ফিরে আসে।
এই করোনা মহামারী ও মহামারী পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা, এমনকি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আমরা দেখব, যেসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী এবং সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পেরেছে তাদের ক্ষয়ক্ষতি সবচাইতে কম। তাদের অর্থনৈতিক নিম্নগতির শঙ্কাও কম। এটা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক বিকাশের সম্পর্ক।
এটা তো একটা সাধারণ অবস্থা যা যেকোন দেশের জন্যই সত্য। বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতা হলো এখানে একটা শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার অনুপস্থিতির ফলে দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের একটা বিপুল অংশ চলে যাচ্ছে বিদেশে। শুধু ভারতেই চিকিৎসা বাবদ চলে যাচ্ছে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা। এগুলো মূলত দেশের মধ্যবিত্তের টাকা। এছাড়া বিত্তশালীরা দেশের বাইরে চিকিৎসায় কত ব্যয় করেন তার কোন হিসাব পাওয়া যায় না। এগুলো যেমন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তেমনি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা রুগ্ন হয়ে থাকার পেছনেও আছে এসব কারণ। ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সংস্কারে কোন তাগিদ নাই, কেননা তারা এখানে চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। বরং এই অব্যবস্থাপনা, দুর্বলতাকে তারা মোটা মুনাফা বানানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। এবারে করোনা মহামারীতে এর ফলাফলটা প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে কিন্তু পরিস্থিতির এই ভঙ্গুরতা আগে থেকেই ছিল। আর পরিস্থিতি খানিকটা শিথিল হতেই ক্ষমতাবান ও বিত্তবানরা উড়াল দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি ঠিকঠাক না থাকে, যদি সামান্য ঝাঁকুনিতেই গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে তাহলে দেশের সার্বিক বিকাশ যে মুখ থুবড়ে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ভঙ্গুরতা একটা লুন্ঠনমূলক ব্যবস্থার ফল ও লুন্ঠন অব্যাহত রাখতে তা ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে একটা উৎপাদনশীল, স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা অবশ্যম্ভাবী।
দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বমুক্ত, জবাবদিহিতামূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শাসনতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামো
একটি আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বমুক্ত, জবাবদিহিতামূলক, দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যখাত প্রতিষ্ঠায় এবং সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একটি স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনের অধীনে পরিচালনা করে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এই কমিশনে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ, অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবিজ্ঞানীসহ নাগরিক প্রতিনিধিরা যুক্ত হবেন। কমিশন স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, ক্রয় ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবেন। এই খাতে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতর সমন্বয় সাধন করবেন। সরকারি. বেসরকারি সকল পর্যায়ে যথাযথ সেবার মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। দ্রুততম সময়ে স্বাস্থ্যকর্মী বা সেবা গ্রহীতার যে কোন অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
ওষুধ কোস্পানি বা তার প্রতিনিধি ডাক্তার, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সাথে সরাসরি বাজারজাতকরণ করতে পারবে না। প্রতিটি কোম্পানির পণ্যের জন্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রচারের ব্যবস্থা করবেন। প্রতিটি ক্রয় (বড় আকারের) উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হতে হবে। কোন স্বাস্থ্যকর্মী কোন ওষুধ কোম্পানি বা মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোন ধরনের সুবিধাদি ( ভ্রমণ, সেমিনার অংশগ্রহণ, নগদ অর্থ) নিতে পারবে না।
প্রতিটি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে সঠিক রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিকের মান নিশ্চিত করতে হবে। একই পরীক্ষায় খরচের ব্যবধান ২০% এর বেশি হতে পারবে না। নির্ণয়কেন্দ্রের বিলে কার দ্বারা নির্দেশিত তার উল্লেখ থাকতে পারবে না এবং কোন চিকিৎসক নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বাছাই করে দিতে পারবেন না।
সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালের বাইরে কাজ করতে হলে তাদের নির্দিষ্ট বেতনে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। কোনক্রমেই ডাক্তারদের কর্মঘন্টা সর্বমোট ১২ ঘন্টার বেশি হবে না। সরকারি বেসরকারি প্রত্যেক হাসপাতালে একটা কেন্দ্রীয় নগদ লেনদেনের কাউন্টার থাকবে। অন্য কেউ কোন নগদ লেনদেনে যুক্ত হতে পারবে না।
প্রতিটি হাসপাতালে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও ওষুধের জন্য ডিজিটাল নথি থাকবে এবং নিয়মিত তথ্যের হালনাগাদ করতে হবে।
ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ না করলে,ভেজাল, নকল, ক্ষতিকর উপাদান সমৃদ্ধ ওষুধ তৈরি করলে লাইসেন্স বাতিল হবে। একই উপাদান দিয়ে তৈরি ওষুধের দামে ২০%এর বেশি ব্যবধান থাকতে পারবে না।
প্রতিটি ওষুধ কোম্পানি, হাসপাতালকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হবে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া সমস্ত কোম্পানি ও হাসপাতালকে পরিবেশের মান অর্জনের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে সেই সময়ের মধ্যে এই মান অর্জন করতে না পারলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি করা হবে। বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার শাস্তি হবে ঘটনার মাত্রা বিবেচনায় জরিমানা, জেল ও লাইসেন্স বাতিল ।
স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভোক্তাকে কোন হয়রানি, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা, অযৌক্তিক ব্যয় ইত্যাদির মুখোমুখি হতে হলে তার প্রতিকার করার জন্য স্বাস্থ্যখাতে ভোক্তা অধিকার রক্ষার ফোরাম গঠন করতে হবে এবং তার প্রস্তাবিত কমিশনের কাছে অভিযোগ করার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সকল ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের মত স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীদেরও সরাসরি দলীয় রাজনীতি বা বিশেষ রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত সংগঠনে যুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সাথে স্বাস্থ্যকর্মীদের দেশ ও জনগণের স্বার্থে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। জনপ্রশাসনের সকল ক্যাডারেই এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন দুর্নীতি, অনিয়ম, অবহেলা, বিচ্যুতি বিষয়ে মত প্রকাশের জন্য কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এবং স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলন শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গণমুখী রূপান্তরে রাজনৈতিক করণীয়
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে দেখলে আমরা দেখতে পাব একটা বিপুল দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা, জনগণের স্বাস্থের প্রতি চরম উদাসীনতা। একটা জবাবদিহিতাহীন আমলাতান্ত্রিকতা। বাংলাদেশে যে জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতা চর্চা, জনগণের সম্মতিহীন শাসন, পোষ্যদের নানামুখী সুবিধা দিয়ে একটা ডাকাতির ব্যবস্থা চালু রাখা এগুলোর বাইরে স্বাস্থ্যখাত নয়। বরং এই মহামারীকালে অন্য সকল লুন্ঠন-দুর্নীতি, ভয়ের শাসন স্বাস্থ্যখাতকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই স্বাস্থ্যখাত পূণর্গঠনের আন্দোলন আসলে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের সংগ্রামের সাথেই যুক্ত। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য বদল দরকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। একটা গণতান্ত্রিক, জনগণের স্বার্থে পরিচালিত ও অধিকার রক্ষায় সক্ষম রাষ্ট্রই পারে একটা গণমুখী, দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে স্বাস্থ্যখাতের পূণর্গঠনের জন্য আমাদের এই আন্দোলনকেও সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত করতে হবে। এই পরিবর্তনের চাহিদা এখন জনগণের কাছে আগের যেকোন সময়ের চাইতে মূর্তরূপে হাজির হয়েছে। জনগণের এই চাহিদায় সাড়া দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এখন আরও শক্তিশালীভাবে এই সংগ্রামে হাজির হতে হবে, জনগণকে সংগঠিত করতে হবে, জনগণের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে। আমরা সকলের কাছে সেই আহ্বানই জানাই।