The reality of factory life and the violence of capitalists, কারখানার জীবন বাস্তবতা ও পুঁজিমালিকদের দৌরাত্ম্য, Ganosamhati Andolon, গণসংহতি আন্দোলন, People's Solidarity Movement, Zonayed Saki, জোনায়েদ সাকি, Abul Hasan Rubel, আবুল হাসান রুবেল, Bangladeshi political movement, International solidarity with Bangladesh, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার, শ্রমিক অধিকার, Reforming Bangladesh politics, Transparency in Bangladesh politics, Social reform in Bangladesh, গণঅভ্যুত্থান, সংবিধান, সংস্কার, গণতন্ত্র, Democracy, Reform, Constitution, mathal, মাথাল
The reality of factory life and the violence of capitalists, কারখানার জীবন বাস্তবতা ও পুঁজিমালিকদের দৌরাত্ম্য, Ganosamhati Andolon, গণসংহতি আন্দোলন, People's Solidarity Movement, Zonayed Saki, জোনায়েদ সাকি, Abul Hasan Rubel, আবুল হাসান রুবেল, Bangladeshi political movement, International solidarity with Bangladesh, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার, শ্রমিক অধিকার, Reforming Bangladesh politics, Transparency in Bangladesh politics, Social reform in Bangladesh, গণঅভ্যুত্থান, সংবিধান, সংস্কার, গণতন্ত্র, Democracy, Reform, Constitution, mathal, মাথাল

কারখানার জীবন বাস্তবতা ও পুঁজিমালিকদের দৌরাত্ম্য

কারখানার জীবন বাস্তবতা ও পুঁজিমালিকদের দৌরাত্ম্য

Spread the love

যখন এই লেখাটা লিখছি তখন নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস ফ্যাক্টরি থেকে বের করা হচ্ছে সারি সারি ১২-১৬ বছরের শিশুদের, নারীদের পোড়া লাশ। আমরা শুনলাম একজন মায়ের আকুতি, ‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলো খুইজ্জা দেন স্যার’। ফিরোজা বেগমের মেয়ে তসলিমার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।  আমার এই লেখাটাতে আমি উপরোক্ত ঘটনার বিস্তারিত বলতে চাইছি না। কারণ সেটা বলে ঘটনার মূলকে স্পর্শ করা যাবেনা। আমরা যদি শ্রমিকদের জীবন বাস্তবতা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা, তাদের সাথে মালিকপক্ষের আচরণ, মালিকপক্ষের সাথে রাষ্ট্রের সংযোগ এই ব্যাপারগুলো বোঝার চেষ্টা করি সেক্ষেত্রে আশা রাখি সংকটের শিকড়কে স্পর্শ করা সহজ হতে পারে। আমার এই রচনাটা হতে পারে তার প্রাথমিক পাঠের পূর্বপ্রস্তুতি মাত্র।    

শ্রমিকের জীবন ও সংকট 

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের একজন সাধারণ শ্রমিকের মাসিক বেতন সাড়ে ছয় হাজার টাকা। তার মানে দৈনিক ভিত্তিতে তার হিসাবটা দাঁড়ায় দুইশত বিশ টাকারও কম। কোন কোন কারখানায় তাদের মাসিক বেতন সাত থেকে সাড়ে সাত হাজারের মতো। একইভাবে দৈনিক ভিত্তিতে তাদেরকে যে বেতন দেয়া হয় সেটাও দুইশো থেকে আড়াইশো টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যখন কিনা এক কেজি চাল পঞ্চাশ ৫০-৬০ টাকা, এক কেজি ডাল ৮০-১০০ টাকা, এক কেজি তেল ১৩০ টাকা তখন দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা বেতনে একজন শ্রমিক ঠিক কিভাবে চলে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? 

আমি কিন্তু পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল, আটশো টাকা দিয়ে এক কেজি খাসির মাংস বা সাড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংসের কথা ভুলেও বলতে চাইছি না। ঠিক এই অবস্থার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা কী করে টিকে থাকে সেটা জানাটা জরুরি। আমাদের শ্রমিকদের বেশিরভাগ মানুষ গ্রাম থেকে আসা। যেহেতু এই বেতনে কোনোভাবেই একটি পরিবারকে ভরণপোষণ করা সম্ভব নয়, এ কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকদের মা-বাবা, কিংবা স্ত্রী, সন্তান গ্রামের বসতবাড়িতেই থাকে। কিন্তু শহুরে ব্যবস্থায় মাসিক এই ছয়-সাত হাজার টাকায় নিজের চলাটাই যেখানে মুশকিল সেখানে পুরো পরিবারের আর্থিক চাহিদা শ্রমিকরা মেটান কি করে? প্রশ্নটা এখানেই শেষ নয়। এ প্রশ্নটাও জরুরি যে আসলে তিনি তিনবেলা কেমন বা কী কী খাবার খান—থাকেন কি অবস্থায়? তাদের সাথে একপাতে আহারের আমার বক্তিগত অভিজ্ঞতা যেটা বলে তিনবেলা আহারের দুইবেলাই তারা ভাত, ডাল, আলুভর্তা, বাজারের কম দামের বা বেলাশেষের আধপঁচা বা ন্যাড়বেড়ে সবজি খেয়ে থাকেন। একবেলা তারা ৮০-১০০  টাকা কেজি দরের মাছ খাবার চেষ্টা করেন। তেলাপিয়া বা পাঙ্গাস মাছ…তাও পারেন কি? পারেন না! কিংবা সপ্তাহান্তে একশো পঞ্চাশ-ষাট টাকা কেজি দরের বয়লারের মাংস। থাকেন একটি দশ ফিট বাই দশ ফিট ঘরে চার থেকে পাঁচ জন। কখনোবা থাকতে হয় বস্তিতে। আর তাতেই তার মূল বেতনের প্রায় পুরোটা শেষ হয়ে যায়। এর পর হাতে থাকে এক থেকে দেড় হাজার টাকার মতো। কিন্তু সে টাকায় তার বাড়িতে থাকা মা-বাবা, স্বামী বা স্ত্রী, সন্তানের সামান্য আর্থিক চাহিদা কি মিটে? মিটে না। তাহলে কি করতে হয়? 

এ অবস্থায় একজন শ্রমিক ওভারটাইম কাজ করে সাধারণত পরিবারের চাহিদা মেটান। কেউ আবার পরিবারের অন্য সদস্য ছোট ভাই-বোনকে  কারখানার কাজে লাগিয়ে দিতে একরকম বাধ্য হন। বাড়িতে হয়তো তার মা কি বাবা একজন অসুস্থ কিংবা রোজগারশূন্য। যে বয়সে একজন শিশু-কিশোরকে স্কুলে বা কলেজে পড়বার কথা, মাঠে খেলার কথা তখন সে রুটিরুজির জন্য  কারখানায় কাজ করছে।  অনেককেই আবার বাধ্যতামূলক বারো ঘণ্টা দৈনিক ডিউটি করতে হয়। ওভারটাইম প্রতি ঘণ্টায় পান মাত্র ২৮ টাকা, কোথাও কোথাও হয়তো ৩০-৩৫ টাকা। খাওয়া দাবার সময়ের কথা বলে তার থেকে আবার এক ঘণ্টা কেটে রাখা হয়। তার মানে অতিরিক্ত ০৪ ঘন্টা ডিউটি করলে ০৩ ঘণ্টার কিংবা অতিরিক্ত ০৮ ঘন্টা ডিউটি করলে ০৭ ঘণ্টার মজুরি তারা পান। দুই-একজন আবার সেটা না করে কারখানার আশেপাশের এলাকায় চা-সিগারেটের মতো ছোট খাটো দোকানপাট খুলে বসেন। 

আমাদের সমাজের মানুষের মাঝে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে নেয়। এ কথাটি যতটা না সত্য, তার অধিক সত্য এটা যে স্বয়ং শ্রমিকরাই ওভারটাইম কাজ করতে চায়। সেটা চায় এই কারণে যে অন্যথা গ্রামের বাড়িতে তার পরিবারের লোকজনকে না খেয়ে থাকতে হবে। শিশু শ্রমিক ও নারীদেরকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিতে মালিকপক্ষ একটু বেশিই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কারণ কম টাকা বেতনে এদের দিয়ে বেশি কাজ করানো যায়, একইসাথে বেতন বাড়ানোর জন্য তারা তুলনামূলক খুব বেশি উচ্চবাচ্যও করেন না। এমনও রয়েছে মাসিক দুই-তিন হাজার টাকা বেতনে শিশু শ্রমিকরা কাজ করছে। এতো কম টাকা মজুরিতে, কোন আইন-বিধিমালার তোয়াক্কা না করে শ্রমিকদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া হয় তারপরও মালিকপক্ষ তার লাখ টাকা বেতনভোগী ম্যনেজেরিয়াল বডির মাধ্যমে শ্রমিকদের ওপর এমন সব কথা জারি রাখেন যে ‘তোমাদের আমরা কাজ দিয়েছি। রুটিরুজির ব্যবস্স্থা করেছি (করুণা করা অর্থে)। এরপরও যদি তোমরা মালিকের সাথে মুনাফেকি করো…. কাজে ফাঁকি দাও…. আমাদের হাতে অল্টারনেটিভ রয়েছে। মুখে এই যে বলছে তাদের হাতে অল্টারনেটিভ রয়েছে; বাস্তবে কিন্তু শ্রমিকরা যেন কাজ ছেড়ে চলে না যেতে পারে সেজন্য মাসের প্রথম সপ্তাহে নয়—দ্বিতীয়  সপ্তাহেও  নয়—তাদের বেতন দেওয়া হয় মাসের বিশ-বাইশ তারিখে।’

আবার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করা বিপুল পরিমাণ শ্রমিকরা থাকেন বস্তিতে। কিংবা এমনসব ভাড়া করা বাসায় যেখানে ৪-৫ টি পরিবারের সাথে বাথরুম, টয়লেট, পানির কল, চুলা এগুলো ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। এক-তো কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করা, তারপর আবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা ও নিম্নমানের খাবার খাওয়ার কারণে তাদের স্বাস্থ্যের হয় ভগ্নদশা। কোন সমস্যা নিয়ে গেলেই কারখানার মেডিকেল সেন্টার থেকে ব্যথানাশক ট্যাবলেট দেওয়া হয়। ফলে এটা খুব সাধারণ ঘটনা যে শ্রমিকরা  ঔষধ দোকানে বিক্রেতার পরামর্শ মতো ঔষধ খেয়ে নেন। 

কারখানার ভেতরের জীবন

গেট দিয়ে একটা মানুষ ভেতরে প্রবেশ করলো, তারপর থেকে সে বন্দী। কার্যত জেলখানার একজন কয়েদির থেকেও বেশি নজরদারি ও নিঃস্পৃহতার মধ্যে রাখা হয় তাকে। কারখানার বদ্ধ পরিবেশে আলো বাতাসের ছোঁয়া পাবার সামান্য সুযোগ থাকে না। প্রায় সব কাজের সাথে সরাসরি কেমিক্যালের সংযোগ থাকে। শ্বাসনালী দিয়ে যা তাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। অধিকন্তু থাকেনা মাস্ক, গ্লাভস, এয়ারপ্লাগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিংবা থাকলেও কারখানার বদ্ধ পরিবেশে সেগুলো ব্যবহার করা কতোটা বিরক্তি বা কষ্টের তা শ্রমিক ভিন্ন অন্যরা কমই অনুধাবন করতে পারবেন। 

তাই প্রতিদিন বিষাক্তসব কেমিক্যাল শরীরে ঢুকে ফুসফুস দুটো ক্রমশ ঝাঁজরা করে ফেলে। মেশিনের প্রচণ্ড শব্দে কানে শোনার স্মায়ুগুলো অসাড়-বোধহীন হয়ে পড়ে। তাদের রোগের নামটা পর্যন্ত তারা জানে না। কেউ বলে বুক ব্যথা, কেউ বলে পেট-পিঠ-কোমর ব্যথা, হালকা জ্বর-সর্দি-কাশি-মাথাব্যথা। এটুকুই। টেস্ট নেই তাই আলসার, ইউরিন ইনফেকশন, টাইফয়েড, জন্ডিস, ফুসফুসের সমস্যা এমনসব বড় রোগগুলোও তাদের নেই। কারখানাগুলোতে নিজস্ব মেডিকেল ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই বললেই চলে। সেখানকার জরুরি ট্রিটমেন্ট বাক্সটাও ঔষধপত্র, ভায়োডিন, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ, তুলা এসবকিছু বেকার পড়ে থাকে। ডাক্তারের কাছে গেলে কিছু লিখে দিক বা না দিক একটা ব্যথানাশক ট্যাবলেটের নাম থাকবে। কেউ কেউ একটু সদয় হয়ে কিছুটা সময় নিয়ে সমস্যাগুলো শুনেবুঝে বেশকিছু ঔষধের নাম প্রেসক্রিপশনটায় লিখে দিতে পারেন। তাতে যে ভাগ্য সুপ্রসন্ন সেটা বলতে পারছি না। কারণ সেসব ঔষধ আদৌ আপনি সেখান থেকে পাবেন না, বাইরে থেকে পকেটের টাকা খরচা করে কিনে নিতে হবে। আর সেসব ঔষধগুলির দাম যেহেতু তাদের সাধ্যের বাইরে তাই প্রেসক্রিপশনটা কেউ কেউ যত্ন করে বালিশের তলে রেখে দেন। মরণদশা হলে কাজে লাগবার আশায়। আবার এমনও দেখেছি কেউ কেউ দামটা শোনার পরই অজানা কোন আক্রোশ-বিদ্বেষ নিয়ে সেটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে । 

কারখানাগুলোতে ফায়ার এক্সিট নেই—নেই অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম। বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থাতো নেই-ই। চলার জন্য যে একটা সিঁড়ি থাকে সেটাও আড়াআড়ি সাইজে ত্রিশ ইঞ্চির বেশি নয়। লম্বায় দৈত্যাকার, দেখে মনে হতে পারে হয়তোবা মানুষ মারার একটি কল-ই বানানো হয়েছে। লিফট আছে, তবে শ্রমিকদের জন্য সেটা ব্যবহার করার অনুমতি কি মিলে? 

দাস প্রথার মতো করে শ্রমিকদের সাথে আচরণ করা হয়। কথায় কথায় চড়-থাপ্পর, গালি, জরিমানা, বেতন কাটা, চাকরি যাওয়া এগুলো খুবই সাধারণ বিষয়।  

সমস্যাটা কাঠামোগত 

প্রতিবছর বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে মারাত্মক সব দুর্ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে শত শত শ্রমিক মারা যায়। তারপর সাথেসাথে একটা তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। প্রশাসনের লোকজন ঘটনার পেছনে কর্তৃপক্ষের  অবহেলাজনিত কোন থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন। কিছুদিন টেলিভিশনের টক শো, পত্রিকার কলামগুলো এ নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে। অতঃপর মালিকপক্ষ দায়সারা জবাব দিয়ে পার পেয়ে যান। এটাই মোটামুটি আমাদের দেশের বাস্তবিক অবস্থা।   

শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারটাকে স্রেফ একটি দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। প্রকৃত-ই এগুলো কোন দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হল কাঠামোগত গণহত্যা (স্টাকচারাল মাস কিলিং)। যখন মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা না দিয়ে কাজ করিয়ে নেন বা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কাজ করান কিংবা কারখানার গেট আটকিয়ে, তালাবদ্ধ করে কাজ করিয়ে নেন এবং এসব কারণে শ্রমিকরা আগুনে পুড়ে—ভবন ধসে মারা যান তখন সেটা কোনভাবেই আর দুর্ঘটনা থাকে না, সেটা হয় একটি কাঠামোগত গণহত্যা।    

এই পুরো বিষয়টাকে আমি প্রশাসনিক ও রাজনীতির কাঠামোগত রূপ হিসেবে দেখি। আমাদের দেশে কারখানাগুলোর মালিকরা মূলত সরাসরি সরকার কিংবা তাদের আদর সোহাগের লোকজন। ফলে তারা আইনের শাসনের উর্দ্ধে অবস্থান করেন। মূল গলদটা শুরু থেকেই। 

যেমন ধরুন ফলের জুস নামের বিষাক্ত পানীয়র কারখানাগুলোতে (যেখানে সে ফলের ছিটেফোঁটাও নেই) এমনসব অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা থাকা সত্ত্বেও সে কারখানাগুলো অনুমতি পায় বা চলমান থাকে কি করে? কিংবা আগুন লাগলে যেখানে বেরুনোর পথ নেই সেই ফ্যাক্টরির অনুমোদন হয়েছিলো কি করে—কার স্বাক্ষরে? বছরের পর বছর এভাবে আইন না মেনে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? তারমানে কারখানা পরিদর্শকরা কি এসি রুমে বসেই কাজ মিটান নি? কিংবা শ্রম মন্ত্রণালয় কিংবা ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেলফ অ্যান্ড সেফটির ভুমিকাটা-ই বা কি… যাইহোক, মূল ব্যাপারটা হল মালিকদেরকে কোন আইন-কানুন দিয়ে বিরক্ত করা হয় না। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কাছে ওসব আইন-বিধিনিষেধ বিরক্তির উদ্রেককারী উপদেশবাণী মাত্র। এসব কারখানাগুলো-ই নারিকেল ছাড়ায় খাঁটি নারিকেল তৈল, ফল ছাড়ায় খাঁটি ফলের জেলি, দুধ ছাড়ায় খাঁটি প্যাকেটজাত দুধ তৈরি করে। এখানেই শেষ নয়। এইসব মালিকরা একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বরাবরই আইনের শাসনের উর্দ্ধে থেকে জোর জবরদস্তিমূলক অর্থাৎ লাশ, রক্ত কিংবা গুমের বিনিময়ে হলেও সাধারণ মানুষের ভূমিতে তারা তাদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখে। সমতলের সাধারণ বাঙালি, পাহাড়ের আদিবাসী কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না। এরা তারাই যারা আবার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পায়। সরকার যাদের ঋণ প্রায়শই বিভিন্ন বাহানায় অর্থনৈতিক সুবিধা দেন। 

কারখানার ভেতরে পুড়ে ছাই না হলেও মাঝেমধ্যে বস্তিতে পুড়ে ছাই হতে হয় ঐসব শ্রমিকদের। কোন একদিন রাতে হঠাৎ করে তাদের বস্তিতে আগুন লাগবে, কিছুদিন পরে সেখানটায় ভূমি মালিকানার একটি সাইনবোর্ড ঝুলবে, তারপর সেখানে একটি অট্টালিকা তুলতে খুব বেশি দিনের প্রয়োজন হয় না। 

তাই এই যে এতো এতো মৃত্যু, লাঞ্ছনা, অন্যায়, দুর্ভোগ, অনাচার এগুলোর একেবারে শিকড়ে রয়েছে রাষ্ট্রের বর্তমান   রাজনৈতিক কাঠামো, প্রশাসনিক নীতি, আইন এবং সেগুলোর অব্যবস্থাপনা ও অপব্যবহার। তাই এই পুরো ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলানো ছাড়া অন্য কোন গত্যন্তর নেই। জনগণের সাথে সম্পর্কহীন একটি লুটতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে কিছু প্রত্যাশা করা যায় না, তাকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলতে হয়।  

জনমানস বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্রের কাছে অবহেলায় জড়িত কারখানা পরিদর্শকদের শাস্তির ব্যবস্থা, মন্ত্রণালয় কিংবা ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেলফ অ্যান্ড সেফটির কর্তাব্যক্তিদের শাস্তি-অপসারণ কিংবা এসব সংস্থা-মন্ত্রণালয়গুলোর ঢেলে সাজানো-সংস্কার-গণমানুষের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি-বাস্তব প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করবে এমনসব প্রত্যাশা আমি করি না। উলুবনে মুক্তা ছড়িয়ে কিছু পাওয়া যেতে পারে, তবে এমনসব প্রত্যাশার চারাগুলো আদতে কোনদিন ফল দিবে না, বরং কোন না কোনভাবে জনমানস বিচ্ছিন্ন মানুষখেকো লুটতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় হাতকে সে শক্তি যুগিয়ে চলে।  

জরুরি বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা 

দেশের সবকিছু রাজধানীকেন্দ্রিক। অথচ আমাদের দরকার ছিল একটি বিকেন্দ্রীভূত জীবন ও সমাজ ব্যবস্থার। দেশের কারখানা তথা শিল্প ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে মানুষকে রাজধানীমুখী হবার প্রয়োজন পড়তো না। কারণ কৃষিসহ স্থানিক অর্থনীতি দুর্বল-মুমূর্ষু হয়ে পড়ার কারণেই দলে দলে মানুষ শহরমুখী হয়। 

পাশাপাশি প্রশাসনিক ও  অর্থনৈতিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ দরকার ছিল। ফলে শহরে যানজট বাড়তো না, উতভ্রান্ত-অস্থির-কর্মময় মানুষের উৎপাত বাড়তো না, সেইসাথে ইট পাথরের এই শহরটাকে অনেকটা সবুজায়ন করা যেতো, তেমনি শহরের চারপাশের নদীগুলোও তার মৃত্যুদশার হাত থেকে রেহাই পেতো।   

যাইহোক রাষ্ট্র যখন মূলত একটা শোষণযন্ত্র ছাড়া কিছু নয়, তখন রাষ্ট্রের বিপরীতে সাম্যতার একটি সমাজ ব্যবস্থার দিকে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন বহুজাতিক কর্পোরেট ব্যবস্থাকে হটিয়ে সর্বজনের সমন্বয়ে মধ্য পরিসরের অঞ্চলভিত্তিক শিল্পব্যবস্থা গড়ে তোলা।    

প্রচলিত একটি ভুল মিথ   

দেশের একদল তথাকথিত প্রগতিশীল তাবেদাররা  সর্বদা এমন একটা বক্তব্য জারি রাখার চেষ্টা করেন যে, দেশের  জনগণ সচেতন নয়—শ্রমিকদের মধ্যে নূন্যতম সচেতনতা নেই। কিন্তু বাস্তবতা হল নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য দেশের  শ্রমিকরা বরাবরই মাঠে নেমেছে। পুলিশের লাঠিচার্জ টিয়ারগ্যাসের তোয়াক্কা তারা করেনি। কখনোবা বুক পেতে দিয়েছে বন্দুকের নলের সামনে, তবুও আপোষ করেনি। 

সত্য ও নির্ভীকতার হাত ধরে আলো জ্বলে উঠে। হয়তো কোন একদিন আলোটা জ্বলে উঠবে। 

 

 

 

 

রাহুল বিশ্বাস

সাবেক শিক্ষার্থী

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

ও 

বর্তমানে একটি ফ্যাক্টরির কর্মকর্তা।

 

 

#উম-৭/৩


Spread the love