You are currently viewing বিরাজমান বুদ্ধিজীবিতাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখান করতে হবে

বিরাজমান বুদ্ধিজীবিতাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখান করতে হবে

[সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য ২৭ ডিসেম্বর ২০১২ সালে এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন স্বকৃত নোমান। সমসাময়িক জাতীয় পতাকা ,জাতি, জাতি গঠন এবং পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে যে সকল প্রশ্ন ও বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছে তা বুঝতে লেখাটি সহায়ক ও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উভয়ের (মানস চৌধুরী ও স্বকৃত নোমান) সম্মতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। -সম্পাদক]

সাপ্তাহিক: বলা হয় যে বাঙালি সংস্কৃতি হাজার বছরের। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বর্তমানে যে-জায়গায় এসে পৌঁছেছি তা আগের চাইতে ভালো, না খারাপ? আমরা কি অগ্রগতির মধ্যে আছি, না ক্রমশই পশ্চাৎপদতার দিকে যাচ্ছি?

মানস চৌধুরী: প্রশ্নটা আসলে ভীষণভাবে প্রগতিবাদী ধারণার ওপর দাঁড়ানো। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি এ ব্যাপারে আমার কিছু অস্বস্তি আছে। তার আগে প্রশ্নের গোড়ার বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। বিষয়টাকে আমি কীভাবে দেখি সেটা বলি। আমার মনে হয় কোনো নতুন রাষ্ট্রে বা সমাজে কোনো একটা জাতিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের বাক্যালঙ্কার ব্যবহার করা, যেমন ‘হাজার বছরের বাঙালি’ বা ‘আবহমান বাঙালি’ সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে এই রেটরিকটার উপরে আমার কোনো আস্থা নেই। না থাকার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। হাজার বছর পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, আপনি যদি সম্রাট আকবরের সময়ের বাংলা অঞ্চলকেও চিহ্নিত করেন, সেটা কিন্তু এখনকার বাংলা না। আমরা যখন জাতীয়তাবাদী উচ্ছাসের সাথে ‘হাজার বছর’, ‘আবহমান’ ইত্যাদি বলি তখন আসলে ইতিহাসের নিষ্ঠাটা প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় জাতীয়তাবাদী স্পৃহা। জাতীয়তাবাদী স্পৃহা দিয়ে যে ধরনের বাক্যালঙ্কার সাজে, সেটা যদি আপনি গবেষক হিসেবে নাও ভাবেন, একেবারে সমাজঘনিষ্ট, রাজনীতিমনস্ক লোক হিসেবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন যে এগুলোর মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চৈতন্য বা ইগোকে উৎসাহ দেয়া হয় কেবল। আসলে এটা বাস্তবতার প্রকাশ হয় না।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন আমাদের অগ্রগতি ও পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে। একটা প্রসঙ্গ টানি বরং। আমাদের এখানে দুটো রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার কারণে পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশ পরিচয় নিয়ে রাজনীতি আছে। এক পক্ষ দুই বাংলা সম্মিলনের জন্য প্রচেষ্টা চালান, অন্যপক্ষ স্পষ্টভাবে মনে করেন এই সম্মিলন আর সম্ভব না, যেহেতু রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বিভেদগুলো অনেক প্রকট। আবার বাঙালি বললে কিছু অংশ না মিলিয়ে বলার কোনো কারণ নেই। কাজের সুবাদে পশ্চিম বাংলায় দু-একবার গিয়ে তাঁদের এ আর্তনাদটা শুনেছি যে, ‘বাঙালিরা নাই কোথাও, বাংলা বাঁচাও।’ একটা আন্দোলনও শুরু হয়ে গিয়েছিল একসময়। আমি তখন দু’-একজন পরিচিত বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ‘বাংলা বাঁচাও আন্দোলন করা হচ্ছে, কিন্তু বাংলা মরল কবে?’

এ বিষয়ে আমি যেটা অনুভব করি, উত্তর ভারতের যে দাপট, তার কাছে তাঁরা এক ধরনের ম্রিয়মান বোধ করেন। একটু খেয়াল করে দেখবেন, নর্থইস্ট জোন যেটা অরুণাচল, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ইত্যাদি ত্রিপুরার মন্ত্রিসভায় আশি ভাগ বাঙালি, অরুণাচল বা গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বাঙালি, বা তাঁরা কলকাতা-এডুকেডেট। এ রকম একটা পরিস্থিতির পরেও তাঁদের মনে হয় তাঁরা যথেষ্ট বেঁচে নেই। এটার একমাত্র কারণ হতে পারে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ। বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা হিন্দি বলেন বা অন্য কোনো ভাষা বলেন। ওই যে এক রকমের দেখতে চাইবার আগ্রহ সেটাই এর কারণ। একই সাথে তাঁরা একটা উন্মুক্ত বাজার খুলে রেখেছেন, সেখানকার বহু জাতি, বহু ভাষা আশ্রয় গ্রহণ করছে বা মিশে যাচ্ছে, অথবা তাঁরা ডমিনেট করছেন, সেটা মেনে নিতে পারছেন না। এখানে একটা মারাত্মক শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। আমি একই সাথে পুঁজিবাদের বৈভবের ছোঁয়া চাই, আবার নানা রকমের জাতির সহাবস্থান বরদাস্ত করতে পারছি না। এটা তো একটা ফাঁকি! সে কারণে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে ওখানকার বাঙালিদের বা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালিদের যে ক্রাইসিসটা, তার সরল একটা রিডিং করে নেয়া দরকার। বাংলাদেশেও ওই একই প্রশ্নটা আসবে। আমার মনে হয়, অগ্রসরতা বা পশ্চাৎপদতা একেবারে পরিপেক্ষিতমূলক প্রশ্ন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে ধরনের ডেমোক্রেসি বা রূপরেখা কল্পনা করা হয়েছিল, সেই ডেমোক্রেসি বা রূপরেখার ধারে কাছে বাংলাদেশ নাই। গুপ্ত বা প্রকাশ্য ফ্যাসিবাদের মধ্যে থাকতে হয়েছে এবং হচ্ছে আমাদেরকে।

সাপ্তাহিক: এই ফ্যাসিবাদের মধ্যে থাকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় রাষ্ট্রের যে ধরনের রূপরেখা কল্পনা করা হয়েছিল, সেদিকে না যাওয়ার পেছনে কারণ কী?

মানস চৌধুরী: কারণ একাধিক। প্রথম কারণটা জাতীয়তাবাদের। যাঁদেরকে ভ্যানগার্ড বলা হয় তাঁদের মধ্যে একাধিক অংশ তখন তথাকথিত মার্কসবাদী ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মার্কসবাদীদের ভেতরের একটা বড় অংশেরই এই প্রশ্নটা ছিল, যুদ্ধটা পরিশেষে জাতীয়তবাদের যুদ্ধ, নাকি একটা গণযুদ্ধ? যদি গণযুদ্ধ হয় তাহলে বিষয়টা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক বা তাদের মিলিটারি ফোর্সের সঙ্গে এত সরল নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে একদম নতুন উদীয়মান পুঁজিবাদের সাথে এখানকার গণমানুষের যোগাযোগটা কী হবে? যত বেশি যুদ্ধটা এগিয়েছে, যত বেশি রাষ্ট্র গঠনের দিকে গেছে, ততই কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের একটা বড় প্রেষণা কব্জা করে নিয়েছে জাতীয়তাবাদী অংশ। ’৭২-এ আমরা যে নতুন রাষ্ট্র শুরু করলাম তখন পরিষ্কারভাবে ভীষণ রকমের জাতীয়বাদী একটা চালিকাশক্তি ছিল। তাদের সাথে মার্কসবাদীরাও ছিলেন, ’৭৩ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সাথে ছিল। এখন জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা ’৭১-এর যুদ্ধে বহিঃশত্রুর সহযোগিতা থাকুক বা না থাকুক, যুদ্ধটা কিন্তু একটা বিশাল ঘটনা। কারণ আমরা একটা রাষ্ট্র আলাদা করতে পেরেছি, ‘খান সেনা’দের হটানো গেছে, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অবসান ঘটল এখানে। কিন্তু অন্য যে প্রশ্নগুলো ছিল সেগুলো হচ্ছে, একটা নব্য পুঁজিবাদের ষাটের দশকের যে পুঁজিবাদ বা নতুন চেহারার যে পুঁজিবাদ গ্লোবেলাইজেশন করছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রম আদান-প্রদান করছে, প্ল্যান্টগুলো সরে যাচ্ছে, এক জায়গার কারখানা আরেক জায়গায় গিয়ে বসছে। এরকম একটা নতুন পরিস্থিতিতে নিউ মার্কসিস্টরা নানা ধরনের ফয়সালা নিয়ে সামনে এসেছেন।

এই যে মৌলিক প্রশ্নগুলো, সম্পদের এক্সেসটা কাদের হবে? এগুলো কীভাবে বণ্টিত হবে? এই প্রশ্নগুলো তো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হোতারা এড্রেস করতে রাজি ছিলেন না। ’৭১-’৭৫ পর্যন্ত আ’লীগের যে ক্রাইসিসটা ছিল সেটা ছিল প্রধানত বৈশ্বিক অঙ্গনে কারা কতটা সোভিয়েতমুখী হবেন বা হবেন না সেই ক্রাইসিস। ’৭৫ পর্যন্ত মোটামুটি একাধিক পলিসিতে দেখা যায়, যেখানে কিছু প্রো-সোভিয়েত পলিসি বা কিছু জানগণিক পলিসি এই ধরনের কতগুলো সোশ্যালিস্ট মুভ ছিল। কিন্তু যে কোনো ধরনের সোশ্যালিস্ট কর্মকাণ্ড গভীরভাবে মনিটরিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। ’৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আদৌ ওটা চেয়ে এসেছেন, নাকি আ’লীগের একাংশ চেয়েছেন বা একাংশ চাননি এগুলো নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন আছে। আ’লীগের কোন অংশ তখনই মুক্তবাজার অর্থনীতি চাইতেন, কোন অংশ চাইতেন না, গবেষণার প্রয়োজন আছে এটা নিয়েও। নিশ্চয়ই আ’লীগও একটা ইউনিফর্ম পার্টি নয়। সেখানে একাধিক স্টেকহোল্ডারের থাকা সম্ভব। তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে অন্যদের দ্বিমত থেকেই এটা বোঝা যায়। যদি ধরেও নিই যে এটা একটা অখণ্ড পার্টি, তাহলেও তাঁরা যে পদ্ধতিগুলো নিয়েছেন একটা রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনৈতিক পলিসি, নীতিমালা এগুলো ঠিক সবসময় কনভিকশনে নিয়েছেন তা প্রতীয়মান হয় না। কখনো নিয়েছেন আন্তর্জাতিক জোয়ারে, কখনো নিয়েছেন রাজনৈতিক স্বার্থে। এটা ঠিক ওই পার্টির বা ওই সরকারের লক্ষ-উদ্দেশ্য নাও হতে পারে। এগুলো হচ্ছে কতগুলো লক্ষণ যার থেকে বলা যেতে পারে আর যাই হোক, ডেমোক্রেসির যে বুর্জোয়া অর্থ, সেই বুর্জোয়া অর্থও তো বাংলাদেশে মিট করে নাই। ’৭৫-এর পর থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা সামরিক সরকার, আধা সামরিক সরকার। নব্বইয়ের পর যেগুলোকে আমরা নির্বাচিত সরকার বলছি সেগুলোর যে চেহারা, সোজা বাংলায় বলতে গেলে তা হচ্ছে পিটিয়ে জনমত আদায় করা। জনমত যে পিটিয়ে আদায় করা হয় তার একাধিক উদাহরণ আছে। এসব দিক দেখে বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের যে লিপিবদ্ধ লক্ষগুলো ছিল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রের চর্চিত ‘গণতন্ত্র’, শ্রমবাজার, সম্পদবণ্টন কোনোটাই ওই লক্ষের আশপাশে যায়নি।

সাপ্তাহিক: না যাওয়ার পেছনে রাজনীতিকদের মেধাগত কোনো সঙ্কট আছে কিনা?

মানস চৌধুরী: মেধাগত সঙ্কটাকে আমি একদম খারিজ করে দেব। এটা কোনো কারণ না। এই সঙ্কট আমি দেখতে পাই না। যাঁরা একেবারে সাধারণ মানুষ তাঁরা রাজনীতি নিয়ে খুবই আগ্রহী। কিন্তু তাঁরা নির্বাচনের সময় যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিতে যান, ঠিক একই ভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে খুব কমই ভাবেন। এত উদ্দীপনা নিয়ে যে তাঁরা ভোট দেন এর কারণ এটার মধ্যে এক ধরনের উৎসবমুখরতা আছে। ঈদ বা মেলায় মানুষ জড়ো হয়। নির্বাচন এরকম আরেকটা ইভেন্ট, যেখানে মানুষ জড়ো হয়। নির্বাচনের দিন নতুন জামা-জুতো পরে, নতুন শাড়ি পরে তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যান, অনেকগুলো মানুষের সাথে দাঁড়ান। এটার একটা অদ্ভূত রকমের লোকজ উৎসবমুখরতা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি হিসেবে এটা নিয়ে তাঁদের কোনো রকমের গুরুত্বপূর্ণ সংমিশ্রণ নেই। ’৭১-এর স্বাধীনতার পর থেকে নতুন ধরনের পুঁজিকেন্দ্রিকতার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়। আপনার প্রশ্ন ছিল মেধার সঙ্কট কিনা? নিশ্চয়ই না। ২০০৭-এ জরুরি অবস্থার সময় আমাদের বিশ্লেষকদের বুঝতে সময় লাগল যে, এটা একটা বিশেষ ব্যবস্থা, এটা গণতন্ত্র নয়। কিন্তু খেটেখাওয়া মানুষরা ষোল দিনেই বুঝে ফেলেছেন। আমি মার্চ মাসে মোহাম্মদপুর বাজারে গিয়ে শুনতে পাই তরকারি ব্যবসায়ীরা তৎকালীন শাসক মঈনউদ্দিনকে ‘আলু’ নাম দিয়েছে। দেখুন তাহলে মানুষের মেধার সঙ্কট কিন্তু নেই! আছে রাজনীতির সঙ্গে সংমিশ্রণের সঙ্কট। সেটা স্বতন্ত্র বিষয়।

সাপ্তাহিক: সাধারণ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে সংমিশ্রণে আমাদের সমাজে তো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন রাজনীতি এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে গেছে। যে মানুষটি শস্য উৎপাদন নিয়ে চিন্তা করার কথা সে রাজনীতি নিয়ে মেতে আছে, দলীয় দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ছে।

মানস চৌধুরী: এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হচ্ছে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট হওয়া, আরেকটা হচ্ছে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট হওয়া। আমাদের এখানে দ্বিতীয়টাই ঘটছে বেশি। সরকারের শত চেষ্টা সত্তেও একদম মাঠ পর্যায়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব সবসময় হয়নি। ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত আ’লীগ-বিএনপি-জাতীয়পার্টি এভাবে করে চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রতীকগুলো হয়তো হয়নি, কিন্তু পার্টির নমিনেশনগুলো গত কয়েক বছর ধরে দল থেকে হচ্ছে। এটা আগে স্বতন্ত্র ধরনের হতো ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাতে। তার মানে জাতীয় রাজনীতির তকমা একেবারে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত যাতে করে বিস্তৃত হয় সেটার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের তরফে আছে; সব ক্ষেত্রে যদিও বাস্তবায়নটা হচ্ছে না। এটা পয়েন্ট না, পয়েন্ট হচ্ছে যাঁরা ভোট দিতে আসেন তাঁরা কোনো না কোনোভাবে দলাদলির অংশ হিসেবেই আসেন। সমাজবিজ্ঞানীরা যাকে ‘ফ্যাকশান’ বলে। তাঁরা হয় অমুক সাহেব নয় তমুক সাহেবের পক্ষ নিয়েই আসেন। এরকমভাবে গোষ্ঠীগত যে ফ্যাকশান ওগুলো ভীষণ সক্রিয়। কিন্তু আমরা যদি ডিফাইন করি রাজনীতি হতে হবে রাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করবার ব্যাপার, তাহলে সেই রাজনীতি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত না, নগরেও না। ’৭৫-এর পর থেকে সামরিকতন্ত্রটা প্রাতিষ্ঠানিক হওয়া শুরু করেছে এখানে। তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার যখন রাষ্ট্র শাসন করে তখন আরো বেশি পোক্ত হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির সাথে সমরতান্ত্রিক ব্যূরোক্রেসির আঁতাত। এই যোগসাজশটা অন-পেপারস নাও হতে পারে, হয়তো অলিখিত। দলীয় হাঙ্গামা কিংবা গোষ্ঠীগত হাঙ্গামা বাংলাদেশের প্রধান সঙ্কট নয়। 

সাপ্তাহিক: তাহলে গণতন্ত্রের পথে আমাদের যে যাত্রা সেটার কী হবে?

মানস চৌধুরী: আপনি যেটাকে গণতন্ত্র বলছেন সেটা ভীষণ রকমের রেপ্রেজেন্টেড গণতন্ত্র। নব্বইয়ে এরশাদের হটে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ভীষণ উল্লসিত। এই ২২ বছরেও এতটুকু উল্লাস কমেনি। বলার সময় সবসময়ই তাঁরা বলেন ‘’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান করেছি, ’৯০-এর স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি।’ এই আত্মম্ভরিতা আধুনিক বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকজনের আত্মাবয়ব গঠন করার ক্ষেত্রে বিশাল স্তম্ভ। নব্বই তাহলে বড় ইভেন্ট! কিন্তু একবারও আমরা কাউন্টার প্রশ্ন করছি না, নব্বই সালে যেখানে এরশাদ স্বৈরাচারী চরিত্রে ছিলেন, এই লোকটা এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছেন, রাজনীতি করছেন, সংসদে বসছেন। বিশ্বের কোথাও কোনো গণ অভ্যুত্থানের পরে এরকম কোনো ‘খলনায়ক’ রাজনীতি করতে পারে না। এরকম কোনো নজির নাই। সুতরাং এখানে কোনো ঝামেলা আছে! ডাল মে কুছ কালা হায়। সিভিল জনপদের সাথে মিলিটারি ডিক্টেটরশিপের সম্পর্কটা কী? ডিক্টেটরশিপ বলতে আমরা একটা অফিসকে বুঝি, কিন্তু সমরতন্ত্র তো শুধু একটা দুটো অফিসকেন্দ্রিক নাও হতে পারে। কতগুলো কল্যাণ তহবিল আছে, কতগুলো সংস্থা আছে, ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট আছে। অনেকগুলো বডি থাকা সম্ভব এবং আছে যেগুলো আসলে অফিসিয়াল বডি নয়। আপনি দেখছেন একজন সামরিক শাসককে, একটা হেডকোয়ার্টার, একটা ডিজিএফআইকে। কিন্তু এর বাইরেও তো প্রচুর সংগঠন বা দপ্তর আছে, যেগুলো তো ফরমাল বডি নয়। তাহলে সিভিল জনপদের সাথে এর একটা সম্পর্ক যে আছে সেটা আমি অনুভব বা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু কী উপায়ে এই সম্পর্কটা প্রমাণ করা যাবে? এই সম্পর্কটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তাঁদের, যারা পেশাগত বিশ্লেষক। কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও তো কল করতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষকদের কর্মকাণ্ড হতাশাজনক। ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর এক বছর ধরে বিভিন্ন রকম যে কলামগুলো বেরুলো পত্রপত্রিকায়, সেগুলো খুবই হতাশাজনক। তাঁদের কর্মকাণ্ড বা বিশ্লেষণ যদি এতটা হতাশাজনক হয় তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে চিনব বলুন?

সাপ্তাহিক: তাহলে গণতন্ত্রে উত্তরণ না করার পেছনে আমাদের ভ্যানগার্ড শ্রেণীও তো অনেকাংশে দায়ী?

মানস চৌধুরী: অবশ্যই তাঁদেরকে দায়ী করা যায়। অন্তত এই কারণে যে, আমাদের ইতিহাস প্রমাণ করে, রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে, আমরা চাই বা না চাই, ভ্যানগার্ডদের আকাক্সক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস বলে, ভ্যানগার্ড যাঁরা, যাঁরা শিক্ষিত সম্প্রদায়, তাঁদের একাংশই বিপ্লবী চিন্তাগুলোর বার্তা নিয়ে আসেন। বিদ্যমান রীতিনীতিকে তাঁরা ক্রিটিক করেন, উল্টে দেন। যাঁরা কিনা ইতোমধ্যে ভ্যানগার্ড হয়ে আছেন, এক, দুই, তিন প্রজন্ম ঢাকাতে স্থায়ী, উচ্চপদের চাকরিগুলো করেন তাঁরা ঐতিহাসিকভাবেই যে-কোনো চিন্তা রদবদলের ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু তাঁরা যদি নতজানু মানসিকতাসম্পন্ন হয়, সব কিছুতে ‘জি হুজুর’ করেন, তাহলে তো বিষয়গুলো অনড় থেকে যাবে।

সাপ্তাহিক: ভ্যানগার্ডদের এই নতজানু অবস্থা আগে ছিল না?

মানস চৌধুরী: ৬০-এর দশক পর্যন্ত ছিল না। এরশাদের সময় পর্যন্ত একটা মাত্রা পাই, এরপর এই ভ্যানগার্ড শ্রেণী গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।

সাপ্তাহিক: বুদ্ধিজীবী বা ভ্যানগার্ড শ্রেণীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমজনতা কীভাবে অগ্রসর হবে?

মানস চৌধুরী: এই কথাটা বললে অনেকটা কেতাবি কথা হয়ে যাবে যে, এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এটা আসলে লিফলেটে লেখা খুব সহজ, কিন্তু এটার কার্যকরণগত মানে কী? কীভাবে আমরা এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে বা এই অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়ালদেরকে প্রত্যাখান করব? কীভাবে আম মানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা সংগঠিত হয়ে উঠতে পারে সেটার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া কঠিন। দশ বছর আগে আমার মনে হতো এজেন্সিভুক্ত বুদ্ধিজীবিতা, যাঁরা ভীষণ রাষ্ট্রবাদী, কিছু একটা হলেই রাষ্ট্রের তরফে কথা বলেন, অমুকের সাপেক্ষে তমুকের পক্ষে কথা বলেন এই ধরনের লঘু রাজনৈতিক মেরুকরণগুলো যাঁরা করেন তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করেই রাজনৈতিক প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু দশ বছর পরে এটা আর সম্ভব বলে মনে হয় না। এটা বলার মতো জায়গাটা একজন ছা-পোষা চাকরিজীবী হিসেবে আমার আর নেই।

সাপ্তাহিক: তাহলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

মানস চৌধুরী: আমি বুঝতে পারি, এজন্য প্রথম যে কাজটা করতে হবে সেটা হচ্ছে ইক্সিস্টিং ইন্টেলিজিনশিয়াকে, বিরাজমান বুদ্ধিজীবিতাকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখান করা।

সাপ্তাহিক: কিন্তু আমি এককভাবে প্রত্যাখ্যান করতে গেলে তো আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব?

মানস চৌধুরী: শুধু বিচ্ছিন্নই নয়, রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ারও ভয় আছে। এখন তো কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়।

সাপ্তাহিক: সেক্ষেত্রে আমার কী করণীয়? বিচ্ছিন্ন হয়ে তো আমি কাজ করতে পারব না।

মানস চৌধুরী: রাজনৈতিক দল পরিচালনা এবং রাজনৈতিক চৈতন্য ধারণ করা দুটো কিন্তু ভীষণ আলাদা ব্যাপার। পাশ্চাত্যে প্রচুর বিশ্লেষক আছেন, কোনো কোনো কফি শপে তাঁদের দেখা হয়, ইন্টারনেটে কথা হয়। কিন্তু তাঁরা নিজের নিজের মতো করে রাষ্ট্রের সমালোচনা করেন, এক ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলেন। কথা হলো যে, ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার জীবন যাপন করি, আমি শুধু আমার মাস্টারিটাই করে যাব, আমি কোনো কিছুই কেয়ার করলাম না এটা বড়জোর একটা ভঙ্গি; আমরা যাকে বলি লাইফস্টাইল। রাষ্ট্রের পরিসরের জন্য রাজনৈতিক দল কীভাবে সংঘবদ্ধ করা যায়, কীভাবে গঠন করা যায় এগুলো আমার কল্পনায় কুলায় না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এটা মহানগর থেকে গড়ে ওঠা কোনো সংঘবদ্ধতা না। এটা সম্ভব না। এটা গড়ে উঠতে হবে প্রান্ত থেকে। একটা উদাহারণ দেই। যখন লালন আখড়া রক্ষা আন্দোলন হলো, তখন আমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমাদের মিটিংগুলো টিএসসিতে হতো। আমাদের দায়িত্ব বণ্টন হলো। কিন্তু নাম কী হবে? নাম প্রস্তাব হলো ‘লালন আখড়া রক্ষা জাতীয় বা কেন্দ্রীয় কমিটি।’ আমি খুব পেরেশান হয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে ফেলেছিলাম, ‘কিছু একটা করলে আপনারা কেন্দ্রীয় কমিটি আর জাতীয় কমিটি বানান কেন? কেন দু-একটা কমিটি ‘বিজাতীয়’ হয় না, বিকেন্দ্রীয় হয় না? শুধু ঢাকাতে থাকার কারণে এই কমিটির নাম জাতীয় বা কেন্দ্রীয় হচ্ছে। সমন্বয় কমিটি হোক, তাতে তো একটু বিনয় প্রকাশ পায়। ভাষার বিনয় তো গুরুত্বপূর্ণ।

সাপ্তাহিক: আমি কেন্দ্রকে স্পর্শ করতে না পারলে তো বৃত্ত রচনা করতে পারব না?

মানস চৌধুরী: না, আমার পয়েন্টটা অন্য জায়গায়। আপনি-আমি শাহবাগে বসে একটা কমিটি ঠিক করে নাম দিলাম কেন্দ্রীয় কমিটি। দেশের নানা স্কুল-কলেজে নানা শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছড়িয়ে আছেন, তাঁরা নানা কিছু চান। এতে তো তাঁদের চাওয়া-পাওয়াকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। আপনি কেন্দ্রটাকে বড় করে দেখছেন, প্রান্তকে উপেক্ষা করছেন। আপনি ঢাকায় থাকার সুবাদে ঢাকাকে কেন্দ্র ঘোষণা করে প্রান্তের সাথে যোগাযোগ করছেন। সেখানে গিয়ে বলছেন আমি কেন্দ্র থেকে এসেছি। এটা একটা বুর্জোয়া নীতি।

সাপ্তাহিক: আধিপত্যবাদী মানসিকতাও বটে…।

মানস চৌধুরী: অবশ্যই আধিপত্যবাদী মানসিকতা। যদি বলি, আমি ঘটনাচক্রে ঢাকায় থাকি, আমরা ঢাকাতে বসে এটুকু করেছি, আমরা আগামি ছয় মাস পরে একটা জাতীয় কমিটি গঠনের চেষ্টায় আছি তাহলেও তো প্রক্রিয়ার দিক থেকে অনেক বিনয় প্রকাশ পায়। কিন্তু আমরা যা করছি তা তো বুর্জোয়া রাজনীতিরই অংশ।

সাপ্তাহিক: বাংলাদেশে যারা বুর্জোয়া রাজনীতির বিরোধিতা করেন, মার্কসিস্টরা, তারাও তো নিজেদের কমিটিকে কেন্দ্রীয় কমিটি বা জাতীয় কমিটি বলেন?

মানস চৌধুরী: এঁরাও কেন্দ্রবাদী। এঁরা বুর্জোয়া রাজনীতিরই অনুকরণ করছেন।

সাপ্তাহিক: আপনার মতে তাহলে আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটাকে প্রান্ত থেকেই উঠে আসতে হবে। কিন্তু প্রান্তে তো বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বিকাশের সুযোগ কম। ধর্মের অতি প্রভাবের কারণে তো সেখানে এটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে?

মানস চৌধুরী: দেখুন, প্রান্তের ধর্মান্ধতা বিষয়ে ঢাকায় বসে যেসব কথা বলা হয়, আমি এর উল্টো চিত্রও দেখেছি। বছরখানেক আগে ঝিনাইদহ অঞ্চলে গিয়ে দেখি, লোকজনের প্রতিবন্ধিতার জন্য থেরাপি দেয়া হয়, ওই এলাকার যিনি সবচেয়ে ভালো থেরাপি দিতে পারেন তিনি একজন মসজিদের ইমাম। একটা চাকরি তাঁর ইমামতি করা, আরেকটা চাকরি থেরাপি দেয়া। মজার বিষয় হলো, তিনি যখন এই কাজটি শুরু করেন তখন প্রচুর লোক এই কাজটি ইমামের কাছ থেকে দেখতে চায়নি। থেরাপি দেয়া হয় প্রতিবন্ধীদের। আম মানুষের ধারণা, মানুষের ‘পঙ্গু’ হওয়া না হওয়া তো আল্লার হাতে। ইমাম সাহেব তো রোগ সারানোর জন্য আল্লার কাছে দোয়া করবেন, তিনি কেন থেরাপি দেয়ার কাজে এলেন? অথচ তিনি একটা এনজিওর সাহায্যে ট্রেনিং নিয়ে গত পনের-বিশ বছর ধরে এই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছেন। বাংলাদেশে এরকম অনেক উদাহারণ পাওয়া যাবে, যেখানে কিনা নানান উপায়ে মানুষ জীবনঘনিষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমরা ঢাকায় বসে যেটাকে ধর্মান্ধতা বলছি, তা কিন্তু একই রকম না। এর চেয়ে বেশি সেখানে জনপদীয় প্রেক্টিস রয়েছে। দাদী হয়ত নামাজ পড়ছেন, আবার অন্য ধর্মের বন্ধুকে সুন্দর করে রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। এরকম প্রেক্টিসও গ্রামে আছে। জনপদের স্পন্দন কিন্তু বহুমুখী। ওটাকে যদি আমরা শনাক্ত বা হৃদয়ঙ্গম করতে না পারি তাহলে ভুল আরো বাড়বে।

সাপ্তাহিক: এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের অগ্রসর শ্রেণী কি গ্রামের মানুষদের ওভাবে রাখবে, নাকি আরো উন্নত জীবনের সন্ধান দেবে?

মানস চৌধুরী: এই প্রশ্নেরও পরিপ্রেক্ষিত আছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপারে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞাত করানোর কাজ করা যেতে পারে। এ জন্য বুদ্ধিজীবী তৈরি হবে ওখান থেকে, ওই প্রান্ত থেকে। তাঁরাই এ ব্যাপারে আমজনতাকে সচেতন করবেন। তাঁর এলাকায় তিনিই ‘হিরো’। এভাবে প্রতি পাড়ায় পাড়ায় ‘হিরো’ তৈরি হবেন। তাঁরাই সমাজকে সংঘবদ্ধতার দিকে নিয়ে যাবেন।

সাপ্তাহিক: কিন্তু ওই হিরো গঠন হওয়ার জন্য যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দরকার তা তো প্রান্তে নেই। আমি নগরে বসে নানা ধরনের বইপুস্তক পড়তে পারছি, নানা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু তিনি প্রান্তে বসে পাচ্ছে না। তা হলে তার বিকাশটা হবে কীভাবে?

মানস চৌধুরী: অন্ত্যজ মানুষের আসলে মুদ্রিত কিতাবের দরকার পড়ে না। যাপিত বাস্তবতা এতই প্রখর, সেখান থেকেই তাঁরা শিক্ষা নেন। আমাদের রেফারেন্সের জন্য কিতাবের দরকার পড়ে, তাঁদের ক্ষেত্রে এটা দরকার পড়ে না। তাছাড়া রাষ্ট্র কেন সমস্ত সুযোগ সুবিধাকে শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখবে? এটা তো একটা বৈষম্য। রাষ্ট্রে এই বৈষম্য চলছে। বুদ্ধিজীবীরাও কোনো না কোনোভাবে এটাকে সমর্থন দিচ্ছেন। এই বুদ্ধিজীবিদেরকে নস্যাৎ করবার জন্য কেন্দ্রে কিছু বিরুদ্ধপন্থী হোয়াইট কলার বুদ্ধিজীবী দরকার। তাছাড়া প্রান্তে যাঁরা আছেন তাঁদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার। প্রান্তের প্রবঞ্চিত মানুষদের দ্রোহ, ক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করার জন্য যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁরা তা করেননি। তাঁরা হয়তো এটা করতে পারেননি, কিন্তু না পারার কথাটা তারা স্বীকারও করেননি। কাজটা করেননি তাঁরা। কাজ যা হয়েছে তা কেবল লিফলেট বণ্টন আর কমিটি গঠন। সুতরাং তাঁদের প্রতিশ্রুত কাজ তাঁরা করেননি। এখন যাঁরা নতুন করে কাজটা করতে চান, এটার উত্তরও দিতে পারবেন সেসকল বন্ধুরা, যাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেন রাষ্ট্রের শত্রু হয়ে বা মিত্র হয়ে।

সাপ্তাহিক: আপনি বললেন যে অন্ত্যজ মানুষের কেতাবি বিদ্যা লাগে না। তাহলে মেধা গঠনের পেছনে বা সচেতন সমাজ গঠনের পেছনে বইয়ের কোনো ভূমিকা নেই?

মানস চৌধুরী: আধুনিক রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিতে কিতাব-শিক্ষিত লোকের এক ধরনের গুরুত্ব আছে। কিন্তু মানুষের দ্রোহ বা তার যে রাজনৈতিকতা, তার যে বিপ্লবাত্মকতা এটা যদি আমাদের প্রসঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে তার জন্য আলাদা করে এ ধরনের কিতাবি বিদ্যার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তার মানে এই নয় যে, আমি কিতাব শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এটার অবশ্যই গুরুত্ব আছে। কীভাবে মুনাফা তৈরি হয় এই কারিকুলাম তো রাষ্ট্র তাকে নাও শিখাতে পারে। তখন তার বইয়ের দরকার আছে। বই তাকে সংঘবদ্ধ হতে সহায়তা করতে পারে।

সাপ্তাহিক: পৃথিবীব্যাপী প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। এই প্রাযুক্তিক সভ্যতা আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে কিনা?

মানস চৌধুরী: আমি এটাকে প্রতিবন্ধকতা বলবো না, বলবো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বদল এসেছে। একটা বদল হচ্ছে, যে যেটা কনজিউম করতে চান বা যে যে-ধরনের তথ্য চান তার গ্রাহক হওয়া সহজ এখন। এর অন্য মানে হলো যে যেটা চান সেটা আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট জানতে পারেন। আমি যা খুঁজব তাই পাব নতুন প্রযুক্তিতে। ফলে খোঁজার যে ইনটেন্ট সেটা সুগঠিত থাকতে হবে। তথ্যের যে হাইপ বা স্ফীতি তৈরি হয়েছে তাতে প্রত্যেক গ্রাহককে আরো বেশি দায়িত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সে যদি ভালো সম্পাদক না হয় তাহলে সে তথ্যের স্রোতে ভাসতে থাকবে, তথ্যটা আহরণ করতে পারবে না। আগে একটা বই সংগ্রহ করে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করাটা ছিল  ইফেক্টিভ। অনেক সময় লাগত। একচুয়াল-মেনুয়াল একটা সময়ের ব্যাপার ছিল। ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। এখন কিন্তু ব্যাপার আরেকটা। আপনি যেহেতু যা কিছু খুঁজবেন তা পাবেন, ফলে আপনাকে অনেক শক্তিশালী এডিটার হতে হচ্ছে। আপনি কোনটা গ্রহণ করবেন আর কোনটা বর্জন করবেন সেটা বুঝতে হবে। এটা একটা নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। যিনি সংগঠক, যাঁর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা আছে, যিনি কেন্দ্রকে আঘাত করতে চান, তিনি তাঁর মতো করে রাস্তাগুলো বের করেন। উইকিলিকস এর প্রমাণ। সুতরাং আমার মনে হয় এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আছে, আবার এটার বিপ্লবাত্মক দিকও আছে। মূল বিষয়টা হচ্ছে, এর মাধ্যমে আমাদের অভিব্যক্তি এবং আকাঙ্ক্ষা নতুন রূপ লাভ করারই কথা। সেটার ব্যাপারে নস্টালজিক কষ্টে না ভুগে ভালো হয় আমরা যদি এই বাস্তবতাকে মেনে নিই।

সাপ্তাহিক: আমরা এই নস্টালজিয়াতেও ভুগি যে, বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এই নস্টালজিয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?

মানস চৌধুরী: বাঙালি জাতিসত্তা বা তার সংস্কৃতি নিয়ে আমি আসলে চিন্তিত নই। বাঙালি জাতিসত্তা যদি মুহূর্মুহূ বিকশিত হতে থাকে, আর তা যদি মান্দি, মারমা, ম্রো, চাকমা, তনচ্যঙ্গা জাতিসত্তার জন্য থ্রেট হয়ে দাঁড়ায়Ñতাহলে ওই বাঙালি জাতিসত্তা বিকশিত না হওয়াই তো মঙ্গল। কিন্তু  যেখানে মানুষ একাত্ম বোধ করেন বিশেষ কতগুলো সাংস্কৃতিক লক্ষণের প্রতি, তখন এই সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলো তাঁর বেঁচে থাকবার, প্রসন্ন থাকবার, উদ্ভাসিত থাকবার উপায়। বিষয়টা হচ্ছে, সংস্কৃতির বদল নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। প্রথম যখন গিটার আসে তখন এমন কোনো মা-বাবা নেই যারা আতঙ্কিত বোধ করেননি। হারমোনিয়ামওয়ালা মায়েরা তো রীতিমতো আতঙ্কিত ছিলেন। এই বুঝি ছেলে হারমোনিয়াম ছেড়ে গিটারে ধরল! একইভাবে যখন জিন্সের প্যান্ট এলো তখনও জিন্স রীতিমতো একটা বন্দুকের মতো ছিল। জিন্সের প্যান্ট, গিটার ছিল নষ্ট হওয়ার লক্ষণ। কুড়ি বছর পরে এ উদাহারণটিই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রূপান্তরগুলো আপনার-আমার ইচ্ছা সাপেক্ষ হয়ে নাই। সুতরাং এই বদলগুলো একসময় গায়ে লাগে, এক পর্যায়ে এগুলো গায়ে লাগে না, সহনীয় হয়ে যায়। আবার সংস্কৃতির একটা কাজ হচ্ছে আমাদেরকে ভালো বোধ করায়। ওটাই আমার সংস্কৃতি যেটা আমি যাপন করি। এখন এই যাপনটা বিঘ্নিত হয় বরং বাজারের কারণে। আমার জন্য বাজার অনেক বেশি চিন্তার বিষয়। বাজার প্রান্তের একটা গরুকেও স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। ও আর দুধ দিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। কারণ আপনি ওখানে কেনেন প্যাকেট দুধ। এটা আতঙ্কের। এটা আপনার ইন্টারফেইস বদলে দিচ্ছে।

সাপ্তাহিক: এতে তো আমি উন্নত জীবন পাচ্ছি?

মানস চৌধুরী: আপনি কনজিউমার পাচ্ছেন। কিন্তু উৎপাদন বা গণভোগ তো বাড়ছে না! যে প্রক্রিয়া শ্রমের অবমূল্যায়ন করে সেটাই তো ক্ষতিকর। উৎপাদিত দ্রব্যাদির প্রতি বেশিরভাগ মানুষের এক্সেস থাকবে এটাই তো সংস্কৃতির ব্যাপার। আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে, সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য কোনো কোনো সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হবে। রাখতে হতে পারে।

সাপ্তাহিক: কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সেটা আদৌ সম্ভব?

মানস: না, সম্ভব না।

সাপ্তাহিক: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং বাঙালি জাতির ভবিষ্যত কী?

মানস চৌধুরী: বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যদি আমরা ভাবতে শিখতাম এটা একটা বহুজাতিক রাষ্ট্র তাহলে খুব ভালো হতো। বাংলাদেশ শুরু থেকেই একটা বহুজাতিক রাষ্ট্র। সংখ্যা কোনো বিষয় হতে পারে না। সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ হলে গণতন্ত্রের কথাই বলতাম না আমরা। একইসঙ্গে আমরা গণতন্ত্রের কথা বলছি, আবার বাঙালির মেজরটির কথা বলছি এটা তো হয় না। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে আমি দেখতে পাই, পরিপূর্ণভাবে এই দেশে মার্কিন পলিসি, মার্কিন স্বার্থ, যথেষ্ট কয়লাখনি খুঁড়বার প্রচেষ্টা, লোপাট হওয়া, খোলা বাজার অর্থনীতির নিরাপদ একটা দুর্গ হিসেবে। বুদ্ধি বলে, নৈরাশ্যজনক অবস্থা হবে এই রাষ্ট্রের, ও এর বাসিন্দাদের। কিন্তু আগ্রহ, স্পৃহা বলে না, এরকম হবে না আশা করি। আমরা এই আগ্রাসন কাটিয়ে উঠতে পারব। আমাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে যে, আমরা এটা হতে দেব না।

#১১/৬/উৎসব মোসাদ্দেক

Leave a Reply